সঞ্জীব সিনহা

আমি কী পাবো
সন্ধ্যে আটটার সময় দীর্ঘ সত্তর কিলোমিটার বাইক বাস ট্রেন অটো লঞ্চ টোটো সব কিছু চেপে অফিস থেকে ফিরে শ্রান্ত ক্লান্ত দীপঙ্কর ঘরে ঢুকে পিঠ থেকে ব্যাকস্যাকটা নামিয়ে সোফায় বসলো। এটা দীপঙ্করের রোজনামচা সেই সকাল পৌনে সাতোটায় দুধ কর্ণফ্লেক্স খেয়ে তাদের উত্তর কলকাতার বাসা থেকে বেরিয়ে হুগলী জেলার এক প্রান্তিক গ্রামের ব্যাঙ্কে যখন পৌঁছায় তখন ঘড়িতে দশটা বাজবো বাজবো করছে। এই ভাবেই চলছে, সকাল সাতোটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটায় শ্রান্ত শরীরে বাড়ি ফেরা। যেদিন কাজের শেষে হিসাব মেলাতে দেরী হয় বা ট্রেন বাস মিস করে বা ট্রেনে গণ্ডগোল থাকে সেদিন তো বাড়ি পৌঁছাতে আরও দেরী হয়ে যায়। বাবা ফেরার সময় হলে দরজায় বেল বাজলেই ছেলে কুশল ছুটে এসে দরজা খুলে দেয়, বাবা বসলে বাবার মাথায় পিঠে একটু হাত বুলিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে। বাবা কখন ব্যাগের ভেতরে তার জন্যে কি এনেছে বার করবে তার অপেক্ষায় থাকে। বাড়ি ফেরবার সময় দীপঙ্কর রোজই ছেলের জন্যে ছানার জিলিপি বা রসগোল্লা, নয়তো ভেজিটেবল চপ, নিদেন পক্ষে বাদামভাজা কিছু না কিছু নিয়ে আসে। বাবা আজ তার জন্যে ব্যাগ থেকে কিছুই বার করল না দেখে কুশল আস্তে আস্তে পড়ার ঘরে চলে গেল। রান্নাঘর থেকে তানিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, - দীপু , কী হয়েছে তোমার শরীর খারাপ? অফিস থেকে এসে মুখ হাত না ধুয়ে গুম হয়ে বসে আছ। 

“না, কিছু হয়নি” বলে দীপঙ্কর বাথরুমে চলে গেল।

দীপঙ্কর স্নান করে ফ্রেস হয়ে সোফায় এসে বসলে তানিয়া দু কাপ চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে তার পাশে বসে টিভিটা চালিয়ে দিল। দীপঙ্কর রিমোটটা নিয়ে টিভি বন্ধ করে চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। তানিয়া তাকে এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল, এবার তার কপালে আর গালে হাতের চেটোটা ঠেকিয়ে দেখল তার দীপুর জ্বরটর কিছু হয়েছে কিনা। যা গরম পড়েছে তার ওপর এই খটাখাটনি। কিগো কী হয়েছে, কি বিড়বিড় করে বলছ,-“আমি কি পাবো”, সে আবার কি? বলো নাগো কি হয়েছে? 

দীপঙ্কর চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিয়ে বলল, - ও কিছু না।

-বল না কি হয়েছে, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, তা না হলে তুমি এই রকম চুপচাপ গুম হয়ে বসে আছ, আপন মনে কি ভাবছ আর বলছ “আমি কি পাব”। তোমার কি চাই বল আমি দেব। 

দীপঙ্কর এবার একটু হেসে বলল, - আরে আমার কিছু চাই না। এই দেখ না ভোটের আগে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের লোন আর অনুদানের টাকা আসছে। ভোটের আগেই সেই টাকা বিলি করতে হবে। লোন অনুদানের খবর পেয়ে অনেকেই দরখাস্ত করেছে। সরকারের এই সব প্রকল্পের টাকা কারা পাবার যোগ্য তার তো কিছু নিয়ম কানুন মানে ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি তো আর ওখানকার লোকদের চিনি না তা কে পাওয়ার উপযুক্ত কে নয় আমি জানব কি করে। ওখানকার দাপুটে নেতা রামানুজবাবুই আজ ব্যাঙ্কে এসে সমস্যার সমাধান করে দিলেন। উনি একটা লিস্ট বানিয়ে এনে বললেন, “ওহে ব্যাঙ্কবাবু সরকারের এবারের লোন অনুদানের টাকা যেন আমার এই লোকগুলো পায় দেখবেন।“

