কোন দেশের শাসক যখন তার সহনাগরিকদের মুক্তচিন্তার পরিসরকে সঙ্কুচিত করে, মেধা ও মননের চর্চাকে উৎসাহিত না করে, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে শ্রদ্ধা না করে ধর্মের আফিং এ বুঁদ করে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে যত্নবান হয় তখন সেই দেশের অন্তরাত্মার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আর যদি সে দেশের জনকন্ঠের স্বচ্ছ আরশিসম সংবাদমাধ্যম স্বধর্ম বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জ চাটুকারিতাকে সোপান হিসেবে বিবেচনা করে তখন কফিনের শেষ পেরেকটি নিশ্চিত সিলমোহর পেয়ে যায়। এইমুহূর্তে ভারতবর্ষ জুড়ে একদিকে বড়, ছোট, পাঁতি, আধুলি, সিকি প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক স্খলন ও অধঃপতন, (ব্যতিক্রম আছেন,যদিও ব্যতিক্রম নিয়ম নয়) স্বধর্মচ্যুত মিডিয়াকুলের শাসক শ্রেণির প্রতি নির্লজ্জ আনুগত্য, ধর্ম নামক ব্যবসার রমরমা। যার আমদানী ও রপ্তানির একচেটিয়া বাজারের নিয়ন্ত্রক স্বয়ং শাসককুল।এই ত্রিবিধ উপসর্গে মরণোম্মুখ আমাদের দেশ। তার সাথে যদি জুড়ে যায় দেশবাসীর অদ্ভুত শৈত্য, প্রতিবাদবিমুখতা,যতোক্ষণ না পর্যন্ত নিজের পিঠ পুড়ছে ততক্ষণ স্থাণুবৎ থাকা,যা দেশটার নাভিশ্বাসকে ত্বরান্বিত করছে। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষ অন্ধকারের এমন বহুমাত্রিকতা এর আগে কখনো দেখেনি।
একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে বিশ্ব যখন মঙ্গল জয়ের স্বপ্নকে সাকার করতে মরিয়া, সূর্যের কেন্দ্রানুগ শক্তিকে স্বায়ত্বাধীন করতে মেধা আর শ্রমকেই হাতিয়ার করে এগোচ্ছে।প্রমাণ করছে "মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই কৃপার 'পরে করে দেব মহিমা নির্ভর!" তখন আমার দেশ মানুষের মেধা নয়, মনন নয়,যুক্তিবোধ নয়, জয়ধ্বনি দিচ্ছে এক বিশেষ চতুষ্পদের।ভাবতেই অবাক লাগে এইদেশেরই কবি আজ থেকে বহুপূর্বে লিখে গেছেন " শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই!"অথচ আজ একশো ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর খাদ্য - বস্ত্র- বাসস্থান, শিক্ষা -স্বাস্থ্য -নিরাপদ আশ্রয়, বাক -মত -বিশ্বাস অনুযায়ী যাপনের স্বাধীনতাকে কন্ঠরোধ করে, মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর গড়ে, দেখনদারি আর প্রচারসর্বস্বতা দিয়ে আচ্ছন্ন করতে চাইছে মানুষের চেতনাকে। প্রশ্নকারীকে দেগে দিচ্ছে 'দেশদ্রোহী' তকমা।অথবা দিনদাহারে লাশ করে দিতেও দুবার ভাবছেনা। মানুষের মৌলিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব যার বা যাদের কাঁধে ন্যস্ত, তারা তাঁদেরই জীবন, সম্পত্তি, এমনকি অস্তিত্বকেই চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিয়ে ধর্মের ধুয়ো তুলে নিজের অপদার্থতা, অক্ষমতাকে আড়াল করতে মরিয়া। মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারেনা, মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারেনা, অথচ বিশেষ চতুষ্পদের জন্য রক্ষাবলয় তৈরী করে বিশ্বের কাছে নিজেকে চরম হাস্যাস্পদ করে তুলতেও দ্বিধাবোধ করেনা একটুও।ইদানীং তাদের গো- প্রেম এতোটাই বাড়বাড়ন্ত যে গোরুর দুধে সোনার সন্ধান পেয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
অত্যন্ত সুচারুভাবে এক একটা 'এপিসোড 'এর অবতাড়না করছেন, যার রচয়িতা, নির্দেশক, অভিনেতা সবই এক উর্বর মস্তিষ্কধারী ও কিছু অন্ধ স্তাবক। এবং বিষয়বস্তুও অবধারিতভাবে পাটিগণিতের সরল সূত্রানুসারে এক। মুসলমান -পাকিস্তান -কাশ্মীর - তিনতালাক -তিনশো সত্তর -গোমাংস। যেন এছাড়া তাদের সিলেবাসে আর কোন শব্দ নেই, ক্ষুধাসূচকে দেশ বিশ্বের তালিকায় সর্বনিম্নে অবস্থান নেই,কর্মসংস্থানের আশঙ্কাজনক সর্বনিম্নগামী হার নেই, মেধা চালান নেই, গরিবী নেই, কৃষকের আত্মহত্যা নেই, নোটবন্দীর প্রহসন নেই, জিএসটির জুজু নেই, পুলওয়ামার কাল্পনিক নাটকের বুজরুকি নেই, 'বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও' মোড়কের আড়ালে কুলদীপ সেঙ্গার, আশারাম, রামরহিমের মতো শ্বাপদদের অবাধ বিচরণ নেই। 'কালাধন'ফেরানোর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নেই, এন. পি.আর, এন .আর. সি.