রত্নদীপা দে ঘোষ

ফুল্লকুসুমিত
ফ্রিল দেওয়া ফ্রক ঘেরা আমার মেয়েবেলা যাকে হরকদম খুঁজে যাচ্ছি , প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছি।বিকেলের মিউজিয়ামে কান পেতে রাখছি হই আর চই আর এক্কা দোক্কার হুল্লোড় শোনার জন্যে। চোখ তুলে ঈষৎ ঘাড় বেঁকিয়ে কী খুব তার উজ্জ্বল রোদ , নিজেকে দেখতে পাই সেই মায়ারোদের রাজকোষে । বাতাসের মলয় পেরিয়ে অই যে দূর দিগন্ত , অই যে একটু দূরেই দাদুর হাত ধরে , আবছায়া পরা আমার মেয়েবলা ... বিপুলা আকাশের নিরবধি সালসা ... সেই সম্পাদনার আঁচড়ে ফুটে ওঠে সময়ের টাচস্ক্রিন ... স্পর্শের বজ্রবিদ্যুৎ , আহ্বানের আশিয়ানা... রোমন্থনের দুই বোন ... আকুলি আর বিকুলি ... 

দাদু , আমার অপ্রাকৃত হাতছানি , প্রাকৃত জলসা । প্রথম অ আ ক খ , প্রথম অঙ্ককষা আঁক... প্রথম মাদলের শিশির ... সব সব ... প্রতিটি সন তারিখ ... বছর মাস পেরনো ... রামায়ণ আর মহাভারতের ডমরু ... কুরুক্ষেত্রের চিকবোন ... গল্প হলেও সত্যি সেই সব কথন , অতিকথন ... সেই নিশ্চিত কাচঘর , স্পষ্ট অস্পষ্ট বোধি , প্রাজ্ঞ মালা ... অনুভূতির সব ... সব কিছুই দাদুর হাতের অক্ষরবরণ জ্যোতিঃপুঞ্জ ... দাদুর সাথেই হাসতে হাসতে ছুটে বেরিয়েছি মাঠে ঘাটে , তোর্সার বাটে ... অঙ্ক ভুল কোরে বকুনি খেয়েছি প্রচুর , কাঁদতে কাঁদতে শিখেছি , কীভাবে প্রতিটি কান্নাকে গানে রূপান্তরিত করা যায় ... কীভাবে প্রতিবার প্রতি গানকে আয়না করা যায় ...প্রতিটি আয়নায় বুনটের বুননে মধুরম করা যায় ... 

দাদু কোথায় , কোথায় যে হারিয়ে গেল আমার সেই মেয়েবেলা , শুকনো মুখ ... সেই বৃদ্ধ হাসিঅশ্রুর সংবেদনকণিকা ... সোডিয়াম আলোর ভিড়ে কোথায় আমার সেই প্রিয়মুখ , নদী আর মাস্তুলের তাঁবু ... সবুজের দ্বীপ ... আহা ! রোশনাইয়ের দীপটি যেন ... 

প্রথম স্কুলে যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ ... চাকুরিরতা মায়ের কন্যা ছিলুম ... তাই প্রথম স্কুলে যাওয়া দাদুর হাত ধরেই । দাদু স্কুলের বাইরে বসে থাকতেন , আমার ছুটি না হওয়া অবধি ... ছুটির ঘণ্টা ... এক ছুটে দাদুর হাত ধরা ... 

খুব খুব ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি তখন ... তখন বন্ধু বাড়ছে , বাড়ছে হোম ওয়ার্কের দিনলিপি ... দাদুর কাছে শিখছি , ইংরেজি আর বাংলা ব্যাকরণের আদিকথা ... শিখছি , ভুল করছি , দাদুর কাছে বকুনি খাচ্ছি , ক্ষেত্র বিশেষে পিটুনিও জুটছে কপালে , দাদুর কাছে শুনছি পুষ্যা নক্ষত্র আর কালপুরুষের অন্তরঙ্গতা ... 

