নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

খোলাম কুচি দর্শনঃ প্রথম পর্ব
স্বয়ং বুদ্ধদেবের কাছেও “বৃদ্ধ” অবস্থা দুঃখ জনক বলে মনে হয়েছিল। শুদ্ধোধন প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে দুঃখ না ‘চেনানোর’, সিদ্ধার্থ চিনে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে বুড়ো হয়ে যাবেন, তাঁর প্রিয়া যশোধরা একদিন জরাগ্রস্থ কুৎসিত হয়ে যাবে – এই ব্যাপার টা বুঝতে পারা থেকেই তিনি বোধিলাভের অন্বেষণে দিকে যাচ্ছেন। আর আমাদের ভারতীয় মহাকাব্যের সুপার হিরোরা কেউ বেডশোর হয়ে মারা যাচ্ছেন না।রামচন্দ্র তাঁর ভাইদের নিয়ে সরযূ নদীতে স্বেচ্ছায় সলিল সমাধি নিচ্ছেন। ভীষ্ম কে অগণিত বাণ মেরে তবে অর্জুন শোয়াতে পারছেন। ধৃতরাষ্ট্র ,গান্ধারী, আর কুন্তী বাণপ্রস্থের পরের ধাপ হিসাবে ‘সন্ন্যাস’ নিয়ে বনবাসে যাচ্ছেন। সেখানে নিদারুন দাবানলে তাঁদের মৃত্যু হচ্ছে। পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে চলছেন।মোদ্দা কথা হল, বিছানাগ্রস্থ, চোখে কমদেখা,কানে কম শোনা, চুঁইয়ে চুঁইয়ে মৃত্যুর দিকে কেউ এগোচ্ছেন না। কিন্তু আধুনিক মানুষের আদত সমস্যা এখন এখানেই।যে মূল জীবন স্রোত আছে সেটা খুব বেগবান। তার পাশে বুড়োবুড়িদের জীবনে দু ধরণের আলো এসে পরে একটা তীব্র অবহেলা অন্যটা হল অবসরের সুন্দর জীবন উপভোগ। আমাদের নতুন বোতাম টেপা ডিজিটাল জীবনে একটা বিশেষ যাপন পদ্ধতি উঠে আসছে রোজ,- বৃদ্ধাবাস বা বৃদ্ধাশ্রম। একটু খুঁজে দেখতে চাইছি। 

Old age home-শব্দটি আমি প্রথম জানি একটু ধাড়ি বয়সে। হস্টেল থেকে দল বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল “baby’s day out”। পুচকি সাদা বাচ্চাটির একটা পিকচার বুক আছে।বেবিসিটার তাকে জু, শপিংমল কনস্ত্রাক্সান সাইট,এর সাথে বুড়োদের থাকার জায়গা হিসাবে দেখিয়েছে।সে ছবিতে দেখা জায়গাগুলো নিজে নিজে চলে আসছে।ঝারির ঝারি সিনেমা। না বুড়োদের ব্যাপার টা খুব একটা ছাপ ফেলেনি। আসলে ওদের সিনেমায় যখন তখন চুমুর ব্যাপার টা থাকে সেটা ছিল না (পুরো পয়সা নষ্ট।) তবে বুড়োদের থাকার ব্যাপার টা একেবারে নতুন। “old age home” নিয়ে উইকি লিখছে এটা “retirement home”. গোদা ব্যাপার হল,কাজ ফুরোলে যে অবসর পেলেন, সেটা উপভোগ অথবা দুর্ভোগ করার বাড়ি। তবে একার নয়। একসাথে থাকবে। বুড়ো শরীরের ঘন ঘন সার্ভিসিং দরকার তার জন্যে চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকবে।এর সাথে সাথে খাদ্য ,পথ্য, ফুর্তি, বিশ্রাম, সব ‘নাচে গানে ফাইটিং’ এ ভরপুর।এই সব সুবিধা পয়সা দিলেই মিলবে।“old age home”শব্দ টির দু-রকম বঙ্গীকরণ পাচ্ছি। বৃদ্ধাবাস আর বৃদ্ধাশ্রম।আবাস হলresidence,house,

