হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

কবিতার পথে পথে
১৫ পর্ব

নিজেকে কতবার ভেঙে ভেঙে তবে জল ? জল হতে গেলে নিজেকে কতদূর গড়িয়ে আনতে হয় ? গড়িয়ে যাওয়া মানে তো অনুকূল পরিবেশে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া নয়। নয় চোখ কান নাক বুজে ভেসে যাওয়া। গড়িয়ে যাওয়া মানে নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া। যতখানি আকাশ হতে পেরেছে, নিজের সবটুকু কথা ভুলে গিয়ে। একফোঁটাও নিজের না হয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে অন্যতে বিলীন হয়ে যাওয়া। 

ভোরের আকাশ আলো কিভাবে তিল তিল করে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে আরও গভীরে ডুব দিল। একেই তো বলে আলোর পূর্ণতা। নিজেকে একটু একটু করে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলল। আকাশ তো তখন আলোর সমুদ্র। একটা একটা করে প্রাণ তাদের নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। এমন আলো তো কখনও ছিল না, তাই দেখার অভিজ্ঞতাও শূন্য। জায়গা করে নিতে নিতে একবারের জন্যও তো কারও মনে হয় নি এ তাদের নিজেদের ক্ষেত্র নয়। বরং উল্টোটাই বার বার তাদের মনে উঁকি দিয়ে গেছে ----- এযেন তাদেরই স্বাধীন বিচরণের জায়গা।

রোদকে দেখে কতবারই তো মনে হয়েছে তার কোনোকিছুতেই কোনো না নেই। কিন্তু কেন ? এত আলো তার শরীরে এল কোথা থেকে ? তার সাথে থেকে থেকে বুঝতে পেরেছি এ তার নিজেকে ভেঙে ফেলা। মুক্ত মনে দু'হাতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। তাই কি এতদিন ঘর সংসারের পরেও একবারের জন্যেও কখনও মনে হয় নি, এই সেই দুপুর যে চিরকালের জন্য দুপুর হবে বলে দুপুর হয়ে গেছে। দুপুরের সঙ্গে মগ্ন হওয়ার মুহূর্তগুলি কখনও দুপুরের আলোকচ্ছটায় মুখর হয়ে যায় নি। বন্ধু হয়েই তো সে কাছে এসেছিল। কখনও সে নিজেকে জানায় নি।

আমি নিজেকেও তো এক এক সময় চিনতে পারিনি। মগ্ন হওয়ার মুহূর্তগুলিতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছি দিগন্ত পর্যন্ত। কে-ই বা তখন আমাকে চিনেছে। আমিও কি চেনাতে চেয়েছি। দুপুরের হাত ধরেই নিজেকে সম্পূর্ণ করতে চেয়েছি। চেয়েছি সেই পরিচয়েই পরিচিত হতে। তাই তো বন্ধু দিয়েছে দুয়ার খুলে। আমিও তো উদাসী হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছি। ভেঙে গেছে আমার সীমায়িত অঞ্চলের আগল।

আলো তার সর্বস্ব নিয়ে চূড়ান্ত গভীরতায় ডুবে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল তখন কি সে আমায় চায় নি ? নিজেকে তাহলে ভেঙে ফেলা কেন ? নিজের মধ্যে নিজে ডুব দিয়ে তার হাত শূন্য থেকে আরও শূন্যেতায় ডুবে গিয়েছিল বলেই তো সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। বেরিয়ে এসেছিল চার দেওয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে। আমার পাশটিতেই সে তার নিজের জায়গা করে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, নির্ভর করেছিল সে আমার ওপর। আমাকে না পেলে সে কিভাবে বুঝে নিত তার ভাঙন যথার্থ ছিল কিনা। আমার গায়ে গা না ঠেকালে সে কিভাবে বুঝত, তার হাতে আজ আর কিছুই নেই , ভেসে যাওয়ার জন্য সে যে কোনো দিক বেছে নিতে পারে। 

হৃদয় দুয়ারে এত আলোর আয়োজন দেখেও দুপুরের মনে হয়, ঘরের সবক'টা জানলা খোলা হয়েছে তো ? জানলায় মুখ বাড়িয়ে তারা কাকে দেখে ? তাদের চোখে মুখে দুপুরের সমগ্রতার কোনো ছাপ নেই তো ? এসব ভাবনাই তাকে মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এসব আশংকাতেই পুনরায় শুরু হয় ভাঙন প্রক্রিয়া ----- " জলের মতো তরল হতে হতে / একটা হাঁস বুঝতে পারল / জলের তাকেও দরকার / নিজেকে জানার জন্য। "

(গদ্যে ব্যবহৃত কবিতাটি কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর লেখা )


mharitbandhopadhyay69@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন