তপশ্রী পাল

চোরাবালি
আর্যর বাড়িতে দুপুরবেলা কেউ থাকে না । আর্যর বাবা মারা গেছে । ওর মা গভর্নমেন্টের অফিসে ক্লার্ক । ছোট বোন আত্রেয়ী ক্লাস টেনে পড়ে । দিনের বেলা স্কুলে। দেবার্ক, অভি, রেয়াংশ, শ্রেয়া, চুমকি সবাইকে সকালেই ফোনে ডেকেছে আর্য। এরা কেউ ক্লাস টেন,কেউ হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছে অথবা কলেজের ফার্স্ট ইয়ার । এক কথায় স্কুল কলেজ পালিয়ে সবাই বেলা বারোটার মধ্যে আর্যর বাড়িতে হাজির । পড়াশুনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক কম, বাড়ির সঙ্গেও তাই । কয়েকজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের, আবার দু একজনের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো । কিন্তু সবার চেহারা হাবভাব একই রকম । ছেলেদের মাথার চুল চারিদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি, মাঝখানের চুল বিরাট বড় । তাতে নানা রঙ লাগানো । হাতে রঙিন ব্যান্ড । মুখে এক দুদিনের না কামানো দাড়ি । পরণে আগের দিন থেকে পরা টি-শার্ট, ট্রাকপ্যান্ট । ঘুম থেকে ওঠে বেলায় । স্নানের বালাই নেই । হাতে স্মার্ট মোবাইল । ইয়ারফোন দুই কানে গোঁজা । 

মেয়েদের চুল কপাল ঢেকে একদিকে ঝোলানো । ছেলেদের চোখে আকর্ষনীয় হবার অসীম চেষ্টা । টাইট টি-শার্টের ওপর দিয়ে উত্তুঙ্গ বক্ষস্থল প্রদর্শনে ত্রুটি নেই । আর্যর বাড়ির মৌতাতের লোভে জড়ো হয় এরা । সিগারেট, বিড়ি টানে চেন স্মোকারের মতো । কিন্তু আজ স্পেশালি আর্য ডেকেছে ওদের হুক্কা পার্টি করবে বলে । ছোট ছোট হুক্কায় তামাকের সঙ্গে নানা জিনিস – যেমন গাঞ্জা, চরস ইত্যাদি ভরে টানে ওরা, কখনো আবার আরো নানা নেশা । এর মধ্যে দেবার্ক আর অভির অবস্থা ভালো । দেবার্কর বাইক আছে, অভির স্কুটি । ওরাই অন্যদের তুলে এনেছে ।

আর্য বলল “ভাই এসে গেছিস তোরা? বোস ঘরে । দাঁড়া, পর্দাগুলো টেনে দি । শালা পাড়ার সব ফুটোস্কোপ মারে ।“

শ্রেয়া বলল “একটু তাড়াতাড়ি করিস তোরা । আমার আবার পাঁচটার মধ্যে সেই বেহালা ফিরতেই হবে ! নইলে মা টিউশন ক্লাসে ফোন করে বসবে !”

“ধুর তোদের যত – সখও আচে – লজ্জাও আচে” ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসে অভি !

একটা অদ্ভুত চেহারার ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে আর্য । তার মধ্যে থেকে বেরোয় নানা সাইজের ছোট ছোট কটা হুকো । সঙ্গে প্লাস্টিকের পাউচে নানারকম গুঁড়ো ! একটা কৌটোর মধ্যে গাঁজা গাছের লতা পাতা বীজ । ছোট কাঁচি, পাতলা কাগজ । আর ডেন্ড্রাইটের টিউব । কিছুক্ষণের মধ্যে নারকীয় ধোঁয়ায় ভরে ওঠে ঘর ! আধশোয়া বুঁদ হয়ে নেশা করে চলে ওরা । 

চুমকি বলে “রেয়াংশ – চল একটা সেলফি নিই তোর আর আমার !” রেয়াংশ কাছে টেনে নেয় চুমকিকে – দুজনে পাউট করে ক্লোস শটে সেলফি তোলে । তারপর কিস করে একে অপরকে । চুমকি উঠে বসে রেয়াংশের কোলে । সবাই চোখ মটকায় ! রেয়াংশ বলে “কি রে – হবে নাকি?” চুমকি বলে “অ্যাঁ! না না, থাক”

এমন সময় অভির ফোন বেজে ওঠে । ধরে না অভি । বারবার বাজতে থাকে ফোন । একবার বাধ্য হয়ে তোলে অভি । “হেলো ! মা? হ্যাঁ বলো ? আমি এক বন্ধুর বাড়ি । অ্যাঁ ? কেন? বাঃ আজকে স্কুল ছুটি হয়ে গেলো তো একজন টিচার মারা গেছেন বলে – হ্যাঁ হ্যাঁ চলে আসছি – এই দশ মিনিটে !” ফোন কেটে দেয় অভি ।

“ভাই তুই গুল মারতে একেবারে গুল গুলশন গুলফাম ! সালা কি দিলি মাইরি মাকে !” বলে আর্য । সবাই হাসতে থাকে । অভির বাড়ি একেবারে অন্যরকম । অবস্থা ভাল । বাবা মা দুজনেই উচ্চশিক্ষিত । ভাল চাকরী করেন । অভি এক ছেলে ওর বাবা মায়ের । সব সময় ওকে সন্ধান করেন ওর মা । কিন্তু অভি কারো কথা শোনার পাত্র নয় । ও জেনে গেছে এই মা ওর আসল মা নয় । ও দত্তক পুত্র । হয়তো কোন ভাগাড়ে পড়ে থাকা অনাথ ছেলে বা বেশ্যার সন্তান । নিজেকেই ঘেন্না লাগে নিজের ।

আরো ঘন্টা দুই নেশা করে সবাই ওঠে আত্রেয়ী ফিরে আসার আগে । অভির স্কুটারে ওঠে দুজন মেয়ে । নেশা হলে দেবার্ক আবার বাইক চালাতে পারে না । অভি এখন একজনকে যাদবপুরে, একজনকে বেহালায় ছেড়ে দেবে, তারপর বাড়ি ফিরবে । ও নেশা করেও স্টেডি থাকে ।

আর্য বলে “টা টা, সামনের দিন বাংলা মদের পার্টি হবে – বলবো তোদের – ট্যাঁকে কড়ি নিয়ে আসবি – আজকের দামও মেটাবি ! নইলে আর মাল পাবি না !”


আজ শনিবার। এমনিতেই কলেজ ছুটি। বেলা দশটার আগে ওঠে না অভি। কিন্তু নটা থেকেই অভির ফোন বেজেই চলল। প্রথম কয়েকবার শুনতেই পেলো না অভি। তারপর দু চারবার হাতের থাপ্পড়ে বন্ধ করে দিল ফোন। দশটার সময় মায়ের ধাক্কায় ঘুম ভাঙল অভির। “কিরে আর কত ঘুমোবি ? রাত জেগে মোবাইলে বকবক করবি, নইলে অনলাইন গেম খেলবি, নয় ভিডিও দেখবি – তো হবেনা? পড়াশুনার তো বালাইনেই – বলেও লাভ নেই – ভস্মে ঘি ঢালছি আমরা “ “আঃ সকাল সকাল মাথাটা গরম করে দিওনা তো !” উঠে দাঁড়ায় অভি। তারপর বাথরুম ঘুরে এসে চায়ে চুমুক দিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। দশটা মিসড কল !! কে করলো এতো কল ! প্রায় তিন চারজন বন্ধু ফোন করেছে। রেয়াংশকে কল ব্যাক করতেই কারণটা বুঝতে পারলো অভি। ফ্যাকাশে গলায় রেয়াংশ বলল “অভি তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি ! এতোবার কল করলাম – কাল রাতে দেবার্ক – দেবার্ক সুইসাড করেছে !” “ক্কি !!” প্রায় খাবি খায় অভি। দেবার্ক ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কই এরকম কিছু তো – ভাবতেই পারেনা অভি। বলে “কখন হল ? তোরা কি করে জানলি !” “কালরাতে – টাইম বলতে পারবো না। আজ সকালে শুনলাম। ওর মা ওকে ডাকতে গিয়ে দ্যাখে – তারপর পুলিশ এসেছে। আমরা সব ওর বাড়িতে। বডি পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছে ! তুই আয় শীগগিরি–“

অভি আর ব্রেকফাস্ট খেলো না । কোনরকমে একটা টি-শার্ট গলিয়ে স্কুটি নিয়ে দেবার্কর বাড়ির দিকে চলল । গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে বেশ ভীড় । পাড়া প্রতিবেশীর উঁকিঝুকি । পুলিশ রয়েছে ঘরে । ওর মার সঙ্গে কথা বলছে । বাইরের বারান্দায় বন্ধুরা কজন দাঁড়িয়েছিল । রেয়াংশকে দেখে অভি বলল “আমি পুরো ঘেঁটে গেছি – কি ব্যাপার বল তো ভাই – পরশুই তো কথা হল আমার সঙ্গে – তখন তো –“ । হঠাত এক আধবুড়ো ভদ্রলোক– বোধহয় ওদের পাড়ার – বলে উঠলো “তা – তোমরা কি ওর বন্ধু নাকি ?” “হ্যাঁ” বলল অভি “আপনারা জানেন কিছু – কি করে এমন –“ “না না – ও আমি লোকের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না – তবে পরশু রাতে খুব চেঁচামেচি শুনে জানালা ফাঁক করে দেখি দেবুর সঙ্গে ওর বাবার হেভি ফাইট চলছে – শুনছিলাম ইদানীং নেশা করার অভ্যাস হয়েছিল – তাই ওর বাবা বোধহয় রিহ্যাবে পাঠানোর কথা বলেছিল । তাতে ছেলে বাপকে টিউবলাইট খুলে মারতে গেছে – সেই নিয়েই চেঁচামেচি মনে হল ! ঘেন্না ঘেন্না – আমি আর শুনি নি তারপর । তা সেজন্য জীবন দিয়ে বসতে হবে? বাপ তো ভালোর জন্যই –ঘোর কলি !!“

অভি আর ওর বন্ধুরা মুখ তাকাতাকি করে । রেয়াংশ বলে “দেবার্কটা কিছু লুকোতেও পারতো না বাড়িতে – সবকিছু বাড়িতে শেয়ার করলে এই হয় ! কিন্তু তা বলে সুইসাইড – নাহ, ব্যাপারটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না । রিহ্যাবের ভয়ে সুইসাইড করার ছেলে ও ছিল না -” 

অভি মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলে “- জানি না রে –আর্য বোধহয় আমাদের ওপরে চেপে বসছে – এর পর নেশা থেকে না বেরোতে পারলে – মাঝে মাঝে বেশ ভয় করে ! মধু জানলে -”
“মধু কে? ও – তোর সেই গার্লফ্রেন্ড ! অভি তুই এসবের মধ্যে এসছিস কেন বুঝি না মাইরী – অত বড় বাড়ি গাড়ি অবস্থা তোদের – অত লাভিং পেরেন্টস – আর তুই – ফিরে যা মাইরী – আমাদের মতো হাঘরেদের আর কিছু নেই – তাই এইসব আঁকড়ে পড়ে আছি ।“

“ধুর তুই বুঝবি না – আমার জ্বালা – এ আমার রক্তের জ্বালা “ বলে বাঁকা হাসে অভি । ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রেয়াংশ ।

