তুষার কান্তি দত্ত

মেঘালয়
ব্রহ্মপুত্র
ধুবরী শহরের তিন দিক দিয়েই জল একদিকে গদাধর অন্য দুই প্রান্তে ব্রহ্মপুত্র।  সাত সকালে পাবলিক বাসে রওনা দিয়েছিলাম কোচবিহার থেকে। গৌরিপুর হয়ে যখন ধুবরী ঢুকলাম তখন ১০টা বাজে। বাসের কনডাকটরকে জিজ্ঞেসা করে ঘাটের দিকে পা বাড়ালাম। ব্রহ্মপুত্র নদী বরাবর সার সার ঘাট। কাছারিঘাট, যোগমায়াঘাট, মেলাগঘাট, সিড়িঘাট, কালিঘাট। একটার পর একটা। কাছারিঘাটে এসে জানতে পারলাম এখান থেকে জলেশ্বর, মাঝেরটারি, ফকিরগঞ্জের লঞ্চ ছাড়ে। কিন্তু আমরা তো যাবো ফুলবাড়ি। তাই আমাদের আবার টোটো তে উঠতে হলো আবার। ফুলবাড়ি যাবার লঞ্চ পাওয়া যায় পঞ্চুঘাট থেকে। সকাল থেকে কিচ্ছু খাওয়া হয় নি। ঘাটে নেমে অল্পকিছু খাবার আর জলের বোতল কিনে তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম লঞ্চে। টিকিট লঞ্চেই। ৫০জন লোক ভর্তি হলে তবেই ছাড়বে লঞ্চ। বসে আছি তো আছিই একজন মাঝি এসে এই ফাঁকেই দু’বার গুনতি করে গেলো মাথা। ১১টায় লঞ্চ ছাড়ল। পঞ্চুঘাট থেকে ফুলবাড়ির মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তার খুব বেশী। ২ঘন্টা সময় লাগে। লঞ্চের নীচের পাটাতনে বসে আছি একটা কাঠের খুটিতে হেলান দিয়ে। ভট ভট শব্দ করে স্টার্ট দেয় লঞ্চ। ফেলে যাচ্ছি শিবমন্দির, কাছারিঘাট, হাটখোলা... ধুবরী শহর। ঠান্ডা বাতাস আর উত্তাল জলরাশি। ইতি উতি জেগে আছে চর।   

কখনো পাশ কাটিয়ে যায় ভারতীয় সীমা সুরক্ষার স্পীডবোট। মানকাচরের কাছে ভারত বাংলাদেশের জলসীমা অনেকটাই। তাই অতন্দ্র পাহাড়ায় ভারতের সীমা সুরক্ষা বাহিনী। বসে আছি তো আছিই। অপেক্ষার ক্লান্ত সময় কিছুতেই এগোতে চায় না। কিছুটা এগিয়ে আবার লঞ্চের হাল ঘোরায় মাঝি। ব্রহ্মপুত্র এখানে অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত। আমাদের গন্তব্য দক্ষিণ-পূর্বে হলেও যেতে হচ্ছে ঘুর পথে। চরে চাষ হচ্ছে আলু, ধান, মুলো, ধঞ্চে। নদীপাড়ের ভাঙন ঠেকাতে পাড় থেকে নদী বরাবর বাঁশের খুটি পোতা হয়েছে। স্পারের মত করে দেশীয় পদ্ধতিতে। চর দখল নিয়ে ঝগড়া বিবাদ নিত্য সঙ্গি। চরের যতটা চোখ যায় উর্বর কৃষিক্ষত্র। প্রতিদিন লঞ্চ ভর্তি করে ধুবরী শহরে যায় মাছ, দুধ, শাকশব্জি। এত সমৃদ্ধি তবু রাত   আসতেই অন্ধকারে ঢুবে যায় চর। বিদ্যুৎ নেই, স্কুল নেই, নেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র। বর্ষাকালে দাঁতে দাঁত চেপে জল মাপে গ্রামবাসীরা। পাশ কাটিয়ে চলে যায় একটা মাছধরার নৌকা। ছবি তোলার জন্য লঞ্চের ছই এর উপর উঠে বসি। মধ্য দুপুরের কড়া রোদ গায়ে এসে পড়ে। একজন মাঝি এসে টাকা তোলে জন প্রতি ৪০টাকা করে। শক্ত নোঙরটা নৌকার একপাশে চকচক করে। মাঝি এসে ফেলে দেয় জলে। জলে জলে কখন যেন চলে এসেছি ফুলবাড়ি ঘাটে। একে একে সবাই উঠে পড়ে। দূরে দূরে দেখা যায় কালাচর আর মহেন্দ্রগঞ্জ। আবার ঘাট বন্দরের ব্যস্ততা......


