পলাশ চ্যাটার্জ্জী

মৃত্যুর আলিঙ্গন
নীল আর সাদা আলোর খেলা । আলোটা কখন নীল হয়ে যাচ্ছে আবার কখন সাদা। এত দিনে সুরজিতের এসব অভ্যেস হয়ে গেছে । সে জানে একটু পরেই সেই আওয়াজটা শুরু হবে আর তার পরেই সব কিছু আবার কালো হয়ে যাবে । তখন ঘন অন্ধকারের ভিতর দিয়ে তীব্র হয়ে উঠবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা । কিন্তু এটা কী হচ্ছে নীলের মধ্যে থেকে জেগে উঠছে এক বিশাল সবুজের মহাসমুদ্র । আর ঐ বিরাট সবুজ বিস্ফোরণের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা বহুকাল আগের স্বপ্ন । সুরজিত কিছুই বুঝতে পারছেনা , সে এখন এক ছুট্টে চলে যেতে চাইছে সেই অনন্ত নীলের মধ্যিখানে । কিন্তু কে যেন তার পা দুটোকে শক্ত করে ধরে রেখেছে । কিন্তু ছুটতে তো তাকে হবেই , তাই এক অদম্য ইচ্ছার উপর ভর করে সে ছুটতে লাগল । সবুজ, নীল,কালো সব ক্যানভ্যাসকে দূরে সরিয়ে রেখে সে এখন ছুটে চলেছে সেই স্বপ্নটার দিকে । কিন্তু কিছুটা গিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল সুরজিত । গাছের ডালে ঝুলছে একটা পচাগলা মৃতদেহ । এই ভাবে স্বপ্নটা আবার হারিয়ে গেল । সে আর থাকতে পারলনা ,অসম্ভব দুঃখে সে চীৎকার করে উঠল ........

নিস্তব্ধ পৃথিবীকে খান খান করে সেই চীৎকার ফিরে এল তারই নাম নিয়ে । কিন্তু সুরজিত কিছুই বুঝতে পারলনা । শেষে যখন সেই তরঙ্গটা বার বার প্রতিফলিত হতে হতে একটা অবয়ব ধারণ করল তখনই সে ফিরে তাকালো ।

রজত এসেছে । ও যেন কিসব বলে চলেছে , কিছুই বুঝতে পারছেনা সুরজিত । বোধহয় সব এখন সবুজ হয়ে গেছে , সেটাই বোঝাতে চাইছে । কিন্তু তার কাছেতো সবকিছু আজও লাল । শেয়ার বাজারের মতো সেটা পড়েই চলেছে ।
রজতের মুখে এখন শুধুই হাসি । এই অদ্ভুত পরিবেশে রজতের অবস্থানটা যেন এক নিদারুণ যান্ত্রিকতার আভাষ । ইতিমধ্যেই আওয়াজটা আবার বেড়ে গেছে । তার সাথে কিছু মানুষের গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে । আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে এত বেড়ে গেল যে সুরজিত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না । তীব্র মাথার যন্ত্রণায় সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসছে। রজতের মাথার ঠিক উপর থেকে একটা হলুদ বিন্দুবৎ আলো আসতে আসতে সমস্ত পৃথিবীটাকে গ্রাস করে নিল । এখন সবকিছুই হলুদ । হঠাৎ রজতের অবয়বটা ছোট হতে হতে একটা বাচ্চাছেলের রূপ ধারণ করল ।

আওয়াজটা এখন আসতে আসতে কমতে শুরু করেছে । হলদেটে আলোয় বেস স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরেকটা ছবি, খুব চেনা লাগছে তবুও কিছুই মনে করতে পারল না সুরজিত। সামনের বিশাল সবুজ বিস্তৃতির মধ্যে একটা অতি স্বচ্ছ জলাশয় । তার মধ্যে বিপুল জলরাশি তীব্র বেগে যেন কোথায়ে ছুটে চলেছে । তার আগ পিছু কিছুই দেখা যাচ্ছেনা । হঠাৎই সুরজিত দেখল একটা বাচ্চা ঐ জলাশয়ের জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে গেল , কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলনা, তার আগেই কোথা থেকে যেন একটা তীব্র তাচ্ছিল্লের হাসি তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। দেখতে দেখতে তারই চোখের সামনে আরো একটা স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

আওয়াজটা এখন অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। চারিদিক ঘন অন্ধকার। কারা যেন ফিসফিস করে কিসব বলাবলি করছে । তবু এই বিরাট অন্ধকারের মধ্যে থেকেও একটা ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। একটা বিরাট বাড়ি, আর ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুরজিত।বাড়িটার কোন শেষ নেই যেন অনন্ত। চারিপাসে সবাই এখন ছুটছে, আর এই ছুটন্ত হাহাকারের সেই একমাত্র একা।এমন সময় যান্ত্রিক আওয়াজটা তীব্রতর হয়ে সব কিছুকে ঝলসে দিল। আর ঠিক তখনই কে যেন তার হাতটাকে শক্ত করে ধরল। অসম্ভব অসহায় সমুদ্রের মধ্যে খড়কুটোর মত আগন্তুকের হাতটাকে জড়িয়ে ধরল সে।

কে যেন হাজার ওয়াটের বাল্ব জেলে দিয়ে গেছে। এখন আর কোন ছবি উঠে আসছেনা। এখন সবকিছুই সাদা ধোঁয়ার মতন। আর এই অপার নিস্তব্ধতার মাঝে আসতে আসতে সুরজিতের সম্পুর্ণ সত্ত্বাটা মিশে গেল ঐ অচেনা অপূর্ব আলিঙ্গনে।

পলাশ চ্যাটার্জ্জী । ৪২/২ বসাক বাগান  /  পাতিপুকুর  কলকাতা -৪৮     pcomtatsat@gmail.com     


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.