ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়

উড়ান
আই সি ইউ এর বাইরেটা কি থমথমে নির্জন আর ঠাণ্ডা! দরজার ধূসর কাঁচের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দরজাটা অল্প কিছু ফাঁক করে কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স ঢুকছেন, বেরোচ্ছেন। তাঁদের ভাবলেশহীন মুখ দেখলে আমার কেমন ডিপ ফ্রিজে রাখা শক্ত ঠাণ্ডা মাছের কথা মনে পড়ে যায়। তেমনই জমাট বাঁধা কাঠিন্য তাঁদের চোখে মুখে। 

তিন নম্বর কেবিনে তুই শুয়ে আছিস দিদি! আজ সাতদিন। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। চোখ দুটো বোজা। অজস্র নল শরীরের নানা জায়গায় গোঁজা। মাথায় ব্যান্ডেজ। আজ মনে হয়েছিল, পাতলা ঠোঁট দুটো যেন একটু নড়ে উঠলো! কেঁপে উঠলো চোখের পাতা! 

- সিস্টার! সিস্টার!

সিস্টার ছুটে গিয়ে ডেকে এনেছিলেন আর এম ও কে। তিনি মিনিটখানেক নানারকম পরীক্ষা করে বললেন,

- কোথায় কি? ...এই সাতদিনে একবারের জন্যেও জ্ঞান ফেরেনি ওঁর। কন্সট্যান্ট মনিটরিং-এ আছেন। চিন্তা করবেন না ম্যাডাম।

তাহলে চোখের ভুল আমার। মনের ভুল। চোখদুটো আজ সাতদিন হল এমনিই বোজা। দীর্ঘ চোখের পাতা নেমে এসে ছুঁয়েছে গাল। গালের সেই গোলাপি আভা মিলিয়ে গিয়ে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে। আর এম ওর কথা অনুযায়ী, কোনও উন্নতিই হয়নি গত চব্বিশ ঘণ্টায়। আবার অবনতিও যে হয় নি, সে খবরটুকুই খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে দুরাশায় বুক বাঁধা। অন্তত সেটুকু শোনার জন্যই অথর্ব বৃদ্ধ বাবা আমার ফেরার পথ চেয়ে রয়েছেন। কিছুক্ষণ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আবার করিডরে এসে বসলাম ডক্টর মিত্রর অপেক্ষায়। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলেই ওনার রাউন্ডে আসার কথা।

পেশেন্টদের আত্মীয়স্বজনের বিষণ্ণ গম্ভীর মুখ, নিচুস্বরে আলাপ আলোচনা, সিস্টারদের ফিসফাস কথাবার্তা, খুটখুট চলাফেরার আওয়াজ, ওষুধ, ফিনাইল, রুম ফ্রেশ্নারের একটা মিশ্র গন্ধ সব মিলিয়ে কিসের যেন একটা ছায়া চারপাশে, ওই আলোকজ্বল লম্বা লম্বা করিডোর জুড়েও যেন একটা দীর্ঘ কালো ছায়া, নাকি ওটা আসলে ছেয়ে থাকে মানুষের মনেই, প্রিয়জনদের কাঁচের দরজার ওপাশে রেখে যারা ডাক্তারের অপেক্ষায় করিডরে প্রহর গোনে। 

ওই চোখদুটো আর কোনদিনই কি খুলবে? কাল ডক্টর মিত্র যা বললেন, যদি বেঁচেও ফিরিস, হয়ত এমন নিথর হয়েই কেটে যাবে বাকি জীবনটা। তা হোক, দিদি। তবু তুই সেভাবেই ফিরে আয়। তোকে আমি সদ্যোজাত সন্তানের মত আগলে রাখবো। নাওয়াবো, খাওয়াবো, সাজাবো, গালে গাল রেখে আদর করব, জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো। তুই তো চিরকাল আমাকে আগলে রেখেছিস, সাজিয়ে দিয়েছিস, আদর করেছিস। আর আমি শুধু তোকে জ্বালিয়েই এসেছি চিরকাল! 

