জয়তী রায়

হাবা কুমারের জীবন যাত্রা ২
হাবা কুমার থেকে ছোট ঠাকুর।
চরৈবেতি, চরৈবেতি
-----//////----------------

নিতাই ঠাকুরকে নিয়ে পেরে ওঠেনা আশ্রমের লোকজন। অর্থ কৌলিন্য না থাক, ছোট আশ্রমটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । মাটি আর সুড়কি মেশানো রাধামাধবের মন্দির। লাইট ফ্যান আনার সামর্থ নেই। ঘিয়ের প্রদীপ, হ্যারিকেন, উৎসবে হ্যাজাক এই যথেষ্ট। গুটি দশেক বৈষ্ণব সারাদিন হরিনাম করে, তুলসী বীজ থেকে ওষুধ বানায়, সেগুলো বিনি পয়সায় বিলি করে, নিজেদের অসুখ বিসুখেও বেশ কাজে লাগে। গাঁ গ্রামে, এখনো কাঁচা হলুদ, থানকুনি ,বাসক নানা পাতা, তিল তুলসী এই সব হলো ওষুধ। আশ্রম মূলত দান দক্ষিনায় নির্ভর। মাধুকরী এখন তেমন আর হয় না। তবে ,বাইরের কিছু ভক্ত আছে, যারা অর্থের দিক দিয়ে শক্তিশালী, তারা নিয়মিত সাহায্য করে থাকেন। মাঝে দুজন বিদেশী ভক্ত মায়াপুর থেকে এসেছিল। অনেক ছবি তুলে নিয়ে গেল। বিদেশী হলেও অতুলনীয় কৃষ্ণ ভক্তি তাদের। ভাঙা ভাঙা বাংলাতে মন্দিরের খুব প্রশংসা করে , অর্থ সাহায্য, ট্রাস্টি , মন্দিরের খরচ নিয়ে প্রশ্ন করলেও নিতাই ঠাকুর পাত্তা দেন নি। দামোদর গোঁসাইএর রাগ ওখানেই। এমন টিক টিক করে চললে বেশিদিন আর হরিনাম করতে হবেনা-- এমন কথা বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে দামোদর। আসলে এই মন্দিরের বিগ্রহ প্রাচীন। প্রায় দুশো বছর বয়স। মন্দির এবং বিগ্রহের প্রচার কম। দামোদরের বক্তব্য প্রচার হলে লোক আসতো আরো অনেক।

আশ্রমের প্রধান নিতাই ঠাকুরের বয়স নব্বই। পরম্পরায় এনারাই পূজো করে আসছেন। দেবোত্তর সম্পত্তি জমিজমা আছে কিছু। সব কিছুর মালিক মদনমোহন। জন্মাষ্টমী উৎসব, রথ যাত্রা -- এই সবে লোক হয় অনেক। আশ্রমে খিচুড়ী ভোগ হয়। আরো খরচ আছে। গৃহত্যাগী দশজন বৈষ্ণব , দুজন বয়স্কা বৈষ্ণবী , তা ছাড়াও এদিক ওদিক নানারকম বিপদ আপদে সাহায্য করে থাকে আশ্রম।

বয়স হলেও , নিতাই ঠাকুরের শক্ত পোক্ত চেহারা হালে অবিশ্যি ঝুঁকেছে সামনের দিকে। নির্লোভ মানুষ। ভক্তদের চাপ দিয়ে এক পয়সা আশ্রমের জন্য নিতে চান না। বোঝেন, কিছু গোঁসাই লোভহীন নয়। বিশেষ করে দামোদর গোঁসাই।

কিন্তু , নিতাই ঠাকুর আমল দেন না। তিনি কণ্ঠী বদল করেন নি। স্ত্রী পুত্র কিছুই নেই। তার অ বর্তমানে অবধারিত ভাবে আশ্রমের প্রধান হবে দামোদর। সে বিপত্নীক। এক পুত্র আছে। সংসার ত্যাগ করে এসেছে বটে, কিন্তু মনের মধ্যে সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যাক। যা হয় হবে। মদনমোহন নিজের ভার নিজেই নেবেন।

