কবিতা টা নকশাল আমলে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এ আর রহমান ওটায় অতি আধুনিক ভাবে সুরারোপ করে ইউ টিউব মাতাচ্ছেন। বাংলা ভাষা কে খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করার চেষ্টা করেছেন। আর তার সাথে এটির হিন্দি অনুবাদ টিও আছে। আমার এই কবিতাটা একটু শব্দ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হল।
১৯১৭ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পড়লেন রবি ঠাকুর। তার পাঠের পর প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল আমি জানি না। পৃথিবীতে সে বছর আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল । রাশিয়ার জার কে টেনে ফেলে দিচ্ছে সমাজতন্ত্র। মোদ্দাকথা বুড়ো বুঝতে পারছিল একটা বড়সড় পরিবর্তন আসছে। আর একটা “ভারতবর্ষ” যে জন্মাবে সেটাও আন্দাজ করেছিল। বাড়িতে মেয়ে কিংবা বৌরা গর্ভবতী হলে সাদাচুলের বুড়ো বুড়ি গুলোর অকারণ স্নেহ ছলকে ওঠে।আদিখ্যাতা ওই আর কি! “বাবু আমাদের এমনি হবে।তার যশে সারা পৃথিবী ভেসে যাবে।” ঠিক অমনি এক আশা আর স্বপ্ন নিশ্চয় ছিল তাঁর মধ্যে। সেই ‘দেশ’টার সর্বাঙ্গ সুন্দর রূপের ছবি তাঁর মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল।দেশ মানে একটা কমন ভৌগলিক সীমানার মধ্যে একটি দীর্ঘ ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক অবস্থা, পরিবার নিয়ে পাশাপাশি থাকা। “এক জাতি” হওয়া। তিনি তাঁর আপন জাতির কাছ থেকে প্রচুর ধাক্কা খেয়েছেন। তবু , আশা ছাড়েননি। লিখলেন ১৯০০ সালে “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,” – অভয়ম্। বৈদিক দর্শনের মূল সুর।সেই ‘দেশে’ হৃদয় নাকি মস্তিষ্ক যাই হোক ভয়হীন হবে সবার । কি অপূর্ব স্পর্ধা!যে দেশে তখনো অর্ধেক লোক রাতে কিছু না খেয়ে ঘুমাতে যায় সেখানে অভয় থাকবে মনন জুড়ে। স্বামিজির “একমুঠো ছাতু খাওয়া ভারতীয়” পৃথিবী উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আসলে মানুষের পূর্ণতা আসে নির্ভীক হলে। আমার খুব ব্যক্তিগত মতামত হল রবি ঠাকুর সম্ভবত এই নির্ভয় হওয়া টা কেবল দৈহিক সুরক্ষার কথা বলে ভাবেন নি। মনে হয় আরও একটু উচ্চতর নির্ভয়তার কথা বলেছেন। স্বাছন্দ্য হারানোর ভয়, হেরে যাবার ভয়, অন্যের পাশে ছোট হয়ে যাবার ভয়, সাধারণ হয়ে যাবার ভয়, বিশেষ সুযোগ সুবিধা না পাওয়ার ভয় আরও বহুমাত্রিক জটিল ভয়। এই সব ভয়ের থেকে উঠে দাঁড়ানো মানুষের ‘শির’ তো উচ্চে থাকবেই।হৃদয় দোলাচল হীন হলে মস্তিষ্ক অবশ্যই স্নায়ু, আর মনের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে।কিন্তু হায় গো ভারতবাসীর যে একটা বিকট জৈবিক জীবন আছে। তাতে উদর,ফুর্তি আর যৌনতা আছে। বুদ্ধিবৃত্তির ঠিক ততটায় দরকার আর উৎসাহিত হয় ঠিক যতটা অর্থ-রোজকারে লাগে। তারপর ‘শিরে’র আর ব্যবহার নাই।