কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য রিপুর তালিকায় এই কটাই নাম। রিপু মানে অভিধানে যার অর্থ লেখা শত্রু। তাহলে ঘেন্না টা কোন পয়েন্টে রাখা হবে! মাৎসর্য নামের রিপুটিকেই এই ঘৃণার পূর্বসূরি বলা যাক। হিংসা থেকে আসে ঘৃণা এর চেয়ে সরলসত্য বোধহয় আর কিছুই নেই। মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে আক্ষেপ ইস আমাদের সময় এত রক্তপাত এত অশান্তি দেখতে হত না। এখন খবরের কাগজ খুললে টিভি খুললে সব জায়গায় শুধু মারামারি হিংসা কাটাকাটিই দেখতে পাই। তাহলে কি মেনে নিতে হবে মানুষ এখন বেশি হিংসুটে হয়ে গেছে? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয় উচিতও নয়। কেননা মানুষ আসলে একটি অসীম মৌল বলে মনে করি। সৃষ্টির আদিম লগ্নেও মানুষকে লড়াই করেই বাঁচতে হয়েছে। তখনকার বিপদ যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা হিংস্র পশু হয়ে থাকে এখনকার দুর্যোগ আসলে মানসিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময়েই বিশ্ব প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট ছন্দে ঘটে থাকে। এ মহাবিশ্ব কে তৈরি করেছে জানা নেই কিন্তু এটি মিলিটারি বাহিনীর চাইতেও ঢের বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই প্রকৃতির বুকে ঘটে চলা বিপদগুলোকেও অঙ্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রতিহত কতটা করা যায় তা বলতে পারি না। কিন্তু মানসিক দুর্যোগের মোকাবিলার তো কোন সরল পথই নেই।
সাম্প্রতিক ভারতে যা রাজনীতির ছবি দেখা যাচ্ছে সেটিও এই ঘেন্নার ছবি মাত্র। আমার পাশের লোকটিকে আমি ঘেন্না করতে শুরু করে দিচ্ছি হঠাত। হঠাত কোন কিছুই কী হয়! না কোন কিছুই নয়। এর মূল লুকিয়ে আছে লোভে। রাজনীতির ক্ষমতা দখলের লোভ। প্রকৃতির সন্তান মানুষের কাছে প্রকৃতির দেওয়া প্রচুর সম্পদ ছিল। বিকট লোভ সে সম্পদ ক্রমে ফুরিয়ে ফেলছে। অথচ লোভ তো উত্তরোত্তর বাড়ছে। কারণ ভোগের কামনা বাড়িয়ে তোলে লোভ। “ন জাতু কাম কামানমুপভোগেন শাম্যতি/ হবিসা কৃষ্ণ বরত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।। লোভ উস্কে দিচ্ছে অন্তর্নিহিত হিংসা। আরো চাই আরো চাইয়ের অসুখে বিপর্যস্ত সমাজ। না পেলেই রাগ। এখন কত সহজেই দেখছি সামান্য মোবাইল চেয়ে না পেলেই গলায় দড়ি, খুনোখুনি হাতাহাতি ইত্যাদি, তাহলে ক্ষমতা দখলের জন্য পস্পরের বিরুদ্ধে মানুষকে লেলিয়ে দেওয়া হবে না কেন! রাজনীতিবিদেরা ঠিক এই কাজটাই করে যাচ্ছে। ষড়রিপুর প্রত্যেকটা একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই লোভকে উস্কালে হিংসা আসে। এই হিংসাই রাবণের চিতার মত পুড়িয়ে দেয় বাড়ি ঘর সমাজ ব্যক্তি মানুষ এমনকী দেশকেও। কোন বড় বড় জ্ঞানবাণী বলে এই প্রচন্ড ঘৃণার বেগ প্রতিহত করা যাবে না। ভাল কথা নীতি কথা বহু বহু বইতে লেখা। অনেক ধর্ম গুরু মোটিভেশনাল স্পিকার কত বছর ধরে এসব বলে যাচ্ছেন। তাতে কী আধুনিক মানুষের বিপর্যয় কিছু কমেছে? না কমেনি। কারণ রোগীর সেরে ওঠার প্রথম ধাপ হল তার নিজের সেরে ওঠার ইচ্ছা। আজকের মানুষ লোভের দাবানল থেকে সেরে উঠতে চায় না।
