স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক

যেখানে সকাল আসে, একটু উষ্ণতার খোঁজে
“এ জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে।” 

শুধু এইটুকু একটা কথা এমনভাবে একটা গোটা জায়গার প্রতি আকর্ষন করতে পারে এ বোধহয় খুব বেশী লোকে বিশ্বাস করবে না। সেই যে একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, আমার প্রিয় লালসাহেবের লেখা, সেই যেখানে শরীর সারাতে গিয়ে একটা মানুষ জায়গাটার প্রেমেই পড়ে যায়, আর যেন ফিরতে ইচ্ছে করে না ইট সিমেন্টের এই পোড়া শহরে। এই সেই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। এই শীতে কাছাকাছি কোথাও যাবার কথা ভাবতে বসে কেন জানি এই নামটাই প্রথম মাথায় এলো। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের এক ছোট্ট টাউন, রাঁচি থেকে যার দূরত্ব মাত্র চল্লিশ মাইল। একদা বিদেশী ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা বলে পরিচিত ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ছিল প্রকৃতির কোলে ছোট্ট এক শান্তির নীড়। তাই ঝাড়খণ্ড বলতেই প্রথমে মনে এল রাঁচি, আর তারপরেই এই ছোট্ট টাউনের কথা। রাঁচিও এককালে বড় সুন্দর জায়গা ছিল। ভারতের সব ছোট শহরেরই যেমন এক অনবদ্য ও নিজ নিজ স্বাদ রঙ গন্ধ শব্দে সমৃদ্ধ নিজস্ব একটি রূপ আছে, রাঁচিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বড় শহরগুলোতে এই সব রূপ রঙ যেন ঠিক সেইভাবে মনকে ছোঁয় না। আসলে সেখানে জীবনের নিত্য টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে শহরের রঙ কেমন যেন পাঁচমিশেলি হয়ে যায়। তার অনন্যতা কোথায় যেন চিড় খেয়ে যায়। কিন্তু রাঁচির সেই অভিনবত্ব হারিয়েছে বহুদিন হলো। ছোট শহর হলেও তার চাকচিক্য আজ কোন অংশে কম নয়। যাকগে যাক, কি বলতে গিয়ে কি বলতে বসলাম। এই আমার এক দোষ, কথায় কথায় যে কখন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী চলে যাই নিজেরই খেয়াল থাকে না। তো যাই হোক এই সব ভেবেই ম্যাকলাস্কিগঞ্জকে বেছে নিতে বিশেষ সময় লাগেনি। আসলে উদ্দ্যেশ্য ছিল কাছেপিঠে একটু নির্জন জায়গায় শীতের আমেজ উপভোগ করা আর নির্ভেজাল ছুটি কাটানো। 

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বড়দিনের আগে এক সকালে নিজেদের একরত্তি চারচাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। ট্রেনেও যাওয়া যেত। হাওড়া থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস নামিয়ে দেবে একেবারে খোদ ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে। কিন্তু একান্ত নিজেদের মিনি বাড়িটিতে হাওয়া খেতে খেতে আর গান শুনতে শুনতে নিজেদের ইচ্ছামতো যাওয়ার মজাই আলাদা। মিনি বাড়ি কেন বললাম ? ছোট্ট একটা কথা বললেই বোঝা যাবে। গাড়ীতে সামনে দুজন বসার পরে পিছনে কোন মতে একজনেরই জায়গা হয়েছিল। পিছনের ডিকি অনেক আগেই হাত উল্টে দিয়েছিল, অগত্যা সিটে জমা হলো দুটো ব্যাকপ্যাক, একটা খাবারের ব্যাগ, চটির ঝোলা, গোটা দুই আরামদায়ক কুশন, মায় বাড়ীর ক্ষুদে সদস্যের সফট টয় পর্যন্ত ! ভোররাতে উঠে সব গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে গাড়ী ছাড়তে ছাড়তে সাড়ে ছটা বেজেই গেল। তা শীতের সময় কলকাতায় সাড়ে ছটা মানে ভোরই বলা চলে। ব্রেকফাস্ট বানাতে অনেকটা সময় গেলেও ইচ্ছে করেই বানিয়ে নিলাম। এটা আমার একটা বাতিক বলা চলে। বেড়াতে যাবার সময় অন্তত একটা খাবার বাড়ি থেকে না নিয়ে গেলে যেন ঠিক মজা হয় না। ট্রেনে হলেই নিয়ে যাই আর এ তো গাড়ী। অগত্যা ভোর রাতে উঠে লুচি ভাজার পর্ব চললো অনেকটা সময় ধরে। এছাড়া সঙ্গে রইল কেক বিস্কুট চিপ্স চকলেটের একটা ঢাউস পলিব্যাগ। আমার পাহাড় প্রমাণ জিনিস পত্রের সঙ্গে যেটাকে গাড়ীতে জায়গা দিতে বেশ বেগ পেতে হলো, কিন্তু ওইটি ছাড়া তো যাত্রা নাস্তি, তাই খাবারের ব্যাগ ধরাও যে কোনভাবে, তারপর বাকি লোকজনের কথা ভাবা যাবে’খন। 

দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়া গেল অবশেষে। টুকটাক মুখ চালাতে চালাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা পার করে দিয়ে দশটা নাগাদ দাঁড়ানো হলো একটা ফাঁকা জায়গা দেখে। আমার প্যান্ডোরার বাক্স, থুড়ি ব্যাগ থেকে বেরোল টিফিন বক্স-বন্দী লুচি আর আলু ছেঁচকি। খাবার বানানোর সময় যতই অভিযোগ আসুক আমি দেরী করছি বলে, খিদের মুখে পছন্দের খাবার হাতে পেলে তখন সবাই সোনামুখ করে খেয়ে নেয় কিন্তু। সকলেই একবাক্যে মেনে নেয় যে এই সময় কোন রোড সাইড হোটেলে অর্ডার দিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট খরচ করে অখাদ্য পুরী তরকারি কিংবা বাজে তেলের ডিম টোস্ট খাবার চেয়ে বাড়ীর লুচি তরকারী ঢের ভাল। খেয়েদেয়ে আবার চলা, চলতেই থাকা। মিউজিক সিস্টেমে কখনো পুরনো তো কখনো নতুন গান, আর সঙ্গে শুধু চলা। মাঝে বোকারোর কাছে একজায়গায় নেমে প্রচন্ড ঝাল ঝাল চিকেন কারি আর ভাত খেয়ে নেওয়া গেল। তারপর আবার চলতে চলতে অবশেষে পৌঁছলাম একসময়, তখন প্রায় সন্ধ্যে সাড়ে ছটা বেজেছে। তবে তার আগে একটা ভয়ঙ্কর রাস্তা পার হতে হয়েছে। হাইওয়েতে রাস্তা ভালোই ছিল, কিন্তু হঠাৎই কোন কারণে এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে হলো। সেখানে রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। সামনে যখন তখন বড় বড় গাছ পড়ছে, কয়েক হাত দূর থেকেও কিছু বোঝার উপায় নেই এতই অন্ধকার। এই রাস্তা চললো প্রায় তেরো কিলোমিটার, সন্ধ্যের অন্ধকারে যা আমাদের ভুলভুলাইয়া মনে হচ্ছিল। যাই হোক, এসব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম আমাদের কাঙ্খিত সেই গেস্ট হাউজে। আমাদের পৌঁছতে সন্ধ্যে হবে জানাই ছিল। তাই গিয়ে কোন অসুবিধা হলো না আমাদের। তবে একটা জিনিস বোঝা গেল যে গেস্ট হাউজে ঠাসা শুধু বাঙালী ট্যুরিস্ট। হে ভগবান, পৃথিবীতে কি বাঙালী ছাড়া আর কোন জাত নেই যারা বেড়াতে ভালবাসে ! দার্জিলিঙে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা না দেখতে পারো, সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ না দেখতে পারো, কিন্তু পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বেড়াতে যাও, নিজেকে ছাড়া আরও অন্তত দুটি বাঙালী পরিবার পাবে। মানে পাবেই। এ আমার উপলব্ধি। না বাঙালী জাতির প্রতি আমার কোন পুরনো রাগ নেই। কিন্তু বেড়াতে গিয়েও যদি কানের কাছে অনর্গল বাংলা বুলি শুনতে হয় তাহলে যে কলকাতার বাইরে এলাম তার জন্য কোন আলাদা অনুভুতি হয়না। যাই হোক, গাছপালা ঘেরা গেস্ট হাউজের ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে দেখলাম টানা বারান্দার একেবারে শেষের ঘরটা আমাদের। ঘরের সামনে আবার একটা বসার দোলনাও রয়েছে। একসঙ্গে তিনজনে বসে দোল খাওয়া যায় সেখানে। গেস্ট হাউজের যিনি মালিক তিনি জন্মসূত্রে সাহেব হলেও তার চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। নামটাই খালি যা সাহেবি চিহ্ন বহন করছে। বহু আগেই এদেশে এসে সাহেবরা আদিবাসী বা বিহারী সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করে নিজেদের সাহেবত্ব খুইয়েছে। তাই আমাদের এই ভারতীয় সাহেবটিও খাস দেশোয়ালি হিন্দিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। 

