মৌমিতা ঘোষ

নো-ম্যানস ল্যান্ড//
আজ সিনেমা দেখতে গেছে অরুণিমা।মান্টো।এই সাহিত্যিকের গল্প আজকাল সরকার বদলের পর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ গেছে।পাকিস্তানের লেখক তো!আবৃত্তির ক্লাস করাতে গিয়েছিল অরুণিমা। ছেলে পাথফাইন্ডার থেকে ফিরবে দুপুর আড়াইটে। শো সিনেপলিসে ১১ .৪৫ এ।গুগল চেক করে দেখেছে এক ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিটের সিনেমা।মানে রাহুল ফিরতে ফিরতে ও ফিরে যাবে। একটা দিন বাড়িতে থাকে। ছেলেটাকে খেতে না দিতে পারলে খারাপ লাগে।লাস্ট রোয়ের আগের রো তে টিকিট কাটল।কাউন্টারের মেয়েটা রি কনফার্ম করল' একটাই?' হু। তারপর একটু অবাক হয়ে ই দিয়ে দিল টিকিট। যেন কেউ একা দেখে না! ওয়াশরুম ঘুরে জল খেয়ে ঢুকল অডি-টু তে।পপকর্ন খাওয়ার মন হয়েছিল। খরচার ভয়ে আমল দিলনা। হলের ষাট শতাংশ ভরা ছিল। পাশের সিটে ষাটোর্দ্ধ বাবা আর তার ছেলে পপকর্ন ওড়াচ্ছে। 'পেটখারাপ হোক' এই অভিশাপ দিয়ে এবং অভিশাপ কার্যকরী করার জন্য পপকর্নে খুব লোভ দিয়ে বসল অরুণিমা।বসতেই জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল। দাঁড়িয়ে জোরে জোরে গাইল ও।পাশের লোকটি বিরক্ত হল যেন।

অরুণিমা তাকায় না লোকটার দিকে।বসে পড়ে। একা একা শান্তিতে দেখে সিনেমা। মান্টো ওর প্রিয় লেখক, অনাপোষী এই মানুষটি কতকাল ধরে ওকে টানে। আরো ভালো লাগে এত কাজে জড়িয়ে রাখা জীবনে এরকম একটা সময়ে ও সিনেমা দেখছে বলে।আর একা বলে আরো আনন্দ। যদিও কেউ সঙ্গে এলেও ও একটা কথাও বলে না সিনেমা দেখার সময়। ওর বর সৌগত ও জানে সেটা। অনিমেষ বলেছিল একসাথে দেখবে। অরুণিমা জানে, সেটা হবেনা। নিজের কাজ, সংসারের দায় দেখিয়ে অনিমেষ পৌঁছাতে পারবে না মান্টোর দরজায় অরুণিমার হাত ধরে। একটি দৃশ্যে মান্টো ছোট ছোট গল্প বলছেন। প্রতিটা চার লাইনের গল্প। আর গভীরতা দেখে কেঁপে উঠছে অরুণিমা।ও বুঝতে পারছে ওর পায়ের তলার জমি আসলে মাটি নয়, বালি। বুঝতে পারছে অস্থির সময়ে সুখী সুখী বোধ একটা অপরাধ। ধনুকের ছিলার মতো রাখতে হয় লেখকের মেরুদণ্ড। তবে দুশো বছর পরেও আরেকজন পাঠক সে লেখা পড়ে জেগে ওঠে আরেক অস্থির সময়ে।

হল থেকে সবাই বেরোচ্ছে বিরস বদনে। একটুও ভালো লাগেনি সিনেমা। আসলে যার সঙ্গে লেখক মান্টো র পূর্ব পরিচয় নেই, তার জন্য নয় এ ছবি, তার কাছে নেহাত বোরিং।বেরিয়ে স্পন্দনকে ফোন করল অরুণিমা। " জানিস, আজ কী করেছি?আবৃত্তির ক্লাস করিয়ে ফেরার সময় ডিসাইড করলাম মান্টো দেখব, দেখব ই দেখব। বাড়ি এসে বেল দিয়ে দরজার বাইরে থেকেই বলেছি, আমি যাচ্ছি, তোমরা খেয়ে নিও।আমার আসতে দুটো বেজে যাবে। এখন তো দুটো কুড়ি। ঘরে ঢুকলেই তো কেচে যেত কেসটা। তাই গেট থেকেই বলে পালিয়েছি। রাহুল ফিরবে। ওকে খেতে দিয়ে নিজে খেয়ে নেব। এটাও বিশাল অ্যাচিভমেন্ট, কী বল। "স্পন্দন বলল " নিশ্চয়ই। আমাকেও এভাবেই দেখতে হবে।" তারপর কিছুক্ষণ সিনেমাটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বাড়ি পৌঁছে গেল অরুণিমা।ঢুকে দেখে ডাইনিং টেবিলে ওভাবেই সাজানো খাবার।কেউ খায়নি। "তোমরা কেউ খাওনি কেন?"