ফুলবাড়ি ঘাটে নেমে বাজারে ফিরে একটা হোটেল নিয়েছিলাম বটে। কিন্তু থাকা হয় নি রাতে। বিকেলে ঘাটে গিয়ে কথা হয়ে গেল মাঝি ইদ্রিশের সাথে। রাতে ইদ্রিশের সাথেই নৈকা নিয়ে নদিতে ঘোরা আর চরে থাকা ফাইনাল। নৈকায় ওঠার আগে বাজার থেকে কিনে নিলাম চাল, তেল, মশলা, লবন, থালা গ্লাস, জলের বোতল, সব্জি আর মুরগির মাংস...।

দক্ষিণ শালমারা নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর অসম আর মেঘালয়ের মানচিত্রও বদলে দেয় ব্রহ্মপুত্র। সেদিন ফুলবাড়িতে আমাদের হোটেলের ম্যানেজার দাস বাবুর সাথে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। শালবাড়ির প্রচুর মানুষ রিফিউজি হয়ে চলে আসে মেঘালয়ের দক্ষিণে, গারো হিলসে। সালটা সম্ভবত ১৯৯১......। আচ্ছা ধরা যাক এই ভয়ঙ্কর বন্যায় আমার সব মূল্যবান কাগজ দলিল দস্তাবেজ, গুরুত্বপূর্ন নথি সব  হারিয়ে গেলে ব্রহ্মপুত্রের ঘূর্ণিপাকে। তাছাড়া, চরের তো কোন দলিল হয় না। চর তো নদীর। এ তো দখলিস্বত্ব।  নদীর ভাঙা গড়ার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের স্থানান্তর শুধু। ব্রহ্মপুত্রের এই নদীর চরে হাজার হাজার মানুষের বাস। সত্যিই   যদি আমার সব কিছু হারিয়ে যায়... NRC আইনে আমি কি তবে বিদেশী?  মনের কোনে কত চিন্তা ঘুরপাক খায় নিরন্তর। নৌকাতে উঠতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরি। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবেছে অনেক্ষন।

খুব সকালে ফেলে এসেছি জিঞ্জিরামকে। জিঞ্জিরাম আসলে ব্রহ্মপুত্রের’ই একটা ধারা। নদীর একপাশে ফুলবাড়ি ঘাট। অন্য দিকে বালাডোবা। বালাডোবা একটা চর। গতরাতে এই চরেই ছিলাম ইদ্রিশের বন্ধু পরমেশ্বরের বাড়িতে। ইদ্রিশের বাড়িতে জায়গা খুব কম। অনেক জনের সংসার। তাই ইদ্রিশের বন্ধু পরেমেশ্বরের বাড়িতেই এ যাত্রায় রাত্রিবাস। আমরা হিন্দু বলেও কোথায় যেন একটা সংকোচ কাজ করে ইদ্রিশের মনে। যে সংকোচ আমাদের সকলের মনে। জন্ম থেকেই সংস্কারের মত রক্তের অন্তর্গ, আসমুদ্র হিমাচলে এই বেভেদ রেখা কষ্ট দেয় অন্তরে ......


