উত্তর পূর্বের আর দশটা শহরের মতই বিজি ট্রাফিক। সরু রাস্তা। পেট্রলের ধোঁয়া। একটানা গাড়ির গোঁ গোঁ.... নামেই তুরা পাহাড়। আসলে পুরোটাই তো মেঘালয় মালভূমি। দিনের শেষে এখন ঘরে ফেরা। বাতাসের পারদ নামছে ক্রমাগত। অটোর খোলা জানালায় শীতের বার্তা...
সকাল ১০টায় ঢুকেছিলাম হোটেল রাজকমলে। ৬৫০টাকায় ডবল বেডে রুম। কমন টয়লেট। বাথরুমে ঢুকে দেখি জল নেই। শুরুতেই জল নিয়ে একচোট হয়ে গেল ম্যনেজারের সাথে। গতকাল সারাটা দিন কেটেছে জলে জলে.... আর আজ এক ফোটা জল নেই। জলই ভাগ করেছে আমাদের। দেশ-কালের এই খেলা জলেরই আবর্তে......
হোটেলে পাশেই তুরা বাসস্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ডে আমাদের রেখে চলে গেলো মুনি। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য দু’হাজার টাকার অটো ড্রাইভ। যথেষ্ট এক্সপেন্সিভ। কিন্তু এছাড়া উপায় ই বা কি!
মুনি ছিল আজ আমাদের ড্রাইভার। ঘুরিয়ে মুনি আমাদের দেখালো দারিবকগ্রী (নকরেক বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অংশ) সাথে পেলগা ফলস, ডাকবগ্রী আর চিবাগ্রী একদিনের মধ্যে যতটুকু দেখে নেওয়া যায়। কাল সকালেই বেরিয়ে যাব বাঘমারায়।
মিজোরাম গিয়ে পেয়েছিলাম "পুক"। জায়গার নামের শেষে পুক কথাটা। মেঘালয়ে এসে পেলাম "গ্রী"।
ডাকব গ্রী, দারিবক গ্রী, শিবা গ্রী.... ড্রাইভার, মুনী কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। "গ্রী" কথার অর্থ বলতে পারে নি। আমার মনে হয় শব্দটার অর্থ স্থান বাচক। আমরা যেমন "পুর" বা "নগর" ব্যবহার করি।
বাঘমারা
ভোর ৫টায় হোটেল ছেড়েছি। একবার বাজার স্ট্যান্ড তো একবার সুমোর স্ট্যান্ড ঘুরে ঘুরে লাট খেয়ে শেষে পাবলিক বাসস্ট্যান্ডে। সকালের গাড়িগুলি ভর্তি হয়ে চলে গেলো , চোখের সামনে। সব টিকিট নাকি আগে থেকেই বুক। না জানলে যা হয়! গতকাল ফুলবাড়ি থেকে তুরাতে অনেকটা পথ দাঁড়িয়ে এসেছি। উফ: কি কষ্ট! আজ আর রিক্স নিলাম না। দেরি হয়, হোক। আজ সিটে বসেই যাব। রাস্তা খুব খারাপ। 3:50 মি: এর পথে এখন লাগছে ৫ঘন্টা। গাড়ি ছাড়বে ৮টায়।
সকালের রোদে আড় ভাঙছে পাহাড়। রাস্তার পাশে সাদা ফুলের গাছগুলো আলো করে দাঁড়িয়ে। গাছের ফাঁক দিয়ে আলো পড়েছে ভেতরের অরণ্যে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি .... তবু অস্পষ্টতা কাটে না। এই বিজন প্রান্তর কুহেলিকার মত ছুটিয়ে মারে। নিজেকে মনে হয় সাপুড়ে, না হয় কোন আদিম জাদুকর। জঙ্গলের মাঝে মাঝে আবাদী জমি ক্ষয়প্রাপ্ত টিলা গুলিকে দ্বীপের মত আগলে রেখেছে।। ধান , শিমুল তরু, মুলা, বরবটি আর ধুন্ধুলের গাছ। ধুলা উড়িয়ে আমাদের গাড়ি পার করলো ডালু। ব্যাগ ভর্তি লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, বরবটি, কোয়াস, রাই শাক, কচু।গাড়িতে উঠেই ব্যাগ গুলোকে ঠেলে দিলো পায়ের কাছে। বুক থেকে জড়ানো লম্বা একটা স্কার্ট আর উপরে বড় ব্লাউজ টাইপের জামা পড়া বেশ কজন গারো মহিলা। এটাই ট্রাডিশনাল গারো দের পোশাক। গ্লোবালাইজেশনের এর যুগে এই পোশাকের ব্যবহার কমছে। চড়া রোদ, ঘাম, ধুলায় ছোট্ট পাহাড়ি জনপদে নাগরিক ব্যস্ততা।
ছোটবেলায় ক্লাস এইট-নাইনের বিজ্ঞান বইয়ে শেষ বারের মত ছবি দেখেছিলাম কলসপত্রি উদ্ভিদের। তারপর বহুযুগ বাদে এই বন পাহাড়ের দেশে চাক্ষুস করলাম। কলসপত্রি। ইংরেজিতে বলে পিচার প্ল্যান্ট ( Pitcher plants are carnivorous plants whose prey-trapping mechanism features a deep cavity filled with liquid known as a pitfall trap) বড় বড় লম্বা পাতার সামনের দিকে ফুলের ভঙ্গিমায় সাজানো মৃত্যুফাঁদ..... দুর্গম এই অঞ্চলে খাদ্য খাদকের শর্তে সতর্ক জীবন। পায়ে পায়ে অজানা ভয়......
