বর্ষায় সমুদ্র দেখবো বড্ড সাধ ছিল। সমুদ্র বলতে সেই কোন ছোটোবেলায় পুরী গিয়েছিলাম বাবা-মা’র সঙ্গে। তখন ক্যামেরা ছিল না আমাদের, তাই যা কিছু ছবি, সব স্মৃতির পাতায়। এর মাঝে বিশাখাপত্তনামের দুটি বেলাভূমির যদিও দর্শন হয়েছে, কিন্তু, সমুদ্রের সাথে একান্ত যাপন কোথাও তেমন ভাবে হয়নি! কল্পনায় এক সমুদ্র দেখতাম। বিশাল সে ঢেউ এর উপর ঝরে পড়ছে বারিধারা আর আমি বিস্মিয়ে চেয়ে আছি সেই সমুদ্রের দিকে। গল্প শুনেছিলাম, বর্ষার সমুদ্র নাকি অসাধারণ! পুরীর স্মৃতি আজ বড্ড আবছা। সংসার,বরের অফিস, ছেলের স্কুল সব দিক ম্যানেজ করে তিনটে দিন ছুটি পাওয়া সত্যিই শুভযোগ ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই মিলে গেল এমনই এক শুভযোগ। ১৩ই আগষ্ট রওনা হলাম ট্রেনে। ঠিক সাড়ে দশটা বা এগারোটা তখন। কাঁথি স্টেশনের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গাড়ি। কাঁথি থেকে মন্দারমণি বেশ ঘন্টাখানেকের রাস্তা। যাত্রার দৃশ্যপটও মনোরম। কালো পিচের রাস্তার দু’ধারে ঘনসবুজ গাছপালা। রাস্তার বিচিত্র পথশোভা দেখতে দেখতে যখন এসে পৌঁছালাম আমাদের হোটেল ‘ সানভিউ’, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজে। একটা সুসজ্জিত বাগান ঘেরা লনের ভিতরে প্রবেশ করতেই কানে এলো সমুদ্রের গর্জন। গাড়ি থেকে নেমেই বিস্মিত হতবাক আমি! সমুদ্র যে ধরা দিতে এসে পৌঁছেছে দরজায়! বাউন্ডারির সমুদ্রমুখী গেটের সিঁড়ি পুরো জলে ডুবে আছে, আর মাঝে মাঝেই সেখানে আছড়ে পড়ছে ঘোলাটে বর্ণের ঢেউ। ফেনিল জলের ছিটে ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তৃত স্থান জুড়ে। আমি রুমে না গিয়ে দাঁড়ালাম সেই উত্তাল সমুদের সামনে। জলের ছিটে ভরিয়ে দিয়ে গেল আমার পা থেকে মাথা। খুব সকালে বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে তাই, স্নান ও খাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। পায়ে পায়ে পৌঁছালাম রুমে। ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের ডাক। ব্যালকনি খুলতেই আরেক চমক। সমানেই দিগন্ত বিস্তৃত ফুলে ফেঁপে ওঠা লালচে সমুদ্র। দূর থেকে ছুটে আসা ঢেউ আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে তার রুষ্ট গর্জন।
দুপুরে ইলিশের ঝোল সহযোগে ভাত। পেটে খাবার পড়তেই ঘুমে যেন চোখ বুঁজে আসতে চায়ছে। কিন্তু ঘুমালে সমুদ্র যাপন হবে কি করে? দেখলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে। কালো একটা মেঘ যেন উঠে আসছে সমুদ্রের বুক থেকে। বৃষ্টি নামবে বোধহয়! একটা ছাতা হাতে বেরিয়ে এলাম বাইরে। হোটেলের বাউন্ডারির বাইরে বসার জন্য কংক্রিটের একটা স্বল্প বিস্তৃত জায়গা আছে। সেখানে কয়েকটি চেয়ার পাতা। গিয়ে বসলাম সেখানে। এখানে দৃষ্টি সীমাহীন অনন্ত বিস্তৃত জলরাশি আপন খেয়ালে মত্ত। বেলা বাড়ার সাথে সাথে জল ক্রমশ পিছোতে শুরু করেছে। হঠাৎ নেমে এলো বৃষ্টি। ছাতা খুলে বসলাম। ধীরে ধীরে তীব্রতা বাড়ছে। সমুদ্রের গর্জনে ঢাকা পড়ে গিয়েছে বৃষ্টির ছমছম শব্দ। এলোমেলো হাওয়ার দাপটে উড়ে যেতে চায়ছে ছাতা। তবু নয়নে ক্লান্তি নেই। যুগান্তরের তৃষ্ণা নিয়ে যেন বেঁচে আছে এ নয়ন।