উনি যে লিস্ট বানিয়েছেন তার মধ্যে থেকে আমি কয়েক জনকে চিনি যারা বেশ স্বচ্ছল আর সবাই ওনার দলের পেটোয়া লোক। এর মধ্যে আবার দুজন খগেন রামদাস আর লতিফ সেখ আগের “স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রক্লপের” টাকা নিয়ে শোধ করেনি। লোনের টাকা শোধের ব্যাপারে কথা বলতে আমি একবার গিয়েও ছিলাম খগেন আর লতিফের বাড়ি। দুজনকারই একই গ্রাম মহেশপুরে বাড়ি। অনেক খোঁজ করে ওদের সন্ধান পেলাম। প্রথমে খগেন রামদাসের বাড়ি গেলাম, ও জুতোর ব্যবসার জন্য লোন নিয়েছিল। ওর টালির ঘরের সামনে একটা ভাঙ্গা বোর্ড ঝুলছে তাতে লেখা “পদশ্রী - প্রসিদ্ধ জুতো বিক্রেতা”। আমার পরিচয় দেওয়াতে খগেনবাবু একটু থতমত খেয়ে আমাকে বসতে বললেন। আমি বললাম, “খগেনবাবু, আপনার জুতোর দোকানটা একটু দেখাবেন? 

- ছ্যার, আমার বাড়িতেই আমার দোকান।

- তা দোকানে জুতো কোথায়?

খগেন আমাকে খাটিয়ায় বসিয়ে ঘরের ভিতর গেল, মিনিট পাঁচেক পর ধুলো মুছতে মুছতে এক পাটি করে দুটো শুকনো খটখটে চটি এনে আমার সামনে ধরে বলল, - এই দেখুন।
- আর সব জুতো কোথায়?

- ছ্যার, এবারের বন্যার জলে সব ভেসে গেছে। ভাববেন না ছ্যার, আবার লোন নিয়ে আমি সব শোধ করে দেব। 

আমার যা বোঝার বুঝে ওখান থেকে আমি লতিফ সেখের বাড়ি গেলাম। লতিফ স্টীল ফার্নিচার ম্যানুফ্যাকচারিং এর জন্য লোন নিয়েছিল। বাড়ীর সামনেই একটা চালা ঘর, সেখানে লেখা আছে “আনোয়ারা ইসটিল ফারনিচার”। আমি ডাকতে ঘর থেকে বছর বাইশের একটা ছেলে বেরিয়ে এল। আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, - ভাই একটু লতিফবাবুকে ডেকে দেবে। 

সে একটু ভেবে বলল, - আব্বা বাড়িতে নেই।

- তোমাদের কারখানাটা একটু দেখাবে?

- গতবারের বন্যায় সব ভেসে গেছে।

- শীট কাটার, ওয়েল্ডিং মেসিন, স্টীলের পাত, পাইপ, সব ভেসে গেছে?

- হ্যাঁ জী।

- তোমাদের তৈরী স্টীলের ফার্নিচার কি কি আছে একটু দেখাও।

- বললাম তো সব ভেসে গেছে।

এবার ঘরের কোনে বহু পুরানো মরচে পরা দুটো স্টীলের চেয়ার দেখিয়ে বলল, - দেখুন, এই দুটোকে কোন রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।

ওখান থেকে বেরিয়ে গ্রামের ধারে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম, দোকানদার আমাকে চিনতে পেরে বলল, - ব্যাঙ্কবাবু আপনি এখানে?

আমার আসার কারণ শুনে একটু হেঁসে বলল, - এখানে আবার বন্যা হল কবে, সে তো বছর সাতেক আগে একবার একটু বন্যার পানি ঢুকেছিল, তা সেও ঘন্টা খানেক পরে নেমে গিয়েছিল। আর খগেন তো জুতো সেলাই করে ওর আবার জুতোর দোকান কবে হল। গাঁয়ের কেউ অর্ডার দিলে অবশ্য পায়ের মাপ নিয়ে জুতো বানিয়ে দেয়। আর ওপাড়ার লতিফ সেখের ইস্টিল ফারনিচারের দোকান আছে বলে কখনো শুনিনি। ওতো ছাগল কেনাবেচার ব্যবসা করে বলেই জানি।

তানিয়া এতক্ষণ আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল, এবার বলে উঠল, - সে যাই হোক, “আমি কী পাব” বলে তুমি বিড়বিড় করে কি বলছিলে, কেন বলছিলে সেটা তো বললে না। আর শোন অফিসের কথা অফিসেই রেখে এসো, বাড়ি এসে অফিসের কথা চিন্তা করবে না, বুঝলে? 

- ও, ওটা তো তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি। আজ রামানুজবাবু ওনার লোকেদের লোন অনুদান পাইয়ে দেবার জন্য লিস্ট দিয়ে চলে যাবার সময় বলে গেলেন, - দেখবেন আমার লোকেরা যেন সবাই লোনের টাকা পায়। আর হ্যাঁ, ওরা তো পাবে, আর এই কাজের জন্যে “আমি কী পাব”, সেটাও ঠিক করে আমার কাছে পৌঁছে দেবেন। 

ssanjibkumar@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.