Home আর আশ্রম মানে hermitage, residential intuition। কেমন ধূপকাঠির গন্ধ আছে। ভক্তি, পূজা, নিরামিষ ভোজন মাখা ব্যাপার স্যাপার। খুব বেশী জ্ঞান দিয়ে ফেলছি। আরে না না আমি আসলে যা জানলাম তাই একটু জানলাম। আসলে বুড়ো হচ্ছি তো। ভাবতে হচ্ছে। আসলে খবরের কাগজে পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপণের পাশে চারকোনা খুপচিতে প্রচুর বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দেখছি যে। তাই একটু বলছি।

বিরাট পরিবার আর নেই। সেটা কেবল ‘ঘোষ বোস মিত্তির’ এর শহুরে শিক্ষিত বাঙালীর গল্প এটা নয়। সাধারণ চাষী, মাছের ব্যাবসাদার, রাজমিস্ত্রী,বংশ পরম্পরায় বিশেষ কুটির শিল্পী,মফস্বল এলাকার সুদীর্ঘকালের ব্যাবসায়ী প্রভৃতিদেরও পারিবারিক জীবন গুলিও ঘেঁটে গেছে। কখনো আধুনিকতা, কখনো জীবিকা...মানুষরা নিজেদের মানুষের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে, পরিবার ভাঙছে। গ্রাম ছেড়ে মানুষ আছে শহরে, শহর উঠে যাচ্ছে বড় শহরে, বড় শহর যাত্রা করছে অন্য দেশ। সর্বদা নতুন প্রতিবেশী, নতুন ভূগোল, নতুন করে বিশ্বাস গড়ে তোলা। বৃদ্ধরা একা হয়ে পড়ছে। পাশ্চাত্য জীবন যাপনে ও মননে এই ‘একা’ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা তার জন্যে কোন মানবিক পরিকাঠামো তৈরি করিনি , না মনন কে তৈরি করছি। মোদ্দা কথা সমস্যা টি ভয়ানক ভাবে জীবনে উপস্থিত কিন্তু সেটা নিয়ে আমরা ভাবছি না। 

সম্প্রতি আমার সাথে কথা হল সঙ্গীতা দে সরকারের। একটি গবেষণার জন্যে বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক দের সাথে তাঁকে কথাবার্তা চালাতে হয়। আমাকে সেই বিষয়ে বলতে গিয়ে বার বার ব্যাথিত হয়ে পড়ছিলেন।দক্ষিন কলকাতার একটি অভিজাত এলাকার বৃদ্ধাবাসের এক বৃদ্ধার কথা বলছিলেন। মাসে পাঁচ হাজার টাকা দিলেই “রাখা” হয় বৃদ্ধবৃদ্ধাদের। একটি সিঙ্গল খাট হল তাঁর পৃথিবী।সেখানেই পুত্রের মঙ্গল কামনাতে সন্তোষীমা পূজা, ঘুম, চুল আঁচড়ানো আর অবশ্যই মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা। তাঁর ছেলে কলকাতাতেই থাকে, অধ্যাপক। ছেলে দেখা করতে আসে কিনা তার উত্তর তিনি দেননি। তিনি স্বেচ্ছায় চলে এসেছেন কিংবা আসতে বাধ্য হয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আন্দাজ করা যায় ছেলের দামী জীবনে তাঁর থাকাটা অসুবিধা জনক।এখানে তিনি ভালো আছেন। আছেন? সঙ্গীতা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞাসা করেন, ছেলেও যখন বুড়ো হবে তখন তাঁর মতোই বৃদ্ধাশ্রমে আসবে কি না? ভয়ানক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান তিনি, “ না না সে বাড়িতে থাকবে। সে কেন আসবে?” আরো বিচিত্র কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা সঙ্গীতার। আমার নিজেরও একটি অভিজ্ঞতা- কিছুদিন একটি মাঝারি নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলাম। এক বিরানব্বই বছরের বুড়ি ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁকে আয়ারা সকলেই চেনে।জানতে পারলাম ভদ্র মহিলার পাঁচ প্রতিষ্ঠিত সন্তান। বিরাট এক বাড়ি আছে সেটা সব সময় জানাচ্ছেন সব্বাই কে। তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান নার্সিংহোমে ঘুরে ‘বেড়ান’। তিনি মনোজগতে আয়াদের কাউকে বড় বৌ ,ছোট বৌ বানিয়ে নেন। আমি তাঁর পাশের বেডে ছিলাম। আমি তাঁর বাড়িতে ‘বেড়াতে’ এসেছিলাম। ডাক্তার এসে পরিজন দের জানান “টায়ার্ড ঘোড়া এখন চাবুকের মার খেয়ে ছুটছে”। সঙ্গীতা জানাচ্ছিলেন, এক বৃদ্ধকে বৃদ্ধাবাসে রেখে গেছেন ‘বাড়ির লোকেরা’ তিনি নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা বলতে পারেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।তাঁর আদৌ কোন যত্ন হয় কিনা কে জানে। অপ্রয়োজনিয় জিনিস যেমন গাদা করে রাখা থাকে গৃহস্থের বাড়ির কোন ‘ভুলে যাওয়া কোনে’ এ রাও তাই। আছেন কিন্তু নেই। এর পাশেই একটি বৃদ্ধদম্পতির খবর জানি একটু অন্য রকম। একমাত্র ছেলে খুব বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। বেনারসের রামকৃষ্ণ মিশনের সিনিয়ার এক সন্ন্যাসী তাঁদের কথা জানালেন। তাঁরা দুজন বেনারসের রামকৃষ্ণ মিশনের বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। যারা দুজন অর্থাৎ যুগলে আসেন তাঁদের দুজন এক সাথে থাকার একটা বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখা আছে। কিন্তু তাঁরা দুজন আলাদা ভাবে থাকেন। ভদ্রমহিলা বৃদ্ধাদের সাথে। ভদ্রলোক বৃদ্ধদের সাথে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা স্মিত হাস্য সহকারে জানান, “দুজন আছি জানলেই সব আত্মীয় স্বজন আসবে...থাক।” 

সঙ্গীতা বলছিলেন , যদি কোন ভাবে এই মানুষ গুলি কে তাঁদের উপযুক্ত কোন কাজে নিয়োগ করা যেত! সদ্য অবসর প্রাপ্ত বা একা হয়ে যাওয়া মানুষগুলি হয়ত শরীরে কিছুটা দুর্বল কিন্তু তাদের স্নেহধারা টি উপচে যায়। সে পালিত পশু পাখি হোক বা নাতি নাতনী। সদাব্যস্ত মা বাবাদের ছানাপোনাদের যে ক্রেশ সিস্টেম আছে সেটার সাথে তাঁদের জুড়ে দেওয়া গেলে কেমন হবে? সঙ্গীতা বৃদ্ধাদের এই কথা জানাতে তাঁরা অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করেন। টাকা পাওয়া যাবে কিনা তাও জিজ্ঞাসা করেন। সঙ্গীতা অত্যন্ত নরম হয়ে জানাচ্ছিলেন যে ,টাকাটা তাঁদের কত দরকার। আমি অবশ্য এই ব্যাবস্থার কথা একজন সদ্য অবসর প্রাপ্ত কে জানিয়ে মতামত জানতে চেয়েছিলাম, তিনি জানালেন, “পাগল হয়েছ, হিসু করে প্যান্টু ভিজিয়ে এলে চেঞ্জ করতে অসুবিধা নেই।কিন্তু আধুনিক বাবা মা রা বলে বসবেন অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল। ওসব ঝঞ্ঝাট থাক।” নতুন মা হয়েছেন তিনি জানালেন তাঁর শাশুড়ির কাছে বাচ্চা কে রেখে যেতে পারেন না। তিনি বাচ্চাকে খাওয়াতে ভুলে যান। আর খুব অপরিষ্কার। এক ভদ্র পরিবারের সমস্যা শুনছিলাম। কিছু বিশেষ খাবার খেলে বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটি হজম করতে পারেন না। সারা বাড়ি পায়খানা করে বেড়িয়ে বেড়ান। অথচ সেটি না খেতে দিলে শাপ শাপান্ত।এক বৃদ্ধা কে নিয়ে আরও মারাত্মক সমস্যা। তিনি ঘোর অবিশ্বাসী। কুড়ি বছর সংসার করা বউমা কে সন্দেহ করেন ,ভাবেন বিষ খাইয়ে দেবে। বেচারি বধূটির সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত।কাঁচের জিনিস ভেঙে গেলে যেমন প্রত্যেকটি টুকরো খুব সাবধানে তুলতে হয়। আমাদের এই সমস্যাগুলিও তাই।