আজ তোর বোজা চোখদুটো দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল, একবার তোর ঘুমন্ত চোখের পাতার ওপর বেশ কয়েকটা লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানলায় সার বেঁধে চলা লাল পিঁপড়েদের সারি থেকে কয়েকটা তুলে নিতে গিয়ে হাতে পিঁপড়ের কামড়ও খেয়েছিলাম খানিক। তুই লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠেছিলি, চোখে জল দিচ্ছিলি বারবার। তবু ফুলে উঠেছিল চোখের পাতা। যন্ত্রণায় কাঁদছিলি তুই। কি যেন হয়েছিল সেদিন, কেন যে অত রাগ হয়েছিল, সেকথা এখন আর মনে নেই। তোর ওপর অনবরত রাগ হত তখন, সেই অর্থে কোনও কারণ ছাড়াই। আসলে তোকে আমি হিংসে করতাম দিদি! ভাবতাম, তুই জন্মেছিলি কেন? জন্মমাত্র মরে যাসনি কেন? 

জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত শুনে আসছি তুই সুন্দর, খুব সুন্দর। সবসময় আমাকে তোর পাশে দাঁড় করিয়ে তুলনা টানা হত। তুই ফরসা, আমি কালো, তোর প্রতিমার মত নিখুঁত ছাঁদ, আমার চোয়াড়ে গড়ন। আসলে তুই মায়ের চেহারার ধাঁচ পেয়েছিলি আর আমি বাবার। বাবার পুরুষ-শরীরে যা মানিয়ে গিয়েছিল, আমার মেয়ে শরীরে তাই বেখাপ্পা, বেমানান লাগতো। আমাদের স্বভাবও ছিল একেবারে বিপরীত। তুই শান্ত, নরম, বাধ্য; আমি ডানপিটে, দুর্বিনীত, অবাধ্য। তুই ছিলি চিরকালের লক্ষ্মী মেয়ে, আর আমাকে নিয়ে সমস্যার অন্ত ছিল না। এমন দিদির কিনা এমন বোন! আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শির মুখে একথা বারবার শুনতে শুনতে আমার মনে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিত। ভাবতাম, আমি দিদির মত নই, হতেও চাই না, হব না কিছুতেই! তোর প্রতি একটা অক্ষম হিংসা আমাকে কুরে কুরে খেত। তোকে হিংসে করতে করতে আমি শৈশব, কৈশোর পেরোলাম।

আমার পৃথিবীটা তখন বড্ড ছোট ছিল রে দিদি! সেখানে রানির মত আলো করে ছিলি তুই আর আমি সকলের বিরক্তি, শাসন আর উপেক্ষা কুড়োতে কুড়োতে অন্ধকারে মুখ লুকোতে চাইতাম। আত্মবিশ্বাস বলে কিছু ছিলই না আমার তখন। নিজের অসুন্দর চেহারাটার ওপর আমি নিজেই এত বিরক্ত ছিলাম যে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ইচ্ছে হত না কখনও। তুই মাঝে মাঝে জোর করে ধরে বেঁধে বসাতিস আমায়। চুল বেঁধে দিতিস। কাজল পরিয়ে দিতিস। বলতিস, আমার চোখ নাকি তোর চেয়েও সুন্দর। বলতিস, 

- এমন জংলি হয়ে থাকিস কেন? দেখ তো! কি সুন্দর দেখাচ্ছে। 

তোর মুখে একথা শুনলে আমি রেগে যেতাম। জানতাম, সাজলেও আমাকে সুন্দর দেখায় না, তোর পাশে তো নয়ই। আবার তুইও যে মিথ্যে বলতিস তাও তো নয়। তোর চোখ আমাকে সুন্দরই দেখত। সর্বক্ষণ খুব রাগ হত আমার, চারপাশের মানুষজনের ওপর, সমস্ত বিশ্ব-সংসারের ওপর। তবে সবথেকে বেশি রাগ হত তোর ওপর। একবার তুই যখন ঘুমিয়েছিলি, কাঁচি দিয়ে তোর মাথার চুল এবরোখেবরো করে কেটে দিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে তোর সে কি কান্না! মা কি ভীষণ মেরেছিল আমাকে! তুই মরিয়া হয়ে মাকে থামানোর চেষ্টা করছিলি, মায়ের হাত ধরে মিনতি করছিলি,

- ও আর করবে না মা! আর মেরোনা ওকে! ও আর করবেনা, বলেছে আমাকে! 