রাতে খাওয়াদাওয়া মন্দ জুটলো না। ভাত আর চিকেন কারি। রান্না যেমনই হোক, বাইরে গেলে যা পাওয়া যাবে তাই চুপচাপ খেয়ে নিতে হবে এই নীতিতে বিশ্বাসী আমরা, তাই খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হলো না। কনকনে ঠাণ্ডা হলেও ক্লান্ত শরীরে বিছানায় পড়েই সবাই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। পরেরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙল তখনও ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ভোরের আলো দেখেনি। বেরিয়ে পড়লাম তৈরী হয়ে। একটু হেঁটে নার্সারি স্কুলের পাশ দিয়ে এসে বড় রাস্তায় পড়া যায়। এই রাস্তাই সোজা স্টেশনে গিয়েছে। আমার গন্তব্য আপাতত ওখানেই। শুনশান ফাঁকা রাস্তায় জবুথবু মার্কা ঠাণ্ডায় জ্যাকেটের ভেতর হাত সেঁকতে সেঁকতে হেঁটে চললাম। বাঁদিকে পর পর জামাকাপড়র দোকান, সেখানে গরম জামা থেকে কম্বল সব পাওয়া যায় দোকানের নামগুলো দেখে বুঝতে পারছি। আর ডানদিকে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে রেললাইন। রেললাইন অনুসরণ করে পৌঁছে গেলাম স্টেশন চত্বরে। বাঁ হাতে দু তিনটে চা শিঙাড়া আর ফলের দোকান। এত সকালেও খুলে গিয়েছে সেগুলো। চায়ের জল ফুটছে বোঝা যাচ্ছে। সেই স্টোভের আশেপাশে দাঁড়িয়ে চা তৈরীর গরমের ওম নেবার আশায় বেশ কিছু স্থানীয় লোক। এরকম ফাঁকা জায়গায় অত সকালে এক শহুরে মহিলাকে দেখে সবার চোখ বোধহয় একই সঙ্গে ঘুরল। যদিও বাঙালী ট্যুরিস্ট এদের কাছে নতুন নয়। যাই হোক এদের বিস্ময় কাটতে যেটুকু সময় লাগে তার মধ্যে আমি প্ল্যাটফর্মটা ঘুরে আসি। একটা কয়লার গাড়ী দাঁড়িয়ে রয়েছে, মনে হয় ছাড়বে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় দুজন আদিবাসী মহিলা ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়লো না। কিন্তু লালসাহেবের লেখায় যে পড়েছিলাম সেই সময় স্টেশন চত্বর গমগম করতো ! কার্নি মেমসাহেবের সেই শিঙাড়ার দোকানটাও আর নেই। কোন দোকানই নেই আসলে। দুদিকে কিছুই তো নেই। একা একা প্ল্যাটফর্মটা বেশ কিছুটা গিয়ে নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেছে। আমার সেই চেনা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের ছবিটা মিলছে না কেন ? মনমরা হয়ে খানিক বসে রইলাম এককোণের একটা বেঞ্চে। কখন একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটে গেছে খেয়াল করিনি। কেমন যেন জাতিস্মরের মতো বই পড়ে চেনা জায়গাটা হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। কখন সকাল এলো জানতে পারিনি। যখন হুঁশ হলো চারপাশে কাছাকাছি গাছগুলো থেকে অনেক পাখির ডাক শুনতে পেলাম। তার মধ্যে বেশ কিছু ডাক একেবারেই অচেনা। সেই যে সেই বুলবুলি, তিতির, ঘুঘু, মৌটুসি যাদের কথা লালসাহেবের লেখায় পড়েছি তারাই বোধহয় ডাকাডাকি করে আমাকে বলতে চাইছে, ‘ওগো আমরা এখনো আছি, অত হতাশ হয়ো না।’ ওরা বললো কিনা জানি না, তবে আমি শুনলাম। যাক কোথাও তো সেই চেনা ছবিটা এখনো রয়ে গেছে। পুরোপুরি হতাশ করেনি আমাকে আমার চেনা সেই ছোট্ট টাউনটা। কিন্তু সেই জঙ্গল কই ? জায়গাটার গ্রাম্য গন্ধ যে থাকবে না সে আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। এতগুলো বছর পেরিয়ে তা থাকার কথাও নয়। কিন্তু চারদিক জুড়ে যে অগভীর জঙ্গল ছিল যেখানে মহুয়ার লোভে ভাল্লুক আসতো, হায়নাও আসতো। সেই জঙ্গল অনেক পিছিয়ে গেছে। রাস্তায় চলতে চলতে চোখে পড়ে কিছু কিছু জায়গায়। এইসব ভাবতে ভাবতে স্টেশনে খানিক ঘুরঘুর করে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে একগাদা কমলালেবু কিনে গেস্ট হাউজের পথে পা বাড়ালাম।


