আগের পর্বে বালীর কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলাম, রামায়ণের কাহিনির মূল ধারায় হামেশাই একটি অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করা যায়---- কোনো চরিত্র যত বেশি যোগ্য, তাকে তত বেশি অবহেলা করে রচনা বা বর্ণনা করা হয়েছে। বালীর কিষ্কিন্ধা থেকে আমাদের আলোচনাকে যদি আবার রাবণের লঙ্কায় ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে এরকম চরিত্র বলতে প্রথমেই মনে পড়বে বিশ্রবা ও কৈকেশীর মধ্যম পুত্রটির কথা। রামায়ণে সেই কুম্ভকর্ণের পরিচিতি মূলত রাবণের ভাই হিসেবেই সীমাবদ্ধ। মূল ধারায় কুম্ভকর্ণকে দেখানো হয়েছে পাহাড়ের মতো অবিশ্বাস্য বড়ো চেহারার এক বিকট রাক্ষস রূপে, যে কিনা মাসের পর মাস টানা ঘুমিয়ে থাকে। তারপরে যদি-বা সে ঘুম থেকে ওঠে তো, প্রচুর খাওয়াদাওয়া করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে! সে নিজে থেকে না-উঠলে, তার ঘুম ভাঙানো যায় না। এমনকি তার কানের কাছে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, শিঙা ফুঁকেও তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো অসম্ভব! কোনো-কোনো বর্ণনায় দেখা যায়, তার শয্যাকক্ষের সামনে রাজকীয় হাতিশালের হাতিরা এসে দাপাদাপি করলেও তার ঘুম ভাঙছে না! কোথাও আবার হাস্যরসের আমদানি করার জন্য দেখানো হয়েছে যে, কুম্ভকর্ণের পাহাড়প্রমাণ শরীরের উপরে উঠে লঙ্কার সৈনিকরা তার কানে-নাকে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে! কিন্তু যখন তার ঘুম ভাঙে, তখন সে এক সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে ওঠে। সেই কারণে তার নিদ্রাভঙ্গের সময় হয়ে এলে, তার শয্যার পাশে থরে-থরে খাবার প্রস্তুত রাখতে হয়। না-হলে কুম্ভকর্ণ নাকি তখন সামনে যাকে-যাকে পাবে, তাদের দিয়েই উদরপূর্তি করতে পারে! মহাকাব্যের চরিত্রের 'লার্জার দ্যান লাইফ' হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক, কিন্তু কুম্ভকর্ণকে প্রায় সীমাহীন করে দেখাতে গিয়ে কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেলার মতো একটা ব্যাপার হয়ে গেছে!
রামায়ণের আধুনিক ব্যাখ্যাতাদের অনেকেই অবশ্য এই ভুল করেননি। অন্যান্য চরিত্রের প্রেক্ষিতে কুম্ভকর্ণকেও সামঞ্জস্য রেখে যাঁরা দেখাতে চেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আনন্দ নীলকণ্ঠন ও কবিতা কানে দু'টি প্রধান নাম।
যদিও পাশাপাশি অমিত মজুমদারের মতো আধুনিক ব্যাখ্যাতাও আছেন, যিনি অলৌকিকত্বের উপর আস্থা রেখেই কুম্ভকর্ণ-সহ প্রতিটি চরিত্রকেই অতিজাগতিক আবরণে ঢেকে লিখেছেন। কিন্তু আমরা যেহেতু প্রথম থেকেই যুক্তিসঙ্গতভাবে মহাকাব্যিক চরিত্রগুলিকে বুঝতে চাইছি, তাই এঁদের ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা চর্বিতচর্বণ করবো না। নীলকণ্ঠনের বর্ণনা রাবণকেন্দ্রিক হলেও, সেখানে কুম্ভকর্ণের