এ কথা আজ অনস্বীকার্য, অধিকাংশ মানুষই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো না কোনো মতাদর্শের অনুসারী। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় বিশ্বাসের ভিত্তি এবং চেতনা এবং বিবেচনা মানুষের একান্ত নিজস্ব।
ধর্মীয় বিষয়টি যেহেতু প্রার্থনার, সাধনার এবং আরাধনার সেইহেতু বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই জনজীবনে ক্ষতিকারক নয়। তথাপি সমাজে ঘটে চলা ধর্মের নামে উগ্রতা, অসহিস্নুতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তার বহর প্রদর্শনে আজ আমাদের কাছে ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ আদি প্রবাদটি আরও বেশ স্পষ্ট এবং শঙ্কার। একশ্রেণীর অসাধু ক্ষমতা লিপ্সু মানুষের নির্লজ্জ এই ধর্ম সন্ত্রাস আমাদের যেমন শিক্ষা - আদর্শের পরিপন্থী তেমনই জাতীয় লজ্জার।
অথচ ধর্ম এবং রাজনীতি দুই’ই নিরপেক্ষ। দুই’ই মানুষের মঙ্গলায়নে। তথাপি, আজ প্রশ্ন উঠছে – ধর্ম, রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক এবং পেশাগত জীবনের নিরপেক্ষতায়।
সমাজ গড়তে, তার অগ্রসরে বহুবিধ কর্মকান্ডে প্রয়োজন মেধা, দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠা। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার অর্জিত শিক্ষায় তার মেধা, তার দক্ষতায় মুল্যায়িত হওয়ার মধ্যদিয়েই যেমন গড়ে তোলেন তার পেশাগত জীবন তেমনই উন্নত সমাজ ব্যবস্থা। অথচ এখন প্রায়ই গাধাকে মেধার মোড়কে, দক্ষতা কে সখ্যতার নিরিখে, সততা ও নিষ্ঠাকে রাজনৈতিক পদলেহনের প্রক্রিয়ায় – ধান্দাবাজ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারবারিদের সফল উত্তরণের পরও আমরা এই তুমুল সমাজ সচেতন নাগরিক, সুযোগ্য অসংখ্য অক্ষর কর্মী, এমন কি শিক্ষিত এই প্রজন্ম নীরব। এই মৌনতা – এই সময়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
সরকারি, বেসরকারি সব ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি থেকে শুরু করে পেশার সর্বস্তরে হয় ধর্ম নয় রাজনৈতিক মেরুকরণই বর্তমানে প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। লজ্জার বিষয়, এ মেরুকরণ আজ বিস্তৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। মেরুকরণের এই করাল গ্রাসে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা অধ্যায়নে মেধাযুক্ত ছাত্র ছাত্রীদের করুন অবস্থা, যারা অভিভাবক তাঁরা অবগত।
‘অন্ন বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষান্তে কর্ম সংস্থান’ ই যেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়া প্রয়োজন সেখানে চলতি রাজনীতি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার মানুষের কাছে আজ অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যার অবিরত অপব্যবহারে শিক্ষাগত যোগ্যতা এমনকি রাজনৈতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই একজন শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে রাতারাতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষমতা তাকে সম্মান, শক্তি ও অর্থ সবই দিচ্ছে। অথচ প্রকৃত যারা মেধাবী, তার রাষ্ট্রের, রাজ্যের আজ করুণা মাত্র।
বলাই বাহুল্য, পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষমতার দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ফলে যে যেই পেশাতেই থাকুক না কেন, পেশাগত উৎকর্ষ সাধন তো দূরের কথা, ন্যূনতম দায়িত্ব পালনও সেখানে গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক তার শিক্ষা ও গবেষণা কর্ম ছেড়ে ছুটছেন রাজনৈতিক দলের পেছনে, চিকিৎসক সেবাদান রেখে করছেন নেতার সঙ্গে সমঝোতা, প্রকৌশলী - দলের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে বিক্রি করছেন নিজের মূল্যবোধ, ব্যাংক কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলের মদতে অবাঞ্ছিত মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের গচ্ছিত কোটি কোটি টাকা। ভয়াল এ মেরুকরণ থেকে বাদ পড়েনি সাহিত্য সাংস্কৃতিক জগত। এখানেও বোধ শক্তি শাসকের কাছে গচ্ছিত, বিনিময়ে অধিকাংশ সেই সব তাঁবেদার শাসকের দুধে ভাতে রক্ষিত। এরপর আরও ভয়ের, বুদ্ধিজীবী প্রোডাকশন! দিন দিন এত এই নোংরা জীবের প্রসবে গদগদ শোষকে, দ্বেষ -বেশে মানুষ আজ সত্যই দিশাহারা।
রাজনীতিতে যেখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই যারা বলেন বা ভাবেন - এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আসলে কিছু নেই। মূল কথা মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক কারবারিদের নিজেদের অপরাধের মাত্রা লঘু করার জন্য এটা একটা প্রবোধ-বাক্য। এগুলো আসলে হিপোক্রেসি। সবাই আজ এই প্রতারণাটা বোঝে। হিপোক্র্যাট নিজেও বোঝে। নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে অনৈতিক জোট, মানুষের মতামত ( ভোট ) উপেক্ষা করে দলবদল আর যাই হোক মানুষের কল্যাণকর নয়।
জীবন ও জীবিকার কঠিন সংগ্রামে মানুষ আজ লড়াইয়ে, ভোট সমাগত। নতুন বর্ষ সমাগত। অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ, প্রতিটি হৃদয়ে উন্মেষ হোক ভ্রাতৃত্ববোধ-মানবতাবোধ, উৎপীড়িতে হোক প্রতিবাদ, সন্মিলিতে অক্ষুণ্ণ থাক নাগরিক অধিকার – প্রতিটি ভোটে নীরব দ্রোহে।
প্রত্যাশায় -
শব্দের মিছিল
১লা বৈশাখ, ১৪২৬
সুচিন্তিত মতামত দিন