এমন কোনও প্রতিশ্রুতি আমি যে দিই নি সেকথা মাও জানত নিশ্চয়ই। মার খেয়ে আমার সারা পিঠ জ্বলছে তখন, যন্ত্রণায় আমি কাঁদছি, তবু তোর মুখে ওকথা শুনে আমি কান্না ভুলে অবাক হয়ে তোকে দেখছিলাম, এখনও মনে আছে। মাও মুহূর্তের জন্য থেমেছিল তোর কথা শুনে। অমনি তুই মায়ের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলি। সেদিনই অমন সুন্দর লম্বা চুল ছোট করে কেটে ফেলতে হয়েছিল তোকে। 

তুই আমাকে খুব ভালোবাসতিস আমি জানতাম। আমার সব ক্ষোভ, কষ্ট, অপমান তুই কি করে যেন টের পেতিস না বলতেই। সেই সব মনখারাপের দিনে তুই আমাকে আদর করতিস খুব। একান্তে, সব্বার চোখের আড়ালে। কখনও নিজেই কেঁদে ভাসাতিস আর বলতিস, 

- একদিন সবাই আমার থেকেও বেশী ভালবাসবে তোকে, দেখিস! 

শুনে আমারও কান্না পেত, কিন্তু আমি কাঁদতাম না কিছুতেই। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকাতাম। তোর মত এমন আপন আমার আর কেউ ছিল না রে! মা বাবাও নয়। 

জেঠিমা-পিসিমারা মাকে বলত, 

- তোমার ছোট মেয়েটির যা ছিরি! বিয়ে দেওয়া মুশকিল হবে। কি যে আছে কপালে কে জানে! 

শুনে শুধু আমার না, তোরও রাগ হত। তুই আগবাড়িয়ে বলতিস, 

- অঙ্কে এবারে একশ পেয়েছে জানো! সেকেন্ড হয়েছে! 

জেঠিমা বলত, 

- অঙ্ক ধুয়ে কি জল খাবে। একটু কাঁচা হলুদ আর দুধের সর মাখাও দেখি! 

তুই আমাকে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলতিস, 

- ওদের কথায় কান দিস না তো! ওরা কি জানে আর কি বোঝে। তুই বানীদির মত প্রফেসর হবি। অঙ্কের। তারপর যাকে ইচ্ছে বিয়ে করবি। 

এরপর একদিন আমাদের স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে অতিথি হয়ে এলেন এক লেডি এসডিও। তাকে দেখে তোর মত বদলে গেল। বললি, 

- তুই বরং এসডিও হবি বুঝলি? ওইরকম চিফ গেস্ট হয়ে আসবি, বক্তৃতা দিবি। সবাই কত সম্মান করবে! 

তুই নিজের জন্য কি চাইতিস রে দিদি? কোনদিন জিগ্যেস করা হয়নি তোকে। তুই শুধু আমার জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতিস। এই কালো, উদ্ধত, অসুন্দর মেয়েটার জন্য, যাকে তুই ছাড়া কেউ এতটুকু প্রশ্রয় দেয়নি কখনও। আর তুই আমার সব অনাদর, অপমান মিটিয়ে দিতে চেয়েছিস চিরকাল। 