টিভির মত একটি শক্তিশালী গণমাধ্যমে,আগডুম বাগডুম সিরিয়াল চলে কি করে? এখনো সংখ্যাগুরু ভারতীয়র কাছে বুদ্ধিমত্তা মানে ইংরেজি ভাষায় কথা বলা,চকচকে থাকা,গ্যাজেট ব্যবহার জানা , মানে কিছু নাগরিক দক্ষতা। যিনি দিনের পর দিন চাষের জমিতে ধীর অপেক্ষায় ফসল তৈরি করেন তিনি ফালতু লোক। আর সেই মা পাঁচ বাড়ি কাজ করে নিজে নিরক্ষর হয়ে সন্তান কে কলেজ পড়াতে পাঠান তিনি অশিক্ষিত। আর যিনি পাঁচহাজার টাকা আয় করে বুড়ো মাকে প্রাণপণে শুশ্রূষা দেবার চেষ্টা করেন তিনি তো ‘অর্থনীতি’ শব্দ টা কোন দিন শোনেননি।আর যারা সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন নি তাদের মধ্যবিত্ত বাঙালী কি ভাবে ? কি অদ্ভুত ভাবে আমাদের মনন আর চিন্তা করার ক্ষমতা কত গুলো ভুল ধারনার শিকলে বাঁধা হয়ে আছে।এই গুলো কি ‘বুদ্ধিমত্তা’ নয়? এই প্রশ্নে আমাদের সাধারণ ‘বুদ্ধিতে’একজন ‘ঠগ’ সৎ মানুষের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান হয়।
ভারতবর্ষের দীর্ঘকালীন সভ্যতায় তত্ব আর তথ্য দুই কিন্তু অভাবনীয় রকম প্রসারিত।আর ঠিক অন্যদিকে এক শ্রেণীর কাছে আবদ্ধ। একটি গরীব শিশু সেই জ্ঞানের কাছে পৌঁছাতে যে পরিমাণ বাধার সন্মুখিন হতে হচ্ছে সেটা কহতব্য নয়।যত কিছু সাহায্য রাষ্ট্র করুক। সমাজ দেয় কি? তার অভিভাবক পিছিয়ে আছেন। সমাজ তার এগিয়ে যাওয়া কে সোজা ভাবে নেয় না। দুর্গম রাস্তা। এছাড়াও “ জ্ঞান যেথা মুক্ত,” রবিঠাকুর ভেবে চললেই তো হল না। “সব ব্যাদে আছে” এই ধারণা ও যে আছে আজো। বেদ কেন যে কোন প্রাচীন গ্রন্থ আমার কাছে প্রিয় কিন্তু সব টা তাতেই আবদ্ধ নয় কিন্তু। আধুনিক বিজ্ঞান ,নতুন জ্ঞান, নতুন মনন, মানুষের বদলে যাওয়া আচরণ নিয়ে চর্চার প্রয়োজন আছে বৈকি। “মুক্ত” শব্দটায় আজো বুঝি না আমরা। এখনো “বুঝিয়ে দেওয়া টা”কে সার বলে জানি। আজো বিজ্ঞান পড়া ছেলেমেয়ের মা জ্যোতিষে অগাথ বিশ্বাস রাখেন।এতবড় দেশের যে জটিল সংসদীয় কাঠামো তার সম্বন্ধে রাজনৈতিক দলের কর্মী, এমন কি নেতাদের ও সম্যক ধারণা নেই। মুক্ত জ্ঞান নেই গো বিশ্বকবি। তুমি বড্ড ভালোবেসে লিখেছ।
১৯০০ সালে একটা ছোট জন গোষ্ঠীর ভাষাতে যে কবিতা তুমি লিখছ রবি বাবু সেখানে বাড়ির বেড়া পার করে, পাড়া, গ্রাম,জনপদ, দেশ পার করে যে এক বিরাট অখণ্ড বসুধা আছে তার কথা জানাতে চাইছ। আমরা যে আপনি আর কপ্নি ভিন্ন ভাবি না। আমাদের বাড়ির বাচ্চাটা রোজ রাতে দুধ দিয়ে ভাত খায় এটা যেমন সত্য তেমনি চিকেন ছাড়া ভাত খায় না অনেকে সেটাও সত্য, আর তার পরেও একটা সত্য আছে যে অনেক শিশু এক পেট খিদে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাতে ঘুমাতে যায়। মনের আর মেধার বিস্তৃতি চাই। বুঝতে হবে সবার ‘ভগবান’ বাঁশী নাও বাজাতে পারে। তাই না। “বসুধা”রে ক্ষুদ্র করে রাখলে মেধা যে বিকলাঙ্গ হবে। উপায় দাও রবি বাবু।