কিন্তু দেবার্কের ব্যাপারটা কি হল ? সুইসাইড করার ছেলে তো নয় ।

ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দেবার্কর বোন দেবমিতা । খুব গুডি গুডি গার্ল । ও এদের সঙ্গে কথাও বলে না অন্য সময় । ফিরেও তাকায় না । কনভেন্টে পড়া টিপিক্যাল মেয়ে । এখন মুখ লাল চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে । দেবমিতার ডাক নাম গুড্ডি । অভি বলল “অ্যাই গুড্ডি, শোন !” “কি বলবে তাড়াতাড়ি বল । আমার ভালো লাগছে না ।“ গম্ভীর ভাবে বলে দেবমিতা । “দেবার্কর কি হয়েছিল রে ?” করুণ শোনায় অভির গলা । “দাদার মৃত্যুর জন্য দীপশিখাই দায়ী !” হিসহিস করে বলে ওঠে দেবমিতা । “ধূর ! কি যে বলিস – ওদের তো স্টেডি রিলেশন ছিল !” “দীপশিখা দাদাকে ডিচ করেছিল ! এতোদিনের রিলেশন ! দাদা নিতে পারে নি !” চাপা স্বরে বলে ওঠে দেবমিতা । “তা বলে সুইসাইড ! একটা মেয়ের জন্য ! পুলিশকে বলেছিস?” “ধূর ! পুলিশ কি করবে? দাদাটা একটা বোকা ছিল !” হঠাত কেঁদে ফেলে দেবমিতা । আস্তে আস্তে সরে যায় অভি । মাত্র সতেরো বছর বয়স ছিল দেবার্কর ! অভির চেয়ে এক বছরের ছোট । এবার ক্লাস টুয়েল্ভে উঠেছিল । মনটা একেবারে দমে গেছে । স্কুটিতে করে বাড়ি ফিরে এলো অভি। 


বাড়ি ফিরে অভি দেখে মা বাড়িতে রয়েছে। অভি আস্তে করে বলে “অফিসে যাওনি?” “না আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না।“ “উঃ তুমি বাড়িতে থাকলেই – হাজার প্রশ্ন করবে – নাঃ আমি বেরিয়ে যাই আবার –“ কেমন রসহীণ স্বরে বলে অভি। মানসী আজকাল কিছুই আর এক্সপেক্ট করে না ছেলের কাছ থেকে।এখন আস্তে আস্তে বলল “সকালে অত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গেলি না খেয়ে?” মুখ নীচু করে মোবাইলে হাত বোলাতে থাকে অভি। খানিক চুপ করে থেকে বলে “দেবার্ক – আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল – আজ সুইসাইড করেছে। ওর বাড়ি গেছিলাম।“

আঁতকে ওঠেন মানসী “কি বলছিস ! কেন !” অভি চুপ। “কিরে কিছু বল ! আমার তো ভয় লাগে এসব শুনে – এইটুকু বয়েস – “ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অভি বলে “ও তুমি বুঝবে না – গার্লফ্রেন্ড ডিচ করেছিল। ও খুব সিরিয়াস ছিল রিলেশন নিয়ে।“ মানসী হতভম্ব হয়ে যান। তারপর আস্তে আস্তে অভির গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন “তোর কি মনে হয় এটা রিলেশন তৈরী করার বয়েস? ও কি পড়তো?” “ক্লাস টুয়েলভ !” “মানে স্কুল থেকেই বেরোয়নি ! আর সিরিয়াস রিলেশন তৈরী করে ফেলল ! আজকের দিনে দাঁড়াতে, একটা ভাল কাজ পেতে, রোজগার করতে কত কষ্ট সে ধারণা আছে? এই বয়েসে – জীবনটা কি ছিনিমিনি খেলার?”

মায়ের হাতের স্পর্শে কত শান্তি ! হঠাত মনে হল অভির। মায়ের চুড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে টানতে লাগলো অভি। মধুর কথা মা জানেনা। বলল “জানো মা, দীপশিখা তিন বছরের বড় ছিল দেবার্কর থেকে। ওরা বিয়ে করবে ঠিক করেছিল।“

হেসে ফেলল মানসী ! “বিয়ে ! এই বয়েসে ! সত্যি তোরা যে কি ছেলেমানুষ ! আর যে মেয়ে এতোদিন মেশার পর একটা বাচ্চার মন নিয়ে খেলার পর ডিচ করে তার জন্য কেউ জীবন দেয় ! স্রেফ ভুলে যেতে হয়। ওর জীবনটাই গেলো। আর কারো কি কিছু হল?” 

হঠাত অভীর মনে হল মা বোধহয় ঠিকই বলছে। আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ফিরে যায় অভি। কেমন খিচড়ে আছে মনটা ! নাঃ, এবার মায়ের কথা শুনবে। হঠাত বেজে উঠলো ফোনটা। মধু’র ফোন । এখন একশো প্রশ্ন শুরু হবে মধু’র । উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না অভির । ধরবেনা ভেবেও ধরলো অভি । “হ্যালো” “সকাল থেকে ছিলে কোথায়?” “কোথায় আবার? বাড়িতে“ এড়িয়ে গেলো অভি । “উঁহু, অত সহজ নয় আমাকে বোকা বানানো, জানি দেবার্কর কথা । নিশ্চই ওখানে গেছিলে –“ “তবে তো জানোই, আর জিজ্ঞাসা করে বোর কোরোনা ।“ “জানো, আমাকে দীপশিখা বলল” “কি !” খুব অবাক লাগে অভির । দীপশিখাকে পূজা চিনলো কি করে ! দীপশিখাকে অভি কয়েকবার দেখেছে দেবার্কর সঙ্গে, ঐ পর্যন্ত । মেয়েরা কি গোয়েন্দা হয় নাকি ! “আরে, দীপশিখাদি আমাদের পাড়ায় থাকে । আমার দিদির বন্ধু । তুমি জানতে না বুঝি? আজ এসেছিল আমাদের বাড়ি দিদির কাছে । খুব আপসেট হয়ে আছে ।“ “একটা ছেলেকে ডিচ করে আবার আপসেট ! মারা উচিৎ এইসব মেয়েদের !” নীরস গলায় বলে অভি । “তুমি ওকে জানোনা ! তাই বলছো । দীপশিখা প্রেগন্যান্ট – তুমি জানো !” ।

আকাশ থেকে পড়লেও এতো আশ্চর্য হতো না অভি ! অনেক কষ্টে বলল “কি করে !” “ওরা দেবার্কর বাইকে লং ড্রাইভে গেছিল ডায়মন্ড হারবার । কোন প্ল্যান ছিল না, কিন্তু নদীর ধারে খুব ভীড় দেখে ওরা একটা ঘর নেয় দিনের বেলার মত । ইচ্ছে ছিল রোদ পড়লে বিকেলে বেরিয়ে নদীর ধারে ঘুরে ফিরে আসবে । তারপর – তারপর যা হয় ! দেবার্ক ছেলেমানুষ আর দীপশিখাও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নি ।“ “সাহস আছে বলতে হবে দীপশিখার !” বলে অভি । “না রে দীপশিখা বলল ও মূহূর্তের জন্য কিরকম হয়ে গেছিল । সব প্রোটেকশন ছিল, কিন্তু তাও – অ্যাকসিডেন্ট !” “তারপর?” “তারপর আর কি – দীপশিখার শরীর খারাপ হয়ে যায় – চেকআপে ধরা পড়ে । দীপশিখার বাবা ওর মোবাইল থেকে শুরু করে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে । ওর কলেজে যাওয়া বারণ । ওর সঙ্গে কারো কথা বলা বারণ । সেদিন অনেক কষ্টে ওর মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিল । দিদির সঙ্গে কথা বলেই চলে গেলো । দীপশিখার বাবা ওর অ্যাবরশনের ব্যাবস্থা করেছে ! ওর বাবার সামনেই ওকে দেবার্ককে ফোনে করে বলতে হয়েছে যে ওর অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । ও আর দেবার্কর সাথে কোনভাবেই দেখা করতে বা কথা বলতে পারবে না । ও ওকে আর ভালোবাসে না ।“