একটু বড় হয়েই আমি বুঝলাম, আমি শুধু একটা জায়গাতেই তোর থেকে এগিয়ে। সেটা হল লেখাপড়া। রেজাল্ট। আমার জেদ চেপে গেল, ওখানটাতেই টেক্কা দেব তোকে। এতটাই এগিয়ে থাকব যে আমার ধারেকাছেও আসতে পারবি না তুই। তোর প্রতিটি পরীক্ষার আগে মনেপ্রাণে চাইতাম, তোর রেজাল্ট খারাপ হোক। তুই রাত জেগে পড়তিস আর আমি নানাভাবে তোকে বিরক্ত করতাম। জোরে রেডিও চালিয়ে গান শুনতাম, কখনো ঘুমের বাহানায় আলো নেভানো নিয়ে বায়না করতাম। আমাদের দুই বোনের তো ছিল একটাই ঘর, একটাই বিছানা, একটাই আলো। কতদিন তুই ঘরের আলো নিভিয়ে বারান্দার টিমটিমে আলোয় পড়তে বসেছিস আর আমি জেগে জেগে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে থেকেছি। বাবা যখন তোকে একটা টেবিল ল্যাম্প কিনে দিলেন, আমি সেটার তার টেনেটুনে সেটাকে খারাপ করে দিলাম। তারপর যতবার সারানো হত ততবার। কেউ ভেবে পেত না কি করে রোজ খারাপ হত ওটা। তুই যদি জেনেও ফেলতিস দিদি, আমি জানি তুই দুঃখ পেলেও কাউকে বলতিস না। আমাকেও বকতিস না, শুধু অভিমান করে একবেলার জন্য আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিতিস। বেশীক্ষণ আমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারতিস না তুই। 

দিদি, আমি জানতাম তুই প্রবালদা কে ভালবাসতিস। প্রবালদাও তোকে। বাবার চোখের সামনে তোর ওই লাল ডায়েরিটা, যার মধ্যে প্রবালদার লেখা চিঠিগুলো লুকিয়ে রাখতিস তুই, আমিই ফেলে রেখেছিলাম। বাবা যখন তোকে বকছিল, আর তুই অঝোরে কাঁদছিলি, আমার ভেতরটা তখন খুশিতে ফুটছিল, কারণ আমি জানতাম তুই আর কখনও প্রবালদা কে চিঠি লিখবি না, ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করবি না, ওর জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবি না, ও রাস্তার ওপাড়ে এসে দাঁড়ালে তুই জানলা বন্ধ করে দিবি। তুই তো চিরকালই খুব লক্ষ্মী মেয়ে দিদি! আর যাই হোক তুই বাবাকে কষ্ট দিবি না। বাবা অনেক কষ্ট করছে আমাদের জন্য, ঠিকমত খায় না, ঘুমোয় না, বিশ্রাম নেয় না। আমাদের কখনই বাবার অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। এসব তুই আমাকে প্রায়ই বলতিস, বলার দরকার হত বলে। আমাকে বকতিস, বোঝাতিস আবার বিপদে পড়লে হলে সামালও দিতিস। কতবার যে মনে হয়েছে, তুই আমার দিদি নয়, তুইই আমার আসল ‘মা’!

প্রবালদাকে আমিও ...ভালবাসতাম কিনা জানি না, তবে পছন্দ করতাম খুব। আর প্রবালদা তো আমাকে একটা মানুষ বলেই মনে করত না তখন। তোরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে, আমার সমস্ত মনোযোগ পড়ে থাকতো তোদের ওপর। একঘর লোকের মাঝখানে, বন্ধুদের আড্ডায়, হাজার কলরব কোলাহলের মধ্যেও, একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে, শুধু চোখের ভাষায় তোরা অনেক কথা বলতিস আমি জানতাম। তোদের এই ম্যাজিকটা শুধু আমি টের পেতাম। তুই ভাবতেও পারতিস না দিদি, শুধু এইজন্যে, এমনকি তোর মৃত্যুও চেয়েছি!
প্রবালদা যখন শেষবার এই বাড়িতে এসেছিল, সেদিন শুধু আমি বাড়িতে ছিলাম। তুই বোধহয় মা’র সঙ্গে বেরিয়েছিলি কোথাও। কেমন উদ্ভ্রান্তের মত তোর খোঁজ করছিল প্রবালদা। আমি ওকে যত্ন করে বসালাম, জল এনে দিলাম, তবু যেন আমাকে দেখতেই পেল না। একটা ষোল বছরের মেয়ে সামনে বসে আর তুমি তার দিকে একবার ভাল করে দেখবে না? নাই বা হল সে দিদির মত সুন্দরী, হোক না সে কালো, তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ! এমন চোখ তো দিদিরও নেই! এত অহঙ্কার কিসের তোমার? সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল রাগে! ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানি না এমন ভাবে বললাম,

- দিদি তো সুদীপদার সঙ্গে একটু বেরিয়েছে, কখন ফিরবে বলতে পারছি না। 

- সুদীপদা কে?