শ্বশুর মশাই বললেন, আসলে খিদে পাচ্ছিল না। এই এখন পেয়েছে। শাশুড়ির মুখ গম্ভীর। বুঝল যে এটা পাল্টা ট্রিক। শ্বশুর মশাইকে খেতে দিল অরুণিমা। ও আজ কিছুতেই সরি ফিল করবেনা। ও কিছুতেই ভালো বৌ হবেনা। ইনসুলিন বার করাই ছিল ফ্রিজ থেকে। আগে শাশুড়ির ভাত বেড়ে তারপর ইনসুলিন দিয়ে দেবে ঠিক করল। যাতে উনি তক্ষুনি খেতে শুরু করতে পারেন। ভাতের থালাটা বিছানার পাশে নিয়ে গিয়ে দিতেই কেঁদে উঠলেন শাশুড়ি।"এত যখন দেরি হল, ইনসুলিন না নিয়ে কেন খাব বলো?' ইনসুলিন তো বার করা আছে। এক্ষুনি ই দেব তো। "ততক্ষণে ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে।"...আবার কান্না।

অরুণিমা আজ ভালো বৌ হতে চায়না। ঠান্ডা ভাবে বলল, "আচ্ছা এই ভাতটা আমিই খেয়ে নিচ্ছি। বলে নিজে শান্তভাবে ভাত, ডাল, আলু পোস্ত , চিকেন সব খেল। গত পনের মিনিট ধরে রাহুল ফিরে এসে জামাকাপড় না চেঞ্জ করেই মোবাইলে খেলে যাচ্ছে। এখন ঘড়িতে পৌনে তিনটে।
নিজের খাওয়া শেষ করে শাশুড়িকে ইনজেকশন দিয়ে খেতে দিল অরুণিমা। সৌগতকে ফোন করল: " কখন আসছো? " এটাই কমন যে , খেয়ে একটা বই নিয়ে বসতে না বসতেই সৌগত এসে বলবে " খেতে দাও।" তখন উঠতে খুব বিরক্ত লাগে অরুণিমার।সৌগতর উত্তর " আসব না ভাবছি আর"। অরুণিমা বলে, "এই ব্যবস্থাটা পাকাপাকি করে নিলে আমার কোন আপত্তি নেই। মাঝামাঝিতে প্রবল আপত্তি। এখন এলে আমি দিতে পারি। আর দশ মিনিটে আমি লিখতে বসব। তখন এলে চিনতে নাও পারতে পারি। " তা তো বলবেই , তুমি এখন বিখ্যাত লেখিকা, সঞ্চালিকা, এত ফ্যান, ফেসবুকে এত ফলোয়ার....। "

" ঈশ্ কী আশ্চর্য দেখো আমার সঙ্গে থেকেও তুমি একটু স্ক্রিপ্টটা ও বদলাতে পারলেনা। সেই একরকম। রীতিমতো আফসোস হয়, জানো! আজ তোমাকে কিছু ভালো লাইনস্ দেবো। " 

ছেলেকে খেতে দিয়ে দেয়।খেতে বসে যথারীতি রাহুল অসভ্যের মতো চিৎকার করে।"আমাকে কম ভাত দিয়েছ আবার!"

রাহুলের স্বভাব, একসাথে একগাদা ভাত নিয়ে ডাল, তরকারি, চিকেন সব একসাথে মেখে নেওয়া। আর অরুণিমা ওভাবে কিছুতেই খেতে দিতে পারেনা। ভাবে, কিছুটা খেলে আবার দেবে। সবের ই তো একটা এসথেটিক্স থাকা উচিত।
রাহুল চিৎকার করতেই থাকে । অরুণিমা ওদিকে আর যায় ই না। " আমি আমার মতো করেই দেব।" বলে না তাকিয়ে বেডরুমে চলে গিয়ে লিখতে বসে। রাহুল নিজে নিয়ে নেয়। 

ইতিমধ্যে সৌগত এসে গেছে।দশ মিনিট হয়নি এখনো।তার আগেই। ততক্ষণে শাশুড়ির খাওয়া শেষ। সৌগত ঢুকেই কোন কারণ ছাড়াই একটা জামা খুঁজে পাচ্ছেনা বলে চেঁচাতে থাকে। অরুণিমা উত্তর দেয়না। শাশুড়িকে ডেলিগেট করে ছেলেকে খেতে দেওয়ার দায়িত্ব। এটাতে উনি এমনিই খুব খুশি হন। অরুণিমা লিখতে থাকে। একদিকে সংসার আর তার অনন্ত চাহিদা, আর অন্যদিকে বিপুল সাহিত্য সম্ভার পড়ার জন্য, লেখার জন্য কিছু আকুতি... এই দুইয়ের মাঝখানে টোবা টেক সিং হয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে একটি মেয়ে, কিন্তু সে মীমাংসা না হওয়া অবধি ছাড়বেনা।

moumitacghosh@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.