বৃষ্টি যখন থামলো, তখন বিকেল। জল সরতে সরতে কতদূরে চলে গিয়েছে। হোটেলের বাউন্ডারির দেওয়াল ছুঁয়ে এতক্ষণ যে জল ছিল, তা প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছে। খুব ইচ্ছা করলো খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় সারা সৈকত জুড়ে। হালকা টিপটিপে বৃষ্টি তখনও পড়ছে। জল সরে গিয়ে সৈকতে নামার সিঁড়িটা বেশ স্পষ্ট হয়েছে, কিন্তু সিঁড়ির ঠিক নিচ থেকেই বেশ দশফুট মত জায়গা হাঁটু সমান জলে ডুবে আছে। বড় বড় কয়েকটা পিচ্ছিল পাথরে পা রেখে ছেলে আর কত্তা পৌঁছে গেল ওপারে। আমি ক্যামেরা হাতে সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই দেখলাম; একটা গিরগিটির মত কিছু লাফিয়ে পালালো। পিছিয়ে এলাম দু’পা। আবার এগোতেই নজরে এলো ডান দিকের পাথরের খাঁজ থেকে উঁকি মেরে দেখছে একটা কাঁকড়া। দাঁড়া দুটো মাথায় তোলা। স্থির দৃষ্টি। রং টা সাদাও নয়, আবার লালও নয়। কেমন একটা নীলচে ছোপ। এই প্রথম দেখা কাঁকড়ার প্রজাতির সাথে। ক্যামেরা তাক করতেই সে দু’পা পিছিয়ে গেল পাথরের ফাঁকে। জলে আধডোবা পাথরে পা রাখতেই পিছলে গেল পা টা। হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল জলে। আবার উঠলাম পাথরে তারপর লাফিয়ে পড়লাম ভেজা বালিতে। ক’পা এগিয়ে পিছন ফিরতে দেখলাম, বালিতে আঁকা আমার পদচিহ্ন। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলে আর কত্তা তখন সমুদ্রের কাছাকাছি। আমি দূ্রদিগন্ত পানে তাকিয়ে আনমনে বেশ কয়েক পা এগিয়েছি, এমন সময় নজরে এলো বালির উপর অপূর্ব সব নক্সা, আর অসংখ্য ফুটো। অবাক হলাম, এত সুন্দর করে বালি খুঁড়ে নক্সা কে আঁকলো? ভালো করে নজর করতেই উদ্ঘাটন হলো সেই রহস্য। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা রঙের কাঁকড়া বালি ফুঁড়ে উপরে উঠে আসছে আর ওদের দাঁড়ার খোঁচায় বালির গায়ে ফুটে উঠছে নক্সা। বর্ষার মেঘ আকাশের গায়ে। অতি সুন্দর এক নীলাভ বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের চ্ছ্বটায় জলে ভেজা বালির গায়ে ফুটে উঠেছে জলছবি। সমুদ্রের দিকে পিছন ফিরে ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। তখনও পুরো অন্ধকার নামেনি। পড়ন্ত বিকালের আলো আর ল্যাম্পপোস্টের আলো মিলেমিশে আল্পনা এঁকেছে তটভূমির গায়ে। বিচিত্র সে আলোর নক্সা! বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশ। সাতটার পর থেকেই আবার একটু একটু করে এগিয়ে আসবে সমুদ্র। ছোলামাখা চিবোতে চিবোতে ফিরে এলাম রুমে। অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি দেখবো। গভীর রাতের নীরবতায় সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল খুব সকালে উঠে হাঁটতে বেরোবো তিনজনে। ঘুম ভেঙে দেখলাম কত্তা একাই বেরিয়ে পড়েছেন। অনেকদিন পর এরকম একটা অলস জীবন যাপন। মন বলছে কত কি তো করার ছিল,কিন্তু কিচ্ছু না করেই হু হু করে বয়ে যাচ্ছে সময়। একটু বেলায় সমুদ্রের সাথে খুনসুটি। বালি খুঁড়ে গর্ত করা, জলে শরীর হালকা করে ঢেউ এ ভেসে থাকা। ছেলের এই প্রথম সমুদ্র দেখা।ওর হেসে কুটোপাটি হওয়া দেখতে দেখতে মনে হলো...কেন এত সুন্দর জীবনটা শেষ হয়ে যায়? চারি দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অসংখ্য অজানা মানুষ। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। তাদের পাগলামী, খুনসুটি, নেশায় বুঁদ হয়ে ঢেউকে জাপটে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস সব মিলিয়ে সমুদ্র ভীষণ সুন্দর!