সরল গলায় বললাম,

- মেজ মাসির ভাসুরপো। ডাক্তার। দিদির সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে...

- আচ্ছা! এবার বুঝলাম...

আবার উদ্ভ্রান্তের মতই উঠে চলে গিয়েছিল। 

ভাল করিনি বল? তুইও তো তখন এড়িয়ে চলছিলি ওকে। ভুলতে চাইছিলি। ও যখন তখন এসে বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো আর তুই ঘরে বসে কাঁদতিস, বাবাকে দুঃখ দিবি না বলে। তার থেকে এই বেশ ভাল হল না? আমি চেয়েছিলাম, ও তোকে ঘেন্না করুক, কষ্ট পাক। আমি তো ওর সঙ্গে খুনসুটি করার ছলে কতবার ওর হাত ধরে টেনেছি, ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছি ...ও এমন ভাবে হেসেছে যেন আমি একটা পাঁচ বছরের শিশু! ও যদি আমাকে একটা ষোলো বছরের মেয়ের মত করে দেখত, আমার সঙ্গে একটু নরম স্বরে কথা বলত, তাহলে হয়ত আমি ওর সঙ্গে এতটা নিষ্ঠুরতা করতাম না!

তারপর তোর বিয়ে হয়ে গেল। নিভন্ত বনেদি বাড়ির ছেলে স্বরুপদা। ফাঁপা বংশগৌরবের অহঙ্কার ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না ওদের। ছিল একখানা পুরনো পেল্লায় বাড়ি, শরিকি দ্বন্দে দীর্ণ। অতি সাধারণ একটা চাকরি করত। আমার মনে হয়, তোর আরও অনেক ভালো বিয়ে হওয়া উচিত ছিল দিদি! তোর রূপের জন্যই। বিয়ের বাজারে আজও মেয়েদের সবথেকে বড় যোগ্যতা যা, তাই তো ভগবান তোকে ছপ্পর ফুঁড়ে দিয়েছিলেন – রূপ! তাও যে কেন স্বরুপদাকেই বাবার এত পছন্দ হল কে জানে? বাবা বোধহয় যথেষ্ট খোঁজ খবর নেন নি বিয়ের আগে। শরীরও তখন ভালো যাচ্ছিল না বাবার। তাড়াহুড়ো করে বড় মেয়ের বিয়েটা দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন হয়ত। ছোট মেয়ের বিয়ের আশা বাবার ছিল না। 

তবে তোর শ্বশুরবাড়িটা দেখে আরেকবার হিংসায় চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। কেমন রাজবাড়ি-রাজবাড়ি দেখতে, চকমেলানো বারান্দা, খড়খড়ি দেওয়া বড় বড় জানালা! মেহগিনির পালঙ্ক, মার্বেলের মেঝে, ঝাড় লণ্ঠন! এ বাড়িটায় থাকবে দিদি? খাবে, শোবে, ঘুরে বেড়াবে? আর আমি পড়ে থাকব ওই অন্ধকার ঘুপচিমত শ্যাওলা ধরা বাড়িটাতে! হয়ত বা সারাজীবন? কারণ, তখন সকলের মত আমিও বিশ্বাস করতাম, আমার বোধহয় বিয়েই হবে না। তোর শাশুড়ি কেমন মাথা নেড়ে নেড়ে বলতেন, সুন্দরী না হলে দত্তবাড়ির বউ হওয়া যায় না। ওনার মেদবহুল বিকট চেহারা দেখতে দেখতে ভাবতাম, উনিও তো একদিন সুন্দরী ছিলেন, দত্ত বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন যখন! সে সৌন্দর্য তো মেদের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে কবে! তাহলে আর সুন্দরী বউ এনে লাভটা কি? 