র মতো মানুষের অস্তিত্বসংকটকারী বিভীষিকা নেই, 'আখলাক' নেই, 'মবলিঞ্চিং', 'দলিত নিধন' নেই। দেশজুড়ে দেশপ্রেমের নয়া সমীকরণ, নব্য সংজ্ঞার আমদানী নেই,প্রশ্নকারীকে 'অসহিষ্ণু 'দেশদ্রোহী' তকমায় চিহ্নিত করা নেই। সংসদ ভবনকে নাট্যমঞ্চে পরিণত করে ভারতীয় ঐতিহ্যকে ধূলিস্যাৎ করা নেই। সাংবিধানিক পদাধীকারীরাও কি অবলীলায় বিকিয়ে যান! 'নিরপেক্ষতা' শব্দটার বলাৎকার হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে।দেশরক্ষকের মুখে 'সত্যমেব জয়তে ' নয়, 'জয় শ্রীরাম', 'আল্লাহু আকবর'ধ্বনি আর বিকৃত অঙ্গভঙ্গী দেখে বোঝার উপায় নেই এ সংসদভবন না যাত্রামঞ্চ। স্বাধীনতা শহীদের আদর্শ নয়, তাদের মূর্তি গড়া ভাঙার হাস্যকর বালখিল্যতা মেতে ওঠা এইসব অর্বাচীনদের সমস্ত ধৃষ্টতা দেখেও যদি আমাদের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হওয়ার জন্য নিশপিশ না করে, যদি মেরুদন্ডে উত্তপ্ত প্রবাহ অনুভূত না হয় তবে এই দেশ নিশ্চিত মৃতদেহ।
এবার প্রশ্ন হলো দেশে দেশে, যুগে যুগে শাসক যখন স্বৈরাচারী হয়। সাধারণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে,তখন জনগণকন্ঠের সম্মিলিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ,বিপ্লব আর দ্রোহ ভাষা পায় প্রচারমাধ্যমে।স্বয়ং সংবিধান সেই বাক প্রকাশের স্বাধীনতাকে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি, সুরক্ষাকেও নিশ্চিত করার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে রাষ্ট্রের ওপর।এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারত দেখেছে সংবাদমাধ্যম তথা মসির জোর!মেধা আর মননের সংযোগসাধনশক্তির ক্ষীপ্রতা!বিদেশি শক্তিও সেই মেধার কাছে, শক্তির কাছে অবনত হয়েছিলো সম্ভ্রমে। অথচ আজ স্বাধীন ভারতবর্ষে মিডিয়ার ভূমিকা দেখলে লজ্জায় ঘৃণায় ক্ষোভে মিশে যেতে হয় চেতনাসম্পন্ন মানুষকে।মানুষ যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সটান দাঁড়াতে না পারে, যদি শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে না পারে "রাজা তোর কাপড় কোথায়?" তাহলে সেই স্বাধীনতা খায় না মাথায় মাখে সে খবর জেনে কি হবে? যে দেশে কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিক জন্মান, সত্যোচ্চারণের মূল্য জীবন দিয়ে চোকাতেও দ্বিধান্বিত হননি। সেখানে নামকরা মিডিয়া হাউসগুলোর নির্লজ্জ চাটুকারিতা, গোরুর বিয়ে, মালাবদল, বাসর এসব উৎপটাং বিষয় নিয়ে খবর করে তখন ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয় বৈকি!
তবু আশার কথা এই অন্ধ সময়েও কিছু মানুষ এখনো আছেন তাঁদের গলা এই অন্ধ স্তাবকের মুহূর্মূহু হাততালির শব্দকে ভেদ করতে পারুক না পারুক গলা তুলে প্রশ্ন করার ঋজুতা রাখে, জোর রাখে মুষ্টিতে ও মেরুদন্ডে। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের সার্কাসের জোকার সরকার (কি কেন্দ্রে, কি রাজ্যে) আর বিদুষক নড়বড়ে তৃতীয় স্তম্ভকে থোড়াই পরোয়া করে তারা। হোক না তারা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু বলতে কোন বিশেষ 'ধর্মে' বিশ্বাসী সম্প্রদায়কে বোঝাতে চাইনি। বলতে চেয়েছি চিন্তাচেতনায় যাঁরা উদার ও সচেতন,। আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার 'হিম্মত' যাঁদের আছে। বুলেটের জবাব বেয়নেটে হলেও যাঁরা দিতে জানে।যুগে যুগে এইসব সমমনস্ক মানুষেরাই সংখ্যালঘু।
আশার কথা মানুষ জাগছে।আসলে না জেগে উপায়ই বা কি!অস্তিত্ব যখন সংকটের মুখে, তখন রাম রহিম নয়, মন্দির নয়, মসজিদ নয়, ভগবানাল্লা নয়, মানুষ নিজের শক্তির ওপরই আস্থা রাখতে চাইবে। নিজেকেই তো বাঁচাতে চাইবে! আমরা নিজেকেই সবচেয়ে ভালোবাসি এ কথায় তো কোন দ্বিমত নেই! তাই জাতের লড়াই, নয় ভাতের জন্য লড়াইটা জারী থাক। আমাদের মুষ্টি হোক দৃঢ়তর, গর্জে উঠুক সম্মিলিত স্বর____
"আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই- এই চাওয়া সরাসরি- ঠান্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই- মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই...
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন-
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই-
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে...
উড্ডীন পতাকাসহ,খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি ...
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো।"(রফিক আজাদ)
সুচিন্তিত মতামত দিন