Poetry is the spontaneous overflow of power feeling, কবিতা হল কবির আবেগ- অনুভূতি-অভিজ্ঞতার এক বাণীবদ্ধ সংগঠিত রূপ । বলা যেতে পারে শব্দ নির্বাচন, নির্বাচিত শব্দাবলীর বিন্যাস, ছন্দ, চিত্রকলা, প্রতীক, অলংকার ইত্যাদির প্রাকরণিক চমৎকারিত্বে কবিতার রূপকলা গড়ে ওঠে । কবিতার বিষয় থাকে সেই রূপকলার অন্তর মহলে, ভাষা প্রকরণের সঙ্গে মিলেমিশে একান্ত হয়ে, দেহের সঙ্গে প্রাণের স্পন্দনের মতোই । যারা কবি, কবিতা লিখছেন তিনি সর্বপ্রথম নিজের জন্য কবিতা লিখবেন না, লিখবেন অন্যের জন্য, অন্যের হৃদয়বেত্তাকে জয় করবার জন্য, জীবনকে সৌন্দর্যময় করে তোলার জন্য ।কবিতা হোক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প। যে শিল্প প্রকৃত অর্থে আর্থিক সংকট মোচনকারী না হয়েও মনের দৈন্যতা, অসহায়তা, নৈরাশ্য সর্বোপরি সামাজিক নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শাণিত তরবারি রূপে ব্যবহৃত হতে পারে ।
কেন কবিতা লিখি? আমরা কীভাবে কবিতা লিখব, কেন লিখব, পথ কোনটা, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকতে পারে। কেউ কবিতাকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে বলেন, আবার কেউ সীমাবদ্ধ বৃত্তের ভেতরে অবস্থান করতে ভালবাসেন । কবিতা মননের, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় একজন কবির ।কবিতার মধ্যে সেই মনন, সেই অনুভূতি , অভিব্যক্তির পরিপূরণ ঘটে ।
' তোমাকে আমার জাতশত্রুই মনে করি না
তুমিও কারো দ্বারা শোষিত, যা জান না
জাতশত্রু খিদে আর দারিদ্র্য
যা মানুষই তৈরি করেছে
পৃথিবীর বুকে আলো আছে, তাই শোষণও আছে ।'
আমার মনের মধ্যে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াগুলো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে দোলায়িত তার ভেতর থেকে কবিতার স্বরূপ বেরিয়ে আসে শব্দে ।জানা অজানা চিন্তা, ভাবনা, দৃশ্যকে শব্দ তুলির টানে প্রতিসরিত করে পাঠকের মনের দর্পণে প্রতিফলন সূত্রে টেনে নিয়ে পাঠকের হৃদয়কে সরসিত করে তোলার চেষ্টা করার প্রয়াসেই কবিতা যথার্থতা লাভ করে ।
আমার মনে হয়, কবিতা সেই দ্যোতনার বাহক।
ছোটবেলায়, গাঁয়ের মুক্ত বাতাসে ভাসতে ভাসতে সবুজ আলপথ বেয়ে নদী পেরিয়ে দশ-বারো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে মামার বাড়ি যেতাম মায়ের হাত ধরে। পথ চলতে চলতে দুপাশের দৃশ্য মনকে নাড়া দিত, প্রকৃতি যেন সাড়া দিত, আহ্বান করত, সুর দিত কণ্ঠে। গুণ গুণ করে কথা বলতাম প্রকৃতির সাথে, বাতাসের সাথে, হেলেপরা পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুরের সাথে, ছন্নছাড়া শরতের মেঘেদের সাথে। মা পেছন ফিরে ডাকতেন, খোকা! দৌড়ে আয়, বেলা যে পড়ে এল। আমি বলতাম, আর কতদূর মা ? এই তো, আর একটু খানি, ,,,
নদীর বুকে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটুর নীচে কলকল স্বরে স্বচ্ছ জলের ধারা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যেত, আমি দু'পা এগিয়ে গিয়ে দৌড় দিতাম, বালিগুলো মায়ের স্নেহকণা নিয়ে আদর করত, দৌড় দিতাম অপথে, বেপথে সৌন্দর্যের টানে। সেই শান্ত নদীর জলে ছোট ছোট রঙ বেরঙের মাছ ভেসে বেড়াত। আনন্দে, শিহরনে মন আপ্লুত হয়ে পড়ত। অদূরে একপায়ে দাঁড়িয়ে কোনো এক বক মহারাজ মাছের অপেক্ষায় প্রহর কাটিয়ে দিত,
"স্বপ্নের চারাটি অদম্য ইচ্ছের কৌতুহলে জাত
ভুখমারি আওয়াজ মাটি পুড়িয়ে পুড়িয়ে
তৈরি করে একটা সবাক গেরুয়া খিদে
গভীরে ঢাকা আছে ছায়াময় ব্যস্ত নিয়তি "
ব্যস্ত নিয়তির ছায়াময় কৌতুহল মনকে নাড়া দিত শৈশব থেকেই, কবিতা কি? কীভাবে লেখা হয় জানতাম না, বুঝতাম না, ছড়ার বইয়ে ছোট ছোট ছড়া পড়তে হোত, পাঠের তাগিদে, একটু বড়ো হতেই কবিতা পড়তে হয়েছে ।
'বাড়ি আমার ভাঙনধরা অজয় নদের বাঁকে
জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে '
সেই অজয়ের ভাঙন তীরে কবির আস্তানা, যেখানে জল সোহাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে, সেই চিত্রকল্প, শব্দ ব্যঞ্জনা মনকে টানে।
' আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে ।'
পাশের নদীতে যখন হেঁটে হেঁটে যেতাম, কবির কবিতার সাথে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা হত, মন বলত, আমি কী কবিতা লিখব। কবিতা কীভাবে লিখতে হয়, অনেক প্রশ্ন । কবিতা লেখা কবিদের কাজ, সাধারণের নয়। তখন ভাবতেই শিখিনি একদিন আমিও কবিতা লিখব। আসলে কী জানেন , কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ।
ষাটের দশক থেকে একবিংশ শতকের এই দীর্ঘ সময়ে কবিতার গড়ন, বলন, চলন, আঙ্গিকের কত বিবর্তন ঘটে চলেছে নিরন্তর তা বলে শেষ করা যাবে না। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমার জন্ম, সমাজকে, দেশকে, জাতিকে,ধর্ম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না, সেই সময়ের অস্থির রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা আমাকে বিশেষ পীড়া দিতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সব দিনের কথা, হাহাকার জীবন, ক্ষুধার্ত মানুষের মৌলিক চাহিদা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি। সেই উপলব্ধিগুলোর ভেতর থেকেই মননের সহাবস্থান দ্বারা কবিতা লিখতে উৎসাহ বোধ করছি। অনেক পরে জেনেছি, সেই সময়ের কবিতা জগতে বিশেষত, বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে যে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রভাব সমাজে পড়েছিল। যেমন, হাংরি, শ্রুতি, প্রকল্পনা, থার্ড লিটারেচার ইত্যাদি আন্দোলন।
হাংরি আন্দোলন নিয়ে লিখতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় কবি মলয় রায়চৌধুরীর, মতামত পেয়েছি, আন্দোলনের জন্য যে যে দিক উন্মোচিত হয়েছিল তা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন, তা পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছি। সেই সময়ে শ্রদ্ধেয় কবি মৃণাল বসুচোধুরী, পুষ্কর দাশগুপ্তদের শ্রুতি আন্দোলন আমাকে অনুপ্রাণিত করে । শ্রুতি আন্দোলন নিয়ে লিখেছি, বুঝতে, জানতে সচেষ্ট হয়েছি। 'কবিপত্র ' পত্রিকাকে ঘিরে 'থার্ড লিটারেচার 'আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সম্পর্কে জেনেছি, পড়েছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ চিত্র, শিল্প, রূপ, যা বাস্তবতার সাথে সংযোজিত তার থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছি।
চর্যাগীতি থেকে সাম্প্রতিক সময়ের কবিতার ভেতর দিয়ে যে নতুন নতুন ভাবনা, চেতনা, অনুভূত হচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে কবিতার নতুন আঙ্গিক, প্রকল্প রচনার ইচ্ছে আবির্ভূত হয়। কবিতা আন্দোলনের ধারা হিসেবে কবি আফজল আলি 'জিরো বাউন্ডারি কবিতা 'র ভেতর দিয়ে এক উন্নত আদর্শ তত্ত্ব আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, কবিতা লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে।
' তুমি তোমার মধ্যে নেই জেনেও আমি
বোতলের লাল রক্তে ছায়াসঙ্গী খুঁজি '
কবিতার ভেতর থেকে সেই রসাসিক্ত বোধ, অনুপ্রেরণা বাড়িয়ে দিয়েছে, কবিতার বুকে ঢলে পড়ি,
' একটা নিষ্ঠুর রোদ জেনে বুঝে হামা টানে
অরণ্যে জোৎস্নাহরিণীর লুকোচুরি বুঝি '
এই বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আর্তনাদ ভেসে আসা জলের চরিত্রের ভেতর কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।
আমি যশপ্রার্থী হয়ে কবিতা লিখতে চাই না। লিখিও না, মনের আবেগ, অনুভূতি নাড়া দিয়ে থাকে, তখন কবিতা লিখে ফেলি। এই যে, অভিব্যক্তির কথা বলে ফেললাম, এটাও আমার কবিতা যাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য। কবিতা যেহেতু মনে খোরাক সংগ্রহ করে, তাই ভালবেসে কবিতা লিখে থাকি।
',,, genuine poetry can communicate before it is understood. '
সমাজকে ধাক্কা দিতে, সচল রাখতে, সঠিক পথে চালিত করতে কবিদের কবিতা লিখতে হয়, আমি মনে করি যথার্থ পথ এটিই। অন্য কোনো পথ আমার জানা নেই আমার কাছে, বস্তুত কবিতা মোক্ষম জবাব দিতে পারে একমাত্র।
সুচিন্তিত মতামত দিন