-(১)
নিমাইদা অফিস কলিগ হলেও অনেকটা নিজের বড়ভাইয়ের মতই আগলে রেখেছেন এতদিন। নয়ত চাকরিসুত্রে বাড়ি থেকে দূরে এই আধা মফস্বলে এসে কি যে করতাম! নিমাইদার বাড়িতেই পেয়িংগেস্ট থাকতাম। এই অন্তরঙ্গতার কারণেই বাইক এক্সিডেন্ট করে নিমাইদা যখন ভাঙা পাঁজর ,চিড় ধরা পায়ের হাড়,আর টুকরো হওয়া কব্জি নিয়ে বিছানায় কাত হয়ে পড়ল তখন কাছের সরকারী হাস্পাতালে নিমাইদার সাথে রাতে থাকার জন্য এককথায় রাজি হয়ে গেলাম।দিনের বেলাটা বৌদি আর অফিসের কেউ না কেউ চালিয়ে নিত।আমি বিকালে অফিস থেকে ফিরে একঘুম দিয়ে উঠে ন' টা নাগাদ খেয়েদেয়ে নিমাইদার খাবার নিয়ে হাস্পাতালে পৌঁছে যেতাম। ছোট হাসপাতাল। রুগী বেশি, বেড কম, ডাক্তার নার্স তো আরো কম।তবে যত্নের খামতি ছিল না। তুলনামুলক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও ছিল। আমার আবার ঘুম তাড়াতে সিগারেট ছাড়া গতি নেই। নিমাইদা ওষুধের জেরে ঘুমিয়ে পড়লে আমি সিগারেট ধরাতে মেল ওয়ার্ডের পাশে কেবিনগুলোর সামনের একফালি বারান্দায় রাখা বেঞ্চের ওপর গিয়ে বসতাম।এক্টাই বেঞ্চ, বেঞ্চের লাগোয়া ছিল তিন নম্বর কেবিনের দরজা। প্রথমদিনেই খেয়াল করলাম আধভেজানো দরজার ওপার থেকে নীচু স্বরে ধীরলয়ে কেউ কিছু বলছে। গা করিনি। দ্বিতীয় দিনে একটু মন দিয়ে শুনতেই মনে হল কথা নয়, কেউ যেন কিছু পড়ছে, পড়ে শোনাচ্ছে। নার্সদিদি ট্রের ওপর ওষুধ নিয়ে ঢুকছিলেন বলে সরে এলাম। পরের দিন ও শুনি একই গলার আওয়াজ। এবার কান পেতে শুনতে গিয়ে মনে হল, আমার শোনা কথা যেন। কোথায় শুনেছি ভাবতে ভাবতে মনে৷ পড়ে গেল এতো রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র,মৃণালের কথা পড়ছে কেউ।কৌতুহলী হয়ে একটু বেশিই কান পাততে সরে গিয়েছিলাম মনেহয়, টাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে আধভেজানো দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকে পড়লাম। সামনে লোহার সরু খাটে শোয়া এক শীর্ণা বৃদ্ধা, মাথার কাছে কাঠের চেয়ারে বসা এক সৌম্যদর্শন বুড়ো মানুষ। ছোটখাটো রোগা চেহারা, সাদা চুল দাড়ি, পরনে ফতুয়া ঢোলা পায়জামা।
আচমকা আমায় ঢুকতে দেখে পড়া থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন।
-কিছু বলবে বাবা?
- না ইয়ে মানে ভুল করে...আসলে আপনি কি পড়ছিলেন শুনতে গিয়ে...বলে ফিরে আসছিলাম।
উনি বললেন,
- দাঁড়াও একটু।
বলে উঠে দাঁড়ালেন, বিছানায় শায়িত মানুষটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে এগিয়ে এলেন।কাছে এসে মৃদুস্বরে বললেন,
- আমার স্ত্রী, ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন, বুঝলে? বাড়িই হয়ত নিয়ে যেতাম কিন্তু সেখানে স্যালাইন, ব্লাড দেওয়ার অসুবিধে, সরকারী হাস্পাতালের ওষুধটাও কমদামে পাই।এই হাস্পাতালের সুজন ডাক্তার সেদিন বল্লেন,
- আর আমাদের কিছু করার নেই মাস্টারমশাই, ঠাকুরই ভরসা। যদি কিছু মির্যাকল হয়! আপনি বরঞ্চ এই ক'টা দিন মাসীমাকে একটু ঠাকুরের নামগান শোনান। আমার তো বাবা এই এক ঠাকুর। রবি ঠাকুর। জীবনভোর তো তাঁর লেখা পড়ে, শুনে আর বুঝে উঠতে উঠতেই কেটে গেল।ওকেও তাই পড়ে শোনাচ্ছি।যে অমৃতের সন্ধান,যে আলোর দিশা আমার ঠাকুর আমায় দিয়ে গেছেন, তার আলোতেই আলোময় হয়ে উঠুক ওর শেষের যাত্রাপথ।
কিছু বলতে পারিনি। অদ্ভুত এক অনুভুতি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। পরের দিন নিমাইদা হাস্পাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ায় আর দেখা হয়নি সেই মাস্টারমশাইয়ের সাথে, নয়ত সে রাতে যে প্রণামটা করতে ভুলে গেছিলাম, সেই ভুল শুধরে আসতাম।
(২)
- ও টুনুদাদা, ওই ঠাকুরের ক্যালেন্ডারটা দেবে গো?