বিনুনি বড় হচ্ছে , বড় হচ্ছে লালফিতের নহর ... আমি বড় হচ্ছি ... তাল মিলিয়ে বাড়ছে আকণ্ঠ আনন্দের এঞ্জিন ... সুনীতি একাডেমী ... আমার বড়বেলার স্কুল ... যেহেতু আমার মা এই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন ... তখন মায়ের সাথেই স্কুলে যাওয়া ... মায়ের সম্ভাবনা উপচে ... আমি তখন ভ্রমরের সফর ... অন্তরীক্ষের ধ্রুবতারা ছুঁতে , ছুটে বেড়াচ্ছি পড়াশুনো আর আবৃত্তির ঢেউ জারণে ... আবৃত্তি তখনকার আমির সদাসম্পদ ... এই সম্পদের মধুকর আমার বাবা ... তাঁর স্রোতে কণ্ঠ মিলিয়ে আমি তখন শিখছি , রবিঠাকুরের ‘ আমি ‘ পৃথিবী ... সাড়ে পাঁচ বছর বয়েসে ‘ দেবতার গ্রাস’ আবৃত্তি করে চমকে দিয়েছি এমনকি নিজেকেও ... বাবার অনন্ত লিরিকে সাত মাত্রার গাঁটবাঁধা ... আমি সেই বাঁধনে , রূপ আর রহস্যের চেনাবিধি আর অচেনা বিহ্বলতার ভাষান্তর করতে চেয়েছি ... 

বাবা লিখতেন কবিতা ... বাংলা আর ইংরেজি দুটি ভাষায় তাঁর ছিল যারপরনাই শব্দদক্ষতা ... সত্যি কথা বলতে কি , তাঁর মতো এমন ঊষাস্নিগ্ধতা , জোনাকির হাতের পাতায় উচ্চারিত অরুণের চাঁদমল্লিকা ... আমি আর দুটি দেখিনি ... 

বাবার জলধারাগুলি থেকেই আমি কুড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছি , আষাঢ়ু বর্ষার দাবাড়ু কণাগুলি ... মর্মরিত রত্নের ক্যামেলিয়াগুলি ... চেষ্টা করেছি , সুদে আসলে , ফুলগাছগুলির আরেক্টু অলিবৃদ্ধি হোক ... 

বাবা বলতেন , তোর ভেতরে লেখা আছে রে ... কথাও আছে , শব্দও আছে , প্রাণ ও প্রচুর ... ফেলে ছড়িয়ে রাখিসনে ...আর লিখতে গিয়ে ভয় পাস্নে কাউকে , কলম ছাড়া তোর কিছু হারাবারও নেই ... তাকিয়ে দ্যাখ ... কোরাল আর প্রবালের প্রমিত ঝঙ্কার ... দুলছে তোর পৃথিবী দুলছে ... এই লেখাপৃথিবীই একমাত্র তোর ... তুই ছাড়া এর আর কোনো মা-বাপ নেই ... মন আর শরীরের করিডোর বেয়ে এক দৌড়ে পৌঁছে যা ... থামিসনে যেন ... 

বাবার সেইসব কারুকাজের অঢেল ... আমি লিখে রাখছি ...এখন ... নির্ভার অলটিচিউড ... বাবা ছিলেন আমার মেয়েকালীন প্রখর ফ্রেন্ডশিপ ... অশেষ বন্ধুতা ... মায়ের সাথে দুরত্ব ছিল প্রবল ... মা ছিলেন গম্ভীর স্বভাবের ... আর বাবা ? তিনি আমাদের দুই বোনের ... হাট্টিমাটিমের সুতীব্র আনন্দতা ... আমার জীবনে বাবার বিশেষত্ব এই যে , বাবা আমার ... এমন অনেক অনেক গল্প ...যার প্রতিটি ... বসন্ত ... যার প্রতিটি ফ্লাও্য়ার শো ... নিখিলের অপার ডায়েরি ... 