নির্বাক হয়ে শোনে অভি ! মধু’র বলা হয়ে গেলেও উত্তরে কিছু বলতে ভুলে যায় । বুকের মধ্যেটা কেমন করে ! মধু অন্য দিক থেকে “হ্যালো হ্যালো” বলে চলে । অনেকক্ষণ পর চটক ভেঙে অভি বলে “শুনে কেমন পাগল পাগল লাগছে রে – পরে আবার তোর সঙ্গে কথা বলছি ।“ ফোন রেখে শুয়ে পড়ে অভি । কখন ঘুমিয়ে পড়ে । স্বপ্ন দেখে ও সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেছে বন্ধুদের সাথে । হঠাত চোরাবালিতে পা ঢুকে গেলো ওদের ! একে একে বন্ধুরা তলিয়ে যেতে লাগলো ! ওর দেহ বুক পর্যন্ত মাটিতে বসে গেছে ! ও প্রাণপণ চিৎকার করছে ! এমন সময় কে এসে ওর হাত ধরলো ! নরম হাত – কার হাত এটা ? মধু ? না – এতো মায়ের হাত! মা ওকে কিছুতেই ডুবতে দিচ্ছে না ! মায়ের হাত চেপে ধরলো অভি ! “আরে এই ছেলে – অবেলায় ঘুমোচ্ছিস কেন? আরে ! আমার হাত চেপে ধরলি কেন – লাগছে, ছাড় !” হঠাত ঘুমটা ভেঙে গেল অভির । মায়ের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন পর হাসল অভি। সেই ছোটবেলার মতো । গন্ধ শুঁকতে লাগলো মায়ের। বলল “আজ থেকে আর কোথাও বেরোবো না । শুধু বাড়িতে । তুমি বলো তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে –“ “ধূর পাগল – আমার তো অফিস আছে –“ “উঁহু, অফিসে যাবে না তুমি । সেই ছোটবেলা থেকে আমি একা ! কত খুজেছি তোমায় স্কুল থেকে এসে, যখন ভালো লাগতো না – তখন কেউ আমার মাথায় এমন হাত বুলিয়ে দেয় নি । শুধু আয়া মাসী থাকতো ! তাই তো আমি বন্ধুদের সাথে গল্প করতাম ফোনে, বেরিয়ে যেতাম বাড়ি থেকে । ক্লাস নাইন টেন থেকে আরো একা লাগত – ফ্রাস্ট্রেশনে জাহান্নমে চলে যাচ্ছিলাম মা !” কেমন কঠিন গলায় বলে অভি । ওর গলায় এমন কিছু ছিল যে ফ্যাকাশে হয়ে যায় মানসীর মুখ । দূরের দিকে তাকিয়ে বলে “নিজের কাজ ছেড়ে দেওয়া যে কত কষ্টের – বেশ, তোর জন্য তাও ছাড়বো আমি – কিন্তু তুই ফিরে আসবি তো?” “উঃ খুব খিদে পেয়ে গেছে ! আলুর চপ আনো না মা ! আমি তো আছিই ! এক্ষুনি খাবো !“ মানসীর সব প্রশ্ন চাপা দিয়ে হালকা গলায় বলে ওঠে অভি ।


তপশ্রী পাল । জি ই ১৯ রাজডাঙ্গা মেন রোড । কলকাতা – ৭০০১০৭ । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.