ড. পূজা মৈত্র

চক্রসম্ভব
এক ।

অফিসের কেবিনে চুপচাপ বসে ছিল অনিরুদ্ধ। সন্ধ্যা ছ’টা বাজে। প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছে। ও আছে বলেই কয়েকজন যেতে পারছে না। এবার উঠতে হবে। ওর না হয় বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। কিন্তু অন্যদের আছে। সবারই বাবা,মা,স্ত্রী,সন্তান,পরিবার থাকে। মধ্য ত্রিশে থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ অনিরুদ্ধর নেই। মা,বাবা ওর বছর চব্বিশেই গত। তাদের ফেলে যাওয়া ব্যবসার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করতে করতে অনিরুদ্ধ এখন পঁয়ত্রিশ। সাম্রাজ্য বেড়েছে বহুগুণ। বিলেত ফেরৎ এমবিএ অনিরুদ্ধ। ডিগ্রি বৃথা যায়নি। অনিরুদ্ধর চব্বিশ বছর বয়সেই একটা অ্যাকসিডেন্টে ওর বাবা-মা চলে যাওয়ার পর কাকা অনিরুদ্ধকে ছোট ভেবে ব্যবসা গ্রাস করতে চেয়েও পারেনি। কাকাদের বাড়ি অনিরুদ্ধর বাড়ির লাগোয়া। অবশ্য দুটোই ঠিক বাড়ি নয়। প্রাসাদ। ম্যানসন। মুখার্জী অ্যান্ড সন্সের তিন পুরুষের জুয়েলারি ব্যবসা। ঠাকুরদা কলকাতায় রসায়ন নিয়ে পড়ে আর গ্রামের জমিদারিতে আটকে থাকতে চাননি। এক অপুত্রক বনেদী স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নেকনজরে পড়ে ব্যবসার হাতেখড়ি। তিনি তার মেয়ের সাথে বিয়েও দিতে চেয়েছিলেন শিক্ষিত,সুদর্শন,ব্রাহ্মণ ঠাকুরদার সাথে। গ্রামের রীতি অনুযায়ী ঠাকুরদা ষোলো বছরেই বিবাহিত ছিলেন বলে ব্যাপারটা হয়নি। কিন্তু স্বর্ণবণিক ভদ্রলোকের স্নেহ আর গাইডেন্সে ব্যবসা খুলে ফেলেন। অবশ্য ঠাকুরদা পরে ঋণ চুকিয়েছিলেন। ঐ ভদ্রলোকের মেয়ের একমাত্র মেয়ের সাথে নিজের বড়ছেলে অমিতের বিয়ে দিয়েছিলেন। অমিত অর্থাৎ অনিরুদ্ধর বাবা। আর স্বর্ণ সাম্রাজ্যের সম্রাটের নাতনি অনিরুদ্ধর মা। আদরে,বৈভবে মানুষ অনিরুদ্ধর মা। সংসারে অমনোযোগী। খামখেয়ালি,জেদিই ছিলেন। মায়ের খেয়াল আর কাকার ইচ্ছাতেই বাবা আর কাকার আমলেই ব্যবসাটা ভাগ হয়েছে। কাকা শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি আর এই ভাগ মিলিয়ে বেশকয়েকটা নতুন শোরুম করেছে। তাও বছর পনেরো হলো। কিন্তু জমাতে পারেনি। এখনো মূল দোকানের আর শাখাদেরই রমরমা। গড়িয়াহাটের মোড়েই অত বড় মূল শোরুমটা দেখলে অন্যত্র যাবে কি করে। নামের আগে ছোট করে একটা আদি বসিয়ে নিয়েছে অনিরুদ্ধ। ব্যাস। তাছাড়া তিন পুরুষের গুডউইল। ঠাকুরদা,বাবার সুনাম,ভদ্রতা এটাও ভাবনার বিষয়। তার ফলটা অনিরুদ্ধই পাচ্ছে। এই নিয়ে কাকার দুই ছেলে অতীন আর অনুপমের বিশেষ করে ব্যবসায়ী অতীনের যে ক্ষোভ নেই তা নয়। কাকারও আছে। সুঁচ হয়ে তাই অনিরুদ্ধকে সাপোর্ট করবে বলে এই ব্যবসায় ঢুকতে চেয়েছিলেন। সদ্য যৌবনে পড়া অনির কাছে বুদ্ধিতে হেরে চলে যেতে হবে ভাবেনি। এই নিয়ে কাকা চারিদিকে নানা কুৎসাও করে বেড়িয়েছে। তাতে অনিরুদ্ধর কিছু এসে যায়নি। সফল ব্যবসায়ীকে অন্যরা হিংসা করেই থাকে।

তবে একটা বিষয়ে অনেক পিছিয়ে গেছে অনিরুদ্ধ। হেরেই গেছে বলা যায়। খাদে পড়ে গেছে। আর ওঠার উপায় নেই। উঠতে চাইলে যে যে রাস্তা ধরতে হবে-তার একটাও অনিরুদ্ধর শিক্ষা,অনিরুদ্ধর বোধ,অনিরুদ্ধর রুচি অ্যালাউ করে না। বিগত ছ’মাসে এ নিয়ে নিজের সাথে নিজে অনেক কথা বলেছে অনিরুদ্ধ। অনেকের উপদেশ কানে এসেছে। অথচ নিজের সিদ্ধান্তে স্থির আছে। এখনও। আর থাকবেও। উৎসব চলে গেছে। দেড় বছর হল। উৎসব অনিরুদ্ধর একমাত্র সন্তান। তিনদিনের জ্বরে ভুগে-হঠাৎ। সাড়ে চার বছর বয়স ছিল তখন। মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর ছিলো ওটা-এখন বোঝে অনিরুদ্ধ। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছিল ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া। থ্রম্বোসাইট মানে প্লেটলেট। ওটা কমে যাওয়াতেই যত বিপ্ততি। চারিদিক থেকে ব্লিডিং শুরু হল। হঠাৎ। সমস্ত জায়গা থেকে। নাক,মুখ,স্টুল,ইউরিন। বেস্ট ডক্টর,বেস্ট নার্সিংহোম,বেস্ট ফ্যাসিলিটিও আটকাতে পারলো না। তিনদিনের লড়াই এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আচমকাই শেষ হয়ে গিয়েছিল। নীরা অনিরুদ্ধর স্ত্রী। তিনদিন জলটুকুও না খেয়ে ছেলের শিয়রে বসেছিলো। নীরা এই আচমকা শেষ হয়ে যাওয়াটা বোঝেনা। আজও বোঝে না বাবিন চলে গেছে,যেখানে গেছে-আর ফিরবে না। বাবিন,উৎসবের ডাকনাম। অনিরুদ্ধ অনেক বুঝিয়েছে। শুধু অনিরুদ্ধই কেন। নীরার মা,বাবা সমস্ত আত্মীয়রা। কিন্তু নীরা তার বিশ্বাস থেকে একচুলও বেরোতে রাজি নয়। তার স্থির বিশ্বাস-বাবিন কোথাও ঘুরতে গেছে। গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। একদিন না একদিন ঠিক ফিরবে। সারাদিন বাবিনের ছবি নিয়ে বসে থাকা,ছবির সাথে কথা বলব,তাকে খাওয়ানো-এই নিয়ে দিন চলে যায় নীরার। একটা ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। বিছিন্ন দ্বীপের মত। অনিরুদ্ধ আর মণিপিসি ছাড়া সেখানে সবার প্রবেশ নিষেধ। মণিপিসি বাড়ির পুরনো কাজের লোক। সারা বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই-দুইজন রাঁধুনি,ড্রাইভার দু’জন,চারজন সিকিউরিটি গার্ড,মালি দু’জন,কেয়ারটেকার দু’জন,ধোপা,সর্বক্ষণের কাজের নিধুকাকা-বাড়িতে গিজগিজ করছে সবাই। তাদের আলাদা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার আছে। মূল ফটক লাগোয়া। মণিপিসি নিধু কাকা,রাধুনিরা মূল বাড়ির একতলার সিঙ্গেলরুমগুলোতে থাকে। তাও বাড়িটা ফাঁকা। বড্ড ফাঁকা লাগে অনিরুদ্ধর। ফিরতে ইচ্ছা করে না। ফিরবেই বা করে কাছে। নীরা তো নিজের জগৎ-এ ব্যস্ত। অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলার বা ফিরে তাকাবার ফুরসৎ তার নেই। অনিরুদ্ধও এখন হতোদ্যম হয়ে পড়েছে বলা চলে। নীরার মাতৃমূর্তি’কে বিব্রত ও কখনোই করেনি। বাবিন চলে যাবার পর থেকেই ওদের স্বাভাবিক দাম্পত্য ছিন্ন হয়েছে। জোর করে নীরাকে পাওয়ার চেষ্টা বা রুচি অনিরুদ্ধর ছিলো না কখনোই। এখনো নেই। তবে এখন ওর ঘরে যাওয়াটাও কমতে কমতে দিনে একবারে এসে ঠেকেছে। ঐ শোকের আবহে যেতে ভালো লাগে না অনিরুদ্ধর। উৎসব ওরও সন্তান ছিলো। সে চলে যাওয়ায় অনিরুদ্ধর জীবনও ভীষণভাবেই ফাঁকা। তাই ঐ ঘর,ছেলের ছবি,নীরার ছেলেকে নিয়ে গল্প-এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে ও। ওখানে গেলেই মনটা হু হু করে। নিজের এত সাফল্যের মধ্যেও সবচেয়ে বড় অসম্পূর্ণতা আয়না হয়ে ভেসে ওঠে।