আমি স্বভাবে ছিলুম কেমন ? দুষ্টু ? মিষ্টি ? নরম ? শিশুকালে আমি অতিরিক্ত শান্ত স্বভাবের ... তবে বয়েসের সাথে সাথে দুষ্টু হয়েছি , আর দুষ্টুমির সাথে সাথে বেড়ে গিয়েছে , শিস দেওয়া হরটিকালচারের প্রগলভ ডালিয়া ... 

এক ছড়া বৃষ্টিতে ভিজেছি বন্ধুদের সাথে কত উন্মাদনা ... ভিটামিন বি সিক্সের নতুন পেন্সিলে , কেটেছি কত কত ভিবজিওরের সিঁদ ... প্রেমে পড়েছি পরিস্কার দু ভাগ করে প্রেমে পড়েছি , মঘাই মহাসাগরের উত্তাল দ্রবণে কার্যত হারয়েছি নিজেকে ... লাজুক আমি , ঠিক এইভাবে নিজেকে হারাতে হারাতে হয়ে উঠেছি , আরও সপ্রতিভ ... শ্যামবর্ণা আমি , অনতিউচ্চ ... ভাদ্রের ভরা আকাশ , আজস্র ঠাণ্ডার গহন উত্তাপ। খুঁজে পেয়েছি নিজস্ব আউটলাইন ... যার ডায়াগনাল রেখাটি একটি সম্পূর্ণ ঠোঁট ... ঠোঁটের বাহারি লিপস্টিক ... ফেটে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে , গ্রেসফুল চুম্বনের গ্রেণকণা ... 

তখনো কিন্তু হইনি সম্পূর্ণ ... উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কুচবিহার জেলায় অধিকার করেছি কলা বিভাগে প্রথম স্থান ... নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরগ্রাউন্ডে ... প্রথম হোস্টেলজীবন ... মা বাবা বোনকে ছেড়ে প্রথম যেন একা-কান্নাকে উদযাপন ...

সে যে ভয়নক বেদনার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ... সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিবেশ ... বাবার স্নেহছায়া ... মায়ের মুখ , বোনের ক্যাবিনেট সাইজের দুষ্টুমি ... কেউ নেই কিছু নেই ... নেই বলতেও আর কিছু নেই ... আছে বোলেও আর কিছু নেই ... স্বয়ংসম্পূর্ণ শূন্যতা ... যেন আমি এক ভিখারিনী ... থমকে আছি ... চিরায়ত অন্নজলের আকাঙ্খায়ায় বসে আছি ... অপার নির্জন ... 

ক্রমেই যাদবপুর চত্ত্বর এক পাখি হয়ে দেখা দিল আমার জীবনে... পর্দা সরিয়ে দিল সেই পাখি ... আমার প্রত্যেক রোমকূপে ... এক গন্তব্যসচেন অলঙ্কারা তরুণীর প্রবেশ ... অজস্র বন্ধুরা জানালো নিমন্ত্রণ ... খুশি খুশি ... হাসিখুশির বিস্তৃত ভূ ... খণ্ড খণ্ড কোরেও আমার মেটেনা সাধ... হোস্টেল জীবন যদি তা ঠিকঠিক সুরে বাজে তবে তা এক জীবনের দুই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ... হাঁটাপথে , মিনিবাসে ... ট্রামলাইনে ... লোকালট্রেনে কেবল বন্ধু ... বন্ধুতার ডবল ডেকার ... আমি সেই সব জেব্রা ক্রসিং কর গুণে শেষ করতে পারিনে ... গুনবোই বা কি কোরে ? এমন অপর্যাপ্ত সেই সিন্ধুসলিল ... কখনো কাজিরাঙ্গার পেলব তর্জনী ... কখনো আবার কঠিন শিমূলের ... সেগুনরূপ ... নীল জিন্স , মেরুন টপ ... শিফন আঁচল সিল্ক কুঁচি ... বিপুল সম্ভার জীবনের ... 