আসলে ,আগে নিতাই ঠাকুরের ছিল কর্মই ধর্ম। এখন সন্ধ্যেবেলা খোল নিয়ে বসে আর উঠতে চান না। ঝকঝকে পেতলের মদন মোহন , প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় হাসে যেন, নিতাই ঠাকুরের গলায় কৃষ্ণ নাম, মুদিত চোখে জলধারা, মুখে অপার্থিব হাসি। সময় বয়ে যায়, জ্ঞান নেই, বিরাম নেই নাম গানের।

আশ্রমে সকলের পেটে খিদে, চোখে ঘুম। ভোরে ওঠো, গোবর ছড়া, জীব সেবা-- রাজ্যের কাজ। কিন্তু, ওনাকে এখন কে ধাক্কা দিয়ে বলবে? বাবা জাগো , প্রাণ যায়।’ গজ গজ করে সবাই দোহার দেয়--’ হরি বোল হরি বোল হরি বো ও ও ল।’

অনেক্ষন ধরে আশ্রমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল হাবা। গঞ্জের বাইরে সে কখনো যায়নি। স্বভাবে কুনো তার দৌড় ওই বাজার পর্যন্ত ছিল। আজ কি যে হলো, কে যেন তাকে এক ধাক্কায় তাড়িয়ে নিয়ে চললো, একটা গোঁ , একটা অদম্য জেদ-- নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে যাওয়ার বাসনায় কতদূর এসে পড়েছে খেয়াল করেনি। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে সে দেখলো একটা অচেনা গ্রাম। নদীর পাড় ধরে হেঁটেছে। চেনা নদী অচেনা হয়েছে ক্রমশঃ। তাদের গঞ্জের রুক্ষ্ম রূপ বদলে মাঠের পরে মাঠ, ধানের ক্ষেতে সরু আলপথ , খড়ের চালের মাটির ঘর, মাঠের পারে সূর্য ডুবে গেল টুপ করে। তবু আলো ছড়িয়ে রইলো ঘাসে, নারকেল সুপারি গাছের পাতায়, তার মধ্যে ভেসে এলো সেই সুর, হরি বোল হরি বোল--সুরের টানেই হবে, মাধবীলতার বেড়া দেওয়া আশ্রমের দুয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙলো এক অচেনা হাতের ছোঁয়াতে। প্রথমে ভেবেছিলো মা। অস্ফুটে মা বলে ডেকেও ফেললো ,চোখ মেলে দেখে মুখ জুড়ে আঁকিবুকি ,মায়া ভরা দুটি চোখ, জোনাকি জ্বলা অন্ধকার, ঘুম ভরা চোখে এর বেশি কিছু দেখতে পেলো না। ইচ্ছেও হলো না। ভেতরে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা খেতে দিলো তাকে, ঘিয়ের গন্ধে ভুর ভুর , শালপাতায় খাবারটি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো মাটির দাওয়ায় , চটের বিছানায়।

#

সকালের প্রশান্ত আলোয় আশ্রম বড়ো সুন্দর। যে যার কাজে লেগে পড়েছে। মুখে মুখে হরিনাম চলছে। হাবা বুঝতে পারে, একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে ঢুকে পড়েছে সে। পাশের পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে, নিতাই ঠাকুর হাতছানি দিয়ে ডেকে পাশে বসতে বললেন। কিশোরের ডাগর কৌতূহলী অথচ নিরাসক্ত চোখ দুটি ওনাকে টানছিল বড়ো। মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন---’ বাড়ি থেকে পালিয়েছ বাবা?’

প্রশ্ন কর্তা সেই স্নেহময় বৃদ্ধ। যার মুন্ডিত মস্তকে , টিকি তে ফুল গোঁজা, গলায় কণ্ঠী, পরনে এক পুরোনো ধুতি। তিলক কাটা বুকে, কপালে। হাবা ভাবছিল কি বলবে! অনেক দূরে সে আসেনি বাড়ি থেকে বোঝাই যায়। মা তোলপাড় করছে ,চায়ের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে মা! সঙ্গে কেউ আছে কি? ফুলি? এক মুহূর্তের জন্য বুকটা মুচড়ে উঠলেও সামলে নিয়ে সে সত্যি উত্তর দিলো--’ পালিয়ে এসেছি। ইচ্ছে করলো, তাই চলে এলাম!’

---’ ঠিক বুঝেছি ঠাকুর, তুমি সেই ঘর ভোলাদের দলে গো। তা কোথায় সেই বাড়ি? যা তুমি ছেড়ে এসেছো?’

