জয়তী রায়

হাবা কুমারের জীবন যাত্রা --৪
শরৎঋতু যেন সবার থেকে আলাদা। এই যে নীল আকাশ, বাতাসে শিউলিসুবাস , নদীর ধারে কাশেরবনের মাথা দোলানো, ভোরে হিমের স্নিগ্ধ পরশ, সেই সঙ্গে পূজো পূজো গন্ধ-- বর্ষা কালের বাঘিনী নদীটিও এখন কেমন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা আলহাদী মেয়েটির মতো কুলু কুলু করে। 

হাবা একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ঘর যেন ডাকছে হঠাৎ করে ? আশ্রমে দুর্গাপূজা হয়না। কিন্তু গাঁয়ে হচ্ছে পূজো, বাজছে ঢাক। কেমন আছে মা? ফুলি? নতুন দাদা এলো নাকি কলকাতা থেকে? এসে খোঁজ করছেন উজ্জ্বল কুমারের?মনে করেই হেসে ফেললো, কি রকম ছেলে মানুষের মতো ছিল সে! যাত্রার আসর, বড় বড় আলো, লোক জন -- কি সব ভাবতো! এখন, এই কয় মাসে সে যেন বয়সের চাইতে বড়ো হয়ে গেছে। 

আপন মনে হেসে ঘাসের ডগা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাবছিল হাবা। বন্যার ঘটনার পরে গাঁয়ে তার বেশ নাম ডাক হয়েছে। হাবা অবিশ্যি নিজেই অবাক হয়ে যায়, ওই সময় ওমন বুদ্ধি বা সাহস তাকে জোগালো কে? তবে মানুষজন এখন বয়স নয়, তার দিকেই সম্ভ্রমের চোখে তাকায়। এমনকি দামোদর গোঁসাই ও বেশ ভরসা করেন। ভাবতে ভাবতে দামোদর এসে বসে। সহাস্যে বলে, 

--’ এত সকালে বসে বসে কি ভাবো ছোট ঠাকুর?’

---’ বসুন বসুন। কিছু নয়। মালতী ফুল নিয়ে আসেনি এখনো, আমি তাই একটু ... বসুন।’ 

--’ ভালো ভালো। আসলে তোমার সঙ্গে ইসকনের লোক জন নিয়ে একটু কথা বলতাম গো।’ 

দামদরকে তার বেশ ভালো লাগছে। মানুষটি বাইরে কর্কশ সন্দেহ নেই। কাজ পাগল। কাজের জন্য মানুষজনের পিছনে লেগে থাকেন। সকাল সন্ধ্যা ওতো হরি হরি করা দামোদরের ধাতে নেই। সোজা কথা মুখের ওপর বলে দেন। নিতাই ঠাকুরের সঙ্গে বনে না মূলতঃ আশ্রমের পরিচালনা নিয়ে। দামোদর চায়, একটু জাঁক জমক থাক, লোক জন আসুক। সে কর্ম যোগে বিশ্বাস করে। বানের জল নেমে গেল যেই, পলি মাটিতে দ্বিগুন ফসল ফলানোর দায়িত্বে মেতে উঠলো দামোদর। 

মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ তার। বলে--

’ ছোট ঠাকুর। ইসকনের বিদেশিরা আসতে চান। দান দক্ষিনা দিতে চায়। একবার ভাবো, আজ যদি বড়ো অসুখ হয়, বিপদ হয়, কোথায় যাবে সব? মদনমোহনের সেবা আটকাবে না এ বিশ্বাস আমারও আছে। কিন্তু সঞ্চয় বাড়ানো দরকার। ‘

---’ সে কথাটা ঠিক গোঁসাই।’

--’তবে? আমার কথা উনি মানতেই চান না। দেখো, ছোট ঠাকুর। জীবন তত্ত্বকথা নয়। সে যুগের কথা এখন ধরলি চলবে? যখন কিনা ভগবান বিপদে নেমে আসতেন? আর সত্যি বলতি কি, আমার কথা হলো, কৃষ্ণ বুদ্ধি শক্তি সব দিয়েচেন কেন? আমরা যাতে নিজের কাজ নিজেই করে নিতি পারি, বলো কিনা ছোট ঠাকুর?’ 