তবে তুই কিন্তু বিয়ের পর আরও শীর্ণ হয়ে যাচ্ছিলি দিদি! সবাই বলত, বিয়ের জল গায়ে পড়লে মেয়েদের রূপ তো আরও খোলে। এ মেয়ের হলটা কি? আমার কিন্তু তখনও তোকে খুব সুন্দর মনে হত দিদি! আর মনে হত, তোর ভেতরের রূপটা আরও অনেক বেশী সুন্দর। সেই সৌন্দর্য দেখার চোখ আছে তো দত্তবাড়ির লোকেদের?

তারপর আমার জগতটাও বদলে গেল ধীরে ধীরে। এঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম। ভালো ডিবেট করতে পারি, এক্সটেম্পোরে আমার সঙ্গে লড়ে জিততে পারেনা কেউ। বন্ধু হল অনেক। ছেলেবন্ধুও। পাশ করার আগেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি। চেহারা নিয়ে হীনমন্যতা উড়ে গেছে কবে! নিয়মিত পার্লারে যাই। হেয়ার স্টাইল বদলাই যখন তখন, ইচ্ছে মত। আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী। শুধু তোর কথা মনে হলে কেমন ‘কু’ গেয়ে উঠত মনটা। কেমন যেন মনে হত, তোর মনের মিল হয়নি স্বরুপদার সঙ্গে। শ্বশুরবাড়িটা তোর নিজের বাড়ি হয়ে উঠতে পারে নি। তোর বিষণ্ণ গম্ভীর মুখ দেখলে দুশ্চিন্তা হত। মনখারাপ হত। কতবার তোকে জিগ্যেস করেছি, তোর কি হয়েছে আমাকে বল! তুই এড়িয়ে গেছিস। নিজের পুরনো নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি নি। কতবার যে মনে মনে তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি! 

আসলে তোকে আমিও ভীষণ ভালবাসতাম দিদি। একটা পাগল করা হিংসা শুধু আমার সেই ভালবাসার বোধটাকে, প্রকাশটাকে রুদ্ধ করে দিত। ছোটবেলা থেকে তোর আর আমার চেহারা আর স্বভাবের নির্মম তুলনা শুনে শুনে কেমন একটা ধারণা হয়েছিল, আমি জন্ম থেকেই তোর কাছে হেরে বসে আছি। শোধরানোর সুযোগ এ জীবনে আর নেই। 

তারপর মা মারা গেলেন। তখন তুই শ্বশুরবাড়িতে। সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা। তার আগে দুটো মিসক্যারেজ হয়ে গেছে তোর। ডাক্তার বলেছেন কমপ্লিট বেড রেস্ট। তোকে বোঝালাম, মা তো চলেই গেছে, যে আসছে তার জন্যই তো ভাবা উচিত এখন। মায়ের কাজ মিটে যাবার পর একদিন দেখা করতে গেলাম তোর সঙ্গে। তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদলি। মনে হল আরও রোগা হয়ে গেছিস তুই। একটা ছোট্ট নরম পাখির ছানার মত আমার বুকের মধ্যে গুঁজে রইলি। কি আশ্চর্য! মনে হচ্ছিল, আমিই যেন তোর মা!

তার তিনমাসের মধ্যে আমি চাকরিতে একটা বড় লিফট পেলাম; তুই মৃত সন্তানের জন্ম দিলি। আমার মাসের শেষে মোটা অঙ্কের পে-প্যাকেট; তোর পৃথিবীটা একটু একটু করে ছোট হয়ে আসছে। আমার চাকরি, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব; তোর জগতে অন্ধকার নেমে আসছে ক্রমশ। 