তবুও ফুল মানেই তো সুন্দর। সাদা সাদা রাস্তা আলো করা ফুল গুলির স্থানীয় নাম মেগং। এই সময় মেগং অনেক ফোটে। এই গাছের কচি পাতা শাক হিসেবেও খায় স্থানীয়রা। লম্বা লম্বা হলুদ ফুলটার নাম ডাডিমিলডং (গারোরা চর্ম রোগের ওষুধও বানায়) আরো একটা ফুল থেকে কি যেন এক ওষুধ হয়। কস্থানীয় নাম মিমাংওয়া। দেখতে অনেকটা আমাদের দোলনচাঁপার মত। তবে গন্ধ নেই। খুব সকলে রওনা দিয়ে বিকেল চারটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম বাঘমারা। লাল মাটির দেশ উঁচুনিচু টিলা। সারিবদ্ধ সুপারির গাছ জানান দেয় জনপদের।
বাঘমারাতে এসে হলো বিপত্তি। বাজারের উপরে একটাই হোটেল। কিন্তু হোটের একটাও ঘর নেই। সব ঘর লোকে ভর্তি। এবারে শেষ উপায় বলতে সার্কিট হাউসের ট্যুরিস্ট বাংলো। বাজারের একটা অটো নিয়ে ছুটলাম পাহাড়ের উপরে। প্রকাণ্ড একটা ঘর পেয়ে গেলাম বাংলোতে। বাঘমারা বাজার থেকে বেশ উঁচুতে। টোটোতেই ভাড়া পড়ে মাথাপিছু ৫০টাকা। কাছে পিঠে আছে বলতে এক ডন বস্কো স্কুল। বাংলোতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। ঘরের মাপের সাথে ভুতের ভয়ের সম্পর্কটা বুঝি সমানুপাতিক। গতকাল সারারাত ঘুম আসে নি। সারারাত বাথরুমে টপ টপ জলের শব্দ, কিম্বা টিকটিকি'র টিক-টিক। বাতাসের সন সন শব্দ। হাওয়াতে দোল খাওয়া গাছের মট মট শব্দ। আর জানলার পর্দা দিয়ে দেখা সেই অদ্ভুত মায়াবী চাঁদ। যত বার তাকিয়েছি বাইরের দিকে ততবার সেই অদ্ভুত ঘোলা... গা ছম ছম। বিছানায় শুয়ে আছি, নিজেকে মনে হচ্ছে খুব ভারী।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পরিনি। মনে হচ্ছিল ঘরের সব জিনিসগুলো অজান্তেই ফিসফিস করছে। চোখ একটু বন্ধ করতেই জাগিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই টেবিল থেকে জলের বোতলটা পড়ে গেল, ঘরের পর্দাগুলো হাওয়ায় কাঁপছে, পর্দার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরের মায়াবী আলোটা বিছানায় পড়ছে, সারারাত বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করলাম খুব কষ্ট করে। ভোর ৪টার দিকে বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় সারা শরীর-হাত-পা সব ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বাথরুম থেকে এসে শুনলাম ধিরাজেরও নাকি ঘুম হয় নি রাতে!
