জয়তী রায়

হাবা কুমারের জীবন যাত্রা ৩
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শুন্য মন্দির মোর
-----------------------------------------------

মূল মন্দিরের সামনের দাওয়াতে কলাপাতা বিছিয়ে ফুল ঢালছিল মালতী। সকালের আলো ঠিকরে পড়ছে নাক চাবি থেকে। চূড়ো করে চুল বাঁধা, পরিষ্কার নিটোল মুখে নাকের ওপর থেকে কপাল পর্যন্ত সযত্নে রচিত তিলক, কমলা রঙের ডুরে শাড়ি, গোড়ালীর উপর গাছ কোমর করে পরা, শাড়ি , গায়ের রং মাজা,সুগোল দুটি হাতে, লাল কাঁচের রুলি, গলায় তুলসীর মালা, বয়স কুড়ি একুশের মালতী গুন গুন করে পদাবলী গাইতে গাইতেও বুঝতে পারছিল, দামোদর তার দিকে কু নজরে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলে,’ ষাট বছরে রঙ্গ দেখে বাঁচিনে। ‘ মুখে বেশ জোরেই গেয়ে উঠলো--’ আমি শ্যাম সোহাগিনী , রাই বিনোদিনী

মরণের কিবা ভয়। সখী মরণের ও কিবা ভয়”

গানে মজে ছিল বলেই প্রথমটায় হাবাকে দেখতে পায়নি মালতী। হাবা জানে তার এখন ফুল বাছা কাজ। কিন্তু, সে লাজুক কিশোর। মাটির দাওয়ার উপরে কলাপাতা বিছিয়ে অজস্র ফুলের সামনে বসা মালতীকে দেখে দূরে দোটানা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। নতমুখে দাঁড়ানো হাবাকে দেখে মালতী চমকে বলে উঠলো,’ কে গো তুমি? মরি মরি। আগে দেখিনি তো কানাই? কি গো? তা হাতের বাঁশীটি থাকলেই ষোলো কলা পুণ্ন হতো যে !’

বলে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে উঠলো। চন্দন বাটতে বাটতে বয়স্কা বৈষ্ণবী চাপা গলায় ধমক দিলো--’ চুপ যা মেয়ে। এলেই একটা হাঙ্গামা করে। ও কানাই কেন হবে? ও তো আমাদের ছোট ঠাকুর।”

--” তা তোমাদের ছোট ঠাকুরকে তিলক পরানো শেখায় নি কেউ?’ বলে হাসি চাপতে গিয়ে লাল হয়ে উঠলো মালতীর মুখ।

--’ শিখে নেবে পরে। ছোট ছেলে। ওতো জানবে কি করে? তুই যা মালু। বড় ঠাকুরের আসবার সময় হয়ে গেল। এখন ছোট ঠাকুর ফুল তুলসীতে চন্নন মাখাবে।’ বৃদ্ধা নিচু গলায় বিরক্তি মিশিয়ে বললেন।

---’ যাচ্ছি যাচ্ছি গো ঠাম্মা। ওমন করো কেন? তা এইটা ভারি ভালো হলো। নিতাই ঠাকুর বড় ঠাকুর, কানাই হলেন ছোট ঠাকুর। মাঝে কেউ নাই।’ বলে উঠোনে কাজ কর্মের তদারকিতে ব্যস্ত দামোদরের দিকে তির্যক নজর হানলো।

হাবার কান গরম হয়ে যাচ্ছিল এই সব কথা শুনে। তিলক কাটতে এখনো পারে না বটে। তাই বলে এমন মুখের ওপর বলে দেবে? আচ্ছা বেহায়া মেয়ে তো! সে বেশ গম্ভীর হয়ে রইল।

মালতীর কৌতুক ভরা হাসি যেন থামতেই চায়না। হাসতে হাসতেই, দাওয়া পার হয়ে, আশ্রমের প্রবেশ পথের দিকে যেতে যেতে সুরেলা গলায় গেয়ে ওঠে---

‘ এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি

পরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি।’

আসি গো কানাই। আবার কাল দেখা হবে।’ রিন রিন করে হাসতে হাসতে মাঠের বাঁকে মিলিয়ে গেল মালতী।