হিন্দুদের একটি পদ্ধতি আছে সাধনা করবার। তা হল লোভ থেকে নিজেকে পরিহার করে নেওয়া। এটা কঠিন কিন্তু সফল পদ্ধতি তো বটেই। কত হাজার বছর ধরে এই পদ্ধতিতে কত সাধক তাঁদের মোক্ষ মানে টার্গেট পূরণ করতে পেরেছেন। এই আত্মসংযম এখন মানুষের ইচ্ছে নেই। স্বামীজী সেই কত দিন আগে বলেছিলেন –“একটি শিশুকেও তুমি কিছু শিখাইতে পারো না যদি সে নিজে ইচ্ছুক হয়।’নিরন্তর চাওয়ার আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমিই কী পারি রোধ করতে! কিন্তু পারতে হবে। পারতেই হয়। তা না হলে চাওয়ার আগুন ঈর্ষা আনে, না পাওয়ার কষ্ট ক্রোধ আনে। আর গীতা তো বলেইছেন “ক্রোধাত ভবতি সম্মোহ সম্মোহত স্মৃতি বিভ্রমহ/ স্মৃতিভ্রংশাত বুদ্ধিনাশ বুদ্ধিনাশাত প্রণশ্যতি।” আজকের ভারতে পেটে খিদে হল রোজের সমস্যা। জ্যান্ত দুনিয়ার কষ্ট। একশ বছর আগে স্বামীজী ভারতের দারিদ্র দেখে চোখের জল ফেলেছেন। এত এত উন্নতির পরেও আজো কেন এত মানুষ খিদে নিয়ে থাকেন? কারণ সম্পদের অসম বন্টন। অথচ ঘেন্নার চাষ তাঁদের ভেতরে নয় সেটি মূলত দেখা যায় কিছুটা খেতে পাওয়া থেকে অত্যন্ত ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাহলে খিদে নয় হিংসে করার কারণ মনের আকাঙ্ক্ষার সীমাহীনতা। তাহলে আমরা প্রয়োজনের জিনিষটুকু পেয়েই থামছি না। আরো চাই বলে নিজেকে বঞ্চিত ভাবছি। Need আর Desire এর তফাৎ বুঝতে পারছি না। তাই এত রাগ হচ্ছে এত ঘেন্না হচ্ছে পাশের লোকটার প্রতি। আর ক্ষমতাসীন দল উস্কে যাচ্ছে সেইসব কিছু পাওয়া স্রেণীর লোকদের। বলে যাচ্ছে তাদের সব সমস্যার জন্য ইসলাম ধর্মের লোকজন দায়ী। চাকরি পাচ্ছি না তাহলে ও দায়ী। শাশুড়ি অত্যাচার করে তাহলে ও দায়ী। রাস্তায় জ্যামে গাড়ি আটকে তাহলে ও দায়ী। এইভাবে আমার সব সমস্যার জন্য তাদের দিকে আঙুল তুলছি। দেখছি বরাবরের সরল হাসিখুশি ছেলেটি একদিন যে নাটকের অভিনয়ের পরে গ্রীনরুমে আমার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ভাসিয়েছিল আর সকলের সঙ্গে দেখা হবে না বলে, সেই আজ ফেসবুকে হেট স্পিচ পোষ্ট করে। উল্লাসে বলে ক্ষমতাসীন দলের নির্লজ্জ সমাজবিরোধী নীতিই সঠিক। কাল্পনিক শত্রু ঘোষণা করে ইসলাম ধর্মের লোকদের। অথচ সে তো এমন ছিল না। প্রয়োজন ও কামনার গোলকধাঁধায় তার মন গুলিয়ে গেছে। এর থেকে বের হবার পথ কী এ কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে ভাবি বের হতে কী সে চায়? হিংসের আগুনে তার নিজের বুকও যখন পুড়িয়ে পুড়িয়ে কালো করে দেবে হয়ত সেদিন সে নিজেই চাইবে ঘেন্নার ব্যূহ থেকে বেরোতে।
ততদিন অপেক্ষাই করে যেতে হবে। আর চালিয়ে যেতে হবে প্রতিবাদ। কথা বলে যেতে হবে কোনটি অন্যায় কোনটি ন্যায়। কেননা শেষ পর্যন্ত ওঁ বাঙ্ মে মনসি প্রতিষ্ঠিতা, / মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্,/ আবিরাবীর্ম এধি- আমার কথা সত্যে প্রতিষ্ঠিত/ আমার মন কথায় প্রতিষ্ঠিত/ স্পষ্ট করো স্পষ্ট করো ... সত্য প্রতিষ্ঠা হলে ঘেন্নাও দূর হবে।