নানান জটিলতা। কেউ সকলের অজান্তে মারা যাচ্ছেন কেউ জানে না। কাউকে বন্ধ করে রাখছে। বাড়ি শুদ্ধ লোক বেড়াতে গেলে বাড়ির বাইরে বারান্দায় খাদ্যহীন, সুরক্ষাহীন ভাবে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন। রেল স্টেশনে ফেলে রেখে যাচ্ছে কাউকে।উপযুক্ত চিকিৎসা করছে না। আমরা এটা তথ্য হিসাবে জানতে পারছি কিন্তু সমাধান কি ? দ্বিতীয় শৈশবে পৌঁছেছেন তাঁদের মানসিক, আর্থিক, সামাজিক এবং শারীরিক সুরক্ষা দেবার জন্যে আমরা কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। আমরা কি প্রশাসন নামক নন্দ ঘোষ কে ধরবো। সামাজিক যে অতি স্বার্থপর “আপনি আর কপনি” বলে বাঁচছি আমরা সেটা ঠিক নয়। সন্তানরা ব্যস্ত হবে, অন্য কোথাও যাবে আরও দায়িত্ব পূর্ণ কাজে যাবে এটা তো স্বাভাবিক।আবার অমানবিক হবে এটা কিছুতেই সহ্য করা উচিৎ নয়। সেখানে শাস্তি পেতেই হবে।বুড়ো হবে মানুষ, সে দুর্বল হবে। সেটা অবধারিত প্রকৃয়া। আমাদের সামাজিক ও মানসিক গঠনে বৃদ্ধ বয়সের জন্যে একটি বিশেষ পরিকল্পনা থাকা উচিৎ। 

নেট থেকে যা টিপস পেলামঃ
• আর্থিক সঙ্গতি তৈরি রাখা।
• নিজের একা থাকার জন্যে মনে মনে তৈরি থাকা।
• সমমনস্ক বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজন এর একটি দল গড়ে তোলা।
• সৃজনশীল কিংবা অনেকে মিলে কোন কাজের সাথে যুক্ত থাকা।
• সবচেয়ে জরুরী শরীরের যত্ন করা। 

কিন্তু সকলের পক্ষে এই নিখুঁত ব্যাবস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় আমাদের ভালোবাসার শক্তি আরও বাড়িয়ে দেওয়া। ন্যাকা শোনাচ্ছে জানি। কিন্তু ওটায় পথ। না আমি কোন দিক নির্দেশ দিতে সক্ষম নই। তবু যা ভাবলাম... আপনরাও ভাবুন। 

niveditaghosh24@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.