‘ তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো না ছোট ঠাকুর। ‘

মিনতি মাখানো সুরে বলে বৃদ্ধা বৈষ্ণবী --’ কি জানো তো? বাপ নাকি জন্মের আগেই মরে গেছে। মা তো বিছানায়। ফুল বিক্কিরি করে মালতী পেট চালায়। তবে, মাথার উপরে বড়ো ঠাকুর আছেন। মালুর চিন্তা কি? জয় শ্ৰী কৃষ্ণ।’ বলে চন্দন মাখানো দুই হাত কপালে ঠেকায় বৃদ্ধা। সঙ্গে সঙ্গে উঠোন থেকে ভেসে আসে ব্যঙ্গের হাসি। দামোদর! হাসতে হাসতেই বলে--’ বলি, সক্কাল বেলা গপ্প করলে চলবে? তুলসী বেছে চন্নন লাগাবে না ছোট ঠাকুর?’

*

অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে গত দুই দিন ধরে। সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। শ্রাবণ শেষ হতে চললেও বৃষ্টির আর বিরাম নেই। আকাশে বিছিয়ে রাখা মেঘলা চাদর পৃথিবীকেও ছায়া ঘন করে রেখেছে। আশ্রমের বাইরের উঠোনের সব কাজ কর্ম চলে এসেছে উঁচু দাওয়ার উপরে। এছাড়াও বাইরের আরো কাজ, যেমন , জমি জমার তদারকি, বাজার হাট দামোদরের তত্ত্বাবধানে থেকে ভাগাভাগি করে ছোট বড় গোঁসাইরা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই করে চলেছেন।

দেখতে দেখতে তিনমাস হয়ে গেল হাবার ওরফে ছোট ঠাকুরের এই আশ্রমে। এখন তার আগের ছাঁচ অনেক বদলে গেছে। আগে আমিষ ছাড়া মুখে খাবার রুচত না, নিদেন পক্ষে ডিম একটা চাই ই চাই। আর এখন শুদ্ধ নিরামিষ খাবার, তৃপ্তি করেই খায়। আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে ছোট ছোট কুটির গুলি, নারকেল সুপারি আম গাছ, গাভী, সব তার ভালো লাগছে ক্রমশই। একবার দীক্ষা নেবার কথা তুলে ছিলেন নিতাই ঠাকুর--’ বাবা! গু মানে অন্ধকার, রু মানে জানা-- গুরু না হলে তো অন্ধকার কাটবে না!’

খুব সংক্ষিপ্ত অথচ দৃঢ় জবাব দিয়েছিল হাবা,’-- এখন ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে হলে বলবো। ‘

সে এখন তিলক কাটে নিপুন করে, পদাবলী সুর করে গাইতে পারে। সব চাইতে আগ্রহ বৈষ্ণব তত্ত্বের সারকথা জানতে। তার এই আগ্রহে খুশি হয়ে নিতাই ঠাকুর , দুপুরের অবসরে মাঝে মাঝে তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে বসে বলেন--’ জ্ঞানের গভীরে ঢুকতে চাইবার এই যে আগ্রহ তোমার ছোট ঠাকুর, এ আমাকে অবাক করে। কত মূর্খ নিজেকে পন্ডিত ভাবে, আবার কত পন্ডিত নিজেকে মূর্খ করে রাখে-- জ্ঞান হলো আলো। শুধু পুঁথি পড়লে জ্ঞানী হওয়া যায়না। পাঠ হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, তবে পাঠ পথ হয়ে দিক নির্দেশ করে।’

ছোটঠাকুর তার বিশাল চোখ দুটি মেলে কথা শোনে। বাইরের মেঘলা আকাশ উঁকি দেয় কুটিরের জানালা দিয়ে, ভেজা বাতাসে ভেসে যায় নিতাই ঠাকুরের ভাব গম্ভীর সুরেলা কণ্ঠ--’ গীতায় শ্ৰী ভগবান অর্জুনকে বলেছিলেন যে, ঈশ্বরকে পাবার জন্য ওতো তপস্যা না করলেও চলবে যদি --’ সর্ব্ব ধর্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণংব্রজ।’ --সমস্ত ধর্ম ক্রিয়া কান্ড বিসর্জন দিয়ে তুমি শুধু একান্ত ভাবে আমার শরণ গ্রহণ কর, তোমার যা কিছু সব আমাতে সমর্পণ কর, তাহলেই আমি তোমাকে সকল দুঃখ সকল ব্যাথা থেকে মুক্ত করে দেবো।