----’ রঘুনাথ গঞ্জ।’

--’ওওও সে তো আমাদের এই মধুপুর গাঁ থেকে আট ক্রোশ দূরে। অনেক হেঁটেছ বাপ আমার। তা এখন কি ভাব আমার ঠাকুরের? ফিরে যাবা ?’

সবেগে মাথা নাড়লো হাবা। ফিরে সে কিছুতেই যাবে না।

--’ আচ্ছা আচ্ছা। এখানেই থাকো। মাধুকরী করে খেতি হবে বাবা। গলায় কণ্ঠী, কপালে তিলক, ধুতি উত্তরীয় --জ্যান্ত মদনমোহন ঘুরে বেড়াবেন এবার থেকে আশ্রমে। হরি বোল। হরি বোল।’

এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে কাজ করে বেড়ানো ভক্তদের কণ্ঠে বেজে ওঠে --’হরিবোল হরিবোল।’

শুধু নিচু স্বরে দামোদর বাবাজী বলে উঠলেন--’ আপনি শুতে ঠাঁই পাই না ,শংকরাকে ডাক।’

--’ জয় শ্রী কৃষ্ণ। কিছু বললেন ঠাকুর?’

দামদরের প্রতাপ আছে। ভক্তদের মধ্যে,আশ্রমের পরিচালনাতে --দামোদরের থাবা বসছে ক্রমশঃ। মাধুকরী আর শুদ্ধ ভক্তি --দুটোর কোনটাতেই আস্থা নেই তার।

--’ কিছু বলিনি। নিজের কাজ করো।’ খেঁকিয়ে উঠলেন দামোদর বাবাজী। ভক্ত তার এহেন আচরণের সঙ্গে পরিচিত। সে অল্প সরে গেল।

#

দিনতিনেক কেটে গেল আশ্রমে । সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, তার নাম কি কেউ জিজ্ঞেস করেনি। সবাই তাকে ডেকে ছোট ঠাকুর বলে। যেন এটাই স্বাভাবিক। তার আগে কি নাম, কি ধাম খুব বেশি ব্যাকুল কেউ নয়। মন্দ লাগছে না জীবন। সন্ধ্যেবেলায় নাম গান তাকে আকর্ষণ করছে। ওই যে চারিদিকে মাঠ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসা, ওই যে আকাশ বাতাস গাছ পালা ভেদ করে শঙ্খ ধ্বনির সঙ্গে হরি বো ওওও ল বলে ওঠা, ধূপের গন্ধ, ঘিয়ের প্রদীপের আলো--মুন্ডিত মস্তক লোকগুলির মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কৃষ্ণ নাম গান, বিশেষ করে নিতাই ঠাকুর যেন ডুবে যান নাম সংকীর্তনে। সে ঠাকুরমন্দিরের বাইরের মাটির দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে শোনে। বাইরে অন্ধকার পৃথিবীও যেন শোনে চুপ করে। সে দেখেছে, উঠোনে বসে আছে কুকুর, বেড়াল। চুপ করে নাম গান শুনছে সারা পৃথিবী। অবিরল জল পড়ছে নিতাই ঠাকুরের বন্ধ চোখ দিয়ে। কিন্তু মুখে এক অপার্থিব আনন্দের আলো।

সংকীর্তন শেষ হবার পরে ভাগবত গীতা পড়ে ব্যাখ্যা করেন নিতাই ঠাকুর। কিছুতেই ওনার ক্লান্তি আসেনা। ব্যাখ্যা কেউ মন দিয়ে শোনে বলে মনে হয়না। হ্যারিকেনের আলোয় কাঁপা কাঁপা সুরে বৃদ্ধ বলে চলেন --” শরীর একটি ক্ষেত্র। যখন হৃদয় দেশে দৈবী সম্পত্তির বাহুল্য ঘটে , তখন এই শরীর ধর্ম ক্ষেত্রে পরিণত হয়, আর যখন এতে আসুরিক সম্পত্তির বাহুল্য ঘটে, তখন এই শরীর কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়।