আমি তিন সপ্তাহের জন্য ট্রেনিঙে গেলাম দিল্লী। ওখানেই খবর পেলাম, তুই একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে। ফিরেই ছুটলাম হাসপাতালে। তখন তুই বিপদমুক্ত। তবে নিজেকে শেষ করতে গিয়ে ব্যর্থ হবার লজ্জায় কথাও বললিনা, চোখ তুলে তাকালিও না। মনে আছে সেই প্রথমবার তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম অনেক। তোর শাশুড়ি বললেন, তোর আর ওখানে না ফেরাই ভালো। পেটে ছেলে ধরে রাখার মুরোদ নেই, উল্টে ঘুমের ওষুধ খেয়ে কোমরে দড়ি পরাবার মতলব। স্বরুপদারও আলাদা কোনও বক্তব্য ছিল না।

তোকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। বললাম, 

- এ বাড়িটা তোর। এখানে তুই যেমন খুশি থাক। যা প্রাণ চায় কর। ও বাড়িতে আর ফিরতে হবে না তোকে। 

শুনে তুই চুপ করে রইলি। বাবা গাঁইগুই করতে লাগলেন, 

- কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? 

বাবাকে বললাম, 

- দিদির দায়িত্ব আজ থেকে আমার। 

কিছুদিন পর তুই নিজেই ও বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলি। তোকে জোর করতে পারলাম না। শুধু বললাম, 

- তোর একটা নিজের বাড়ি আছে, আমি আছি, মনে রাখিস। 

মাসতিনেক পর তুই আবার এলি এ বাড়িতে। একা। হাতে একটা ছোট সুটকেস। ক্লিষ্ট হেসে বললি, 

- ক’দিন থাকতে এলাম রে! 

কেমন অদ্ভুত লাগলো। কোনও সমস্যা হয়েছে বুঝলাম। তখন আর কিছু জিগ্যেস করলাম না। ভাবলাম, পরে জেনে নেব।

গভীর জ্যোৎস্নার রাত ছিল সেটা। আকাশে রুপোঝরানো চাঁদ ছিল। রাতে শোয়ার আগে আমরা দুই বোন উঠোনে নেমে চাঁদ দেখেছিলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ঝিরিঝিরি নেমে আসা জ্যোৎস্না গায়ে মেখেছিলাম। তারপর পাশাপাশি শুয়ে জেগেছিলাম অনেকক্ষণ। আমি গুনগুন করে গাইছিলাম, “আজ জ্যোৎস্নারাতে...”। তোর হাতটা আলতো করে ছুঁয়েছিল আমাকে...। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি! পরদিন সকালে বাড়ির পাশের নোংরা গলিটায় তোর রক্তাক্ত শরীরটা পড়ে ছিল। এমন মরণ ঘুম আমার! টেরও পাইনি কখন আমার পাশ থেকে উঠে গিয়েছিস তুই, চিলেকোঠার ছাদের ওপর থেকে মরণ ঝাঁপ দিয়েছিস। ঘুম ভেঙেছে পাড়ার লোকের চিৎকারে। 

আমার মনে হয়, তুই আসলে উড়তে চেয়েছিলি পাখির মত। উড়ে উড়ে অন্য কোনও পৃথিবীতে চলে যেতে চেয়েছিলি। মানুষের তো একটু দাঁড়াবার জায়গা দরকার হয়! তার খোঁজেই তুই হয়ত এখনও উড়েই চলেছিস। তোর শরীরটাই শুধু পড়ে আছে আই সি ইউ এর ঠাণ্ডা কেবিনে। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, উড়তে উড়তে আবহমণ্ডলের একের পর এক স্তর পেরিয়ে যাচ্ছিস তুই। ভেজা ডানা সেঁকে নিচ্ছিস সূর্যের আলোয়। রাতের নক্ষত্রমণ্ডলী পথ দেখাচ্ছে তোকে। তোর সমস্ত ইচ্ছে, স্বপ্ন আর ভালবাসা দিয়ে গড়া রামধনু রঙা পথ।

যা রে মেয়ে, যা, তুই উড়ে যা.....

ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায় । ‘সৃজন’, সেকেন্ড ফ্লোর, ।১১৩, পূর্বাচল কালিতলা রোড,। কলকাতা - ৭০০০৭৮ Email: bbhaswatee@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.