এই শোনো , শোনো ... 
ডাকছি তোমাকেই 
হাঁকছে জীবন 
ডাকছে জীবন 
আমি সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারিনে 
এই পথ এই রাস্তা ইতিহাস নগরের রাজপথে 
এই নটী এই বসন্তসেনার নাচনৃত্য সহসা ফিরে আসা 
সাহিত্যের মকশো মৌতাতে টং হোয়ে আছে 
বেদম রঙিন ঘূর্ণি হাওয়ার দামাল 
এই যুবক সেই মালঞ্চ 
এই যুবতী সেই মাধবী 
পরখ করে দেখি অমল যৌবনের 
বিস্তর কবিতাস্তম্ভ 
টান পড়ে কাছিতে 
তান পড়ে লাবডুবের সেতারে 

আমি সেই তরল সরলের হারমনিয়ামে খেয়া পার করতে করতে দেখি ভেসেছি ... ভেসেছি। ৮বি বাসস্ট্যান্ডের চা-মোড়ে ভেসেছি , ভিজেছি সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর মেহফিলখানায় , বয়েজ হোস্টেলের কবিখানায় ভিজেছি , অট্টহাসির কাব্যপ্রাশানের পথে বেজেছি ... বইমেলার বাল্যবন্ধতায় ... অকালপক্ক রোগে অসুখিত হয়েছি ... আবার ... বারবার পরিধির বাইরে গিয়েও ... গুল্মদমকায় ... গোল গোল চারকোল পরা মেধাবী বিষণ্ণতায় কান্নার প্ল্যাকার্ড দুলিয়ে , আড্ডার ক্রুশ গায়ে টেনে , পেরেকবিদ্ধ চার্চসকালে ... সন্ধ্যার সচিত্র বিজ্ঞাপন করেছি ... আমার মেয়েবেলা আর থামানো যায়নি ... নিজেকে আমি থামাতেই পারিনি ... ঝাঁ চকচকে চার প্রহর রাতে ...নেমেছি গবেষণায় ... গম্ভীর কফিহাউজ ভেঙে ... উঠে দাঁড়িয়েছি পদ্যকবিতার কুর্তা পাজামায় ...ভেবেছি বার বার ভেবেছি ... দু চার গণ্ডা ...ভাবতে ভাবতে নিশিডাকের দৃশ্য সমূহে রক্তসমীক্ষায় মেতেছি ... 

তারাদের ঘুমপরী ,বোদলেয়ারের স্নিগ্ধ অমরাবতী ... বিস্ফোরণের শ্বাস ... একবার হারিয়ে গেলে কোনোদিন কি ফিরবে ? কোনোদিন কি ফিরে আসবে আবার দুরন্ত মাকড়ির তেজস্ক্রিয় বারুদের ... নথের মতো ঝরে পড়া শিলের ফোয়ারা... ওগো আমার সাদা সাদা দুধেসাদা মেয়েবেলার মেয়ে , বলো , কাকে ভালোবাসো তুমি ? আমি ? আমি অই নির্মল জয়ন্তিয়া , রুমালে ঝুলে থাকা আশ্চর্য মেঘের খঞ্জনী ? তুমি একতারা ? আমি দোতারার ঘুঙুর ... মেয়েবেলায় ঘন হয়ে থাকা বারুদ আর বাষ্পের সুমঙ্গল হাতছানি ... আমি যে তোমারি শাঁস আর খোসা ... আমার ত্বকে তোমার পমেটমের প্রতিবেশীরা ঠাসা ... আমি কি তবে ইতিহাস? 

সমস্ত অফবিট কাণ্ডকে বানিয়ে ফেলবো হিমশিমের কারখানা? আমি কি মুরারির ত্রিভঙ্গকে এক ফর্মার বাঁধাইকে বেঁধে ফেলবো ভিশ্যুয়ালের টাইটেলে ? নাকি বাদামী কাগজের লণ্ডভণ্ডকে গুছিয়ে রাখবো গড়ের মাঠে, বইমেলায়  স্টলের মুখে ? হৈ হৈ করে ঘোলাটে পেঙ্গুইনে ,অক্সফোর্দে ইতিউতি... খোলস ভেঙে, নিজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো নিজেই ? 