আষাঢ় চলছে, বৃষ্টির দেখা নেই। প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে আমরা ক'জন অকাজের গোঁসাই ক্লাবে বসে ক্যারাম খেলছি আর ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের পিন্ডি চটকাচ্ছি।তার মধ্যে পিন্টুর এই আবদার। পিন্টু আমাদের ক্লাব লাগোয়া মানিকদার চায়ের দোকানে কাজ করে, আমাদের ফাইফরমাশ খাটে, বাচ্চা ছেলেটা, বছর বারো হবে মেরেকেটে। সম্পর্কে নাকি মানিকদার কেমন ভাইপো হয়। ওর বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে উপায়ন্তর না দেখে মা-মরা এইটুকু ছেলেকে কাজ করতে পাঠিয়েছে।
- কোন ঠাকুরের ছবি রে পিন্টু?
ওই যে গো, দাড়িওয়ালা ঠাকুর, রবি ঠাকুর। দেবে গো?
- ধুৎ বোকা, ওটা তো গেল বছরের ক্যালেন্ডার রে। তারিখ দেখতে পারবি না। আমি কাল বাড়ি থেকে নতুন ক্যালেন্ডার এনে দেব'খন।
- না গো টুনুদাদা, আমার ওই ছবিখানাই চাই। তারিখ দেখার জন্য তো কাকার দোকানের ক্যালেন্ডার ই আছে।
ক্যারামবোর্ড ছেড়ে উঠে দেওয়াল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি হাতে নেওয়া ছবিসহ পুরানো ক্যালেন্ডার টা খুলে গুটিয়ে নিয়ে পিন্টুকে দিলাম।
- কি করবি রে পুরোনো ক্যালেন্ডার নিয়ে? তাও আবার রবিঠাকুর নিয়ে?
- তুমি জানো না টুনুদাদা?মা সরস্বতী যেমন বিদ্যার দেবী, তেমনি এই ঠাকুর হলেন গিয়ে পড়াশোনার দেবতা। ক্লাশ থ্রি পড়তে পড়তে এখানে চলে এলাম।পড়াও হল না আর। কিন্তু মা বলত পড়তে। আমিও আরো পড়তে চাই। তাই সরস্বতী ঠাকুরের পাশাপাশি রবিঠাকুরের এই ছবিখানাও টাঙিয়ে রাখব আমার ঘরে আর রোজ-রোজ বলব বাবার কারখানাটা যেন আগের মত চালু হয়ে যায়, আমি যেন আবার পড়াশুনোটা শুরু করতে পারি।
দু' দিন ধরে পিন্টুর দেখা নেই। মানিকদা বল্ল খুব নাকি জ্বর ছেলেটার। আমাদের ক্লাবের সায়নদা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তাকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা পিন্টুকে দেখতে গেছিলাম। দোকানের পিছনেই মানিকদার টালির ঘর। বারান্দার একটা সাইড বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।সেখানেই একটা তক্তাপোশের ওপর পাতা মলিন বিছানায় শুয়ে আছে পিন্টু। দেওয়ালে৷ পাশাপাশি ঝুলছেন ক্যালেন্ডারকাটা দেবী সরস্বতী আর রবিঠাকুর। দু'জনেই নির্মল স্নেহের দৃষ্টি নিয়ে অনিমেষ তাকিয়ে আছেন তাদের ক্ষুদে ভক্তের দিকে।
(৩)
"এই করেছ ভালো নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।"
গরমের ছুটি, ঘরে বসে শার্লক হোমসের সাথে বাস্কারভিলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ করে গানটা কানে যেতে বইটা বন্ধ করে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। যা ভেবেছি তাই,গানদাদু এসেছে। গানদাদু আমার কেউ হয় না তবে জ্ঞানত দেখেছি প্রতিমাসে দু'বার করে গলায় একটা ভারী হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আমাদের পাড়ায় ভিক্ষে করতে আসে।ভিক্ষে বললাম বটে তবে লোকের কাছে হাত পেতে দান নেওয়া ছাড়া গানদাদুর সাথে আর পাঁচটা ভিখারীর কোন মিলই নেই।সেদিক দিয়ে বলতে গেলে গান শুনিয়ে নিজের পারিশ্রমিকটুকুই নেয়।
