নজরুল ইসলাম তোফা

নজরুল ইসলাম তোফা
প্রত্যেকটি গ্রাম এবং শহর এক অদৃশ্য দাগেই যেন বিভাজিত। হিন্দু আর মুসলিম।একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামির উন্মেষ অন্যদিকে নিজ জন্মভূমিতে আত্মমর্যাদার সহিত জীবনযাপনের যুদ্ধ। 'ইসলাম' প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এই বাসনায় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বা পরিস্থিতি প্রায় এক দশক ধরেই  চলছে এ বাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এদেশে যারা বাস করেন তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাঁদের দোষটা কোথায়? সংখ্যা তত্ত্বের বিচারে তারা গৌণ বলেই কি তারা শুধুই  'সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়। তাইকি তারা নির্যাতিত, তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।

সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ঠিক কোন অর্থে একটি রাষ্ট্রে আইনত প্রতিষ্ঠিত অনেকেরই জানা নেই।  জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনের সর্ব বৃহৎ এক আলোচনায় অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৪৭/১৩৫ সিদ্ধান্ত মোতাবেক জাতিসংঘে গৃহীত হয়, সংখ্যালঘু ঘোষণা পত্রের ধারা ১ অনুযায়ী জাতিগত ভাবেই  নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের সংখ্যালঘু হিসেবে ধরা হয়েছে।

এই সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ বা তাদের মানবাধিকার সুরক্ষা সংক্রান্তের জন্য জাতিসংঘের উপকমিশনের একটি বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কো ক্যাপোটোর্টি ১৯৭৭ সালেই সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিল- সংখ্যালঘু বলতে সেই সম্প্রদায়কেই বোঝায় -  যারা সংখ্যাতাত্বিক দিক দিয়েই একটি রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র জনসংখ্যা, আর নাকি ন্যূনতম আধিপত্য এবং অবস্থানও আছে, আর যারাই জাতিগত ভাবে এমন একটি নৃতাত্বিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা বৃহৎ জনসাধারণের কাছেই পার্থক্য নির্দেশ করে।

সারা বিশ্বের সকল দেশে জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত এমন এই "সংখ্যালঘু" সম্প্রদায়ের বসবাসের মাধ্যমেই সমাজকে নান্দনিক বৈচিত্র্যময়ও করেছে। এ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিচিত্র পরিস্থিতিতে বসবাস করলেও তারা সাধারণ ভাবেই প্রায়শ বহুবিধ বৈষম্যের শিকার বা তারা নির্যাতনের কবলে পড়ছে। তাদেরকে 'প্রান্তিক অবস্থান' থেকেও একবারে সমাজের বাহিরে ঠেলে দিচ্ছে। লিখতে বা পড়তে কম জানা জাতিরা সীমাহীন নির্যাতন কিংবা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। তারা নিজ দেশেও বাস করে অনাহূত পরবাসীর মতো জীবনযাপন করছে। অথচ এরাই সারাবিশ্বের মানব পরিবারের অংশীদার এবং তারা নিজ নিজ দেশ গঠনে, দেশের উন্নয়নে কিংবা সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশে তাদের বহু অবদান রেখেছে। বাংলাদেশেও এই জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ও দেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা ও কার্যক্রম রেখেছে।

কিন্তু বহু পরিসংখ্যানে আবার উঠে এসেছে তাহলো সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন, উৎপীড়ন কিংবা নানান প্রকার অমানবিক অত্যাচারেই তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এই অবস্থাতেই এমন সংখ্যালঘু জনগণকে সংহতি বা তাদের অধিকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা 'সকল জাতির' কাম্য হওয়া উচিত। হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষদের  উদ্দেশ্য করেই যেন গুনীব্যক্তিরা বলেছেন 'সংখ্যালঘু' শব্দটিতে কষ্ট পাবেন না, তা ভুলে যান। যে দেশে আমরা-আপনারা জন্মগ্রহণ করছি , যে দেশের আলো-বাতাস গ্রহণ করে আমরা বড় হয়েছি, সে দেশে আবার সংখ্যালঘু বা  সংখ্যাগরিষ্ট কি? জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ। সুতরাং সংখ্যালঘু নয়।