অতীন ফোন করেছিলো। অনুপমের ছেলে হয়েছে। এটা দ্বিতীয়। আগেরটা উৎসবের থেকে তিন বছরের ছোট। অবিন নাম তার অতীনের দুই সন্তান। বড়টা ছেলে। অতীনের বড় জন উৎসবের থেকে বছর খানেকের ছোট ছিলো। আর ছোটটা মেয়ে। বছর তিনেক বয়স ভারী মিষ্টি। অনিরুদ্ধ ছোটটাকে পরী বলে ডাকে। ঐ বাড়িতে একমাত্র ঐ পুচকিটাই জেঠুমণির ন্যাওটা। দুটোবাড়ির দুর্গাপুজোটা এখনো একসাথেই হয়। মূলত কাকিমণির উদ্যোগেই। কাকিমণি কখনোই এই আলাদা হওয়াটা চাননি। দুর্গাপুজোটা ধরে রেখেছেন তাই। কাকিমণিও স্বর্ণব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে। কত ফারাক! ওখানে চারটে দিন অনিরুদ্ধর কোলেই ছিলো পরী। অনিরুদ্ধর মনে হয়েছিল ঐ চারটে দিন যেন না কাটে। উৎসব হবার সময়েও মেয়েই চেয়েছিল অনিরুদ্ধ। পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। সারাদিন জেঠুমণি,জেঠুমণি করে ভরিয়ে রেখেছিলো। অনিরুদ্ধ ওর চুল বেঁধে দিয়েছে। হেয়ারব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছে। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে...নীরা কখনো মেয়ে চায়নি। বরাবরই ছেলের শখ ছিলো ওর। উৎসব হতেই নীরার আনন্দ যেন বাঁধ মানেনি। একটু বেশিই মা হয়েছিল নীরা। এখন মনে হয় অনিরুদ্ধর।

-নীরা যদি আবার কোর্টে যাতায়াত শুরু করে...

নীরার বাবা হাইকোর্টের উকিল। বড় মাপের। নীরাও ওকালতি পাশ। বিয়ের আগে প্র্যাকটিস-ও করতো। এমনকি কনসিভ করার আগে অবধি কোর্টে যেত। কনসিভ করার পর নিজে থেকেই ছেড়ে দিলো। অনিরুদ্ধ একবারো ছাড়তে বলেনি। বরং উৎসব বছর দুয়েকের হবার পর থেকে বারবার উৎসাহ দিয়েছে আবার প্র্যাকটিস শুরু করতে। নীরা চায়নি। আসলে উৎসবের বড় হবার একটা মুহূর্তও মনে হয় ও মিস্‌ করতে চায়নি। উৎসব ভীষণ চঞ্চল ছিলো। দুষ্টুই বলা যায়। একদণ্ডও স্থির থাকতে পারতো না। নীরা ছাড়া কারোর পক্ষে ওকে সামলে রাখাই মুশকিল ছিলো। অনিরুদ্ধও পারত না। বকাঝকা করে ফেলতো। দুই একবার মেরেওছে। কিন্তু নীরা কখনোই উৎসবকে বকেনি। মারাতো দূরের কথা। অনিরুদ্ধ শাসন করলে অনিরুদ্ধর সাথে কথা বন্ধ করে দিত নীরা। শেষে অনিরুদ্ধই বাধ্য হত সরি বলতে। সবারই ঠারেঠোরে একটাই বক্তব্য ছিলো উৎসব বখে যাবে-এবং নীরার প্রশ্রয়েই। অনিরুদ্ধও যে সেটা বুঝতো না,তা নয়। কিন্তু চাইতো আরো একটু বড় হোক উৎসব। তারপর নিজে হাল ধরবে। বাপিকে উৎসব সমঝে চলতো। বাপির সামনে বেলাগাম দুষ্টুমি করা যায় না,এই বোধটা ছিলো ওর।

সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর চক্রবর্তী প্রায় বিগত দেড় বছর ধরে নীরাকে দেখেছেন। অনিরুদ্ধদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান রুদ্রদেব ব্যানার্জী। ডক্টর ব্যানার্জীকে ছোট থেকে দেখেছে অনিরুদ্ধ। ডাক্তার কাকা বলে অভ্যস্ত। ডাক্তারকাকার পরামর্শই ডক্টর চক্রবর্ত্তীর কাছে আসা। উনি যেভাবে বলেছেন এই দেড় বছর অনিরুদ্ধ চলেছে। নীরারযত্ন,ওষুধপত্র-কোনটাতেই খামতি হয়নি। অথচ কোন লক্ষ্যণীয় উন্নতি নেই। মরবিড গ্রিফটা স্থায়ী ডিপ্রেশনে পর্যবসিত হয়েছে বলে ডাক্তারের অভিমত। তার সাথে নীরা এখন হ্যালুশিনেটও করছে। একলা দুপুরে বাবিনের ছবির সাথে কথা বলে নীরা। মণিপিসি দেখে অনিরুদ্ধকে বলেছিলেন। অনিরুদ্ধও খেয়াল করেছে। রবিবারে-হ্যাঁ,ঠিকই। অনিরুদ্ধ বোঝাতে চেয়েছে বাবিন নেই...নীরা আগে শুনত। এখন এই নেই টাকে নিতে পারে না আর। রেগে যায়। অনিরুদ্ধকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে। অনিরুদ্ধ ঘরে এলে যেন ওর শান্তি ভঙ্গ হয়। এমতাবস্থায় অনিরুদ্ধ গতকাল নীরার বাবা-মা’কে নিয়ে এসেছিলো ডক্টর চক্রবর্ত্তীর চেম্বারে। নীরার বাবার প্রস্তাবটা শুনে ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,

-উকিলবাবু,আপনার মেয়ে ডিটোরিয়েট করছে। এমতাবস্থায় কোর্ট...!

