কয়েক বছর আগেও যারা বিকালের দিকে বড়রাস্তা ধরে পলাশপুরের উপর দিয়ে পানাগড়ের দিকে যেতেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন পলাশপুরের মোড়ে মন্দিরের সামনে বছর চোদ্দ বয়সের একটা মেয়ে হাতে এক ঝাঁক টগর গাঁদা জবার মালা নিয়ে, কোন কোন দিন আবার রজনীগন্ধা নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। যখনই কোন গাড়ি যেত সে তার মালা সমেত হাতটা গাড়ির দিকে এগিয়ে ধরত। এখনও পলাশপুর চাষাপাড়ায় ষষ্ঠীতলার খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘড়টার বাইরে কান পাতলে শোনা যায় এক অভাগা মায়ের কান্না – সোনাই, সোনাই আমার, ফিরে আয় মা, একবার আমার বুকে আয়।
বিয়ের দেড় বছর পড় ঘরে যখন মেয়েটা জন্মাল হরিপদ তার বউ আশালতাকে বলেছিল, - “তোমাকে সোনার গয়না কিনে দেবার মত ক্ষ্যামতা তো আমার নেই। এই মেয়ের নাম রাখি সোনাই, এই হল গিয়ে তোমার সোনা।“ তার বরের কথা শুনে আশালতা হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। হরিপদ রোজ কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে চাষির বাড়ি থেকে সব্জি কিনে নিয়ে আসে। সকাল হলে বউ এর হাতে চা মুড়ি খেয়ে গামছাটা পাকিয়ে বিঁড়ে করে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ইস্টিশনের বাজারে সব্জি বেচতে চলে যায়। এগারোটা বারোটার মধ্যে মোটামুটি সব বিক্রি হয়ে যায়, তারপর বাড়ি ফেরবার সময় স্টেশন বাজারের দোকান থেকে বাড়ির জন্যে চাল ডাল নুন তেল যেদিন যেমন বউ এর ফরমাশ থাকে সওদা করে আনে। আশালতা মেয়েকে সামলে আর ঘরের সব কাজ করে যেটুকু সময় পায় খবরের কাগজের ঠোঙা বানায়। পুরোনো খবরের কাগজ হরিপদই কিনে এনে দেয়, আবার তৈরি ঠোঙা জমে গেলে সেই বাজারের দোকানে দিয়ে আসে। দেখতে দেখতে সোনাই একটু বড় হয়েছে, রোজ সকালে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মতন সেও এখন স্কুলে যায়, আবার মাঝে মাঝে মায়ের পাশে বসে ওর কচি হাতে ঠোঙা বানাতে বসে। আশালতা নিজে ইস্কুল যেতে পারেনি, তাই তার সোনাই স্কুলের জামা প্যান্ট জুতো পরে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে যখন স্কুল যায় তা দেখে ওর বুকটা আনন্দে ভরে যায়।
সোনাই আরও বড় হয়েছে, এখন সিক্সে পড়ে। ওদের গাঁয়ে হাই স্কুল নেই তাই পাশের গাঁয়ের হাই স্কুলে যায়। বড় রাস্তা ধরে স্কুল যাতায়াত করতে হয় বলে বাবামায়েদের সব সময় চিন্তা। অত গাড়ি লরি বাস সব সময় চলছে, জানি না কপালে কি লেখা আছে, তবু স্কুলে তো পাঠাতেই হবে। হরিপদ সোনাইকে বলে দিয়েছে, ‘বড় রাস্তা দিয়ে সব সময় গাড়ি যাচ্ছে, সাবধানে যাতায়াত করবি মা, রাস্তার একদম ধার দিয়ে হাঁটবি, পিচ রাস্তায় উঠবি না। ভাগ্যিস রাস্তা পাড় হবার দরকার নেই।‘ সোনাই রোজ সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসার আগে চা তৈরি করে মুড়ি মেখে বাবা মাকে দেয়। কোন দিন হয়ত বলল, - ‘আজ আদা নেই, থাকলে চায়ে একটু আদা দিতাম, মুড়িতে তেল পেঁয়াজ লঙ্কা কুচো দিয়েছি, খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে।‘ এইভাবে বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো।