না , যাদবপুরে ... রাজনীতি আমাকে কোনোদিন টানেনি । বরং টানটান রেখেছে কাব্যনাট্যসিনেসূচির আস্তাবল ... আমি সেই আস্তাবল থেকে প্রিয় ঘোড়াদের টেনে নিয়েছি কাছে , লিটিল ম্যাগের স্বরে রীতিমত গমগম বেজেছি ... লেখালেখির বাইসেপগুলিকে অদূর বন্দর থেকে সুদূর সাঁতারে ভিজতে পাঠিয়েছি ... না , সিঁড়ি কখনো থেমে থাকেনি আমার ... 

সিঁড়ি নেমেও যায়নি কোনোদিন ... এক একটি কাঠের স্ক্রু ... আমাকে বেঁধে রেখেছে রঙ এবং মার্বেলের উডপাথরে ... আমি বুঝতে পারছিলাম , সিঁড়ি আসলে একটাই ... একটাই রহস্য ... উন্মোচনের আকাঙ্খ্যায় আমাকে ওপরে ওঠাচ্ছে , আবার নীচেও ওঠাচ্ছে , ওপরেও ওঠায় আবার নীচেও ওঠায় ... কিন্তু নীচে নামায় না ... নিজেও নীচে নামেনা কখনো ... 

সিঁড়িটি কবিতার হতে পারে , ইতিহাসের হতে পারে ... 
সিঁড়ি নাব্যতার হতে পারে , নৌকোরও হতে পারে 
সিঁড়ি দর্শনের হতে পারে , সুদর্শনের চক্র হতে পারে 
সিঁড়ি বাংলা বিভাগের স্বচ্ছ ঘাঘরা হতে পারে 
সিঁড়ি অঙ্ক বিভাগের অভিকর্ষ , ইংরেজির মহাকর্ষ 
সিঁড়ি মহাজীবনের মহাসাহিত্যেরও হতে পারে 

বুঝতে পেরেছিলুম , সিঁড়ি আসলে পিতলের পায়ের ছাপ ... আমার সমস্ত ফুলকারি পাপ আমার চিরকরুণ চাকার মর্মর ... আমি সেই প্রতিধ্বনির ভেতরে কেবলি নিজের ধ্বনি পেতে চেয়েছি ... সারেগামার দ্বিতীয় স্বরে । যমুনার পুলকিত স্বরে । ও কাঁপছে । আমি কাঁপছি । শিরশিরিয়ে উঠছে কুসুমবেলা ... আতরের স্ল্যুইস গেট ... সুগন্ধের ফ্রস্টেড ঘ্রাণ ... সেই গন্ধ – লেবরোটোরির খোলা দরজায় বৃষ্টিদিনের কাজরী-লাজুকে সূর্যমুখী সংক্রান্ত আমার মেয়েবেলার ম্যুরাল ... ছবির প্রতিবিম্ব ... স্কোয়াড্রন নেমে আসছে আর আমাকে বলছে , আমার পাতাটি মুড়োনা কখনো ... আমাকে রাখো সদাশান্ত আর শীতল প্যালেসে , আমাকে বাঁচাও করোটি আর মূর্ছনার টেলিস্কোপে ... আমাকে রাখো ... নোটিশহীন । আবরণহীন , আব্রুহীন ... আরব্যরজনীর প্যানোরমায় ... আমাকে রাখতে পারো ১৮০ ডিগ্রি কাঞ্চনে , জঙ্ঘায় , আমাকে রেখো , তোমার প্রথম হাতে লেখা ধ্বংস এবং নির্মাণের বল্লমে , যুদ্ধরেখায় ... 

আলোর বৃত্তাকার আমার হোস্টেল জীবন ... ভিড়ের মধ্য থেকে ছিটকে আসা কল্লোলের জমিজমা ... 