-ওষুধে কী তাহলে কোন কাজই দিচ্ছে না?

নীরার বাবা নিমেষ অধৈর্য হলেন।

-ওষুধের একটা লিমিটেশন আছে। সাহেব।

ডঃচক্রবর্ত্তী হাসলেন,

-নীরার প্রয়োজন সন্তান। ওষুধ কী করবে?

নীরার মা অনিরুদ্ধর দিকে তাকালেন। জামাই-এর সামনে বলতে সংকোচ হলেও সুনয়না বলেই ফেললেন,

-বাচ্চা এলেই,মানে কনসিভ করলেই তো ভালো হয় তাহলে।

-এই শরীরে তা-ও কী সম্ভব?

ডাক্তারকাকাও ছিলেন।

-নীরা নিজে ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না-সারাদিন বাবিন বাবিন ওর হিমোগ্লোবিন এখন সাড়ে আট। চেহারা ভাঙছে। সব কী আর ওষুধ আর সাপ্লিমেন্ট ঢাকা যায়?

-এক্সাক্টলি। তাছাড়া সাইকিয়াট্রিক মেডিসিনের সাইড এফেক্টও আছে। কনসিভ করলে বেবি কতটা সুস্থ হবে তা নিয়েও সংশয় আছে।

অনিরুদ্ধ চুপ করে ছিলো।

মা,বাবা বলে ও শ্বশুর শাশুড়িকে। তাদের সামনে কীভাবে বলবে যে কনসিভ করাটা সম্ভব নয় কারণ নীরা আর অনিরুদ্ধ গত দেড় বছর একঘরে শোয়নি। ডাক্তারকাকা জানেন। উনিই বললেন,

-তাছাড়া অনি হয়তো বলতে পারছে না-নীরা আর অনির দাম্পত্য বলেও গত দেড় বছর কিছুই নেই আদতে।

নিমেষ অবাক হলেন

-সেকি! না-না! এটা ঠিক নয়। অনিরুদ্ধ তো ভিক্টিমাইস হচ্ছে এতে। ওদের কনজুগাল লাইফ...

-বাবা,থাক সেসব।

-থাকবে কেন? এটাও পার্ট অফ লাইফ। নীরাকে নিয়ে কী তুমি অখুশি,অনি? তাহলে বলো আমরা নিয়ে যাবো। কী-বা বয়স তোমার। তুমি চাইলে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করো আবার।

অনিরুদ্ধর বুকে তীরের মত লাগে কথাটা। নীরা আর অনিরুদ্ধর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। সাড়ে সাত বছরের দাম্পত্য। নীরা ওর বিবাহিত স্ত্রী। ওর দায়িত্ব। অথচ কত সহজেই সবাই ভাবে অনি নীরাকে চাইলেই ছেড়ে দিতে পারে। এই পরামর্শ বন্ধুদের থেকেও পেয়েছে। কাকার থেকে তো বটেই। অথচ ছেড়ে দেওয়াটা অসম্ভব। নীরাকে ভালোবাসে অনিরুদ্ধ। ওর ব্যবহারে হয়তো বিরক্ত হয়। এড়িয়ে যায়-তবে ওকে ছেড়ে আর একটা বিয়ে...সম্ভব নয়।

-বাবা আপনার মেয়ে তো আমার বিবাহিতা স্ত্রী। তার হাত যখন বিশ্বাস করে আমাকে সঁপেচেন,তখন একটু ভরসা রাখুন। আমরা এখানে আমার কনজুগাল লাইফ নয় নীরাকে নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি। তাই না?

অনিরুদ্ধর কথায় নিমেষ চুপ করলেন। সুনয়না বললেন,

-উপায় কী তবে?

-কনসিভ করার আরো একটা নেগেটিভ দিক আছে মা। নীরা মেয়ে চায় না। কনসিভ করে মেয়ে হলে...

-সে কি! ও নিজেও তো মেয়ে। আমাদের একমাত্র মেয়ে। এমন শিক্ষা পেলো কোত্থেকে!

সুনয়না অবাক হল।

-অনি তুমি নীরার কাছে যাওয়াটা কবে থেকে কমিয়েছো?

অনিরুদ্ধ তাকালো

-নীরা বলছে ডাক্তার কাকা?

-বলছিলো কাল। তুমি নাকি দিনে একবার আসো।

বাবিনের খোঁজ ভালো করে নাও না। ওর সারাদিনের গল্প শোনো না।

অনিরুদ্ধ হাসে,

-সেই তো এক গল্প। অফিস থেকে ফিরে...

-তবুও যেতে হবে মিস্টার মুখার্জ্জী। হাল ছাড়লে হবে না। আপনি যাচ্ছেন না এটা কিন্তু নীরা নোটিশ করেছে। গেলে খুশি হবে।

-যাবো।

-আর এবার থেকে ওর হ্যাঁ এ হ্যাঁ মেলান ক’দিন। এই যে আপনি বোঝান বাবিন কোথাও নেই-আর আসবে না। এটা নীরা মেনে নেয় না। ভাবে আপনি ওকে বাবিনের থেকে দূরে রাখতে চান।

-তবে মিথ্যা কথা বলতে বলছেন?

-মিথ্যা নয়। মন ভোলানো। কাস্টমারদেরও তো ভোলান নাকি?

অনিরুদ্ধ হাসল

-বেশ। যা চান তাই হবে। কিন্তু এটা করলেই নীরা আমাকে বলবে বাবিনকে এনে দিতে। বাবিনকে কোথা থেকে পাবো বলুন তো?

ডক্টর চক্রবর্তী বললেন,

-ভাবছি সেটা নিয়েও।

-ছোট বাচ্চাকে তো ও বাবিন মানবে না...ডাক্তারকাকা।

-দেখছি ডক্টর ব্যানার্জ্জী। আগে অনি আর নীরার মধ্যে দূরত্বটা কমুক।

গতকালের পর থেকে আজ অবধি দূরত্ব কমাতে মন যায়নি অনিরুদ্ধর কিন্তু আজ অফিস থেকে ফিরে যাবে ও। নীরার কাছে। গড়িয়াহাটে দোকানের তিনতলায় ওর অফিস। ওর সেক্রেটারী,ডিজাইনার,অ্যাকাউন্ট্যান্ট,ডাটা এন্ট্রি,ক্লার্ক-সবাই তিনতলাতেই বসে। এখন দু-তিনজন বাদে সবাই চলে গেছে। ওদের ডিউটি অফিস আওয়ার্সে। দোকান খোলা সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা আটটা। অনুপমের খবরটা শুনে উপরে খুশি দেখালেও মনে মনে একটা খারাপ লাগা জমেছে অনিরুদ্ধর। অনুপম বছর চারেকের ছোট ওর থেকে। ওরও দুটো সন্তান হয়ে গেল। এদিকে অনিরুদ্ধর শূন্য। এত বড় দোকান,এত বড় বিজনেস-এত টার্নওভার থেকেও...নেই কিছুই। নীরা যদি কখনোই না সারে তবে? ভেবেই কেঁপে ওঠে অনিরুদ্ধ। এসবই অতীন,অনুপমের ছেলেদের হবে। না,না। তেমন হলে পরীকেইও সব দিয়ে যাবে। পরীটাই যা ওকে একটু ভালোবাসে। নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলো অনিরুদ্ধ। নীরা তো সবে বত্রিশ। ও সেরে উঠবেই। উঠতেই হবে। অনিরুদ্ধর ফোকাস সেটাই হওয়া উচিৎ। তা না ভেবে ও এসব অবান্তর! ছি ছি! হোয়াটঅ্যাপটাকে চেক করলো একবার অনিরুদ্ধ। কলেজের গ্রুপে থেকে। বার বি কিউ এ ডাকছে সবাই। গেটটুদেগারের জন্য। ওহ আজ শনিবার। সাপ্তাহিক হ্যাং আউটের ডেট। অনি আগে যেত। এখন যায়না। সবাই তাই ওকেই বেশি করে ডাকে। অনি এড়িয়ে যায়। আজ তো আরোই যাওয়া চলবে না। নীরার কাছে ফিরতে হবে ওকে। ফিরতেই হবে।

