'সোনালী কাবিন' শব্দ দুটো শ্রবণে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক নির্মল ছবি। মন স্মৃতির সমুদ্রে হাতড়ে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মায়ের নোলক। তিনি কবি আল মাহমুদ। ১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর জন্ম। পূর্ণ নাম মীর আব্দুর শাকুর আল- মাহমুদ। লেখালেখি শুরু করেন পঞ্চাশের দশকে। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ এবং অগাধ বিচরণ থাকলেও, কবি হিসেবেই অধিক পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাগ্ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তাঁর কবিতা বাংলা সাহিত্যকে সবুজ-শ্যামল উর্বর ভুমিতে পরিণত করেছে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'লোক লোকান্তর' প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। তারপর কালের কলস (১৯৬৬) সোনালী কাবিন (১৯৬৬) মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬। 'সোনালী কাবিন'ই তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। এভাবেই সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ।
তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় গ্রামের জীবন, বামপন্থী চিন্তা-ধারা এবং নারী ছিল মুখ্য উপজীব্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক ও পরবর্তী সময়ে তাঁর মতাদর্শে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাম-ধারার দেখা মেলে। পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে বেশ বড়সড় মোড় বদল হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় কবি আল মাহমুদের কবিতাতেও রাজনীতি, দেশপ্রেম, দ্রোহ এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রবল প্রভাব পড়ে। ১৯৭৪ সালের পর থেকে তাঁর কবিতায় ইসলামী ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়।
কবি হলেও আল মাহমুদ দীর্ঘ দিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। পাকিস্তানিদের শাসনকালে দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব (১৯৭২-১৯৭৪) পালন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পরিচালকের পদেও ছিলেন। কিন্তু বরাবরই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর কবিতাকে। লোক-লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন একের পর এক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। জাসদ কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক গণকন্ঠের (১৯৭২-১৯৭৪) সম্পাদক থাকলেও তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, তাঁর কোন দলীয় পরিচয় ছিলনা। তা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ জাসদের উদ্যোগে ঘেরাও কর্মসূচীর কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। অনেকদিন বিনা বিচারে কারাগারেও থাকতে হয়েছিল কবিকে। তবে নিজেকে রাজনৈতিক দর্শন থেকে খুব বেশি দূরে রাখেননি। যদিও এনিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে। অনেক তর্ক-বিতর্কও চলছে।
দেশ ও আন্তর্জাতিক স্তরে বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত তিনি। ১৯৬৮ সালে ‘বাংলা আকাদেমি পুরস্কার’, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরস্কার ‘একুশে পদক’ এবং জয়বাংলা সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। গত শুক্রবার, ১৫-০২-২০১৯ রাত ১১টা ৫ মিনিটে বাংলা সাহিত্যে পতন হল সাহিত্য আন্দোলনে উজ্জ্বল এই নক্ষত্রের।
ইবনে সিনা হাসপাতালের সিসিইউ থেকে শুভ্র মেঘের ডানায় চেপে 'সোনালী কাবিন'-এর স্রষ্টা পাড়ি দিলেন না-ফেরার দেশে। ঠিক যেমনটা তিনি কামনা করেছিলেন ‘স্মৃতির মেঘলা ভোর’ কবিতায়ঃ-
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে / মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; / অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে / ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
matin.cu@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন