মীর রবি

বার্ড অব প্যারাডাইস
অর্কিড ফুল ভিষণ প্রিয় তোমার।  বর্ষায় ফোঁটে বলে রবীন্দ্রনাথের গন্ধ পাও তাতে।  ভালবাস তাকে।  এছাড়াও কিছু অর্থ আছে।  আভিজাত্য আর সৌন্দর্যের প্রতীক।  তুমি তাকে ভালবাসতেই পারো।  অর্কিডের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই।  কিন্তু হিংসে হয়।  ওকে দেখলেই তুমি লাফিয়ে ওঠো।  আমাকে ভুলে যাও একদম।  এনিয়ে বিস্তর অভিযোগ করতে পারি।  একটা চেরিফুল ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেও তুমি আফসোস কর না।  অর্কিডের একটা পাপড়ি মলিন হলেই তোমার চোখে জল জমে।  হয়তো তার খুনে তুমি বৃষ্টি নামিয়ে ফেলতে পারো অঝরে।

অর্কিডের পাতায় জমা একবিন্দু শিশির তোমার কাছে মুক্তোর মতো দামি।  রোদ্দুরে জ্বলে ওঠা শিশির চকচক করে যখন আলো ছড়ায়, তুমি তখন আপ্লুত হও।  বাচ্চাদের মত ডায়মন্ড ডায়মন্ড বলে চিলৎকার কর। অথচ অনাদরেই পড়ে থাকে আমার দেওয়া হিরের নেকলেস, মুক্তোর সবচে দামি আংটিটা।  তুমি ফিরেও তাকাও না ওদের।  অর্কিড তোমার কাছে নিজের চেয়েও যেন বেশি কিছু হয়ে ওটে।  এ নিয়ে গোলাপেরও কম অভিযোগ নেই।  তুমি গোলাপকেও তো ভালবাসতে পারতে।  নেতাজী সুভাস বাবুও তো গোলাপ পছন্দ করতেন।  কই তুমি তো করলে না? আমাদের পছন্দগুলো কি ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই বাঞ্চনিয়ো? না কি আভিজাত্য নিয়ে জন্ম বলে তুমি আভিজাত্যের এই প্রতীকের ফুলকেই বেছে নিলে! আর যাই হোক, তোমার জানা আছে নিশ্চই- আমাদের দেশে যে দু’প্রজাতির অর্কিড জন্মে, তার একটা পরজীবি ও অন্যটা মাটিতেই জন্মায়। এপিফাইটিক অর্কিড বড় গাছের উপর বেঁচে থাকে।  আর টেরেস্ট্রিয়াল অর্কিড বাঁচে মাটির বুকেই।  এদের মাঝে কোন প্রজাতির অর্কিড তোমার বেশি প্রিয়, আলাদা করে আমাকে জানাওনি কিছু।  সুযোগ হলে একবার জানিযে দিও।

সেবার ডালিয়া আর মল্লিকাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওরা দুজন তোমার কথা বলল। ভিষণভাবে না কি রাগ করে আছে ওরা। তুমি কি না একদমই ভুলে গেছো ওদের। দুবোনের জীবন ঘিরেই তো তোমার শৈশব জুড়ে ছিল। এখনো তোমার গা থেকে সেই গন্ধ বেরোয়। আমার মনে পড়ে, ভিক্টোরিয়া পার্কে তুমি যখন আমাকে আলিঙ্গন করে চুমু খাও, আমিও তখন সেই গন্ধ পেয়েছিলাম। তোমার গা জুড়ে এখনো সেই গন্ধ আছে কি না, আমি জানি না। কত বছর হলো তোমাকে আর জড়িয়েই ধরি না। আদর করে ছোঁয়া হয় না তোমার নরম পাপড়িগুলো। স্মৃতি কাতরতায় মল্লিকা আর ডালিয়ার মতো আজ আমারও অভিমান হয়। যাকে ঘিরে বেড়ে ওঠা দূরন্ত শৈশব আর তারুণ্যের সোনাঝরা দিন, তাকে এত সহজে ভুলে যাও কেমনে! সামান্য একটু ভুলের দোহাইয়ে অর্কিড কি তোমাকে গিলে ফেলেছে পুরো শরীরজুড়ে?

আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়ার রাজপথে হাঁটি, ফুটপাতের পাশের বাগানগুলো থেকে টিউলিপের গন্ধ আসে।  মাঝে মাঝে ওদের গন্ধ শুকি। এইতো গত হয়ে যাওয়া বছর, আমি ইউরোপের শহরে।  টিউলিপ বাগানের এক ভদ্র মালিকের সঙ্গে আমার ভাব জমে গেল।  রোজ যাওয়া আসা হত, এ নিয়ে ঘনিষ্টতাও কম নেই।  ভদ্র মহিলার নামও টিউলিপ।  জমতো বেশ।  কি বলব, তার গোপন আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারি নি কখনো। মহিলার বেড ভরে ছড়িয়ে থাকত অর্কিড।  আমার বিরক্ত লাগতো, ভয়ও হত।  মনে পড়ত- এই বুঝি আসবে তুমি আসবে ! হলোও তাই, তুমি সব জেনে গেলে।  অর্কিড বুকে সুদর্শন ম্যাপলপাতাটার মতো করেই ছুড়ে দিলে আমাকে।  এ ভেবে কত দিন যাই না ম্যাপল বনে!

আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।  আমরা কানামাছি খেলতাম।  চোখ বাঁধা মাছি ছিলাম এক বিকেল।  ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’ এখনো কানে বাজে।  ছুঁতে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম পদ্মপুকুরের শাপলাকে।  ঝড়ের মতো উড়ে এলে তুমি।  ওর চুলের মুঠি ধরে আস্ত জোয়ানের মতো মারলে।  আহা ব্যাচারি! জ্বরে উঠতে পায়নি সাতদিন।  সেই দিন রাতে- সারারাত লেপ্টে ছিলে আমার বুকে, হাঁটুজলে চরা গরুদের ধরা জোঁকের মতো করে।  জোঁক বললাম।  রাগ করবে না।  এখন অবশ্য আমাদের সম্পর্ক নেই, রাগ অভিমানের হয়তো কোনো বালাইও নেই।  অর্কিড বুকে চেপে ভুলে গেছো সব- বহুকাল আগেই।

এই যে ক্যালিফোর্নিয়ার কথা বলছিলাম না তোমাকে? এখানে আমার এক রুশ বান্ধবী থাকে।  ওর স্বামীসহ ও মারা গেছে গত বছর।  ছোটবেলা থেকেই ওর ছেলেটা আমাকে বাবা ডাকতো, জানবে হয়তো।  ইদনীং ওর সাথেই দিন কাটে।  মাঝে মাঝে ও তোমার কথাও বলে।  মানিব্যাগে রাখা তোমার ছবিটা দেখে তোমাকেও মা ডাকে।  আমি চুপ থাকি।  কেমন জানি নিঃসঙ্গ বোধ হয়।  মনে হয় বার্ড অব প্যারাডাইস হয়ে যাই।  বার্ড অব প্যারাডাইস চেনো তো? এটা কিন্তু পাখি নয়।  পাখির মতো ফুল! তোমার কাছে হয়তো ভাল লাগবে।  হাওয়ায় দুললে মনে হয় ফুলটা পাখি হয়ে গেছে।  উড়ে যাবে এক্ষুণি।  উড়তে পারে না ও।  পা টেনে ধরে থাকে তার শক্ত ডাটাটা।  আমাকেও তাই মনে হয়।  তোমার-আমার বিচ্ছেদের পর আর ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না, আর হয়ে ওঠে না আমি তোমার।

আচ্ছা, তুমি কি পারবে বাবা-মা হারা এই ছেলেটার জন্য এখানে আসতে? দ্যাখো, আমি কিন্তু আমার জন্য আসতে বলছি না।  যদি চাও এসো।  আর হ্যাঁ, ছেলেটাও অর্কিড ভালবাসে।  তোমাকে পেলে ভিষণ খুশি হবে। আর আমি উড়তে না পারা বার্ড অব প্যারাডাইসের মতোই উড়বো।  তোমরা তা দেখে হাসবে।  আসো, একবার দেখে যাও আমার অসহায়ত্বকে।  তোমাকে ছেড়ে আসার পর হাঁটতে পাই না যে কত দিন থেকে!


মীর রবি
জন্ম ১৯৯৮খ্রি. ২৪ নভেম্বর রংপুরের প্রতাবজয়সেন মুন্সিপাড়ায়। বাবা- মীর ফজর আলী, মা- শেখ রহিমা বেগম। প্রকাশিত বই অ্যাকোয়ারিয়ামে মহীরুহ প্রাণ ও ইরেজারে আঁকা ব্ল্যাক মিউজিক। পেয়েছেন ‘সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’। সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ- ঠোঙা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.