বলে উৎসুক চোখে তার দিয়ে তাকায় দামোদর। রোগা, দোহারা চেহারা, শক্ত পোক্ত ,বয়সের ছাপ বোঝা যায় না। মুখে বলিরেখা আছে, তবে চোখ দুটি প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। 

---’ বড় ঠাকুর কৃষ্ণগত প্রাণ। আপনার বিষয়ের কথা ওনার মাথায় ঢুকবে না। তবে আপনি বলেছেন ঠিক ই।’ সমর্থন সূচক মাথা নেড়ে বলে হাবা। 

---’ আরে ছাড়ো কৃষ্ণ গত প্রাণ! তুমি চুপ যাও ছোট ঠাকুর। কথায় বলে, সর্ব জীবে কৃষ্ণ দেখো। ওনার বুঝি সেই ভাব? থাকো না আশ্রমে। সব টের পাবে!’ 

মনে মনে শিহরিত হয় হাবা। তদগত চিত্ত, মুদিত চোখের নিতাই ঠাকুরকে মনে পড়ে তার। দামোদর ঠিক কি চাইছে? তাকে হাত করে ,নিতাই ঠাকুরের বিরুদ্ধে নিজের মতলব শক্তিশালী করবে? বিদেশী ভক্ত ঢুকিয়ে দেবে মন্দিরে? মনে পড়লো নিতাই ঠাকুরের কথা--’ দেখো বাবারা, ভক্ত ভক্তই। তার দেশি বিদেশি হয়না। কৃষ্ণ কারো সম্পত্তি নয়। কিন্তু এখানে এই মাটির ঘরে, পদাবলির সুরে আছে বড়ো শান্তি। ওনারা এসে এর চেয়ে বেশি কি দেবেন , একবার ভাবো তো? দুবেলা প্রসাদ জুটছে আমাদের, আর কি চাই?’
কিন্তু দামদরের কথায় যেন অন্য আরো কিছু ইঙ্গিত আছে। শুধু বৈষয়িক নয়, তার থেকেও ভয়ঙ্কর কোনো কথা যেন সে বলতে চায় নিতাই ঠাকুরের ব্যাপারে। তার মন কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। এ কোথায় এসে পড়লো সে? তার বয়েস চোদ্দ কি পনেরো, সে কথাও কি এনারা ভুলে যাচ্ছেন? একলা বসে ,মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিল হাবা। তাকে অনেক শিখতে হবে। জ্ঞান যদি না জ্বলে অন্তরে, তবে মানুষকে হাবা হয়েই বাঁচতে হয়। দেখা যাক কতখানি শেখাতে পারে এই আশ্রম তাকে, নাহলে ছেড়ে যেতে কতক্ষন? 

মুখে বললো--’ আমি বয়েসে অনেক ছোট। কি ই বা বুঝি বলুন গোঁসাই?’

---’ বয়েসে ছোট তুমি সন্দেহ নেই। তবু তুমি পারবে। অনেক দূর যাবে। এই আমি বলে রাখলুম।’ 

কথার মোড় অন্যদিকে নেবার জন্য হাবা বলে--’ এলাকায় শ্মশান কোথায় গো গোঁসাই? ‘

---’ সে কি? শ্মশান মশান দিয়ে কি কাজ কৃষ্ণ ভক্তের?’ 

--’ আমি কি একবারও নিজেকে কৃষ্ণভক্ত বলেছি? আমি কি বলেছি আমি বৈষ্ণব?’ চাপা কঠিন স্বরে হাবা বলে। 

হতবাক দামোদর ম্রিয়মান স্বরে বলে--’ বলতে হবে কেন? এই তিলক, এই সংকীর্তন ,নিতাই ঠাকুরের পায়ে পায়ে ঘোরা, এ সব থেকেই বোঝা যায় তুমি কৃষ্ণের মহাভক্ত।’ 

তীক্ষ্ণ ঠোঁটে নিজের অজান্তেই এক ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে । শিহরিত দামোদর শোনে এক অন্যরকম অচেনা কণ্ঠস্বরে ছোটঠাকুর বলছে----

‘ মানুষ চিনতে ভুল করছেন গোঁসাই। যাক ছাড়ুন। শ্মশান কোথায় আছে বললেন না?’