প্রসঙ্গ বহুবার বহুভাবে এসেছে। লেখক হিসেবে তিনি যেহেতু প্রথম থেকেই বাস্তবোচিত ও যুক্তিগ্রাহ্য বর্ণনাপদ্ধতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন, তাই নীলকণ্ঠনের দৃষ্টিতে কুম্ভকর্ণ অতিমানব বা অবমানব কেউ নন। বরং তাঁর লেখায় কুম্ভকর্ণ চিত্রিত হয়েছেন একজন শক্তিশালী ও সরলমনা অসুর হিসেবে; যিনি খুব কষ্টের শৈশব-কৈশোর পেরোনোর পরে, অগ্রজ রাবণের ক্ষমতাপ্রাপ্তির নিশ্চিন্ততায় ভোগবিলাসে গা-ভাসিয়ে দেওয়া এক যুবক। স্বাভাবিকভাবেই সেই বিলাসের হাত ধরে এসেছে অত্যধিক মদ্যপান ও আফিমসেবনের প্রবণতা, যা কুম্ভকর্ণকে অধিকাংশ সময়ে নেশাচ্ছন্ন ও নিশ্চেষ্ট করে রেখেছে। রামায়ণের অলৌকিক বর্ণনায় এই ধারাবাহিক নেশাচ্ছন্নতাকেই কুম্ভকর্ণের ছয়মাসব্যাপী ঘুম বলে চালানো হয়েছে। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনিই রাবণের প্রিয়তর, তাই তাঁর এইসব বদভ্যাসে বাধা দেওয়ার সাহস অন্য কারও ছিল না। এখানে অন্যদের বলতে, রাবণের মাতৃকুলের বড়দের বুঝতে হবে। এঁদের মধ্যে মাতামহ সুমালী ও তাঁর অগ্রজ মাল্যবান ছাড়াও মামা মারীচ ও আরেক সম্পর্কিত মাতুল প্রহস্তের ভূমিকাই মুখ্য হওয়ার কথা। এঁরা সকলেই রাবণের উপদেষ্টা, প্রহস্ত আবার তাঁর প্রধানমন্ত্রীও বটে। কিন্তু রাবণের অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে এঁরা কেউই কুম্ভকর্ণের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রায় রাশ টানার চেষ্টা করেননি, যদিও বিভিন্ন সময়ে রাবণের কাছে কুম্ভকর্ণকে নিয়ে নানারকম অভিযোগ-অনুযোগ পৌঁছে দিয়েছেন। কিছুটা নিজের ক্ষমতার উপরে অপার আস্থায়, আর অনেকটাই ভ্রাতৃস্নেহে অন্ধ থাকার কারণে রাবণ সেইসব অভিযোগকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। যদিও আধুনিক মননের বিশ্বস্ত ব্যাখ্যাতা হিসেবে নীলকণ্ঠন দেখিয়েছেন যে কীভাবে একটা সময়ে রাবণ নিজের এই ভুলের জন্য নিজের মনেই আক্ষেপ করেছেন। শুধু তাই নয়, রাবণের মনের গোপনে যথেষ্ট যুদ্ধকৌশলী ও শক্তিমান কুম্ভকর্ণকে নিয়ে কি এই ভয়ও ছিল যে, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে থাকলে ভবিষ্যতে একদিন তাঁর মধ্যম ভ্রাতাটি লঙ্কার সিংহাসনের জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন? তাই কি কুম্ভকর্ণকে নেশাচ্ছন্ন হয়ে থাকতে দিতে চেয়ে ভ্রাতৃস্নেহের আড়ালে রাবণের এই উদ্যোগহীনতা? নীলকণ্ঠন কিন্তু রাবণের স্বগতোক্তির মধ্যে দিয়েই এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন! এই প্রশ্নটি অত্যন্ত সঙ্গত ও জরুরি ছিল, কিন্তু আগে কোনো রচয়িতা বা ব্যাখ্যাতাই এর আশপাশ দিয়েও যাননি! উত্তর যাই হোক, প্রশ্নটি উঠে পড়ায় অন্তত একথা পরিষ্কার যে কুম্ভকর্ণ চরিত্রটি রামায়ণে শুধুই এক বিস্মৃত বিশ্বস্ত মধ্যম ভ্রাতা হিসেবে চিত্রিত হওয়ার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দাবি করে।