তাজপুরঃ
সন্ধে বেলায় সমুদ্রতটে মাছভাজা খেতে যাবো, কিন্তু তার আগে তাজপুরটা দেখতে হবে। ছবিতে দেখেছিলাম তাজপুর ভীষণ নির্জন আর ছবির মত সুন্দর। দুটো চল্লিশ বাজে তখন। বেরিয়ে পড়লাম গাড়িতে। পথের দু’ধারে জলাতে ভাগে ভাগে জল বেঁধে চলছে মাছ চাষ। চিংড়ির চাষ। বড্ড লোভ লাগে চিংড়ির নাম শুনলে। দুপুরে ইয়া বড় কাঁকড়া দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে ছিলাম। হোটেলের রাঁধুনির প্রশংসা না করে পারছিনা। যেন আগের দিন ইলিশ রেঁধেছিল,তেমন দুপুরের কাঁকড়া। তখনও ঢেকুর উঠছে মাঝে মাঝে। আঁকাবাঁকা অমসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছালো,কোনো এক সবুজের দেশ। দু’পাশে সরে সরে যাচ্ছে ঘনসবুজ, কেমন যেন ভেজা একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব মনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে নীরবতা। সবুজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম তাজপুর তটে। সমুদ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে বালির ঢিবি। মাঝে মাঝে সবুজ ঝাউগাছ। যেন জীবন্ত ছবি! বালির গায়ে দাপাদাপিতে কিন্তু বেশ মজা! হঠাৎ দূরে তাকাতেই নজরে এলো পুরো সমুদ্রতট জুড়ে লাল লাল কি যেন ছড়ানো রয়েছে। দূর থেকে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। কাছে যেতেই বিস্ময়ে থমকে গেলাম। অসংখ্য লাল কাঁকড়া। ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিকে ওদিকে। কেউ কাছে যেতেই ঢুকে পড়ছে গর্তে। শুধু দুটো সাদা চোখ উঁকি মারছে গর্ত থেকে। অসাধারণ এই দৃশ্য সৌন্দর্য! ঠিক এভাবে লিখে প্রকাশ করা যাবে না। ছবি তুলে রাখলাম ক্যামেরায়। এখানে সমুদ্র অনেক দূরে, মন্দারমণির মত নয়।খাঁড়ির মত মাঝে মাঝে জল জমে আছে। সারা তট জুড়ে কাঁকড়াদের নক্সা আঁকা দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম সমুদ্রের কিনারা বরাবর। ছোটো ছোটো পাখি দৌড়ে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। আমি ক্যামেরায় রানিং মোডে তোলার চেষ্টা করে চলেছি ওদের গতিটা ধরার। একটু দূরেই তটে দাঁড়িয়ে আছে একটা অচল নৌকা। তাকে ঘিরে কয়েকটি ছেলে মেয়ে আড্ডা জমিয়েছে। দূরে সমুদ্রের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত জেগে আছে সবুজ ঝাউবন। একটা মাছধরা নৌকা ভেসে চলেছে। বসে আছি একা শূন্য বেলাভূমির বুকে।একপ্রান্তে আমি অন্য প্রান্তে কত্তা। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম একপা একপা করে হেঁটে যাচ্ছে সাদা দু’তিনটে বক। তটরেখা ধরে ফিরছে ক্লান্ত মাঝি কাঁধে তার লাঠিতে বাঁধা গুটানো জাল। সন্ধে হতে একটু বাকি আছে। ফিরতে মন চায় না, তবু ফিরতেই হয়।
সন্ধের ঠিক মুখে ফিরে এলাম মন্দারমণি। এখন আর রুমে ফেরার প্রশ্ন নেই। অন্ধকারে ভেজা বালির বুকের উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় এক কিমি পথের শেষে দেখা মিললো মাছ ভাজার দোকানের। পমফ্রেট আর চিংড়ি পছন্দ করার আধঘন্টার মধ্যেই ভাজা হয়ে এলো আমাদের টেবিলে। ছেলে মাছ খায় না। আমার আবার চিংড়ি খুব প্রিয়! মচর মচর আওয়াজটা সমুদ্রের গর্জনের সাথে মিশে যাচ্ছে যেন। ভাবছি কিভাবে যেন কেটে গেল দুটো দিন। রাত পোহালেই ফিরতে হবে বাড়ি। কিন্তু সেই ইচ্ছাটার কি হবে? সেটা কি সত্যিই কোনো দিন পূর্ণ হবে? আমার যে বড্ড ইচ্ছা রাতের তারা ভরা আকাশের নিচে, সমুদ্রতটে শুয়ে তারা গুনবো! পাশে সমুদ্র ফিসফিস করে কথা বলবে আমার সাথে।খুব গল্প হবে। কিন্তু, রাতের বেলাভূমি কি সত্যিই নিরাপদ! সেখানে যে অসংখ্য কাঁকড়া দাঁড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বপ্নটা তুলে রাখলাম মনের গহনে। হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে আমার এ স্বপ্ন একদিন বেলাভূমি ছোঁবে!
রাত শেষ হয়ে আরেকটা দিনের শুরু। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে। সামনে দাঁড়ানো ঝাউগাছের সারির উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র।একটা ভাঙা ডালে বসে আছে কালো একটা ফিঙে পাখি। পাখিটি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে জানি না, তবে আমি মনে মনে বললাম, বিদায় সমুদ্র। আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে হয়তো এই তটে বা অন্য কোনো তটে!
সুচিন্তিত মতামত দিন