প্রকৃতি জাত তিনটি গুণের বশীভূত হয়েই মানুষ কর্ম করে। সে ক্ষণ মাত্র কর্ম না করে থাকতে পারে না। কুরু মানে করা। মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কর্ম করে। ওটাই তাঁর ধর্ম। অতএব জন্ম মৃত্যুময় এই ক্ষেত্র, বিকার যুক্ত এই ক্ষেত্রই কুরুক্ষেত্র এবং পরমধর্ম পরমাত্মাতে প্রবেশ প্রদান করতে পারে যে, পুণ্যময় প্রবৃত্তি সমূহ ,সেই পুণ্যময় প্রবৃত্তি সমূহের( পাণ্ডবের) ক্ষেত্রই ধর্মক্ষেত্র। “

হাবা কুমারের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায় এসব শব্দ গুলি। সে বোঝে এ এক অন্য জগৎ। তার গঞ্জ, ফুলি, চায়ের দোকান, মা -- সব কিছু থেকে আলাদা। তাকে যখন এরা ছোট ঠাকুর বলে ডাকে, কেমন অন্যরকম লাগে। আগের মতো নিজেকে ফ্যালনা মনে হয় না । স্বভাবত সে কম কথা বলে। তারপরে যেটুকু কাজ তাকে দেওয়া হয়, খুব শান্ত ভাবে, সুন্দর করে কাজটি সে সম্পন্ন করে। ছোট ঠাকুর নামটি উচ্চারণ মাত্রে সে মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন সংকীর্তন হয়, বা গীতা পাঠ, সে নিজেকে অসহায় বোধ করে। হাবা কুমার আর ছোট ঠাকুরের মধ্যের ফারাক কাটাতে হলে তাকে শিখতে হবে অনেক কিছু। এই প্রথম কিশোর হাবা কুমার অনুভব করে নামের একটা মস্ত বড়ো ভার আছে। তাকে বহন করার যোগ্যতা চাই। 

গোয়াল ঘরটির প্রতি আশ্রমের ভক্তদের বিশেষ সতর্কতা আছে। পরিষ্কার তো বটেই। প্রত্যেকটি গাভীকে আলাদা করে যত্ন নেওয়া হয়। হাবা কুমার আজ গোয়াল ঘর পরিষ্কারের কাজে সাহায্য করছিল। যে অল্প বয়সের ভক্ত গোঁসাই তার সঙ্গে ছিল, শক্ত পোক্ত চেহারা, এক মনে কাজ করতে করতে হাবা প্রশ্ন করলো--’ জয় শ্রীকৃষ্ণ। আপনার ঘর কোথায় ভাই?’

---’ জয় শ্রীকৃষ্ণ। পূর্বাশ্রমের কথা না তোলাই ভালো।’

--’ কিছু মনে করবেন না গোঁসাই। ‘ কুন্ঠিত গলায় হাবা বলে।

--’ না না। তুমি ছোট ছেলে। কিছু প্রশ্ন থাকলে করবে বই কি!’

---’ আমি আসলে সন্ধ্যে বেলায় ঠাকুর যা বলেন, কিছুই বুঝতে পারি না।!’ অসহায় গলাতে বলে হাবা।

উজ্জ্বল হেসে গোঁসাই বলে, --’ ও এই কথা। ধুর। ওতো আমরা কেউ বুঝিনা, ছোট ঠাকুর। ওতে কিছু হবে না।’ পরম আশ্বস্ত ভঙ্গিতে সে ধবলী গাইটির গলায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যেতে যেতে বলে--’ একটু হাত চালিয়ে বাকি কাজ শেষ করে চলে এসো ছোট ঠাকুর। একটু পরেই মালতী দিদি ফুল নিয়ে আসবে। বেছে তুলে, চন্দন মাখায়ে রাখতে হবে।’

হাবা বেশ অবাক হলো, এরা কেউ কিছু না বুঝেই সকাল সন্ধ্যে হরিনাম করে যাচ্ছে? নিতাই ঠাকুর বলেন কৃষ্ণ নাম করো, অন্তর থেকে একবার বোলো--’ হরে কৃষ্ণ।’ সে পড়াশুনো করেনি। কিন্তু তার কেমন মনে হচ্ছে, নিতাই ঠাকুরের ওই পাঠ আর তার ব্যাখ্যার মধ্যে কিছু সত্য লুকিয়ে আছে। যা শেখা দরকার। কিন্তু সে একে নতুন তায় মুখচোরা। তবু , তার মধ্যে জেগে উঠলো এক বাসনা, শিখতেই হবে। যে ভাবেই হোক। হাবা একটু অবাক হলো, নিজের ভাবনা দেখে। তবে কি তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে অন্য কেউ ?

joyeelove@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.