মাঝি ইদ্রিশের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়। সাত আট’টা বাচ্চা। আগের বউ মারা যাওয়ার পর এখন দ্বিতীয় বউ। খুব অভাবের সংসার। সারাদিনে মাছ ধরে গরে ৩০০টাকা আয়। এই দিয়ে কি দশ জনের চলে? ছোট ছেলে ফয়জল খাঁ, বাপের সাথেই মাছ ধরে। ছেলেটার পড়াশুনাও লাটে। ১৯৯১এর নদী ভাঙনে একবার ভিটেমাটি চলে যায় নদীগর্ভে। তারপর হয় উদ্বাস্তু। নদী ভাঙন আর উদ্বাস্তু সমস্য ব্রহ্মপুত্রের নিত্য সঙ্গী। এর পর বালাডোবাতে অল্প অল্প করে পলি জমে ... চর পরে। চরের নরম মাটিতে আবার বাসা বাঁধে ইদ্রিশ। বাসা বাঁধলে কি হবে? ইদ্রিশের ভেতরে যে বাসা বেঁধেছে অন্য কিছু। কিছুদিন থকেই অজানা জ্বর বয়ে নিয়ে চলেছে। হাত কাঁপে। কলিজায় নাকি খুব ঠান্ডা লাগে। শীত শীত করে ...। চর গুলিতে মশাও খুব। কে জানে কি রোগ! সেদিন ভোরে আমাদের যখন ফুলবাড়ি ঘাটে পৌঁছে দিয়ে গেলো তখনো গায়ে জড়ানো অনেকগুলো জামা। চোখ বন্ধ করলেই ইদ্রিশের মুখটা দেখতে পাই! চোখ দুটো কোটরে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মলিন হাসি। ফ্যাকাশে মুখে ছল ছল চোখে শেষবারের মত তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। অস্ফুট কোন শব্দ পান্ডুলিপির মত ভেসে যায় ব্রহ্মপুত্রের ঘুর্নিস্রোতে। ডাক্তার দেখানো আর ব্লাড টেস্ট করার জন্য সামান্য কিছু টাকা এগিয়ে দেয় ধীরাজ। ইতস্তত করে কাঁপ কাঁপা হাতে। বন্ধুত্বের সেই হাত ...
যে হাত খুঁজে ফিরি ভারতের কিনারে কিনারে।
মাঠে ঘাটে গ্রামে গ্রামান্তরে।

স্লো বাট স্টেডি 
ভেটুল, জারুল, কুল, বন কলমি, গোবরা, ফুলঝাড়ু, ছোট বাঁশ, কলা, ছাতিম, অশ্বত্থ, মেহগিনি, কৃষ্ণচূড়া, কদম, জাম, লেবু সেগুনের জঙ্গল চিরে পথ দক্ষিণ পূর্বে। তুরা থেকে বাঘমারার দিকে পথ। এত নিবিড় সুপারির গাছ আগে কোথাও দেখি নি।

রাস্তার বাঁক পার করতেই কোন এক আদিম বৃদ্ধ গাছের কঙ্কাল এলোমেলো হাত তুলে জানান দেয় গারো পাহাড়ের প্রাচীনত্ব। ফুলবাড়ি থেকে চরণতলা, হলদিবাড়ি হয়ে এখন তুরার পথে....


আর থেকে থেকেই কাজুর বাগান। দক্ষিণ পশ্চিম মেঘালয়ের এই অঞ্চলটাতে এত কাজুগাছ আছে, না দেখলে বিশ্বাস’ই হত না। মালভূমির ঢালে ঢালে কাজুর বাগান। গাছে গাছে যখন কাজু ধরে তখন স্থানীয় অধিবাসীরা কাঁচা কাজু বিক্রি করে দেয়। ফুলবাড়ি থেকে মহাজন আসে কাজু কিনতে। কাঁচা কাজু কেজি প্রতি ১২০-১৫০টাকায় কিনে নেয়। তারপর কাজু গুলিকে ফুলবাড়িতে নিয়ে যায় ট্রাক ভর্তি করে। ফুলবাড়ি ঘাটের উপরেই তিন তিনটা কাজু তৈরিরি কারখানা। প্রথমে কাজুগুলিকে গরম বাস্পে সেদ্ধ করা হয়। তারপর একটা হস্তচালিত যন্ত্রে খোসা থকে সুন্দর করে কাজুর ভেতরের বীজটাকে আলাদা করা হয়। তারপর হালকা আঁচে সাদা সাদা কজু গুলিকে ট্রের উপরে বিছিয়ে ২৪ ঘন্টার জন্য সেঁকা হয়। তারপর প্যাকেজিং। প্যাকেজিং করা কাজু এখানে কিলো প্রতি ৯০০টাকা। কাজু ফ্যাক্টারির একজন কর্মী আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালেন। ফুলবাড়ি থেকে রাস্তা সোজা পূর্বদিকে। ঢিমেতালে উপরে উঠছি। রাস্তা এতটাই খারাপ যে, পেছনের সিটে বসে থাকাই দায়। সমতল সবুজ কৃষি জমির মাঝে জেগে থাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত খয়প্রপ্ত টিলা। ঝাঁকি খেতে খেতে কখন যেন পৌঁছে গেছি তুরা তে।
tarai.tushar@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.