ব্যক্তি কুম্ভকর্ণকে নীলকন্ঠনের থেকেও বেশি যত্নে এঁকেছেন কবিতা কানে। তাঁর বর্ণনা শূর্পনখাকে কেন্দ্র করে এগোলেও সেখানে রাবণের মতোই কুম্ভকর্ণকে নিয়ে আলোচনা অনেক চিন্তার পরিসর খুলে দেয়। কানে অবশ্য নীলকন্ঠনের মতো সম্পূর্ণ বাস্তববাদী ব্যাখ্যাকার নন, জায়গায়-জায়গায় অলৌকিকের আশ্রয় ও স্বীকৃতি তাঁর ব্যাখ্যায় আছে। ঠিক সেই জন্যই কুম্ভকর্ণের ওই দীর্ঘ নিদ্রাভ্যাসের কারণের বর্ণনা তাঁর ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়। আলোচনায় আরও এগোনোর আগে সেই গল্পটি এখন আমরা আরেকবার দেখে নিতে পারি। আমরা জানি, ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর চেয়ে রাবণের দীর্ঘকালীন তপস্যার সময়ে তাঁর দুই ভাইও রাবণের সঙ্গী হয়েছিলেন, যদিও প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। কুম্ভকর্ণের কাম্য ছিল অক্ষয় শক্তি ও শৌর্যের বর এবং দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসন। বিভীষণের ছিল প্রকৃত জ্ঞানের সাধনা, যা কিনা তিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য নিয়োজিত করবেন! এই তপস্যার পরে রাবণের অমরত্ব না-পাওয়া, অথচ প্রায় অমর হওয়ার বর পাওয়ার ঘটনাটির বিশ্লেষণ এই লেখার সপ্তম পর্বে করা হয়ে গেছে। তার পুনরুল্লেখ এখানে অপ্রয়োজনীয়। তবে রাবণ তাঁর মনমতো সম্পূর্ণ বর না-পেলেও বিভীষণ নিজের ইচ্ছানুযায়ী বর পেলেন, এবং তিন ভাইয়ের মধ্যে বিভীষণই একমাত্র প্রার্থনা অনুযায়ী ঠিকঠাক বর পেলেন। কিন্তু অক্ষয় শক্তি-শৌর্যের বর চাওয়া কুম্ভকর্ণ কী পেলেন? ব্রহ্মা তাঁকে প্রশ্ন করলে, তিনি বলতে চেয়েছিলেন 'ইন্দ্রাসন', অথচ তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল 'নিদ্রাসন'! নিজের ভুল দ্রুত বুঝতে পেরে, তিনি আবার উচ্চারণ করতে চাইলেন 'নির্দেবত্বম', অর্থাৎ দেবতাদের বিনাশ----যা ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই ইন্দ্রের সিংহাসন আর থাকবে না; কিন্তু এবারে তিনি উচ্চারণ করলেন 'নিদ্রাবত্বম', অর্থাৎ নিশ্ছিদ্র ঘুম চাইলেন প্রপিতামহের কাছে। তিনি নিজে এবং রাবণও বুঝতে পেরেছিলেন যে এই উপুর্যুপরি গণ্ডগোলের পিছনে দেবতাদের হাত আছে। এই প্রসঙ্গটি কবিতা কানে তপস্যার পরে ফিরে এসে মা কৈকেশীকে বলা রাবণের বয়ানে অনবদ্যভাবে তুলে দিয়েছেন----'Later, I got to know that this was Indra's doing. He had beseeched Saraswati, the lady of knowledge, to make Kumbha utter the wrong words. That powerful Indra was so insecure about our Kumbha that he had to beg for Saraswati's intervention.' এই প্রসঙ্গে আরও জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হলো, উচ্চারণের মুহূর্তে বাগদেবী সরস্বতী এসে কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় (মতান্তরে, বাকযন্ত্রে) অধিষ্ঠান করলেন, এবং তাঁকে