ব্রেকফাস্টে ডিম সেদ্ধ আর পাউরুটি মাখনের সৎকার করে গরম জলের খোঁজ করতে হলো। বেরোতে গেলে তো চান করতে হবে। এখানে আবার কারেন্টের বেশ সমস্যা, তাই চাইলেই গরম জল পাওয়া যায় না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে আদিবাসী একটি মেয়ে এসে অনেকটা গরম জল দিয়ে গেল। চাইলে আবারও দেবে এমন আশ্বাসও মিললো। সব সেরে রেডি হয়ে বেরোতে দশটা বেজেই গেল। প্রথমেই গেলাম আদিবাসীদের নিয়ে যারা নানারকম কাজ করে তাদের সংস্থা জাগৃতি বিহারে। কিন্তু বড়দিনের সময়, তাই বোধহয় সব বন্ধ ছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্কুল বাড়ি, খাবার ঘর, কাজের ঘর রান্নাঘর দেখে বেরিয়ে এলাম। এমন জনমানবশূন্য জায়গা বড় একটা দেখা যায় না। সেখান থেকে হাঁটা রাস্তায় গেলে ডন বসকো স্কুলের বিরাট ক্যাম্পাস। ওইরকম ফাঁকা একটা জায়গায় যে এমন এলাহি একখানা স্কুল থাকতে পারে সে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। দারোয়ানের কাছে অনুমতি নিয়ে নাম লিখিয়ে আমরা স্কুলে ঢুকে পড়লাম। বিরাট বড় উঠোন, বাস্কেট বল কোর্ট, পিছনে বিশাল খেলার মাঠ, আর তার মাঝে লম্বা টানা বারান্দার বাঁদিক দিয়ে সারি সারি ক্লাসরুম। কি যে ভাল লাগছিল দেখতে ! ক্লাসরুমের ফাঁকে ফাঁকে আবার ছাত্রদের সারা বছরের কাজকর্মের নানান নমুনা, কিছু বোর্ডে বড় করে হাতে লেখা মনীষীদের বাণী, কোথাও বা ছাত্রদের মেধা তালিকা টাঙানো রয়েছে। আর প্রতি ক্লাসরুমের বাইরে লেখা রয়েছে ক্লাসের নাম, কোথাও সিক্স এ তো কোথাও এইট সি। বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই পর পর পাওয়া গেল লাইব্রেরি, টিচার্স রুম আর ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর বায়োলজির ল্যাব। কাঁচের জানলায় নাক ঠেকিয়ে ভেতরে যতটুকু চোখ যায় তাও দেখে নিলাম আমরা, সেই ছোটবেলার মতো। আসলে স্কুলে গেলেই আবার যেন সেই ছোটবেলাটা ফিরে আসে। কি মজা যে লাগছিল একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে ডেস্কে বসে। খুব ইচ্ছে করলো আবার ছোট হয়ে যাই। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন ছিল স্কুলের দিনগুলোই, এ ব্যাপারে বোধহয় সকলেই একমত হবেন। 