ছোটঠাকুর। এ জীবন বিষ জীবন। লোভ হিংসা কাম , শরীরে কত জ্বালা বলতো? কত কষ্ট ? আহ্হ্হঃ,,,--বলতে বলতে নিতাই ঠাকুর যন্ত্রনায় মুখ কুঞ্চিত করেন। হাবা তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দেয়। নিতাই ঠাকুর হাত দিয়ে বরণ করে বলেন---

‘ যত চেষ্টা করি , তবু পূর্বাশ্রম পিছু ছাড়েনা গো ছোটঠাকুর। একমাত্র শরণাগতির চোখের জলে যদি সব পাপ ধুয়ে যায়।’ বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করলেন--’ বৃন্দাবনে শ্রীমতী আর গোপ বধূরা সেই পন্থাই গ্রহণ করেন। মান অপমান, ভালো মন্দ সু বিচার কু বিচার নিন্দা স্তুতি সমস্ত বিসর্জন দিয়ে তারা একমন হয়ে চেয়েছিলেন গোবিন্দকে, এবং আনন্দে গোবিন্দ দিয়েছিলেন তাদের কাছে ধরা। শ্ৰী কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা হলো সেই আত্মসমর্পণ যোগের ই জীবন পরীক্ষা।

ছোটঠাকুর, আপাতত শুনতে মনে হয় এই আত্মসমর্পণ যোগ তো খুব সহজ ,শরীরের কোনো কঠিন ক্রিয়া করতে হয়না বটে, কিন্তু অন্তরকে নিঃশেষে তাঁকে দিতে গেলেই দেখা যায়, অন্তরের ভেতর সংগোপনে বহু ফাঁক আছে। তার কাছে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করতে গেলেই দেখা যায় বহু বাধা মন কে জড়িয়ে আছে।

ছোট ঠাকুর গো, আকুল ভাবে তাকে ডেকো কেবল। ‘ বলতে বলতে নিতাই ঠাকুরের চোখ জলে ভরে এলো। তিনি হাত জোড় করে ব্যাকুল স্বরে বলতে থাকলেন--’ হে কৃষ্ণ, আমরা শুধু তোমাকেই চাই। সুখের জন্য তোমাকে চাই না, ঐশ্বর্যের জন্য তোমাকে চাই না, তোমার জন্যেই তোমাকে চাই। কৃষ্ণের জন্যই কৃষ্ণকে চাই।’

মেঘে ঢাকা বর্ষণ সিক্ত সমস্ত পৃথিবী আকুল হয়ে যেন বলতে লাগলো --’ কৃষ্ণের জন্য কৃষ্ণকে চাই।’ এ কি আকুতি? এ কি প্রেম? এই জন্য রাধার প্রেম সাধ্যশিরোমণি, অর্থাৎ সর্ব শ্রেষ্ঠ? এই জন্য মহাপ্রভু চৈতন্য দেব রাধা প্রেমে নিজেকে মেলে ধরেন?

স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল ছোটঠাকুর। পাঠ শেষ হয়েছে। কিন্তু দুজনের কেউই স্বাভাবিক হতে পারছেনা। পুঁথি খোলা সামনে। নিতাই ঠাকুর এখনো বন্ধ চোখ। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত। হঠাৎ সমস্ত চরাচর কাঁপিয়ে বাজ পড়লো কোথায় যেন! আর তার চেয়েও তীক্ষ্ণ গলায় বাইরে থেকে ভেসে এলো মালতীর চিৎকার---জল বাড়ছে। জল বাড়ছে নদীতে। ও ছোট ঠাকুর, ও বড় ঠাকুর, গোঁসাই দাদারা শিগগিরি চলো গো, জল বাড়ছে। ‘