দিয়ে ভুল বর চাইয়ে দেবকুলকে রক্ষা করলেন। এই ব্যাখ্যা যতই অলৌকিক হোক না কেন, ঘটনাক্রম থেকে একথা পরিষ্কার যে রাবণের মতোই কুম্ভকর্ণও দেবতাদের কাছে ক্রমশই আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠছিলেন। অর্থাৎ তাঁর বীরত্ব ও গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয়ের কারণ নেই। অথচ রামায়ণের মূলধারা-অনুসারী কোনো ব্যাখ্যায় প্রাপ্য সেই গুরুত্ব কুম্ভকর্ণকে দেওয়া হয়নি।
স্বয়ং কুম্ভকর্ণের চরিত্রচিত্রণেরই যখন এমন দশা, তখন তাঁর স্ত্রী বজ্রমালা এবং দুই পুত্র কুম্ভ ও নিকুম্ভকে নিয়ে চর্চার খুব একটা সুযোগ যে থাকবে না, তা সহজবোধ্য। অথচ বজ্রমালা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বংশের মেয়ে, যারা পারিবারিক গরিমায় কম কিছু নয়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে রামায়ণের ব্যাখ্যাতাদের মধ্যে কারও বিশেষ মাথাব্যথা নেই। অথচ অলৌকিকে বিশ্বাস করলেও, শাপে পরিণত হওয়া যে-বরের দৌলতে কুম্ভকর্ণ বছরের অর্ধেক সময় নিদ্রামগ্ন থাকেন, তার স্ত্রী হিসেবে বজ্রমালার যাপন ঠিক কীরকম, তা নিয়ে ভাবনার অনেক অবকাশ ছিল। কুম্ভকর্ণের এই অবস্থা জানা সত্ত্বেও যে-মেয়েটি তাঁকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করলো, তার ঔদার্য ও ধৈর্য সম্পর্কে মুগ্ধ না-হয়ে উপায় থাকে না। অবশ্য রামায়ণের মূলধারা-অনুসারীরা তো রাম-লক্ষ্মণ তথা দেব-সংস্কৃতির মহিমা বর্ণনায় একনিষ্ঠ থাকলেও লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলার আত্মত্যাগকে যথাসম্ভব গুরুত্বহীন করে দেখিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, একজন অসুরকন্যার আত্মত্যাগ তাঁদের আর কতটা ভাবাতে পারে! একইভাবে কুম্ভ ও নিকুম্ভ সম্পর্কেও বিশেষ আলোচনার অবকাশ তাঁরা রাখেননি, শুধুমাত্র এইটুকু ছাড়া যে, যুবক-বয়সে পৌঁছে যথেষ্ট উন্নত যোদ্ধায় পরিণত এই দুই ভাই রাবণের জ্যেষ্ঠপুত্র মেঘনাদ তথা ইন্দ্রজিতের অধীনে লঙ্কাবাহিনীর বিভিন্ন সেনাদলের অন্যতম দুই নেতা হলেন, যাঁরা ওই রাম-লক্ষণ ও তাঁদের বানরসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হবেন।
কবিতা কানের ব্যাখ্যার বিশেষত্ব এইখানে যে, তিনি মহাকাব্যের জিজ্ঞাসু পাঠককে কুম্ভকর্ণের মনের ভিতরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কুম্ভকর্ণ সহজ-সরল ঠিকই, কিন্তু মূর্খ নন। তিনি রাবণ ও বিভীষণের মতো শাস্ত্রজ্ঞানী নন ঠিকই, কিন্তু জাগতিক ও মানবিক বিষয়ে যথেষ্ট গভীর চিন্তনের অধিকারী। তিনি রাবণ ও মেঘনাদের মতো সর্বশক্তিমান কিংবদন্তি যোদ্ধা নন ঠিকই, কিন্তু শৌর্য ও রণকৌশলে তিনি তাঁদের সমতুল্য।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, তিনি নিজের পরিবারের একান্ত অনুরাগী। তিনি প্রায়শই রাবণ ও বিভীষণের মধ্যে মতান্তরের সেতুবন্ধনকারী। তিনি প্রায়শই রাবণ ও শূর্পনখার মতো দুই চূড়ান্ত উগ্র চরিত্রের সংঘাতের মধ্যে শান্তিস্থাপক। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি রাবণের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সমালোচক, সবচেয়ে একনিষ্ঠ অনুগামী ও সবচেয়ে সৎ পরামর্শদাতা। তাঁর উপর রাবণের নির্ভরতা এতটাই যে, একাধিক ব্যাখ্যায় আমরা কুম্ভকর্ণকে রাবণের অল্টার ইগো হিসেবে স্বীকৃত হতে দেখি। মেঘনাদ যুবক হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত তিনিই রাবণের প্রত্যেকটি যুদ্ধাভিযানের কমান্ডার-ইন-চিফ। মা কৈকেশী ছাড়া একমাত্র কুম্ভকর্ণই রাবণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর কুখ্যাত ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম। বোন শূর্পনখার প্রতি তিনি রাবণের মতোই অত্যন্ত স্নেহশীল; কিন্তু তিনি রাবণের মতো শুধুই শূর্পনখার অভিভাবক নন, বরং বন্ধুও। একইভাবে তিনি শূর্পনখার প্রতিটি অন্যায় ও হিংসাত্মক কাজেরও তীব্র সমালোচক। এহেন গুরুত্বপূর্ণ একটি লোক যদি বছরে ছয়মাস নিদ্রাচ্ছন্ন থাকে, অথবা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যায় অধিকাংশ সময়ে নেশাভাঙে বুঁদ হয়ে থাকে, তাহলে কোনো রাজত্বের এবং পরিবারেরও নড়বড়ে হয়ে পড়ার কথা। লঙ্কার রাজ-পরিবারেও তাই হয়েছিল। সীতাহরণের মতো ন্যক্কারজনক কাণ্ড কুম্ভকর্ণের অগোচরেই হয়, তখন তিনি তাঁর একটি দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রায় মগ্ন। কিন্তু একের পর এক রথী-মহারথী যোদ্ধার মৃত্যুর কারণে রাবণ কুম্ভকর্ণকে জাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। মধ্যম ভ্রাতাটির উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস, সে একাই বানরসেনাদের ছারখার করে দিতে পারবে। কনিষ্ঠ বিভীষণ ততদিনে শত্রুশিবিরে যোগ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে কুম্ভকর্ণ উঠলেন, রাজসভায় এলেন, সমস্ত ঘটনা শুনলেন, এমন একটি কাজের জন্য রাবণের নিন্দা করলেন, সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে রাবণের ক্রোধের কারণ হলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে সম্মতও হলেন। কবিতা কানে চমৎকার ভাষায় কুম্ভকর্ণের বয়ানে তাঁর এই অবস্থান তুলে ধরেছেন----'I told him I shall obey him not just because he is my king, but also a brother. But as a friend, I cannot agree with what he is doing.' মনে রাখতে হবে, ততক্ষণে কুম্ভকর্ণ কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁর দুই সদ্যতরুণ পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে গেছেন! কিন্তু পুত্রশোক করার সময় তাঁর নেই। রাবণের প্রতি আনুগত্য ও লঙ্কার প্রতি কর্তব্যকে প্রাধান্য দিয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়াই তখন তাঁর প্রধান কাজ।