দুই।

দোকান থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ একটা চেনামুখ দেখলো অনিরুদ্ধ। ফেসবুকে দেখেছে মেয়েটাকে ওর ফ্রেন্ডলিস্টে চলে এসেছিলো কীভাবে কে জানে! অনি ভাবতে চেষ্টা করলো। বছর তেইশেকের মেয়ে দেখেই বোঝা যায় ভীষণ চঞ্চল আর চটপটে। এখানে কী জন্য? গয়না কিনতে? শাঁওলি নামটা মনে পড়লো অনিরুদ্ধর। ওর স্কুলের বন্ধু প্রতীকের খুড়তুতো বোন মনে হয়। অত খেয়াল করেনি অনিরুদ্ধ। কলেজে পড়তো জানে। এখন মনে হয় কলেজ শেষ। বিয়ে নাকি? কৌতূহলী হলো অনিরুদ্ধ। প্রতীক বলেনি তো? অনিরুদ্ধ ফেসবুক প্রোফাইলে ব্যবসার নামধাম উল্লেখ করে না। খুব লিমিটেড বন্ধু রাখে। শাঁওলি ওকে তাই দাদার বন্ধু হিসাবেই চেনে। মেসেঞ্জারে টুকটাক ফ্লার্ট মতো করতো বছর দুই তিন আগে। কিন্তু অনিরুদ্ধর পাত্তা না পেয়ে চুপ করে গেছে। ছিপছিপে চেহারা মেয়েটার। রোগাটে গড়ন। কোঁকড়ানো স্টেপ কাট চুল। গায়ের রং চাপা। দূর থেকে দেখেই অনিরুদ্ধ বুঝলো কোন জিনিস ভারী পছন্দ হয়েছে-অথচ বাজেট কম। কৌতূহলী হল। ইশারায় স্টাফকে বললো চুপ থাকতে। সবাই স্যারকে দেখে তটস্থ ছিলো।

-আটে এটা আসবে না,না?

-নো ম্যাম। এটা বারো হাজার তিনশো সাতান্ন।

আড় চোখে অনিরুদ্ধ দেখলো শাঁওলি সোনার কানের দুল দেখছে।

-ওহ। আটে কিছু...

বলেই তাকালো শাঁওলি। অবাক হল,

-আরে অনিদা-তুমি?

-তুই প্রতীকের বোন না?

-হ্যাঁ তো। ভুলেই গেছো। কত যেতে আমাদের বাড়ি।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

-মনে থাকবে কী করে-তুই তখন কত ছোট ছিলি।

-এমা! আমি তো তোমার ফেসবুকেও আছি গো।

-তাই?

-এ বাবা! কবে থেকে। তুমি খেয়ালই করেনি।

অনিরুদ্ধ বললো,

-তা হবে। কানের দুল কিনবি?

-হ্যাঁ গো। চাকরি পেয়ে ফার্স্ট মাসের স্যালারি দিয়ে মায়ের জন্য।

অনিরুদ্ধর নিজেকে ভীষণ হতভাগ্য মনে হলো। ও তো মা’কে কিছু দিতেই পারেনি। মেয়েটাকে নিরাশ করবে না স্থির করলো।

-কিন্তু যা দেখি বাজেটেই আসছে না।

-তাই? কত বাজেট?

-আট গো।

-মাইনে বারো পাই। যাতায়াতের জন্য চার রাখতে হবে।

-কোথায় পেলি?

-একটা মিশনারী স্কুলে।

বাহ। মাস্টার্স করেছিস?

-হ্যাঁ। বি এড-ও করেছি। ডিস্ট্যান্সে।

-আপনি একটু দেখুন না-আটে ভালো কিছু নিশ্চয় আসবে। স্টাফকে চোখের ইশারা করে বললো অনিরুদ্ধ। সে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে গেলো। ট্যাগ চেঞ্জ করে আনবে।

-তুমিও গয়না কিনতে?

-হুঁ? হ্যাঁ রে...

-বৌদির জন্য,না?

অনিরুদ্ধ থমকালো। শেষ কবে নীরাকে গয়না নিয়ে গিয়ে উপহার দিয়েছিলো ও!

মনেই পড়ে না।

-হ্যাঁ।

-কী নেবে?

-বৌদি আসেনি?

-বৌদির শরীরটা ভালো নেই।

-এমা! কী হলো? জানো তো তোমাকে একটু আধটু অন্যরকমের টেকস্ট করে ফেলেছিলাম।

-অন্যরকমের বলতে?

-ফ্লার্টিং।

-ওহ।

-সরি। তখন তো জানতাম না বৌদি আছে। দাদার বন্ধু আর হ্যান্ডসাম দেখেই...

-বৌদি আছে কে বললো?

-কেন? আমার দাদা! তোমার তো ছেলেও আছে একটা,তাই না?

অনিরুদ্ধর চোখ পাশের কাউন্টারের স্টাফের দিকে পড়লো। সে অবাক হয়ে শুনেছিলো। চোখ নামিয়ে নিলো।

-আছে না,ছিলো।

-মানে?

-ম্যাম-এগুলো দেখুন...

শাঁওলির মন ওদিকে ঘুরলো।

পছন্দও হলো একটা।

-এটা ভালো অনি দা?

-পছন্দ তোর?

-হ্যাঁ। মা’কে মানাবে?

অনিন্দ হাসলো।

-বেশ মানাবে।

-নিই তবে?

-নে।

-ক্যাশ না কার্ড ম্যাম?

-ক্যাশ-না না কার্ড কার্ড...একাউন্টে পে ঢুকেছে তো।

অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো।

শাঁওলি বিল করতে গেলে অনিরুদ্ধ ম্যানেজার কাকাকে বললো

-নীরার জন্য একটা ডায়মন্ড নেকলেস দেখে দিন না কাকা।

-এখনই নিয়ে যাবে,অনি?