----’ গ্রামের শেষ প্রান্তে। ওখানে অঘোরী সাধকের আড্ডা। নর মাংস খায়। নানা রকম ব্যভিচার করে সাবধান।’

*

জীবন তার বড়ো গোলমেলে এ কথা মালতী ছোট থেকেই জানে। গোলমাল গুলো কে সে মেনে নেওয়া অথবা না নেওয়ার মধ্যে দিয়ে দেখে দেখে ,জীবনকে একটা জায়গায় এনে ফেলেছিলো বলা যায়। তার মা রোগে পড়বার আগে , আশ্রমের ফুলের জোগাড় দিত, হঠাৎ কি এক জ্বর বাঁধলো, আর সে জ্বর সারে না। তার সঙ্গে মুখে অরুচি, মেজাজ গরম, ভাগ্যিস বড় ঠাকুর ফুলের কাজ তাকে ধরে দিলেন! কিন্তু এখন ওই গোলমেলে জীবনের মাঝে আরো একটা নতুন উপসর্গ হাজির হয়ে তাকে ভারি ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে ডাহুক ডাকে। শুন্য লাগে। মাঠপাড়ের হু হু হাওয়া বয়ে যায় বুকের ভিতর। অকারণ জল আসে চোখে। এমন তো ছিল না সে! 

‘ ও মালু ও মালু কোথায় গেলি ? মুখপুড়ি! ভোর সকালে সাজতে বসলি নাকি রে?’ চিল চিৎকার ভেসে এলো ঘরের থেকে। মা! রোগে পড়ার পর থেকে মালতী চোখের আড়াল হলেই চিৎকার জুড়বে! ঘরের মধ্যে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো সে --,’

-- সারাদিন আমি সাজি? তাহলে এই রাজ্যের কাজ কে করবে শুনি? তোমার রাধামাধব?’ 

প্রায় অন্ধকার কুটিরের মলিন বিছানায় মা জড়ো সড়ো হয়ে বসে আছে। বয়স বেশি না , কিন্তু এর মধ্যে চুল সাদা, বুড়িয়ে গেছে, কেমন কাতর চোখে তাকিয়ে বললে--’ চা দিলি না তো এখনো?’ 

--’ মা , দেব চা। ওই তো উনুনে কাঠ দিয়ে এলাম গো। পুজোর সময় ফুল বেশি লাগে। সেই ভোর থেকে জোগাড়ে লেগেছি। তুমি আমার সাজ দেখলে?’ 

--’ মালু । আমার কাছে আয়। কতদিন কাছে বসিস নি বলতো! সারাদিন খাটিস। সদা জ্যাঠার বাগানের ফুল তো কম পড়েনা? ওখান থেকেই তো আশ্রমে ফুল দিতাম আমি।’ মা কেমন উদাস হলেন। 

চায়ের গেলাস হাতে মায়ের কাছ ঘেঁষটে বসলো মালতী। রোগে পড়লেও মা নিজেই খুব পরিষ্কার থাকে। আর কেমন এক মিষ্টি চন্দনের গন্ধ পায় মায়ের গায়ে।

‘ মা তোর কণ্ঠী বদল হয়েছিল না? সে গেল কোথায়?’ আলহাদ করে মা কে তুই সম্বোধন করলো সে। 

--’ কতবার এক কথা বলবি মালু?’ মৃদু ধমক দিয়ে মেয়ের টোপা কুলের মতো মুখখানি নাড়িয়ে বললো--’ এবার তুই বিয়ে করে ঘাড় থেকে নাম দিকি। বয়স কতো হলো খেয়াল আছে?’ 

--’ বাপ চলে গেল কেন মা?’দূরে ঢাকের আওয়াজ, সোনা ঝরা শরতের মিষ্টি আলো, সব ছাপিয়ে কেমন করুণ শোনালো মালতীর গলা। মেয়েকে কাছে টেনে মা বললো--

--’ সে ইচ্ছে করে যায়নি মালু। যেতে বাধ্য হয়েছিল। অগাধ ভালোবাসতো এই মালিনীকে তোর বাপ। যে যা খুশি বলুক। আমি তাকে বিশ্বাস করি। তোর বাপকে ভুল বুঝিস না। এই গাঁ থেকে দু কোশ দূরে ছিল মোর বাপের ঘর। বাপ টাও মোর ফুলের যোগানদার ছিল। সেখানেই এলো সে। বলবো একদিন সব মালু। তুই নিশ্চিত থাক।’

মালতীর অবাক চোখের সামনে রুগী মা কেমন রাধিকার মতো প্রেমময়ী হয়ে উঠতে লাগলো। বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে সে প্রশ্ন করে--

--’ এখনো এত ভালোবাসিস?’