কুম্ভকর্ণ যখন যুদ্ধে যাবেন, তখন তিনিই প্রধান সেনাপতি। খুব দ্রুত তিনি এতদিন অসুরসেনার যুদ্ধকৌশলে কী ত্রুটি ছিল, তা বের করে ফেললেন। ঘোড়ায় টানা যুদ্ধরথ মূল ভূখণ্ডের সমতলভূমিতে যুদ্ধের ভালো মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু নরম ভিজে সাদা বালিতে ঢেকে থাকা লঙ্কার সমুদ্রসৈকতের পক্ষে উপযুক্ত নয়। কুম্ভকর্ণ বাহিনী সাজালেন পদাতিক সৈন্য ও যূথবদ্ধ রণহস্তীদের দিয়ে। পদাতিকদের অধিকাংশের হাতে তীর-ধনুক ও তরোয়ালের জায়গায় বর্শা দেওয়া হলো। তিনি নিজে সবচেয়ে বড়ো হাতিটির পিঠে থাকলেন, বাকিগুলির পিঠে অন্যান্য অভিজ্ঞ সৈনিকেরা। সম্পূর্ণ নতুন কৌশল নিয়ে অসুরসেনা অগ্রসর হলো। যাকে নীলকণ্ঠন বলেছেন, 'Kumbhakarna was taking the battle to the enemy camp.' কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীনই ভ্রাতুষ্পুত্র মেঘনাদের সঙ্গে রণকৌশল নিয়ে তাঁর মতভেদ চরমে উঠলো। মেঘনাদ তখন অশ্বারোহী, তাঁর কিছু অনুগামীদের নিয়ে হস্তিযূথের সহায়ক হিসেবে যুদ্ধে এসেছেন। কিন্তু তারুণ্যের অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে তিনি কুম্ভকর্ণের নির্দেশ অমান্য করে এগিয়ে যেতে গিয়ে বিপদে পড়লেন। লঙ্কাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের সুযোগে বানরসেনারা মেঘনাদকে মোটামুটি ঘিরে ফেললো। ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষা করতে কুম্ভকর্ণকে দ্রুত আসরে নামতে হলো। নীলকন্ঠন কুম্ভকর্ণের যুদ্ধের একটি অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন----'He smacked the Vanaras with his huge club, smashing their skulls and limbs before they could brandish their swords or aim their arrows. And so one man single-handedly held the mighty Vanara army on that narrow bridge.' এই সময় কুম্ভকর্ণ প্রায় একইসঙ্গে সুগ্রীব ও হনুমানের মুখোমুখি হলেন।সুগ্রীবকে তুমুল যুদ্ধের পরে ভয়ানক আহত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ঘুরে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই তিনি দেখলেন হনুমান মেঘনাদকে অসতর্ক অবস্থায় আক্রমণ করতে উদ্যত। তীব্র মল্লযুদ্ধের পরে হনুমানকে তুলে আছাড় মেরে অচৈতন্য করে দিয়ে যখন কুম্ভকর্ণ সবে লঙ্কাশিবিরে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন, ঠিক তখনই পিছন থেকে রামের নিশানা করা তীর উড়ে এসে তাঁর ঘাড় দিয়ে ঢুকে গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। নীলকন্ঠন লিখেছেন, 'Rama, an expert at shooting arrows at people from behind, had not missed this time either.' কুম্ভকর্ণ একজন যোদ্ধার যোগ্য মৃত্যু পেলেন না, রামের হাত আবার পিছন থেকে শত্রু হত্যায় কলঙ্কিত হলো। যুদ্ধের তখনও অনেক বাকি ছিল ঠিকই, কিন্তু কুম্ভকর্ণের মৃত্যু যেন যুদ্ধের ভবিতব্য তখনই লিখে দিল!
(ক্রমশ)
সুচিন্তিত মতামত দিন