-হ্যাঁ।

-দাঁড়াও,দেখে দিই।

-আপনার যেটা সবচেয়ে ভালো মনে হবে দিন কাকা।

-সেতো বটেই অনি। বৌমা তো দোকানে এসে কোনদিন কিছু নেন নি। আগে বড়গিন্নী রোজই কিছু না কিছু নিতেন। ছোট গিন্নী অবশ্য তেমন আসতেন না।

-কাকিমণির অত গয়নার শখ নেই কাকা। মায়ের ছিলো। নীরারও নেই।

-তোমার বাবাও খুব পরাতে ভালোবাসতেন তোমার মা’কে। তুমি এই প্রথম নিচ্ছো।

অনিরুদ্ধ থমকালো। বাবা মা’কে খুব ভালোবাসতেন। অনিরুদ্ধও কী নীরাকে কম ভালোবাসে? অথচ প্রকাশের কতটা ভিন্নতা। নীরা তাই মনে হয় ভাবে অনি ওকে ভালোইবাসে না। ভালবাসলে বলাটা,বোঝানোটাও জরুরী। বেশ বুঝতে পারছে অনিরুদ্ধ।

-অনিদা-চলো।

-কোথায় রে?

-চলো বাইরেটায় ভালো ফুচকা বসে।

-আমাকে খাওয়াবি?

-এমা! চাকরি পেলাম। তুমি দাদার বন্ধু। খাওয়াবে না?

অনিরুদ্ধ দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো,শাঁওলি পিছু টেনে ধরলো।

-আর তোমার জন্যই তো ওরা রেঞ্জের জিনিস দেখালো। নাহলে তো বারোর নীচে দেখাচ্ছিলই না। পচা দোকান।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

তুই যা,আমি ফুচকা খাই না। খুব একটা

শাঁওলি অনিরুদ্ধর হাত ধরল,

-খাবে না মানে? চলো-খেতেই হবে। হলে তুমি বড়লোক আর আমি গরিব-তা বলে খাবে না!

অনিরুদ্ধর ড্রাইভার অবাক হচ্ছে গিয়েছিলো। সামনের ফুচকাওয়ালা অনিরুদ্ধকে চেনে। মুখটিকে হাসছিলো।

-আচ্ছা। খাবো খাওয়া।

শাঁওলিকে কষ্ট দিলো না অনিরুদ্ধ। ওর মন রাখতে পেট ভরে ফুচকা খোলা। বহুদিন পর। কলেজের পরে এই প্রথম বোধহয়।

-কত হলো?

-শো রুপিয়া।

-দেখলে-দিব্যি পঞ্চাশটাকার খেয়ে নিলে-এদিকে নাকি খাও না।

টাকা দিয়ে বলল শাঁওলি।

অনিরুদ্ধ রুমালে মুখ মুছলো।

-কোথায় যাবি?

-বাড়ি।

-চল ড্রপ করে দিই।

-তোমার কষ্ট হবে তো...

-না পথেই পড়বে।

-চলো তবে। বৌদির নেকলেসটাও দেখে নেবো যেতে যেতে।

-বেশ।

-একদিন বৌদিকে দেখাও। খুব সুন্দর না? তোমার ফেসবুকে ছবি নেই?

অনিরুদ্ধ গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে যেতে বললো শাঁওলিকে। নিজেও ভেতরে গেলো।

-ছবি দাও না কেন?

-বৌদি পছন্দ করে না ছবিটবি দেওয়া,তাই।

-ইস! তুমি বৌকে লুকিয়ে রাখতে চাও,বুঝি। দেখাও না।

অনিরুদ্ধ মোবাইলের ওয়াল পেপারটা দেখালো। নীরার ছবি। স্ক্রিনসেভারে ছেলের ছবিও আছে।

-সুন্দর?

-খুব।

-কই-আমার তো তেমন মনে হয় না।

-হয়,হয়। না হলে অন্যকারোর মেসেঞ্জারে রিপ্লাই দাও না?

অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো

-পাকা বুড়ি হয়ে গেছিস তো।

-হব না? এখন স্কুল মিস্ট্রেস। আর তুমি সেই গোমড়ামুখোটাই রয়ে গেছো।

-আমি গোমড়ামুখো? কে বললো?

ছোট থেকেই দেখেছি। সবাই লাফাতো ঝাঁপাত হই হই করতো। তুমি চুপচাপ।

-মনে পড়ে তোর? কতটুকু ছিলি।

-ক্রাশ হবার বয়স হয়ে গিয়েছিলো।

অনিরুদ্ধ অবাক হলো।

-ক্রাশ?

-কাউকে বলিনি অনিদা। তোমাকেই বলছি। তুমি আমার ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ক্রাশ। বুঝলে? অনিরুদ্ধ বুঝলো শৈশবের প্রীতি। সহজে ভোলার নয়।

-বয়ফ্রন্ডের নাম কী?

-ধুর,সেসব নেই।

-সেকি!

-আগে ভালো কোন জব পাই-তারপর ভাববো।

-এই তো পেয়েছিস।

-এতে কাজ চলে?

-কততে চলে?

-পঞ্চাশ কম করে।

-বেশ।

-কী বেশ? এমন ভাব করলে তুমি পঞ্চাশ হাজারের জব দিয়ে দেবে আমাকে।

অনিরুদ্ধ হাসলো

-দিতেও পারি।

-কী করে? তুমি থোড়ি শিল্পপতি।

-নই,তা জানলি কী করে?

-হলে দাদা বলতো। আর অত বড়লোক থোড়ি আমাদের বাড়ি আসে?

অনিরুদ্ধ শাঁওলির মাথায় আদরের হাত রাখলো,

-তোর যদি মনে না হয় তাহলে নই।

-ইস্‌!

-কী হলো?

-লোকের ক্রাশ প্রথম টাচ করছে তাও দাদার মতো করে... কী দুর্ভাগ্য!

-দাদার মত কান মুলে দেবো ভালো হবে?

-দারুন হবে। এই অনিদা-তুমি আমার স্কুল দেখতে আসবে একদিন?

-গেলে কী বলে পরিচয় দিবি-আমার ক্রাশ এসেছে?

শাঁওলি হাসলো

-না,না। এমনিই মনে হলো তোমাকে যেতে বলি।

-আচ্ছা যাবো একদিন।

-তোমার নম্বরটা দাও।

অনিরুদ্ধ একটুও ইতস্তত না করে নম্বরটা দিলো।

-এটাই হোয়াটঅ্যাপ?

-হ্যাঁ।

-এবার বলো তোমার ছেলের কথা কত বড় হলো।

অনিরুদ্ধ থমকালো।

আবার উৎসবের প্রসঙ্গ। আড়চোখে দেখলো ড্রাইভারেরও কান খাড়া। তাও বলতে হবে। থেমে থেমে বললো,

-আমার ছেলে দেড় বছর আগে তিনদিনের জ্বরে ভুগে মারা গেছে।

শাঁওলি ভীষণ অবাক হলো

-সে কি!

-হ্যাঁ রে।

-এমা! তিনদিনের জ্বরে...কী জ্বর?

-মনে হয় ডেঙ্গু।

-এ বাবা! সরি অনিদা। আমি জানতাম না।

-বুঝেছি।

-বৌদির খুব কষ্ট। তাই না? মা তো।

-কেন মায়েদেরই কী শুধু কষ্ট হয়? বাবাদের হতে নেই?

শাঁওলি অনিরুদ্ধর হাত ধরলো

-বাবারা যে স্ট্রং হয়। তোমার মতো বাবারা মায়েদের আগলে রাখে। যেমন তুমি বৌদিকে রাখছো।

অনিরুদ্ধ অবাক হলো। ও কী নীরাকে আগলে রাখছে,আদৌ? নাকি অবসাদের গহ্বরে একা ছেড়ে রেখেছে। আগলে রাখাটা উচিৎ এইটুকু মেয়েও বোঝে। অথচ অনিরুদ্ধ নীরার থেকে সরে এসেছে। ঠিক করেনি ও। একদমই ঠিক করেনি। সমস্ত ভুলগুলোকে শুধরে নিতে হবে এবার।

তিন।

-অনিকে বললি?