---’ পাগলি। ভালোবাসা মরে নাকি রে? পিরিতি শুধু তারাই জানে, যে তাতে মজেছে রে মালু।’ 

ভালোবাসার গঙ্গাজলে ধোয়া শিউলি ফুলের মতো মায়ের মুখখানি দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে মালতী---

‘ রাধা কৃষ্ণের চাইতে বয়সে কতো বড় ছিল গো মা?’ 

*

জপ ধ্যানের উপকারিতা বোঝাচ্ছিলেন নিতাই ঠাকুর---’ মণি বিহীন সাপ যেমন দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়ে , তেমনি আমরাও পরমাত্মার সাথে বিচ্ছেদের ফলে অনাথ শিশুর মতো ভীত সংকুচিত হয়ে পড়েছি, সব সময়ই মনে হয়, আমাদের জীবন থেকে কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে। সেই হারানো জিনিসটিকেই জপের দ্বারা আহ্বান জানানো হয়। বেড়ালের বাচ্চারা এদিক ওদিক চলে গেলে ,ডাক শুনে ঠিক চলে আসে। কোনো শিশু হারিয়ে গেলে ,তার খোঁজ পাবার জন্য তার নাম ঠিকানা বিবরণ সহ ঘোষণা করা হয়। ঈশ্বরের নাম জপ ও ঠিক এই উদ্দেশ্যে করা হয়।’ 

সন্ধ্যা আরতি শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। পুজোর পরে হাওয়াতে ঠান্ডা ভাব, সেই সঙ্গে মশার কামড়। দামোদর ফিস ফিস করে বললো--

‘ ছোট ঠাকুর। সামনের মাসে ইসকনের সাহেব ভক্ত আসবে আবার। তুমি একটু কথা বলে দেখো তো!’ 

হাবা উত্তর দিলো না। নিতাই ঠাকুরের কথা তার ভালো লাগছিলো। এই জগৎ এই জ্ঞান তার অজানা। সে শিখতে চায়। গভীর মনোযোগে সে শুনলো ---

--” ভগবান মানে আলো। অজ্ঞানতার অন্ধকারে পথভ্রষ্ট জীবের অবস্থা শোচনীয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ মাৎসর্য মিলে সে অসহায়। জপের মাধ্যমে বারবার ভগবানের নাম স্মরণ ,পতনের গহ্বর থেকে হাত ধরে ওপরে উঠবার জন্যই করা হয়।

ঈশ্বরের নাম জপ করার বিষয়ে চাটুকারিতায় তাঁর মন ভোলানো এবং কৃত্রিম পূজা আচ্চার কোনো দাম নেই। জামা কাপড় ঘর বাড়িতে যেমন ময়লা জমে তাকে পরিষ্কার করতে হয়, তেমনি মনের মলিনতাকে ধুয়ে ফেলতে প্রতিদিন উপাসনার দরকার হয়। ঈশ্বরকে নিজেদের অন্তকরণে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নামের আশ্রয় নিতে হয়। নাম জপের আধারেই যে কোনো সত্তার বোধ ও স্মরণ করা যায়।’ 

কথা থেমে গেলেও রেশ বাজতে থাকলো ছোট ঠাকুরের কানে। হ্যারিকেনের আলো প্রায় নিভু নিভু। বাইরে আঁধার ঝুঁকে রয়েছে , মন্দিরের সামনে। রাতের প্রসাদের জোগাড় চলছে ,কথা শেষ হলে, দলটির মধ্যে মৃদু চাঞ্চল্য চোখে পড়ছে। মৃদঙ্গ, খোল, করতাল গুছিয়ে রাখার টুং টাং শব্দ, চাটাই গোটানোর খস খস আওয়াজ-- ছোটঠাকুর প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল মদনমোহন কে দেখছিলো এক মনে। সত্যি কি তেমন ভাবে ডাকলে পাথরের ঠাকুর জাগ্রত হয়? বিশ্বাস হয়না আবার অ বিশ্বাস করতে মন চায়না। তবে কত কিছুই তো জানে না সে এখনো। জানতে চায়। জানার ক্ষুধা বেড়ে চলেছে ক্রমশই। 

joyeelove@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.