পুজো প্রায় এসে গেল, রবিবারের বাজার বিক্রিবাটা ভালোই হয়েছে আজ। ইস্টিশন বাজার থেকে বাড়ি ফেরবার সময় হরিপদ সোনাই এর জন্যে ফ্রক আর ইজের, আর আশালতার জন্যে সিঁদুর আলতা কিনেছে। বাড়ি এসে সোনাই এর হাতে ওর জামা প্যাণ্টের প্যাকেটটা দিয়ে বলল, - “নে মা, তোর পুজোর জামা প্যাণ্ট, পরে দেখ ঠিক হয়েছে কিনা।” প্যাকেটটা থেকে ওর জামা প্যান্টটা বার করে সোনাই হাসতে হাসতে মাকে দেখিয়ে বলল, দেখ মা কি সুন্দর হয়েছে আমার জামা প্যান্টটা’ এবার বাবাকে বল, - বাবা তোমার জন্যে কি কিনেছ দেখাও? – নারে মা আজ আর আমার জন্যে কিছু কেনার সময় পাইনি। আমার লুঙ্গিটা ছিঁড়ে এসেছে ভাবছি পুজোর মুখে একটা লুঙ্গি কিনে নেব, ওটাই না হয় পুজোর সময় পরব।
- বাবা, তুমি একটা ধুতি কিনো, পুজোর সময় পরবে।
- ঠিক আছে মা, সে নায় তখন দেখা যাবে।
#
পুজো মিটে গেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ হল, সোনাইদের স্কুলও কয়েক দিন আগে খুলে গেছে। এখন শেষ রাতের দিকে একটু ঠাণ্ডাও পড়েছে, হরিপদর আজ গাটা ম্যাচম্যাচ করছে তাই ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আশালতা বলল, - শরীলটার যখন জুত নেই আজ তুমায় আর বাজার যেতি হবে নাকো, ঘরে শুয়ে বসে একটু জিরিয়ে নাও।
পুজো মিটে গেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ হল, সোনাইদের স্কুলও কয়েক দিন আগে খুলে গেছে। এখন শেষ রাতের দিকে একটু ঠাণ্ডাও পড়েছে, হরিপদর আজ গাটা ম্যাচম্যাচ করছে তাই ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আশালতা বলল, - শরীলটার যখন জুত নেই আজ তুমায় আর বাজার যেতি হবে নাকো, ঘরে শুয়ে বসে একটু জিরিয়ে নাও।
হরিপদ কাজের মানুষ, ঘরে বসে থাকা তার কি আর কপালে আছে। সে তার সাইকেল আর ঝুড়ি নিয়ে চাষির বাড়ি থেকে সবজি কিনে নিয়ে এল। তারপর পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে এক বাটি পান্তাভাত খেয়ে সাইকেলের কেরিয়ারের ওপর সবজিভর্তি ঝুড়িটা রবারের পুরোনো টিউব দিয়ে ভালো করে বেঁধে, আর হ্যাণ্ডেলের দুদিকে দুব্যাগ ভর্তি সবজি ঝুলিয়ে বাজারে গেল।
আশালতা দু হাত কপালে ঠেকিয়ে দুগগা দুগগা বলে ঠাকুরের কাছে হরিপদর শুভ কামনা করল। সোনাই ওর মাকে বলল, - মা, বাবার শরীরটা ভালো নেই বলছিলে, তাহলে বাবাকে আজ বাজার যেতে দিলে কেন?
- তোর বাবাকে তো তুই জানিস, কবে আমার কথাটা শুনেছে শুনি। নিজে যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে, পইপই করে বননু আজগে বাজারে যেওনাকো ঘরে বসে একটু জিরিয়ে নাও, সেকথা কি শুনলো?