বাবার কথা শুনে তাকালো অতীন।

-কী?

-অনুপমের ছেলে হলো যে।

-হ্যাঁ বললাম তো।

অনিরুদ্ধর কাকা অচ্যুত তাকালেন।

-কী বললো?

-কনগ্র্যাচুলেশন জানালো। আর কী-বা বলবে।

-ভিতরে ভিতরে যা জ্বলছে না...

অতীন বলেই ফেললো। অচ্যুত অতীনের আনন্দের কারণ বুঝলো।

-জ্বলবেই স্বাভাবিক। বংশের অভিশাপে,ও-ই নির্বংশ হয়ে মরবে,দেখিস।

বলেই থামলেন। অতীন বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখতে পেলো অতীনের মা আসছে। অনিরুদ্ধর কাকিমণি। ছোট থেকে অনিকে খুব ভালোবাসতেন সুহাসিনী। এসব কথা সইবে না।

-অনুপম ফিরলো?

-না,মা-আজ সল্টলেকেই থাকবে।

-মুখুজ্জে বাড়ির ছেলেরা শ্বশুরবাড়ি থাকছেও আজকাল?

-এতদূর যে...

অচ্যুত বললেন।

-থাক। তুমি সাফাই দিও না। অনিকে দেখেছ কখনো থেকেছে?

সুহাসিনী বললেন।

-মা,তোমার এই সবেতে দাদাভাইএর সাথে তুলনা কী আর যাবে না?

-ভালো উদাহরণ দেবো না তবে?

-ভালো? এতই ভালো যে বৌকে সামলাতে পারে না। ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেছে বৌ আর উনি পুরুষমানুষ হয়ে তাকে ভোলাতে পারছেন না।

অতীন বললো,

-জোর করা সব পুরুষমানুষের অভ্যাস হয়না অতীন।

সুহাসিনী অতীনকে থামিয়ে দিলেন।

-ছোটকর্তার তো আর একটা নাতি বাড়লো। মুখে হাসি নেই যে?

-আর হাসি। অনির প্রসঙ্গ তুলে তো মুডটাই খারাপ করে দিলে।

সুহাসিনী হাসলেন,

-ঠিক আছে। আমি উঠি। তোমরা ভালো মুডে কথা বলো বাপ-ছেলেতে।

-মনে হয় অনুপমের থেকে অনির ছেলে হলে তুমি বেশি খুশি হতে।

অচ্যুত চাপা গলায় বললেন। সুহাসিনীর কান এড়ালো না।

-বেশি,কম বুঝি না। খুশি হতুম। আর হবেও। কতই বা বয়স অনি-নীরার। ঈশ্বর চাইলে একটা কেন,দুটো হবে।

ক্ষুব্ধ অচ্যুত আর অতীনকে রেখে চলে গেলেন সুহাসিনী। গেলে অতীন বললো

-বৌদিমণি কি ঠিক হবে আর?

-ধুর কোন আশা নেই। পাগল ভালো হয় শুনেছিস। গারদে দিতে হবে।

-সেটা তো দাদাভাই দেবে না।

-জানি তো। আবার ডিভোর্স দিয়ে বিয়েও করবে না। ছেলে মেয়ে হবে কোত্থেকে?

-যদি সত্যিই না হয়? লিগ্যালি তো পুরোটাই আমরা পাবো।

-আলবাৎ। তোর ছেলে,অনুপমের ছেলেই তো পাবে সব।

-দাদাভাই কিন্তু পরীকে বেশি ভালোবাসে।

জানি তো। তোরা তো গর্দভ। সুযোগ নিতে জানিস না। পাশেরই তো বাড়ি। মেয়েটাকে অনির কাছে একটু দিয়ে আসতেও তো পারিস।

অতীন একটু ভাবলো। তারপর বললো,

-মন্দ বলোনি।

-তবে? এখন ওদের সন্তান দরকার। যদি পরীকে দত্তক নিয়ে নেয়। ক্ষতি কি?

-কী বলছো?

অতীন চমকে ওঠে।

-পরী আমার মেয়ে।

-রাখ তো। তোর মেয়ে সম্পত্তি পাবে,পুরোটা। তুই-ও ভোগ করতে পারবি। বুঝলি?

অতীন আর তর্ক করলো না। বাবা যেটা বলেছে সেটারও লজিক আছে। কিন্তু পরীর মা-মানবে কী? বলে দেখবে অতীন। জিনা প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে। মানতেও পারে।

চার।

অনিরুদ্ধ অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়েই নীরার ঘরে গেল। নীরা খাটের উপর বসেছিল। চুপচাপ। অনিরুদ্ধ এসে নীরার পাশে বসলো।

-খেয়েছ?

-ওষুধ?

-না,লাঞ্চ?

-খেয়েছি। বাবিনকে খাইয়েওছি।

-বেশ। কী বললো বাবিন?

-বললো আর অল্প কাজ আছে-চলে আসবে।

অনিরুদ্ধ নীরার পিঠে হাত রাখলো। ওর কপালের নেমে আসা চুল সরিয়ে দিয়ে বললো

-বেশ।

-বাবিন আসবে তুমিও জানো,তাই না?

-অনিরুদ্ধ হাসলো,

-জানি তো।

-তাহলে বকতে কেন আমাকে এতদিন?

-তুমি খেতে না যে।

অনিরুদ্ধ ভোলালো।

-আজ খেয়েছি বলেই বলছো?

অনিরুদ্ধ নীরার গালে চুমু খেলো।

-তুমি নিজের যত্ন নিলে বাবিন তাড়াতাড়ি চলে আসবে।

-সত্যি?

নীরার ঘোলাটে চোখ দুটোতে আলোর ঝিলিক দেখতে পেলো অনিরুদ্ধ।

-সত্যি। আজ তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি। নীরা অবাক হলো

-গিফট!

-হুঁ। দেখবে?

-কই? চোখ বন্ধ করো।

-আমি বাবিন নাকি?

অনিরুদ্ধ হাসল,

-বাবিনের থেকেও ছোট।

-ইস্‌!

নীরা চোখ বন্ধ করলো।

-তাকাও এবার।

অনিরুদ্ধ নেকলেসের সেটটা খুলে ধরেছিলো।

-নেকলেস!

-হ্যাঁ।

-ডায়মন্ড তো।

-হ্যাঁ।

-অনেক দামী তো,অনি?

অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো

-তাতে কী? আমার বৌটাও তো দামী।

-না অনি,এসব পাগলামো করো না। আমি কোথায় বেরোই বলো? লাগবে না এসব।

-বেরোবে নীরা।

অনিরুদ্ধ নীরাকে নেকলেসটা নিজে হাতে পরিয়ে দেয়। নীরার পিঠে চুমু খায় তারপর।

-বাবিন আসুক বেরোবো।

আবার বাবিন...অনিরুদ্ধ রাগলো না।

-তা বেশ। নীরা দেখো কী সুন্দর লাগছে তোমায়-আয়নায়...

নীরা দেখলো।

-একটু সাজগোজ করবে,বুঝলে? বাবিন তো পছন্দ করে তোমার সাজগোজ।

-হ্যাঁ-কোথাও বেরোলে ভালো করে সেজেগুজে বেরোতে হবে মামণিকে।

-তাহলে? তুমি না সাজলে হয়!

-ঠিক বলেছো?

অনিরুদ্ধ নীরাকে আবার চুমু খেলো।

-আজ রাতে এখানে থাকতে দেবে?