বাদশাজীবনের অমোঘ সম্রাট ... যেন আমি টলটলে খুব... নিপুণ স্বরে দেদার বিলিয়েছি ... মহেঞ্জোদড়ো আর হরপ্পপার স্নানঘর গানঘর ... আই মাস্ট সেলিব্রেট মাই ডেস্টিনি ... এই ধূমধাম বেঁচে থাকার লাবণ্য ... যা এতো কাল পরেও ধাউস ব্যাগ বোঝাই এক লগহাউজ ... স্মৃতিস্তনের দুধে বাসন্তিক রেখেছে আমাকে, আমার সোহিনীকাল, সেই অগ্নিবর্ণা ... 

নিজের বাইরে এসে দেখি ... এখনো ভেতরে একগোছা কমলা আলোর ফিঙেপাখি ... আমাকে দেখে ... সে বলে , তুমি কি এখনো ইতিহাস প্রেমিক ?আজো ইতিহাস গায়ে মেখে আছো নাকি ? 

আমি হেসে উঠি ... না না ... এখন ইতিহাস পড়িনা আর ... এখন শুধু ফল্গুনদীটি ... এক তীরে পিতৃপক্ষ ... অন্যদিকে কুশাসন যব তিল ফুল আর ফলের পুঁটলি ... এখন এক ব্যক্তিগত তর্পণ ... তবে এখনো সুধারসের ভেতরে ইতিহাসের কর্পূরী গন্ধ ... পাতার কোমরবন্ধে লেগে আছে ... আমার অলঙ্কারের জল কাদা মাটি ... শব্দটি টের পাও কি ? 

টের পাইতো ... তবে ইতিহাস পড়তে আর ভালো লাগে না ... বরং দেখতে ভালো লাগে ... ইতিহাস আঁকতে আরও বেশি ভালো লাগে ... ইতিহাসের পারাদীপ পেরিয়ে ভূগোলের ভেলোসিটি ...টোপোগ্রাফির ভেসেলগুলো আমাকে ভাসিয়েছিল কার্গোর ওজোন হোলে ... আন্ডার ওয়াটার নদীগর্ভ ... জলের নিঃশ্বাসে আমার মেয়েবেলার মনসবদার ... আমার ... উত্ততেজনা ... আমার প্রথম পিরিয়ড ...বরজ ভরা রক্তের রূপ ...প্রথম ব্রেসিয়ার শোভিত বুকের রূপ ... অঢেল পাহাড়ের বৈধ – গঙ্গাবেসিন ... নিজের বুকে নিজের হাত বোলানোর অভিজ্ঞতা ... সেই সব তন্ত্রের মন্ত্রের ক্যাসুরিনা ... নিজেই নিজেকে আদর ... আদর খেতে খেতে এক কুঠুরি চিলাপাতা ... যা হাল্কা ফরেস্ট অথচ ভারি অরণ্য ... 

আহা ! কুয়োর পিঠে চড়ে মরুবালির চরে হাঁটা চলা ... আমি তখন প্রায় যুবতী তবু যেন বহু প্রাচীন ... প্রাচীনের হলদিয়া ... আহা ! অমন হলদে নদীর বন্দর কন্দর ... উপকন্দরের স্যান্ডহেড , বালির মাথায় নোঙর ফেলে আজও দাঁড়িয়ে আছি ... কই ... কোনো ড্যামারেজ তো লাগছে না ... আমার মেয়েবেলার রিবার্থ ঘটাবে এমন স্পেস আর নেই ... তবু জায়গার অভাব কিছুই ঘটছে না ... ভাবা যায় ? ফয়েলে মোড়া ফসফরাস , গরমাগরম এই জীবন , মিঠাই বুলিয়ে সম্মোহনের হটকেক চারিয়ে দিয়েছি ... চরাচরের অনুরাধায় ... হে আমার মেয়েবেলার কোস্টলাইন ... 