#
কোন মন্ত্রী না কে মারা গেছে, সোনাইদের স্কুলে তাই আজ বারোটার সময় ছুটি হয়ে গেছে। সোনাই ওর বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বড় রাস্তার ধার ধরে বাড়ি ফিরছিল, খানিকটা আসার পর মোড়ের কাছে এসে দেখল পিচরাস্তার ওধারে কি যেন হয়েছে, রাস্তার ধারে একটা সাইকেল ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে, কয়েকজন লোক এক জায়গায় ঘিরে কি দেখছে। অজয় বলল চল, দেখি বোধ হয় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ছুটল, একটু কাছে যেতেই সোনাই চেঁচিয়ে উঠল, “এটাতো আমার বাবার সাইকেল” কাঁদতে কাঁদতে ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখল তার বাবা হরিপদ মাটির ওপর পড়ে রয়েছে, দুটো পা-ই থেঁৎলে গেছে নাক কান মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে চলেছে। সোনাই কাঁদছে আর সবাইকে বলছে “তোমাদের পায়ে পড়ি একটা গাড়ি থামিয়ে আমার বাবাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমার বাবাকে বাঁচাও।“
কোন মন্ত্রী না কে মারা গেছে, সোনাইদের স্কুলে তাই আজ বারোটার সময় ছুটি হয়ে গেছে। সোনাই ওর বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বড় রাস্তার ধার ধরে বাড়ি ফিরছিল, খানিকটা আসার পর মোড়ের কাছে এসে দেখল পিচরাস্তার ওধারে কি যেন হয়েছে, রাস্তার ধারে একটা সাইকেল ভেঙে দুমড়ে পড়ে আছে, কয়েকজন লোক এক জায়গায় ঘিরে কি দেখছে। অজয় বলল চল, দেখি বোধ হয় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ছুটল, একটু কাছে যেতেই সোনাই চেঁচিয়ে উঠল, “এটাতো আমার বাবার সাইকেল” কাঁদতে কাঁদতে ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখল তার বাবা হরিপদ মাটির ওপর পড়ে রয়েছে, দুটো পা-ই থেঁৎলে গেছে নাক কান মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে চলেছে। সোনাই কাঁদছে আর সবাইকে বলছে “তোমাদের পায়ে পড়ি একটা গাড়ি থামিয়ে আমার বাবাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাও, আমার বাবাকে বাঁচাও।“
হরিপদকে বাঁচানো যায়নি, রাস্তায় হাত দেখিয়ে কোন গাড়ি থামানো যাইনি, দু একটা গাড়ি গতি কমিয়ে মুখ বারিয়ে উঁকি মেরে একটু দেখে চলে গেছে। কান্নাকাটি শোকের মধ্যে কদিন চলল, পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন হরিপদর বাড়িতে এল, আশালতা সোনাইকে সান্ত্বনা দিয়ে আবার চলে গেল। আশালতা ভাবে মানুষটা বাজারে সবজি বিক্রি করে ঘরে ট্যাকা আনত, সেই ট্যাকায় তাদের সংসার চলত, সেই মানুষটাই চলে গেল, এবার তাদের কিভাবে সংসার চলবে। আশালতা সোনাইকে বলল, ‘তোর বাবা বলত, আমার মেয়ে স্কুলপাশ করে কলেজে পড়বে, চাকরি করবে। এখন কি করে কি করব আমি জানি না, সোনাই কবে তুই পড়াশোনা করে বড় হবি।‘ ঐটুকু মেয়ে হয়েও সোনাই তার মায়ের চোখের জল তার কচি হাতে করে মুছিয়ে বলে, - মা, তুমি ভেবো না। আমি পড়াশোনাও করব আবার কিছু কাজ করে টাকাও রোজগার করব।
আশালতা তাদের গ্রামের জমিদারবাড়ি রক্ষিতবাবুদের গিন্নীমাকে ধরে একটা কাজ জুটিয়েছে। গিন্নীমার বাতের অসুখ, ওনার হাঁটুতে বাতের তেল মালিশ করে দেওয়া, ফাইফরমাস খাটা, আর রান্নাঘরে সবজি কেটে দেওয়া ইত্যাদিই তার কাজ। এই কাজে তার দুপুরের খাওয়াটা জোটে আর হাতে কিছু টাকা মাইনে হিসাবেও পায়। এছাড়া সন্ধ্যেবেলা লন্ঠনের আলোয় স্কুলের পড়া হয়ে গেলে সোনাইও বসে যায় তার মায়ের সাথে খবরের কাগজের ঠোঙা বানাতে, তার থেকেও কিছু আয় হয়। এইভাবে কষ্টেসষ্টে যাহোক করে ওদের দিন চলে যাচ্ছিল।