পরণে সাদা ধুতি আর হাফহাতা ধুতি শার্ট, মলিন,এখানে সেখানে সুন্দর করে রিফু সেলাই করা কিন্তু পরিস্কার করে কাচা। গানদাদু কিন্তু সব বাড়িতে যায় না। নির্দিষ্ট কয়েকটা বাড়িই যায়, যেখানে লোকে তার গান পুরো শোনে বা গানের ফরমায়েশ করে, সেই সব বাড়িই যায়। তার থেকেও বড় কথা, একটা ছোট নাইলনের বাজারের ব্যাগ থাকে গানদাদুর হারমোনিয়ামের সাথে বাঁধা, সেটা ভরে গেলেই আর কারো বাড়ি যায় না। গানদাদু শুধু রবিঠাকুরের গানই গায়৷ তাও একই গান নয়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত গান যে গায়। মুখস্থও থাকে।গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ- হেমন্ত- শীত-বসন্ত, সারা বছর ওই ভারী হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে রোগাভোগা বুড়োমানুষটা ভাঙা গলায় গান গেয়ে যায়। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যায়, গানের সুরের উদারা মুদারায় টান পড়ে। চড়া সুরে ভুল হয়ে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে থেমে গিয়ে নীচু স্কেলে আবার গাইতে থাকে আর মাথা নাড়ে, নিজেই বোঝে ঠিক হচ্ছে না, সেই সময়ে কেমন একটা অসহায়তা গানদাদুর ভাঙাচোরা মুখে ঘামের মত লেপ্টে থাকে যে দেখলেই মায়া হয়। আজ মা ঘরে নেই, বোনকে নিয়ে মাসীর বাড়ি গেছে।তাই মায়ের মত স্টীলের থালায় চাল- ডাল, সব্জীর ডালা খুঁজে দুটো আলু, একটা বেগুন আর আমার পয়সা জমানোর ভাঁড় থেকে একটা পাঁচটাকার নোট গানদাদুকে দেওয়ার জন্য নিয়ে এলাম। গানদাদু গানটা শেষ করে রোয়াকের একধারে বসে ধুতির খুঁটে মুখ মুছতে মুছতে বল্ল,
- মা বুঝি বাড়ি নেই দিদিভাই?
- নাহ
- বাইরে বড় রোদ গো, একটু জল দেবে?
ঠাম্মা ঘর থেকে বল্ল
-এই রোদে শুধু জল দিস নে দিদি, একটু গুড় কি বাতাসাও দিস।
বাতাসাটা খেয়ে আলগোছে জল খেয়ে গ্লাস্টা ফেরত দিল গানদাদু। অনেকদিন ধরে যে প্রশ্নটা করব ভাবছি, কিন্তু করলেই মায়ের বকুনী খাব ভেবে করতে পারিনি, সেটাই জিজ্ঞাসা করে ফেললাম,
-তুমি ভিক্ষা কর কেন?
-অন্য কোন কাজ যে আর পারিনা দিদিভাই, শরীরটা সায় দেয় না। ওদিকে জুটমিলের এতদিনের কাজটাও চলে গেল। খাব কি?
- সে না হয় হল, কিন্তু তুমি খালি রবিঠাকুরের গানই গাও কেন গো? ( ট্রেনে ভাঙা হাঁড়ির টুকরো বাজিয়ে চটুল হিন্দী গান গাইতে শুনেছি, একতারা হাতে বাউল গান গাইতে শুনেছি, অন্ধ ভিখারীকে লোকগীতি বা আধুনিক বাংলা গান গাইতে শুনেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই প্রশ্নটা করেছিলাম আর কি)
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব নীচু গলায় গানদাদু বলেছিল,
- এ গান যে আমার প্রাণের কথা বলে গো দিদিভাই, আমার ইষ্টদেবতাকে যে কথাগুলো আমি বলতে চাই সেগুলোই তো রবিঠাকুরের গান। এ গান ছাড়লে তো আমি মরেই যাব। তাই বাঁচব বলেই এ গান আমি আঁকড়ে ধরেছি।
কথাগুলোর মানে বোঝার মত বয়স তখনো হয়নি আমার। আজও কেমন ধাঁধার মতই লাগে।
সুচিন্তিত মতামত দিন