ওখান থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটু ঘুরে বেড়ানো হলো। কিছু সাহেবি বাংলো দেখলাম, সবই এখন হস্টেল হয়ে গেছে। গোটা টাউনটায় আর কিছু থাকুক না থাকুক বেশ কিছু ভালো স্কুল রয়েছে ছেলেদের ও মেয়েদের। আর সেই সব স্কুলের কারণেই চারদিকে রয়েছে অজস্র হস্টেল। ছেলেদের মেয়েদের আলাদা আলাদা। এমনকি শীতকালে যেগুলো গেস্ট হাউস, গরমে সেগুলোই হস্টেল হয়ে যায় এমনও আছে। সেদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেশ বেলা হয়ে গেল। খাবার খোঁজ করতে করতে মনে পড়লো সকালে স্টেশনের কাছে একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম কোন এক রেস্টুরেন্টের। খুঁজতে খুঁজতে সেখানে হাজির হওয়া গেল। ছোট্ট একটা ঘর, মোটামুটি পরিস্কার, দুজন বই আর টুরিস্ট নেই সেখানে। গিয়ে বসা গেল। মেনু বলতে এখানে দুটোই বৈচিত্র্য, লাঞ্চ এবং স্ন্যাক্স। লাঞ্চ খেলে মিলবে ভাত ডাল আলুভাজা আর চিকেনের ঝোল। আর স্ন্যাক্স হলে নুডলস। প্রায় বিকেল হতে চলেছে দেখে আমরা নুডলসই অর্ডার করলাম। স্বাদ কিন্তু মন্দ না। জায়গাটার একটা অ্যাংলো ঔপনিবেশিক ইতিহাস আছে বলেই বোধহয় এসব এখানে সহজে মেলে। স্ন্যাক্সটা ভালোই লাগলো। সঙ্গে মালিক এও বলে দিলেন আপনারা রাতে এখানেই চলে আসুন খেতে। গোটা ম্যাকলাস্কিগঞ্জে এই একটিই রেস্টুরেন্ট রয়েছে, আর আপনাদের হোটেলের খাবারও এখান থেকেই যাবে। মাঝখান থেকে হোটেল এক্সট্রা চার্জ নেবে। তার চেয়ে চলে আসুন এখানেই। বুঝলাম কাল অত তাড়াতাড়ি কিভাবে ডিনার পেয়ে গেলাম আমরা। 

রাতে যখন ঘরে ঢুকলাম মনে হলো পাহাড়ের কোন গুহায় ঢুকেছি। স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডায় ঘর পুরো বরফ হয়ে আছে। বিছানায় হাত রাখলে ছ্যাঁকা লাগার জোগাড়। কম্বল যা দিয়েছে তাতে রাতে কোনরকমে প্রয়োজন মিটলেও আরাম পাওয়া যাবে না। আগেরদিন এত ক্লান্ত ছিলাম যে এসব ভেবে দেখার অবস্থাও কারোর ছিল না। অতএব সেই ভারতীয় সাহেবকে ডেকে কম্বল চাইতেই হলো। 


পরেরদিন আর গরম জলের অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না আমাদের কারোরই। সময় কম, সারাদিন ঘুরতে হবে আজ। আগামী দুদিন এখানে থাকলেও একটু দূরে বেতলা আর রাজরাপ্পা যাবার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো আর কাছের জায়গাগুলোকে ছাড়া যায় না। তাই বিনা চানেই বেরিয়ে পড়তে হলো সেদিন। দিনটা ছিল পঁচিশ তারিখ, অর্থাৎ বড়দিন। তাই প্রথমেই পুরনো চার্চে যাওয়া হলো। একটা বহু পুরনো গেটওয়ালা বাড়ীর ভেতর ঢুকে চার্চে যাওয়া যায়। পুরনো চার্চ যেমন হয় তেমনই। তবে খুব একটা বড় নয়। এখানকার চার্চ অবশ্য প্রটেস্টাণ্ট। বড়দিন উপলক্ষে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে চারদিক। ছোট ছোট অনেক আদিবাসী বাচ্চা দেখলাম সেখানে। আজ তারা চকলেট কেক সব পেয়েছে, মুখে হাসি তাই ধরে না। ফাদারকেও দেখলাম এক ঝলক। বয়সে তরুণ হলেও চেহারায় একটা প্রসন্ন ভাব আছে দেখে ভালো লাগলো বেশ। কাছাকাছি একটা নতুন চার্চ হয়েছে শুনলাম, যদিও সেটা বন্ধ ছিল আসার সময় দেখেছি। চার্চে খানিক সময় কাটিয়ে উঠে পড়লাম। পরের গন্তব্য সর্বধর্মস্থল। এটা বেশ কিছুটা দূরে। একটা বেশ বড় খোলা চত্বর। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রায় একই উচ্চতার হিন্দু মন্দির ও তার পাশে মুসলমানদের মসজিদ। মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকলেও বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেল নিয়মিত পুজো হয় সেখানে। মসজিদেও নিয়মিত চাদর চড়ানো হয় তার প্রমাণও পাওয়া গেল। পাশেই একটা খোলা জমিতে একটা বড় ক্রশ গাঁথা রয়েছে। অদুর ভবিষ্যতে ওখানে চার্চও হবে সে বোঝাই যাচ্ছে। তার পাশে আবার একটি ছোট্ট গুরুদোয়ারাও রয়েছে। কাজ হচ্ছে হয়তো। খুব শিগগিরই এখানে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সর্বধর্মস্থল তৈরী হবে। নিজে খুব একটা ধর্মভীরু না হলেও বেশ ভালো লাগলো দেখে যে এই বিশ্বব্যাপী হিংসার যুগে এমন জায়গাও রয়েছে যেখানে পাশাপাশি আজানের সুর, ভজনের গুঞ্জন, প্রেয়ারের ধ্বনি আর গুরুবাণীর স্বর একই সঙ্গে শোনা যায়।


