আলোর মধ্যেই তো চোখ মেলেছি। আলোর মধ্যে যে নিহিত আলো তখন সেই আলোই ছিল চোখের আবাসস্থল। অতি স্বাভাবিকতার হাত ধরে সেই আলো থেকেই একটু একটু করে নিয়েছি আমার জীবনের রসদ। অঙ্গীভূত করেছি দেহের প্রতিটি কোষের সঙ্গে। একটু একটু করে চোখ খুলতে চেষ্টা করেছি। প্রথমেই যে ঠিক ঠিক পেরে উঠেছি তা কিন্তু নয়। প্রতিটা দিন আলোর পথে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আরও বেশি বেশি করে আমাকে আলোমুখি করে তুলেছে। এই আলোই দেহের প্রতিটা কোষকে দিয়েছে স্বচ্ছতা। এই স্বচ্ছতাই যেন সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছে আলোর এক স্তর ভেদ করে আরও ভিন্ন এক আলোর স্তরে পৌঁছে যেতে।
আলোর যোগ্যতাতেই আলোর সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। দেখে নিয়েছি আলোর বিভিন্নতাকে। আলো চোখে নিয়েই ধরা পড়েছে আলোর যাবতীয় উৎসবিন্দু। দেখেছি আলোর অধিকারেই প্রত্যেকে তৈরি করে নিয়েছে নিজস্ব বলয়। এত কঠিন তার প্রাচীর যে কিছুতেই তা ভেদ করা যায় না। আমার সুকুমার ইচ্ছা আহত হয়েছে বলয়ের কাঠিন্যে। যেন এটাই রীতি। আলো দিয়ে শুধু নিজস্ব পৃথিবী নয়, আলোই যেন তৈরি করে দিয়েছে এক অহংকারের বাতাবরণ।
আলো শুধু স্বতন্ত্রতার পরিধি রচনা করে না। উৎসবিন্দুতে দেখেছি এক অদ্ভুত তেজ। কত কত বাক্যবন্ধ রচিত হয়েছে এই আলোর উৎসপথকে ঘিরে। চারপাশের পরিস্থিতিই যেন আমার মন আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে আলো মানেই সংঘাত। এই সংঘাত পিলসুজের গায়ে ও চারদিকের অন্ধকারের ঘন বুননের সঙ্গে।
কিন্তু চোখ এটাও দেখেছে আলো মানেই একটা আর্থিক উর্বর পৃথিবী নয়। হরিহরের দুয়ার থেকে দেখা অপুর সেই বটগাছ, যে বটগাছকে সামনে রেখে অপু রোজ কল্পনার সুতোয় নিজের চরিত্রদের আঁকত। আমিও দেখতে পাই বটগাছটার পিছনে তখনও যারা সকাল সকাল পরিবারটাকে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য মাটি কোপাচ্ছিল তাদের হাতেও দেখেছিলাম আলো। পরিশ্রান্ত কিছু মানুষের পরিশ্রমের ফলে অর্জিত আলো। এখানে সংঘাতের কোনো গন্ধই নেই। তাদের আলোয় তারা দেখছিল নিজেদের। আর তার ঠিক পাশেই মন বাড়ালেই যাকে পাওয়া যায় সেই মানুষটিও আলোয় কতটা সেজে উঠেছে তাও অতি ব্যস্ততার মধ্যেও জেনে নিতে এতটুকুও কষ্ট হচ্ছে না। কারণ তাড়াতাড়ি আসার জন্যে যে লোকটা রথের মেলায় কেনা জুতোটাও পরতে পারে নি আজ এই অবেলায় জুতো পরতে পরতে তার শরীরে লেগে থাকা সামান্য আলোটাও যখন অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছিল তখনও সংঘাত কি জিনিস জানতে পারল না সেও। কারণ ওইটুকু সময় সে তার প্রতিবেশীর দুয়ার থেকে উপচে পড়া আলোয় পড়ে নিয়েছিল তার কিছু সময়ের প্রাত্যহিক দিনলিপি। আসলে সবাই নিজের মতো করে সাজাচ্ছিল নিজেকে। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছিল না পর্যন্ত। কোথাও কোনো অনুকরণ নেই। এখানে সাজানো তো নিজের জন্যে। তাই কাউকে কোনো দেখানোর প্রবৃত্তিও অঙ্কুরিত হয় নি মনের গোপন কোণে। ঠিক যেমন সবাই চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নিজের পরিচয় দেয়। প্রত্যেকটা পরিচয়ই হয় নিজের রঙে রঙিন।
নিজেকে সাজাতে সাজাতে তারা ভুলে যায় নি গোড়ার কথা। ফেলে আসা পথের যাবতীয় কথাবার্তাও তারা সঙ্গে এনেছিল। ছিল তাদের নিজেদেরও অনেক অনেক কথা। যে মাটিতে তারা দাঁড়িয়েছিল সেই মাটির কথা এবং সেই মাটিকে কারা কিভাবে বর্ণনা করছে, কিই বা তাদের সম্বোধনের ভাষা, সেসবও তারা শুনে নিচ্ছিল। অনেকেই বদলে দিতে চেয়েছিল মাটির রঙ ; প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাতেও তাদের সেই উদ্যোগ সফল হয় নি। তারা দেখে নিয়েছিল এইসমস্ত কিছু। আসলে নিজের মাটির ওপর নিজস্ব বাক্যবন্ধ ফুটিয়ে তোলার যে ইচ্ছা তার মধ্যেই নিহিত আছে অন্য এক পাঁচালী। সেই পাঁচালীর রঙ অবশ্যই নিজস্ব রঙে রঙিন।
সূর্য যখন বটগাছের মাথা পেরিয়ে অনেকটাই পশ্চিমে ঢলে পড়েছে তখন অনেকেরই বাহির কথা মনে পড়েছিল। প্রাণপাত পরিশ্রমের পরেও তাদের শরীরে ছিল না কোনো ক্লান্তির ছাপ। আসলে তাদের একবারের জন্যও মনে হয় নি যে তারা পরিশ্রম করছে। তারা যে উৎসবিন্দু থেকে বেরিয়ে এসেছে সেখানের শুরুটাই ছিল এরকম -------- যেখানে যতটুকু যাওয়া সবটুকুই শুধু নিজের পরিশ্রমের ফল। নিজেকেই সবকিছু সাজিয়ে নিতে হবে। সবদিক গুছিয়ে নিয়েই তবে হেঁটে যাওয়া। আমার পরিশ্রম শুধু তো আমারই জন্যে। তাই কি দরকার অন্যের সামনে নিজ পরিশ্রমের চিত্র আঁকার? সেই পরিশ্রমের ইতিবৃত্ত বর্ণনারও নেই কোনো প্রয়োজন। তাই সবশেষে তারা তাদের যত্নের নির্মাণের সামনে সাজিয়ে দিয়েছিল তাদের যৎসামান্য আলোটুকু। ততক্ষণে তারা এক একটি গাছ।
আগের পর্ব পড়ুন -
আগের পর্ব পড়ুন -
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ।ময়নাডাঙা ( আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্ট )।পোঃ --- চুঁচুড়া. আর. এস.।জেলা --- হুগলী
পিন --- ৭১২১০২
সুচিন্তিত মতামত দিন