রত্নদীপা দে ঘোষ

জাগো, তুমি জাগো ////
এতো বছর ধরে আকাশপথে বাড়ি আসা-যাওয়া তবু মেঘভ্রমণের ভয়খানি গ্যালো না। সারাটা পথ একটু ভয় ভয় যেন লেগেই থাকে , সামান্য ধুকপুক... দেবী চোখ বন্ধ করলেন, প্লেন মাটি থেকে শেষ পা উঠিয়ে নিচ্ছে... সামান্য ঝাঁকুনি। সিটবেল্ট আছে শক্তটাইট কোমরে, সেই জন্যেই কি একটু ব্যথার বাতাস ...

উইন্ডো সিটটের কানকো সরিয়ে বাইরে তাকালেন দেবী। এমন অতলস্পর্শী মেঘ, মেঘের জলাধার। সতত সুন্দর। ঠিক পাশের সিটেই লক্ষ্মী আর সরস্বতী। আকাশে উড়েই স্বরস্বতী বই খুলে বসে যায় ... বই থেকে কিছুতেই চোখ তোলে না। লক্ষ্মী অবশ্য তেমনটি নয়। ভারি চঞ্চলা। দুষ্টুমতি। কানে হেডফোন। সানগ্লাসে ঝিকমিক ধ্রুবতারা ...

না, একটুও শান্তিতে বস্তে পারছেন না দেবি। কোমর পেঁচিয়ে ব্যথা শুরু। চেনা ব্যাথা। তলপেটের থেকে ঘন হয়ে উঠে আসছে। কিন্তু এখন তো পিরিয়ডের ডেট ও নয় ... রেডি হয়ে আসেননি তিনি ... আবার মোচড় ... টের পেলেন দেবী ... সে আসছে... ঠেলে ঠেলে আসছে ... তীব্র জোয়ার ... কী করবেন, বুঝতে পারছেন না... ভয় করছে সাঙ্ঘাতিক ...
উশখুশ ... উশকুশ ...

যতই বইয়ের থেকে চোখ না ওঠাক সরস্বতী, সে টের পেয়েছে মায়ের কিছু সমস্যা হয়েছে ... কী হল মামমাম? এনি প্রব্লেম?

দেবী বললেন, মনে হচ্ছে , পিরিয়ড শুরু হচ্ছে আমার  ... আমি তো সাথেও আনিনি ... এইসময় আমার তো সময় নয় ... গতমাসে তো ত্রিশ তারিখে হয়েছিল ... এখন আবার কেন? ...

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে স্বরস্বতী... ওপর থেকে নামিয়ে নিয়েছে ল্যাপটপ ব্যাগ।

সবুজমোড়া হুইস্পার বেরিয়ে এসেছে, এই নাও, ওয়াশরুমে যাও ... ডেট থাকুক না থাকুক, আই অলওয়েজ ক্যারি ...
দেবী ভাব্লেন, এই বইমুখো মেয়ের কাছে কতকিছু যে শেখবার আছে ... সারা দুনিয়া চরিয়েও যে বুদ্ধি মায়ের হয়নি, তা এই বইমুখো মেয়ের ক্যামনে হয় ... সত্যি তো! দেবির এখন মেনোপজের সময়... এখন তো যখন তখন হয় ... রূপো শাড়ির আঁচলটা সাম্নের দিকে টেনে ...ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি ...


কী ভিড় কী ভিড় অষ্টমীর প্যান্ডেলে। অপূর্ব সব শাড়ি পাঞ্জাবি জিন্স কুর্তি শার্ট ... সুখিখুশি চেহারার মানুষ। কেউ প্রার্থনা, কেউ গল্প। কেউ হাসি। কারুর চোখে জল, কেউ বা স্তবপূর্ণ দিঘী।  ...নিজেকেও খুব খুব অপূর্বজ্যোতি লাগছে দেবির... হঠাৎ চোখ চলে গ্যালো মণ্ডপের সিঁড়িমুখে ...

এক ঘনলাল শাড়ি, নীলশাড়িকে বলছে,আমার ডেট কত আগে ছিল, দ্যাখো ... পেছাতে পেছাতে আজকের দিনেই হতে হল ... দশমীতে সিঁদুর অব্দি ছোঁয়াতে পারবো না মা’কে , মণ্ডপে একবার উঠে একবার স্পর্শ করতে পারবো না ... এতো মন খারাপ হয়ে আছে ...

অহংকারী নীল শাড়ি বলছে, আমি ভাই কাল্কেই শেষ হয়েছি ...
আই অ্যাম সো লাকি, তুমি ভাই এখানে দাঁড়াও, আমি একটু মা’কে স্পর্শ করে আসি ...

ভিড় সরিয়ে এগিয়ে আসছে গোলাপি কড়িয়াল বেনারসি। পাশে এক সোনালিফ্রক প্রজাপতি।
মা মেয়েকে বলছে, তুমি তো আজ মণ্ডপে উঠতে পারবে না, এখানেই থাকো... আমি একটু মাকে প্রণাম জানিয়ে আসি ... কোথাও যাবে না কিন্তু ...

সোনালি প্রজাপতি বায়না শুরু করেছে, কেন পারবো না বলো, কেন পারবো না ... দেবী ও তো মেয়ে ... হয়তো আজ তাঁরও পিরিয়ড হয়েছে, সে তো তাহলে হুইস্পার পরেই মণ্ডপে দাঁড়িয়ে আছে ... পুজো নিচ্ছে সবার , তাহলে আমি কেন পারব না ... আমি তো স্নান করেই এসেছি মা ... নতুন প্যাড পরেই আসেছি ... এখনো আমি নোংরা হইনি , প্লীজ প্লীজ আমাকে তোমার সাথে দেবীর কাছে নিয়ে চলো ...আমিও প্রণাম করবো... 

গোলাপি কড়িয়ালের হুঙ্কার শুনতে পেলেন দেবী ...
না, তুমি অশুচি। তুমি অশুচি হয়ে আছ, দেবীর কাছে যেতে পারবে না ...
সোনালি প্রজাপাতির হুঙ্কারও শুনতে পাচ্ছেন দেবি ... কেন কেন কেন পারবো না, বলো বলো ... দেবীও তো মেয়ে, তার কি পিরিয়ড হয় না?

প্রজাপতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেবী চুমো খেলেন প্রজাপতির চিবুকে ...
প্রশ্ন করো, আরও প্রশ্ন করো রে মেয়ে ... প্রশ্ন ছুঁড়ে দাও অন্ধকার মুখগুলির চোখে ...

তুমি যে আরতি, সকল প্রদীপের পিয়াসা। তোমার রুধিরস্রোতেই ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর পাপ-পঙ্কিল অমাবস্যা।  তোমার আলোজরায়ুর তপোবনে নিষিক্ত হচ্ছে বসুধার বসুধারা। তুমি যজ্ঞের নিধুবন, তুমি কৃষ্ণবাঁশীর ফোয়ারা ...

সেই মুহূর্তে মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হোল শস্যসাগরের সঙ্গীত।
লক্ষ্মী হেসে উঠল চপল-দুনিয়ার ঊষাকুম্ভে। ধরাপুস্তকের আঙিনায় বেজে উঠলো সরস্বতীর অমর-পূর্ণিমা। ভুবনমোহিনী কণ্ঠে ভুবনের চিরদোলায় ধ্বনিত হোলো ...

জাগো তুমি জাগো, জাগো মা ...


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.