আমাদের এমন হীনমন্যতা সামনে চলার পথকে কিংবা বাংলাদেশের উন্নয়কেই আদতে বাধাগ্রস্থ করে। খুব পরিকল্পিতভাবে এখন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে। যারা এই অসামাজিক কাজে লিপ্ত তারা জানেন না আসলে জাতিসংঘের মৌলিক নীতি। জাতি সংঘের মৌলিক নীতিতে বলা হয়েছে, জাতি, বর্ণ, ভাষা-লিঙ্গ লঘুত্বের কারণে কারোর প্রতি বৈষম্য মুলক আচরণ কখনোই করা যাবে না। তাই বলতেই হয় এমন মানবাধিকারের মূল স্তম্ভ এবং সংখ্যালঘুর আইনগত সুরক্ষার মূলমন্ত্র বৈষম্যহীনতা বা সমতার নীতি, যা কিনা সকল সংখ্যা লঘু জাতির জন্যই যেন আন্তর্জাতিক চুক্তির ভিত্তিতে সবাই একমত হয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা এবং জাতি নির্বিশেষে সবার জন্যে মানবাধিকার বা স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান সহ বৈষম্যকেও নিষিদ্ধ করা আছে। এই বৈষম্য হীনতা কিংবা সমতার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমেই সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহনে কার্যকর অংশগ্রহণসহ সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ২৭ ধারা এবং আন্তর্জাতিক শিশুসনদের ৩০ ধারায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার কথাও বলা হয়েছে। তবে আবার জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু অধিকার বিষয়ক- "জাতিসংঘের ঘোষণা পত্রে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংক্রান্ত কিছু মানদন্ড নির্ণয় করেছে। যা সংশিষ্ট রাষ্ট্রকেই যেন সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং পদক্ষেপ গ্রহনের 'গাইডলাইন প্রদান' করেছে। সর্বোপরি 'আন্তর্জাতিক চুক্তি সমূহের অধীনে' প্রদত্ত রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা এবং প্রতিনিধি জাতিসংঘের মানবাধিকার মনিটরিং দল এই কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তাদের অধিকার বা সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বা তারা সমাজের অন্য বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর মতোই যেন জীবন যাপন করতে পারে এমন কথাটিও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।


জানা দরকার আসলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কারা। বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪৫ টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার দুটি পৃথক ভৌগলক পরিবেশেই তাদের বসবাস। এ দুটি  ভৌগলিক পরিবেশের মধ্যে একটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি), আর একটি উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা সমূহ। এদের মধ্যেই মধুপুরের গড়াঞ্চল বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। এ দেশের সংখ্যালঘুরাই হচ্ছে:- গারো, খিয়াং, ম্রো, বন, চাকমা, চাক, পাংখু, লুসাই, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, তঞ্চঙ্গা, খাশিয়া, মণি পুরি, সাঁওতাল, রুজুয়াড়, মন্ডা পাহাড়িয়া, আসাম(অহমিয়া), মুসহর, সমাহাসী, সিং, বেদিয়া, মুরিয়ার, কর্মকার, মাহাতো, উঁরাও, খারিয়া,পাহান, কোচ, কাজবশী, হাজং, ডালু, ক্ষত্রিয়, গোর্সা, কন্দিকোল, চমনি, তুরি, পাত্র, রাই, মালো, ঘুনী, খন্ড, বানই, রাজবংশী। এই গুলোই এ দেশের 'সংখ্যালঘু' জাতি, এবং  সাংবিধানিক স্বীকৃতি। তাদের সঠিক জীবন যাপনের অধিকারও এই 'বাংলার জমিনে' প্রয়োজন রয়েছে। ভূমি কিংবা অরন্যের উপর অধিকার, নিজস্ব সম্পদ অর্থাৎ ধন সম্পদের উপর অধিকার তাঁদের রয়েছে। কিন্তু এই অধিকারে তাঁরা কতটা সস্তি বোধ করেন প্রশ্ন থেকেই যায়।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান জাতিগোষ্ঠীরও মানুষ প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এদেশের ধর্মীয় বেড়াজাল ও জাতিগতভাবে তাদের সংখ্যালঘু মনে করেই যেন নির্যাতিত হচ্ছে একথা অনস্বীকার্য।

বিশ্ব জুড়ে নির্যাতন বন্ধ সহ অন্যান্য অমানবিক নিষ্ঠুরতা এবং মর্যাদাহানিকর আচরণ ও শাস্তির বিরূদ্ধেই ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের এক আলোচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই তা কার্যকর করে। কিন্তু এমন সিধান্ত বাংলাদেশে  সফল ভাবে কার্যকর হলে 'সংখ্যালঘু দের  উপর নির্যাতন করবার খুব একটা সাহস  হতো না।

পরিশেষে, মানবাধিকার মঞ্চ বা  জাতিসঙ্ঘের সিধান্তে যদি সংখ্যালঘুদেরকে নিয়েই উন্নয়নের ভাবনার সৃষ্টি হয় বা নাগরিক জীবনের প্রতিটি স্তরে অন্তর্ভূক্তি করে সকল স্তরের মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারা যায়, সমস্যা কোথায়? সংখ্যালঘু মানুষদের নির্যাতন, তাঁদের সম্পত্তি গ্রাস করা থেকে বিরত হয়ে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির বাংলা গড়ার ভাবনা বা মুক্ত চিন্তা করতে পারলেই -  বাংলাদেশের জনগণ একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার ভিত্তিক উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে বা দেখাতে পারবে সমগ্র বিশ্বকে ।

যে স্বপ্ন নিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আমার সোনার বাংলা ...


নজরুল ইসলাম তোফা,
টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক। বাংলাদেশ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.