সেবছর সোনাইদের গ্রামের শীতলা পুজোকমিটির ছেলেরা ভ্যান রিক্সার ওপর বিশাল মাপের বক্স বসিয়ে ডিজে বাজাতে বাজাতে মাইকে করে বলে গেল “আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, অদ্য সন্ধ্যা ছয় ঘটিকায় পূর্বপাড়ার শীতলাতলার পূজামণ্ডপে সিনেমা দেখানো হইবে সম্পূর্ণ ফিরিতে, কোন পয়সা লাগিবে না। আপনারা দলে দলে যোগদান করিয়া এই সিনেমা প্রদর্শণীকে সার্থক মণ্ডিত করিয়া তুলুন।“ সোনাই মাকে বলল, - মা, তুমি এবারে শীতলাতলায় যাওনি আজ সন্ধ্যেবেলা আমরা দুজনা মিলে সিনেমা দেখতে যাব।
- না মা, আমার আর ঠাকুরতলায় যেতে ইচ্চে করে না, আমি যাব না। তুই তোর সইদের সঙ্গে গিয়ে সিনেমা দেখে আয়।
সোনাই জানে মাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাই আর কিছু বলেনি। সন্ধ্যাবেলা সে বন্ধুদের সাথে শীতলাতলায় সিনেমা দেখতে গেল। নটার সময় বাড়ি ফিরে সোনাই দেখল তার মা তখনও ঠোঙা বানাচ্ছে। ও মাকে বলল, - সিনেমাতে দেখলাম একটা মেয়ে তার ঠাম্মার কাছে থাকে, সে আর তার বুড়ি ঠাম্মা, তাদের আর কেউ নেই। মেয়েটা রাস্তার ধারে মন্দিরের সামনে ফুল মালা বিক্রি করে। রাস্তাদিয়ে গাড়ি যাবার সময় গাড়ি থামিয়ে ওর কাছ থেকে ফুল মালা কিনে লোকেরা ঠাকুরের মন্দিরে পুজো দিচ্ছিল, কেউ কেউ আবার মালা কিনে তাদের গাড়িতে ঠাকুরের ছবিতে দিচ্ছিল। ঐ টাকাতেই সেই মেয়েটার আর তার ঠাম্মার চলে যাচ্ছিল। আমিও কাল থেকে ফুল মালা নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে বনকালী মন্দিরটার সামনে ফুলের মালা বিক্রি করব। আমি দেখেছি সব বাস আর এক একটা গাড়ি ওখানে থেমে মন্দিরে প্রণাম করে যায়। ওদের কেউ কেউ যদি আমার কাছ থেকে মালা কেনে, ওদের গাড়ির ঠাকুরের ছবির জন্যেও তো কিনতে পারে, তাহলে আর আমাদের এত কষ্ট থাকবে না।
- তুই স্কুল যাবি না?
- স্কুলে কেন যাব না মা। বিকেলে আমি খেলতে যাই, আর খেলতে যাব না, আমি বিকেলবেলা ফুল মালা নিয়ে বড় রাস্তার ধারে বনকালী মন্দিরের সামনে দাঁড়াব।
- তুই রোজ রোজ অত ফুল কোথায় পাবি? আমাদের উঠোনে তো একটা টগর, একটা জবা আর কটা গাঁদা গাছ আছে, এই দিয়ে তোর হবে?
- দেখি না মা একবার শুরু করে। গোঁসাইকাকীদের তো অনেক ফুল গাছ আছে, বললে নিশ্চয়ই দেবে। আমি আমাদের বাড়ির সামনে ফুলগাছ পুঁতবো, সেখানে ফুল ফুটবে তখন আর ফুলের অভাব হবে না।
- যা ভালো বুঝিস করিস, দেখিস যেন কোন বিপদ আপদ না হয়। তোর বাবাকে তো ওই বড় রাস্তাই খেল। আমার বড় ভয় হয়রে মা।
- তোমার কোন ভয় নেই মা, ওখানে বলাইকাকার চায়ের দোকান আছে, মন্দিরে ঠাকুরমশাই আছে, আমার কোন বিপদ হবে না।
সোনাই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ফুল তুলে মালা গেঁথে জল ছিটিয়ে রেখে দেয়, বিকালে একরাশ ফুলের মালা হাতে ঝুলিয়ে ফুলওয়ালী হয়ে বড় রাস্তার ধারে বনকালী মন্দিরের সামনে দাঁড়ায়। মন্দিরের সামনে কোন গাড়ি এলে ও তার মালাসহ হাতটা এগিয়ে দেয়, কেউ কেনে কেউ আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওর মা বলে দিয়েছে গাড়ির দরজার বেশি কাছে যাবি না, দূর থেকে হাত বাড়িয়ে মালা