জীবন সব সময় কিছু না কিছু রসদ দেয় অবাক হবার। অবশ্য সেরকম হতে যদি ইচ্ছে করে আপনার তবেই তা সম্ভব। এই যে সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বের হল। একটু ভেবে বলুন তো পাঠক তা দেখে অবাক হন নি? সে আপনার ইচ্ছের অনুকূলেই হোক বা প্রতিকূলে অবাক হবার যথেষ্ট রসদ ছিল এবারে। তবে আজকে যে কথা বলব তা কিন্তু ঘটেছিল প্রায় মাস দুয়েক আগে। আজকাল শহরে চলাচলের জন্য ট্যাক্সির বিকল্প হিসাবে রমরম করে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রাইভেট পরিষেবাগুলি। কিন্তু এখনও তারা সবার মনেই ঠিক আসন করে নিতে পারে নি। আমার যেমন। সেদিন ফিরছি কর্মস্থল থেকে। প্রবল দাবদাহে প্তহের ট্র্যাফিক সিগন্যালের রবি ঠাকুরও প্রাণ জুড়াতে পারছে না এতই গরম। তাড়া ছিল বলে ট্যাক্সি চড়ে বসলাম। কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালকরা হলেন এক একটি গল্পের খনি। আমার চালক ছিলেন বাঙালি। টিপটপ ট্যাক্সি আর পাওয়ার স্টিয়ারিঙে ভর দিয়ে বাতাসে হুস করে সন্তরণ। হাতের মুঠোভাষ তখন প্রাণে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে অনুপমা ভগতের সেতার। অনুপমার নাম শুনেছেন তো? নাকি রবিশঙ্কর বিলায়েত নিখিল বুধাদিত্যের পরে আপনার কান আর কোনো সেতারের দিকে ফেরায় নি! অনুপমা এই সময়ের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতারী। আমাদের পূর্বজদের সম্মান দিয়েও আমরা যদি নতুনদের গ্রহণ না করি তাহলে সভ্যতা এগোয় কী করে? যা বলছিলাম ব্যাক টু আওয়ার ট্যাক্সি। সেতার শুনতে শুনতে গল্প জুড়ে ফেললাম আমরা। যেমন আমাদের সকলেরই একটা করে সংগ্রামের কথা থাকে ওঁরও তেমনি। কীভাবে একদম সামান্য থেকে উত্থান। থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর একসময়কার ড্রাইভারের সঙ্গী হয়ে। তারপর নানান উত্থান পতন। ট্যাক্সি চালিয়েই ভাব পাঞ্জাবীর স্ত্রীর সঙ্গে। অবশেষে দুটি মেয়েকে মনের মত গড়ে তুলেছেন। বড় মেয়ে কে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছেন ইংল্যান্ডে। হ্যাঁ ঠিক শুনছেন। তাতে অবশ্য নিজের টাকা ছাড়াও পার্টির থেকেও সাহায্য পেয়েছেন। সেকথা বলতে গিয়ে স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে কপালে ঠেকালেন। এখন ছোট মেয়েটাও পড়ছে, সেও পড়াশোনায় ভাল।
- জানেন ম্যাডাম, আমার লেখাপড়া হয় নি টাকা ছিল না বলে, কিন্তু মেয়েদের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। ওরা মানুষ হোক।
- তাহলে বলুন ট্যাক্সিই আপনার সব।
- না না কেবল এটা নয়। আমি তো গান গাই।
- ওঃ আপনি গান করেন?
- করি মানে? আমি ছোট বেলা থেকেই গান করি। আমার তো বউয়ের সঙ্গে আলাপই গান করতে গিয়ে । আমি একসময় বারেও গাইতাম। আমাদের সময়ের গানের কথা মনে আছে ম্যাডাম? আপনাকে দেখে মনে হয় আমার বয়সী। আমাদের সময় শানু কেমন গাইত? সেই আশিকী থেকে শুরু।
- - হুম
- আমি ম্যাডাম শানু ছাড়া কাউকে এত মাথায় রাখি না। কিশোরকুমারের পরে আমাদের শানুই সেরা। এখনকার গান আমার মনে ধরে না
আপনমনে বলে যেতে লাগলেন তিনি। ঝকঝক ট্যাক্সিটি গরমকালের বিকেলের দখিনা বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল হু হু করে। বাইপাসের ধারের গাছ গুলো মাথা দুলিয়ে আমাদের সঙ্গে গল্পে মজে গেছিল। চলতে চলতে হঠাত মনে হল। আচ্ছা এই মানুষটির এমন প্যাশন গান গাইবার। কেমন গান তিনি? একবার শুনলে হত না? ভাবতে ভাবতেই ভদ্রলোক বাঁ হাতে ডায়াসের নীচ থেকে একটা মাইক বের করে আনলেন।
- দেখুন ম্যাডাম সব সময় আমার সঙ্গে থাকে এটা। এখনও আমি মাসে দুমাসে প্রোগ্রাম করি। একসময় গান গেয়ে সংসার চালিয়েছি তো। বউ বলে গানকে ওর চেয়ে বেশি ভালবাসি। আপনি মোবাইলে কারাওকে রাখেন?
অবাক হয়ে বললাম
-আমি তো ওসব জানি না।
গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন-
- ম্যাডাম এই দেখুন আমি সত্যি গান গাই, এসব গল্প নয়। বলে নিজের মোবাইল খুলে কিসব বাজনা চালিয়ে দিলেন। তার সঙ্গে শানুর সেই ... “ম্যাঁয় দুঁনিয়া ভুঁলা দুঁঙ্গা তেঁরি চাঁহত মেঁ ......”
বুঝলেন দুনিয়াটা আজও এইসব পাগল মানুষের জন্য আনন্দময়। আনন্দ কী অর্থ দিয়ে কেনা যায়?
jayakc2004@yahoo.co.in
সুচিন্তিত মতামত দিন