এই যা ... আসল প্রশ্নটাই করিনি ... মেয়েবেলা আসলে কতদূর ? কত ঘণ্টা কত সেকেন্ড কত মিনিটের বারফট্টাই এই মেয়ে বেলা ? আমি কি মেয়ে নই আর ? 

বিবাহিত বলেই কি মেয়ে নই আর ? স্ত্রী হয়ে আছি ? গৃহিণী শুধু ? নাকি এখন আমার শুধুই মা-বেলা ... মা বলে কি আর মেয়ে নই ? আমি কি বাইশের কিশোরী নই ? শুধু চুয়াল্লিশের ? আমি কি ঠোঙাকাগজের ফ্রন্ট পকেট ? আমি কি আমার জীবনের হিপ পকেটে লুকোনো পুরনো ডাকটিকিট ?

হে জীবন ! ওগো ড্রাইভার ভাই , একটু দাঁড়াও এখানে । এসিটা বন্ধ করে দাও ... ঠাণ্ডাটা কমুক একটু ... বাইরে এখন পঁয়তাল্লিশ ... তাপমাত্রা ... জানি ... জানি ... আমারি বয়েস প্রায় ... জ্বলছে ... জ্বলছে ... অনবোর্ড তারকাদের পুরনো বোতল ... নতুন মদ ... এক রাউন্ড সিগারেট হয়ে যাক , এসো ড্রাইভার জীবন ... তোমাকেও একটু পান করি ... ফেডেড জিন্স পরা তোমাকে টেন্সড মনে হচ্ছে ... টেনশন কিসের ? এই নাও ... চিউং গাম ... আঠাহীন বুম বুম ... চলো ... তিন তলা বুমার থেকে দুজনেই ঝাঁপ দিই ... আমার মেয়েবেলা আর তোমার ছেলেবেলা ঝাঁপ দিই এক সাথে ... 

চল , নতুন কিছু লেখা যাক ... তুমি আমার মেয়েলি লেখো , আর আমি তোমার ছেলেলি ... নইপাল পড়েছ ? চল , আমরাও নতুন কোন ভ্রমণ , ট্রাভেলগ লিখি ... হেভেন লেকের সারপ্রাইজ থেকে ম্যাগনামের বিস্ময় ... 

টেল মি , জীবন ... আমার কি সব শেষ ? স্মোকের চাদরে ধোঁয়া লেগে লেগে কি পুড়ে গিয়েছি সম্পূর্ণ ? চাঁদপালের বুদবুদে, তানপুরায় ... আমার একটা পেরেনটাল টালমাতাল ছিল না ? শতকরা হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কোথায় আমার পৈতৃক জেটি ? 

না ... হারায়নি কিছুই ... অক্ষত যোনির মেয়েবেলা ... কুসুমে কুসুমা ... ওঃ কী দারুণ যে লাগছে ... এই যে অপেক্ষা করছে ফেরি ... সনাবাথের সোনা তরী অপেক্ষা করছে ... রাস্তা কি খারাপ ? না না ... অই যে একটা বেশ বড় আকারের ওয়াকিটকি ... আমি তো একখানা ছোট্ট লঞ্চমানুষ ... পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওলটপালটের মুখে গিয়ে পড়ছি ... সামান্য উতলা ... উদগ্রীব ...তবু স্যুইচ অনের আলো জ্বলে উঠছে মুখে চোখে ... ভেসে উঠছে মেয়েবেলাটি ... আমার এযাবত দুর্গাপুজা, সমস্ত সমেত ভেসে উঠছে ... নতুন শাড়ি ... চুড়িদার ... ওড়নাবেলার শৃঙ্গার ভাণ্ডার ... 

সেই অগাধ প্রাচুর্যের ভান্দারায় বারো দুয়ারী হৌস ... হুঁশ থাকছে না ... বহুদিন বহুকালের পুরনো আমি কি খুঁজে পেলে একটু কেমন কেমন লাগে না ?

লাগে বৈকি ...




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.