নীরা অবাক চোখে তাকায়,

-তোমার ঘর তুমি থাকবে।

-তোমার ডিস্টার্ব হবে না তো?

-না,না তিনজনে শুয়ে পড়বো। বাবিন মাঝে কিন্তু।

অনিরুদ্ধ মেনে নিলো

-বেশ। নীরা,বাবিনের ভাইবোন হলে কেমন হবে?

-ভাইবোন!

-হ্যাঁ। জানো আজ অনুপমের আবার ছেলে হলো। সেকেন্ড টাইম।

-তাই? বাহ,কিন্তু বাবিনের ভাইবোন হলে বাবিন যত্ন পাবে না যে...

অনিরুদ্ধ তর্ক করলো না,

-তাও ঠিক। ধরো,বাবিনই ছোট হয়ে এলো।

-ছোট্ট হয়ে...কী করে। যেমন গেছে তেমন আসবে। এখন তো ছয় বছর বয়স।

-বাবিন ফিরে এলে নেবে?

-কী?

-আর একটা?

-আসুক আগে।

-এলে কিন্তু চাইবো তোমার থেকে।

-তুমি নিয়ে এসো আগে দুষ্টুটাকে। মা’কে ফেলে কোথায় না কোথায় লুকিয়ে বসে আছে। ভাবছে খুব জব্দ করেছি মামণিকে।

-তোমার কাছে আসে তো।

-কখন?

নীরা অবাক হয়।

-কেন? দুপুরে? ওর সাথে কথা বলো,খাওয়াও।

-সেতো ছবিটাকে। ও আসে না।

নীরার মুখ ছোট হয়ে যায়।

-ছবি জেনেও খাওয়াও?

অনিরুদ্ধ জানতে চায়।

-খাওয়াবো না? বাবিন কোথায় আছে,কার কাছে আছে,কী খাচ্ছে-এসব চিন্তা সবসময় হয় যে। মুখচোরা ছেলে। মা না খাওয়ালে খায় না। ওখানে কেউ কী আছে বলো যে খাইয়ে দেবে খিদে পেয়েছে বুঝে?

অনিরুদ্ধ চশমা খুলে চোখ মুছলো।

-তাই তুমি খাইয়ে দাও?

-হ্যাঁ। ভুল করি?

-নাহ। কিন্তু নিজেও খাবে। ডাক্তারকাকা বলছিলেন তোমার হিমোগ্লোবিন খুব কম।

নীরা হাসে,

-খাই তো। ডাক্তারকাকা আর কিছু বলেননি?

অনিরুদ্ধ নীরার হাতে হাত রাখে,

-বলেছেন। বকেছেন আমাকে। কাজ কাজ করে সোনাকে সময় দিই না বলে।

-ঠিক করেছেন।

-তুমি চাও আমি সময় দিই,তাই না?

-বোঝ না?

-বুঝি তো। মাঝে কাজের জন্য কিভাবে ভুলে ছিলাম কে জানে?

-কাজের চাপ খুব,অনি?

অনিরুদ্ধ মিথ্যাই বললো,

-খু-উ-ব।

-ওহ,আমি ভাবতাম আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো।

-এড়াবো কেন? এই যে তোমার কথা শুনিনা। বাবিন নেই বলো তুমি,মানতে পারি না।

অনিরুদ্ধ নীরার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে গভীর ভাবে চুমু খেলো তারপর।

-তোমাকে এড়িয়ে যাবো কোথায়?

নীরা অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মাথা রাখলো।

-রাতে থাকবো কিন্তু।

-থেকো।

-বাবিনকে মাঝে রেখেই...

-হুম। কাড়াকাড়ি কোরো তারপর। কার দিকে ঘেঁষে শোবে দুষ্টুটা।

অনিরুদ্ধ হাসলো। নীরাকে বকে নয়,ভালোবেসে সহজ করতে হবে। এটা বুঝেছে ও।

রাতে অনিরুদ্ধ শুতে এসে দেখে বিছানার মাঝে পাশবালিশ।

-বাবিন ঘুমিয়ে গেছে?

-এই ঘুমালো।

বকতে হলো?

-না,না। তুমিও শোও। ঘুমিয়ে পড়ো।

অনিরুদ্ধ শুলো। পাশবালিশটাকে একটু আদর করলো।

-বাবিনকে ওপাশে দিয়ে দিই?

-না থাক না।

-একটু দিই...

অনিরুদ্ধ পাশবালিশটাকে সরিয়ে দিল। নীরার কাছে গেলো। বহুদিন পর নীরাকে এত কাছে পেয়ে অনিরুদ্ধর শরীর জেগেছে। নীরার বুকের আঁচল সরিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ।

-কী করছো!

-কিছু না,সোনা!

ব্লাউজের হুকগুলো খুলে দিলো অনিরুদ্ধ। নীরা রাতে অন্তর্বাস পরে না। স্তন দুটো বেরিয়ে এলো। অনিরুদ্ধ স্তন দুটোতে হাত দিলো। মুখ লাগিয়ে দিলো একটাতে।

-অনি...

অনিরুদ্ধ বললো,

-উ...

-ছাড়ো

-না ছাড়বো না।

অনিরুদ্ধ নিজের দখলদারি বাড়ালো।

-ছাড়ো বলছি। এই জন্যই এখানে শোবার ইচ্ছা না তোমার। ঠিক বুঝেছি। যত বলছি যে বাবিন আছে...তাও...সন্ধ্যা থেকে মিষ্টি মিষ্টি কথার আসল কারণ এটা।

অনিরুদ্ধ থামলো। কষ্ট হলেও ব্রেক কষলো। নীরার স্তনে দুটো চুমু খেয়ে ব্লাউজ আটকে শাড়ি ঠিক করে দিলো।

-তুমি বললে,থেমে গেলাম।

-ও ঘরে যাও।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

-নাহ,আর অমন করবো না। একটু ঘুমাই?

-বাবিনকে মাঝে দাও।

অনিরুদ্ধ দিলো,পাশবালিশটাকে।

-হয়েছে? এবার শুতে পারি তো?

নীরা পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরলো। অসংখ্য চুমু খেলো।

-হয়েছে,ছেলেকে আদর করা? এবার ঘুমাও,সোনা।

-তুমিও ঘুমাও।

অনিরুদ্ধ পাশবালিশ সমেত নীরাকে জড়িয়ে ধরলো। নীরা সহজেই ঘুমিয়ে গেলো। নীরার প্রত্যাখ্যানে অনিরুদ্ধর শরীর আর মন দুই-ই জেগে রইলো।

ঘুম ভেঙ্গে অনিরুদ্ধ অবাক হল। নীরা ওর বুকের মধ্যে রয়েছে। অনিরুদ্ধকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। অনিরুদ্ধর সব রাগ জল হয়ে গেল যেন। নাহ। দোষটা ওরই। একদিন কাছে এসেই নীরার শরীর পেতে অত তাড়াহুড়ো করা উচিৎ হয়নি। নীরা এতে ভুল বুঝবে ওকে। নীরাকে সুস্থ করতে হলে নীরার মনে কোন চাপ দেওয়া যাবে না। অনিরুদ্ধ ঘুমন্ত নীরাকে দেখলো। দিব্যি অনিরুদ্ধর বুকের মধ্যে ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে,ভরসা করে তবে। নীরার মুখটা বড্ড নিষ্পাপ লাগছে আজ। অনিরুদ্ধ নীরাকে আদর করলো। আলতো আদর। কপালে,নাকে,দুগালে-নীরা চোখ খুললো। অনিরুদ্ধ বিব্রত হলো। ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় মেয়েটা। ঘুম ভালোভাবে না হলে বিপদ।

-সরি।

নীরা হাসলো,

-উঠে পড়েছো?