দেশের মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারবে । হ্যাঁ গো... বুড়ো চেয়েছিল সেই ‘স্বাধীন বাক’। “বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে”। উচ্ছসিত মতামত জানানো সুখী আর সভ্য দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট। অথচ আমরা ডেমক্রেসিনে ক্যায়া ক্যায়া চিজ্ দেখা ভাঁইয়ো অর বঁহেনও । মিথ্যাচার, ক্ষমতার অপব্যাবহার(যে দল যখন ক্ষমতায় থেকেছে সকলেই এটায় করে),আসল খবর প্রকাশ হতে না দেওয়া-দীর্ঘ তালিকা। মতামত শব্দ টা ভাঙলে মতের পাশে ‘অমত’ টাও আসে।শক্তিশালীর সাথে অমত হলেই... গলা টিপে ধরে। “উচ্ছ্বসিয়া উঠে” ফেসবুক পোষ্ট না করায় ভালো টা আর কে না জানে।
এমন একটা লোক এই কবিতা টা লিখছেন যার কলম কখনো থামে না। সদা ব্যস্ত অর্থাৎ “অলসতা” থেকে বহু গুণ দূরে। তিনি তো লিখবেন, “দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়”। উরিব্বাস। এই জায়গাতে আমরা একটু ঘ্যাম দেখাতে পারি গো রবি বাবু। আমারা বাচ্চা গুলো কে গুঁতিয়ে গাঁতিয়ে কিংবা প্রতিভার জোরেই হোক সারা পৃথিবীতে নানান কাজে পাঠিয়ে চলেছি। যারা অন্য দেশের উন্নয়নের জন্যে খুব খাটা খাটনি করে চলেছে।
তাঁরা আমাদের রাজনীতি সমৃদ্ধ করে না, গবেষণা সম্বৃদ্ধ করে না, নতুন ব্যবসা তৈরি করে না… তাঁরা চলে যায়। তাঁদের চলে যেতে হয়। বাথরুমে গিয়ে হাগু করতে হয় , এখনো সেই জন্যে সরকারী বিজ্ঞাপন দিতে হয়। এখনো ভিখারি হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে শপিং মলের ধারে। আচ্ছা ‘চরিতার্থতা’ কথা টার মানে কি বলুন তো?
আমাদের রাস্তা, প্রকল্প, হাসপাতাল তৈরির জন্যে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানের মতো শিলান্যাসের মতো অদরকারী উৎসব হয়ে থাকে। কেন?এই আচার সর্বস্ব রাজনীতি কিংবা লোক দেখানো প্রবণতার কোন সত্যি দরকার আছে? রক্তদান শিবিরে জোরে জোরে মাইক বাজানো... কম্বল দানের সময় গরীব মানুষ টিকে আরও “গরীব”করে ছবি তুলে... কি হয়? আমাদের ধর্ম গুলো উচ্চকিত ভাবে শুধু আর্থিক শ্রেণী বিভেদ বুঝিয়ে দেবার উৎসব করে। মানবিক বা আধ্যাত্মিক কোন স্ফুরণ দেয় না। আনন্দ ও দেয় না।
কারণ টেক্কা দেওয়া থাকে সোজা কথা অনেক কিছু পাবার উদ্দেশে আমরা এখন উৎসব করি। যেখানে দেবার ইচ্ছে থাকে না...।আচার সরিয়ে না দিলে... “বিচারের স্রোতঃপথ” খুলবে কি করে? নাকি ঐ পথ বন্ধ করে রাখাটার মধ্য দিয়ে কিছু মানুষ ‘করে খাবে’ !
এইবার হল মুস্কিল।রবি ঠাকুর ঘন কুয়াশায় ঢাকা ব্যাপারটা বললেন,“সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা” আর তাঁকে আবার পিতা বলে ডাক দিয়ে বলছেন, যদি এই সব কথা এই ‘দেশের লোকজন’ না মানে, না পালন করে তাহলে ধরে প্যাঁদাও। এ আর রহমানের গাওয়া ‘জাগাও মেরে দেশ কো’ গানটিতে পরিস্কার ‘প্রহার কর’ ‘প্রহার কর’ বলে ভালো রকম চিৎকার দিয়েছেন।কিন্তু এই পিতা টা কে রে বাবা। আমাদের সংবিধান, ঈশ্বর, ইয়োরোপীয় পিতার মত দেবতা, জনতা, নাকি সচেতন বিবেক? একটা তো বাজখাঁই গলার স্কেল হাতে কেউ এসে দাঁড়াবে। ও রবি ঠাকুর... বলি ডাকছি তো সাড়া দাও।
(কবিতা টা একবার উচ্চস্বরে পড়বেন।স্কেল হাতে কেউ যদি আসেন)
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ;
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত॥
সুচিন্তিত মতামত দিন