বিকেলের রোদ ঝলমলে পরিবেশে কি সুন্দর ই না লাগছিল বাঘমারা ট্যুরিস্ট লজটা’কে। অথচ রাতটা এমন কেন হলো? দিন আর রাতের ফারাকে কেন সব কিছু এতটা পাল্টে যায়! সাত সকালে ব্যলকোনি তে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি। ইতিমধ্যে তাড়া লাগায় ড্রাইভার ফাউলুস সাংমা। ফাউলুস আজ আমাদের নিয়ে যাবে নেংকং আর সিজুতে।
গুহাটা কোথায় ?
নেংকং এ আমরা যখন এলাম তখন সকাল ৮.৩০মিঃ। ছোট্ট জনপদ। পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। সুপারির বাগান দিয়ে ঘেরা। পথে ফেলে এসেছি কারুকোল’কে। সিমসাং এর সাথে রংদেক নদী যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানেই ছিল কারুকোল। সমতল ক্ষেত্র। উঁচু উঁচু পাহাড় গুলো সরে গেছে দূরে দূরে। যেখানেই নদী সঙ্গম সেখানেই প্রসস্থ উপত্যকা। উপত্যকা জুরে সবুজ ধান খেত। কারুকোল থেকে আর একটা রাস্তা বাটুলের মত ভাগ হয়ে চলে গেছে সিজুতে। এ পথেই পড়ে ইষ্ট গারো হিলের সদর শহর উইলিয়ামনগর। ছালবাকলা একটা পথে সকাল ৬টায় রওনা দিয়ে এসে পৌঁছেছি।
কিছুটা এগিয়ে এসে, আবার অটোটা পেছায় ফাউলুস সাংমা। ফাউলুস আজ আমাদের ড্রাইভার। এই কদিনের যাত্রা পথে, দ্যা বেস্ট ম্যান অফ দ্যা ট্যুর। খুব ভালো বাংলা বোঝে। বলতেও পারে বেশ ভালো। তবে উচ্চরণে অদ্ভুত এক টান। যাই বলি না কেন, তাতেই ফাউলুসের উত্তর – হবো হবো। আর আমরা ওনাকে কিছু জানালে বলে – অও... অও...অও...
সাকুল্যে দশ বারোটা দোকান। একটা বাজার চত্ত্বর। মাটির রাস্তায় গাড়িটাকে নীচে নামিয়ে একটা খাবার দোকানের সামনে দাড় করায় ফাউলুস। দোকানে ঢুকে অর্ডার দেয় চা, বড়া আর দচি। বড়া, চালের ব্যসনে ভাজা একধরনের খাবার আর দচি মানে সেদ্ধডিম, হালকা করে ভাজা। নট ব্যাড! গত কাল দুপুরে কাঁচা কাঁচা গারো রান্নার চেয়ে ঢের ভালো। গারো ভাষায় কেউ কিছু একটা জিজ্ঞেসা করতেই ফাউলুস কে দেখিয়ে দি। একজন আধো বাংলায় জিজ্ঞেসা করে, আমরা গবেষণা করতে এসেছি কি না! বহুদিন পড়ে ঠেটেংকোলে যাবার জন্য আমাদের দেখে সবার মনেই বেশ কৌতুহল। কিছু গারো মহিলা আমাদের পর্যবেক্ষন করেই চলে। বুঝতে পারি অনেক দিন এই পথে বাইরের কেউ আসে নি। কেউ কেউ আমাদের নিয়ে কথা বলছে অবাক বিস্ময়ে। কারো মুখে লেগে থাকে স্মিত হাসি।
নেংকং বাজার থেকে ঠেটেংকোল যাওয়া আসা মিলে প্রায় ৫কিমি পথ। দক্ষ গাইড ছাড়া পথ হারানোর ভয় আছে। নদীর জলে জলে পার হতে হয় অনেকটা পথ। নদীর জলের গভীরতা সব জায়গায় সমান না। জঙ্গলে সাপ ও অজানা পোকামাকড় এর উপদ্রপও আছে। কোথাও কোথাও পায়ে চলার রাস্তাটুকুও নেই, তাই গাইড ছাড়া অসম্ভব। চা খেতে না খেতেই ফাউলুস কোথা থেকে একজন গাইড জোগাড় করে ফেলেছে। ২০০টাকা নেবে। নো প্রবলেম। ব্যাগ গুলো টোটো তে রেখে একটা জলের বোতল হাতে নিয়ে রওনা দিলাম ... আজকের গাইড মারছান মারাক।
সুচিন্তিত মতামত দিন