-হ্যাঁ।

-অফিস আছে?

-উঁহু। আজ সানডে।

-তাহলে আর একটু ঘুমোও।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

-আটটা বাজে। তুমি ঘুমোও। আমি উঠি এবার।

নীরার অনিরুদ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরা চায় ও থাকুক।

-থাকবো?

-হ্যাঁ।

-আচ্ছা। থাকছি তবে।

-উঠেই বা কী করবে? সানডে তো। অবশ্য তোমার যদি না ক্লাব,পার্টি,ক্লায়েন্ট ডিল থাকে।

অনিরুদ্ধ নীরার নাকে নাক ঘষলো,

-কিছু নেই ক্লাব,পার্টি,গেটটুগেদারে গত দেড় বছর যাইনি নীরা।

-বাবিন চলে যাবার পর যাওনি?

অনিরুদ্ধ নীরার মাথাটা নিজের বুকের উপর টেনে আনলো।

-যাবো কী করে? আমার কষ্টটাও তো তোমার সমান।

তাহলে কোথায় থাকতে?

নীরা অবাক হয়।

-আমার ঘরে। কখনো গার্ডেনে,গার্ডেনিং করতাম,কখনো স্টাডিতে।

-এ ঘরে আসতে না কেন?

অনিরুদ্ধ নীরার অভিমান ভাঙাতে চাইলো

-বুঝতামই না যে নীরা আমাকে এতটা কাছে চায়।

-কাছে নয়। পাশে। 

-ঐ আজ কোথাও বেরবে?

-কোথায়?

নীরা আকাশ থেকে পড়লো

-এদিক সেদিক। বিয়ের পর পর যেতাম যেমন।

-বাবিন?

-বাবিনকে নিয়ে যাবে?

-না,না,যদি বাবিন ফিরে এসে বাপিকে মামনিকে খোঁজে আর না পায়?

-তাই তো। তবে বাড়িতেই থাকি। সোনা,তুমি লাঞ্চে কী খাবে?

-মণিপিসিতো জানেই।

-আজ ভাবছি লাঞ্চটা আমি নিজে হাতে করবো,হবে?

-মানে রান্না?

-হ্যাঁ। বিলেতে করতুম যেমন।

-সে তো ন-দশ বছর আগে। এখন ভুলে গোছা নির্ঘাৎ।

-ভোলে নাকি কেউ? দেখাই না-একদিন।

-একটা শর্ত।

-বলো।

-উপরের কিচেনে ট্রাইকরবে। আর আমিও থাকবো।

অনিরুদ্ধ মনে মনে খুশি হলো। ঘরের বাইরে বেরোতে চেয়েছে নীরা। এটাই অনেক।

-তোমার কষ্ট হবে যে। ওষুধপত্র চলে। ক্লান্ত থাকো।

-তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে কষ্ট হবে আমার,অনি?

-হবে। তুমি বসে থাকবে। আমি রান্না করবো,কেমন?

-আচ্ছা। বেশি ঝাল দেবে না,বাবিন খাবে তো।

অনিরুদ্ধর মনটা মুচড়ে উঠলো। তাও মুখে হাসি বজায় রাখলো।

-ঝাল কমই দেবো। চিন্তা করো না।

নীরা খুশি হলো। অনিরুদ্ধ লুকিয়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

পাঁচ। 

-দ্যাখ দাদাভাই-কেমন হয়েছে?

শাঁওলি বাড়ি গিয়ে সব্বাইকে দেখিয়ে ফেলেছিলো মায়ের জন্য কেনা কানের দুলটা। প্রতীককেই দেখাতে পারেনি কেবল। প্রতীক ফার্মা কোম্পানির রিজিওন্যাল ম্যানেজার। অফিস ট্যুরে মাসে বাইশ-চব্বিশ দিন বাইরেই থাকে। আজই ফিরেছে। আর ফিরতেই শাঁওলির হাতে পাকড়াও লাঞ্চ টেবিলে। আজ সানডে। প্রতীক-শাঁওলিদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। প্রতীকের বাবা শাঁওলির জেঠুমণি। প্রতীকের মা,শাঁওলির মা,প্রতীকের স্ত্রী,মেয়ে সবাই একসাথেই থাকে।

-বাহ। দারুন তো,তাই না মিত্রা?

মিত্রা শাঁওলির বৌদির নাম।

-বলেছি বোনুকে কালকেই। কিন্তু তোমাকে না দেখিয়ে শান্তি পায়না,জানোই তো।

শাঁওলির মা পরিবেশন করছিলেন।

-পুরো মাইনেটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছে,মনে হচ্ছে।

-তুমি থামো তো মা। আট হাজার টাকা লেগেছে বলছি তো।

প্রতীক অবাক হলো। আট তো মনে হচ্ছে না। বারো-তেরোর কমে তো হবেই না। বাক্সের গায়ে নাম লেখা দেখলো। মুখার্জী অ্যান্ড সন্স। অনির দোকান।

-জানো দাদাভাই ওখানে তো দামী দামী জিনিস দেখাচ্ছিলো। বাজেট আট বলছি,তাও বারো-চোদ্দর...

-তারপর?

-ভাগ্যিস অনিরুদ্ধ দার সাথে দেখা হলো।

-অনির সাথে?

-হ্যাঁ,বৌদির জন্য গয়না কিনতে এসেছিলো।

প্রতীক হেসে ফেললো,

-ধুর বোকা মেয়ে। অনির নিজের দোকান ওটা। গড়িয়াহাটে মেইন ব্রাঞ্চ। এছাড়াও সারা পশ্চিমবঙ্গে গোটা কুড়ি-বাইশ ব্রাঞ্চ আছে।

শাঁওলি থ হয়ে গেল,

-অনিদার দোকান? কই বললো না তো? আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে গেলো একবারো বললো না...

প্রতীক হাসলো,

-অনি অমনই। নিজের প্রাচুর্য প্রকাশ করতে চায় না। তা তোর অনিদার বলাতে কম বাজেটর দুল দেখালো?

-হ্যাঁ তো।

প্রতীক মিত্রাকে চোখের ইশারা করলো। মিত্রাও বুঝলো। মা-কাকিমা,বাবা কারুর সামনে বললো না।

-আমার স্কুলেও যাবে একদিন। স্কুল দেখতে।

-অনি তো আগে প্রায়ই আসতো এখানে তাই না,বাবু?

প্রতীকের বাবা বললেন।

-হ্যাঁ। এখন খুব ব্যস্ত,সময় পায়না। তাছাড়া সাড়ে চার বছরের জলজ্যান্ত ছেলেটা দেড় বছর আগে...

সবাই চুপ হয়ে গেলেন।

-ও হ্যাঁ,বলেছিলি তো।

প্রতীকের বাবা আস্তে করে বললেন।

-সেই থেকে আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। কাজ আর বাড়ি। কোনো গেটটুগেদারেও যায় না।

শাঁওলি মনে মনে কষ্ট পেলো। গোমড়ামুখোটা আরো গোমরা থোরিয়াম হয়েছে তবে। শাঁওলি ওকে হাসাবে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে-তার জন্য চুপচাপ করে বাঁচার কী দরকার? পচা লোক একটা। আজই ফোন করবে একটা লোকটাকে।

ক্রমশ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.