মুহূর্তে শান্ত আশ্রমে কোলাহল জেগে উঠলো। নদীর লাগোয়া আশ্রম। গোয়ালে বাঁধা আছে গাভী গুলি। তাদের বাঁধন খুলতে হবে। কোদাল চালিয়ে মাটি ফেলে উঁচু করতে হবে পাড়। লাফ দিয়ে উঠে পড়লো হাবা। নিতাই ঠাকুরকে বললে--’ আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমি দেখছি। ‘ 

বাইরের দাওয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠোনে নামলো ছোট ঠাকুর। সামনে কাদা মাটি জল মাখা মালতীর দাঁড়ানোর মধ্যে এক অসহায় আর্তি। মেয়েটিকে যত চিনছে হাবা, অনুভব করছে তার একাকিত্বকে। তার রঙ্গ রসিকতার পিছনে আছে লুকোনো ক্ষত। নিরন্তর মন খারাপের সুর বেজে চলেছে মালতীর বুকের ভিতর। হয়তো তার কুটিরটিও আজ বিপন্ন। গভীর বিশাল চোখ দুটি মেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে মালতীর দিকে চেয়ে বললো ছোট ঠাকুর--’ ভয় নেই। চলো।’

--’ না আর ভয় নেই গো কানাই,’ জলে ভেজা স্বরে বললো মালতী--’গিরি গোবর্ধন আঙুলে তুলে ব্রজবাসীদের বাঁচালে তুমি। আজ তবে কিসের ভয়? জয় শ্ৰী কৃষ্ণ। ‘

বর্ষা ঝম ঝম শব্দ ছাপিয়ে আশ্রমের আনাচে কানাচে প্রতিধ্বনিত হলো --’জয় শ্রী কৃষ্ণ।’

মালকোচাঁ মেরে ধুতি , মাথায় গামছা বেঁধে পুরুষেরা নদীর ধারে চললো। দামোদর খুব করিৎকর্মা মানুষ। ঝুড়ি কোদাল হাতে নিয়ে সব চললেও, হাবা ওদের থামিয়ে বললো--’ শুধু মাটি ফেললে হবে না, চাই শক্ত কাঠ বা পাথর। এক কাজ করো , বর্ষা আসার আগে পুরোনো গাছের মোটা গুঁড়ি আলাদা করে রেখেছিলাম, সেগুলো নিয়ে যাই।’

--’ কিন্তু আমরা প্রত্যেক বছর মাটি ফেলেই তো বন্ধ করি ছোট ঠাকুর।’

‘ ছোট ঠাকুর ঠিক বলেছে’ প্রশংসার গলায় বললেন দামোদর গোঁসাই,--’ কাঠের গুঁড়ি নিয়ে এসো। ইঁদুরে খুবলে নিয়ে ঝুর ঝুর করে দিয়েছে মাটির পাড়। গর্তে কাঠ ঢুকিয়ে মাটি ফেলতে হবে।’

তিন জন জোয়ান ছেলে দৌড়োলো আশ্রমের পিছন দিকে। বাকি সকলে নদীর ধারে পৌঁছে হতবাক হয়ে গেল। সেই চেনা ছোট্ট নদী আজ গুর গুর গর্জনে প্রবল বেগে বইছে। ফুলে উঠছে জল। কোন মহাকালের গর্ভ থেকে সর্বনাশ জেগে উঠছে যেন। দামোদর মালতীকে বললেন --’ মালু, গাঁয়ের মেয়েদের বাচ্চাদের নিয়ে ইশকুল বাড়ি চলে যা। তবে, আমাদের নদী তেমন বান কখনো দেন নি, এটাই ভরসা। ছোট ছোট নালা কেটে দেব। জল বেইরে যাবে। তুই যা। ‘ বলেই ষাটোর্ধ বৃদ্ধ সিংহের মতো শরীরে মোচড় দিয়ে, বললেন--’ চলো ছোট ঠাকুর। মারো কোদাল। জয় শ্ৰী কৃষ্ণ।’ দশ দিক কাঁপিয়ে আবার প্রতিধ্বনিত হলো নাম--’ জয় শ্ৰী কৃষ্ণ।’



joyeelove@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.