আজ আর বেশী দেরী করিনি খেতে যেতে। আগেরদিন রাত্রে শুধুমাত্র টাকা বাঁচানোর উদ্দ্যেশে আর সেই এক ও একমাত্র রেস্টুরেন্টটিতে খেতে যাওয়া হয়নি। হোটেলেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম। ওই ঠাণ্ডায় কে আবার বেরোবে ! তাই আজ দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে একেবারে লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া হলো। মোটা চালের ভাত, বাটি থেকে তাকিয়ে থাকা ডাল, তেলে ভেজানো আলুভাজা আর প্রচুর মশলা দেওয়া চিকেন খেয়েও যখন তৃপ্তি হয় তখন জানবেন আপনি ভোজনরসিক নন, বরং ভ্রমনরসিক। তাই আজীবন নিজেকে পেটুক বলে আখ্যা দেওয়া আমিও ভারী খুশী হয়ে চেটেপুটে সব খেয়ে ফেললুম। 

ওখান থেকে বেরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম দামোদরের চরে। অদুরে লাতেহারের কাছেই দামোদরের উৎসস্থল। এখানে দামোদর বেশ চওড়া হলেও শীতকাল বলেই সে এখন বেশ শান্ত। দুদিকে বালির চর অনেকটা জায়গা জুড়ে। বেশ ঘুরে বেরিয়ে আসা যায় জায়গাটায়। তবে তলা দিয়ে নদী গেছে বলেই বালি বেশ আলগা আর নরম। তবু শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে বালির চরে হেঁটে বেড়ানোয় মজা আছে। শেষ বিকেলের আলোটুকু যতটা শুষে নেওয়া যায়, আর যতটুকু তাজা অক্সিজেন টেনে নিয়ে জমিয়ে রাখা যায় সেই সবটুকু জমা করে শরীরে, মনে, মাথায় ভরে নিয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালাম আমরা। আর সঙ্গে নিজের অনেকটা দিয়েও এলাম বোধহয়। আর কানে কানে বলে এলাম ‘তোমার জন্যই তো আজ অবধি “একটু উষ্ণতার জন্য”শেষ করিনি কখনো। এ কথা আমি আর কাউকে বলবো না, কক্ষনো না। শেষ হলেই যদি ফুরিয়ে যায়, হারিয়ে যায় সুকুদা আর ছুটির ভালবাসা, সেই ভয়ে প্রতিবার অনেকদুর পড়েও প্রাণে ধরে শেষ করতে পারিনা আমি বইটা, এ কথা আমি আর কাউকে কোনদিন বলবো না দেখে নিও।’ এ শুধু আমার আর একা একা বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের গোপন কথা। আপনারা শুনে থাকলেও ভুলে যাবেন কিন্তু। 

আরো দুদিন ছিলাম আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জে। কিন্তু সেই দুটো দিন বেরিয়ে পড়েছিলাম বেতলার জঙ্গল দেখতে আর রাজরাপ্পায় ছিন্নমস্তার মন্দির ঘুরে ভেড়া নদীতে পা ডোবাতে। সেই অভিজ্ঞতা নাহয় আর একদিন বলবো।


swatich78@yahoo.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন