কৃষ্ণা রায়

সুয়োরানীর অপেক্ষা
সারাদিন রিমলির বড্ড বোরিং লাগে। ছিমছাম ফারনিশড ফ্ল্যাট, আলমারি ভর্তি পছন্দের জামা-কাপড়, দু-তিনমাস অন্তর শখের বেড়ানো, -- অর্ণব একদম বশংবদ ভৃত্য । পার্লারের মেয়েটা বাড়ি এসে বডি-ম্যাসাজ করে দেয়, নিখুঁত রান্না করে রান্নার- লোক । ঝুট-ঝামেলাহীন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। শবশুরবাড়ির লোকেরাও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ধূমকেতুর মত আসেনা। অর্ণব এসব ব্যাপারে দারুণ সাপোরটিভ। আজ সন্ধ্যেয় ফোর-স্টার হোটেলে ডিনার। কাল রাতেই অর্ণব এক্সক্লুসিভ একটা ডায়ামন্ড -সেট গিফট করেছে। কদিন ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। নির্ঘাত লোন করে কিনেছে। এত কিছু প্রাপ্তির পরেও বুকের ভেতর তিরতিরে একটা অস্বস্তি। না পাওয়াটাও যে কত দামি! সেই দুঃখভরা ছোট্টবেলার মত, যখন বাবা মায়ের কাছে কত কি চেয়ে আর না পেয়ে গোপনে ছাদের সিঁড়িতে বসে একা একা কাঁদত। কান্নার পর নিজেকে খুব পবিত্র মনে হোত। বিয়ের পর থেকে গত দশ বছর শুধুই সুখ, প্রাপ্তি। শেষ কবে কেঁদেছে? মনেই পড়েনা। 

স্মারট-ফোনে অর্ণব ডাক দেয়, ডারলিং রেডি থেকো। বিকেল ছ”টায় গাড়ি যাবে।

বিরক্ত লাগে রিমলির। বাইরে ফাল্গুনের মায়াবি দুপুর। নিজেকে কেমন ঘর-বন্দী সুখী কুকুর- বেড়ালের মত লাগে। কাঁড়িকাঁড়ি আদর, ছকে মাপা সুখ। ধ্যুত!

আবারো ফোন । সৌগত। রিমলির খুড়তুতো ভাই। হ্যাপি বারথ-ডে রিম। এবারে ইউ- এস থেকে পাক্কা একমাস ছুটি। পি এইচ ডির কাজটা দাঁড়িয়ে গেছে। 

- থাম । তোর যত্ত উদ্ভট এক্সপেরিমেন্ট। ডাক্তারি পড়ে রিসার্চের কি দরকার-?

-দারুণ বারথ- ডে গিফট এনেছি রে। 

- কী আর হাতি-ঘোড়া আনবি? পারফিউম , ফ্যাশানেবল- ড্রেস, চকলেট--- একঘেয়ে । 

- আছিস কেমন? 

- হোপ্লেসলি হ্যাপি। ভাল্লাগেনা । অর্ণব হতচ্ছাড়াটা আমাকে কিছুতেই আনহ্যাপি হতে দেয়না।

- কবিতা লিখিস এখন? 

- ধ্যুস! কষ্ট, অপ্রাপ্তি না থাকলে ওসব আসে? যত্ন করে সারাদিন মন খারাপগুলো জমিয়ে রাখি। অর্ণব সন্ধ্যেবেলায় এসে মিষ্টি কথায় ঘেঁটে দেয়। সন্ধ্যে সাতটায় আয়, হোটেল স্টারট-ডাস্ট ইন। 

#

সৌগত টাইম মত এসেছিল। হাতে সুদৃশ্য প্যাকেট। 

রিমলির ভুরুতে ভাঁজ, অর্ণবের দেরি হবে। অফিসে ফেঁসে আছে। এরপর চারটি গিফট আনবে, ঘ্যানঘ্যান করে আপোলজি চাইবে। ইরিটেটিং। দম বন্ধ লাগেরে! কাউকে বলতে পারিনা, একটু রিসনেবল সলিড কষ্ট চাই। তীক্ষ্ণ  -কাঁটার মত সারাক্ষণ কুরে খাবে। 

- আসল কষ্ট চিনিস ? বিদেশে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। 

- থামতো। আমাকে ও জীবনভোর সুখ দিয়ে মুড়েমুড়ে আঠার মত লেগেই থাকবে। কোনদিন কষ্ট পাওয়াও হবেনা। থাকগে, ততক্ষণ তোর গিফটা দেখি। 

- রিম। আমায় না ডাকলেও আসতাম। নেমন্তন্নটা পেয়েছি, মাস খানেক আগে। অর্ণব খুব রিকোয়েস্ট করেছিল।

প্যাকেট থেকে ঝকঝকে কাগজের-তাড়া বেরোয়। কাল সকালে অর্ণব কেমোথেরাপির জন্য হাসপাতালে ভর্তি হবে। আকিউট হেপাটিক-কারসিনোমার থার্ড-স্টেজ । ই-মেলে আগেই জানিয়েছিল। আয়ু হয়তো মাস ছয়েক। 

সৌগত বলে চলেছে---ঝিমলির ফ্যাকাশে মুখে পাহাড়ের ঢালে মরা চাঁদের আলো। অস্ফুটে বলল, ট্রেটর।

- কিরে! অনেক অপেক্ষার পর কষ্টের এই প্যারামিটারটা এবার পছন্দ হয়েছে তো?

সৌগতর গলা ঝাপসা হয়ে যায় ...।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.