দিবি আর পয়সা নিবি। আর দেখবি কেউ যেন শুধু শুধু তোর গায়ে হাত না ঠেকায়, আমাদের কপাল খারাপ, কোথায় কখন বিপদ আসবে কে অত বলতে পারে। প্রথম দিন মালা বেচে সোনাই বাড়ি এসে পকেট থেকে টাকাপয়সাগুলো বার করে গুনে দেখল পঁচিশ টাকা। টাকাগুলো মায়ের হাতে দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে সে পড়তে বসল। এই ভাবেই চলছিল স্কুল আর মালা বেচা। সোনাই এর স্কুলে খুব সুনাম আছে, পড়াশোনাতেও বেশ ভাল, মাষ্টারমশাইরা সবাই ওকে ভালোবাসেন।
সোনাই বড় হয়েছে বছর চোদ্দ বয়স হবে , এখন ক্লাস এইটে পড়ে। এখনও সে রোজ ফুলের মালা নিয়ে বের হয়, দাঁড়ায় বড় রাস্তার মোড়ে মন্দিরের সামনে। এখন কয়েকটা লরির ড্রাইভারের চোখের চাওনি তার ভালোলাগে না, কেউ কেউ আবার মালা নিয়ে মুচকি হাসে কেউ আবার পয়সা দেবার সময় ইচ্ছা করে হাতে হাত ঠেকায়। সোনাই এখন সব বোঝে, নিজেকে সাবধান করে নেয়। আবার অনেক ভালো ড্রাইভারও আছেন, তাদের দেখে শ্রদ্ধা হয়। একটা মাসীমা ছোট সাদা গাড়ি নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে প্রায় দিনই যাতায়াত করেন, তিনি ওর কছ থেকে দুতিনটে করে মালা নেন। একটা সর্দারজীদাদু আছেন তিনিও খুব ভাল লোক, তিনি বলেন বাড়িতে সোনাই এর মতন তারও একটা নাতনি আছে। সোনাই রাতে খেতে বসে মায়ের সাথে কত গল্প করে, ওর স্কুলের কথা, সেদিনের ফুলমালা বেচার নতুন কোন অভিজ্ঞতার কথা ইত্যাদি। আশালতা মেয়েকে সাবধান করেন যাতে কোন বিপদ না আসে। সোনাই রোজ বিকালে ফুলের মালা নিয়ে বেরলে আশালতা দুগগা দুগগা বলে তুলসী তলায় গিয়ে মেয়ের মঙ্গল কামনায় দেবতাকে প্রণাম করে বলে, - ঠাকুর আমার তো আর কেউ নেই, আমার মেয়েটাকে তুমি বিপদ আপদ থেকে রক্ষা কোরো।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সোনাই বেশি করে মালা নিয়ে বেরল, পূজার দিন বেশি বিক্রি হবে সেই আশায়। ও রোজ সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে এসে সেদিনের বিক্রির সব টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয়। আজ সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হল, এখনও সোনাই বাড়ি এল না। এত দেরি তো ও কোন দিন করে না, আশালতা চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাশের গোঁসাইবাড়ি গিয়ে গোঁসাইবউকে বলল, - “সোনাই আজ এখনও ফেরেনি, খুব চিন্তা হচ্ছে।“ ওবাড়ির ছেলে বাপন বলল, - জেঠিমা, তুমি মায়ের কাছে বস, আমি সাইকেলে করে গিয়ে সোনাইদিদি যেখানে মালা বেচতে যায় খোঁজ করে আসছি। কিছুক্ষণ পরে বাপন ফিরে এসে বলল, সোনাই দিদি ওখানে নেই, মন্দিরেও কেউ নেই। চায়ের দোকানের বলাইকাকু বলল, সোনাই এসেছিল দেখেছি, কখন চলে গেছে তা তো দেখিনি।
সোনাই আর ফেরেনি, পরের দিন ভোরে দুর্গাপুরের কাছে একটা পেট্রলপাম্পের সামনে রাস্তার ধারে একটা বছর চোদ্দ বয়সের নগ্নমেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু বললেন, ঘন্টা খানেক আগেই ওর মৃত্যু হয়েছে। ওর ওপর অত্যাচার আর অধিক রক্তক্ষরণই ওর মৃত্যুর কারণ। পেট্রলপাম্পের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছিল একটা টাটাসুমো গাড়ি থেকে চারজন ছেলে মেয়েটিকে রাস্তার ধারে ফেলে চলে যায়। আশালতা এখনও কেঁদে চলে - সোনাই, সোনাই আমার, ফিরে আয় মা, একবার আমার বুকে আয়।
সুচিন্তিত মতামত দিন