কাজী রুনালায়লা খানম

কাজী রুনালায়লা খানম
জ ছাব্বিশে জানুয়ারী। দেশজুড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের হুজ্জুৎ চলছে। গাঁয়ের স্কুল মাঠের কচিকাঁচা থেকে দেশের বাছাই করা সেনারা পা মিলিয়েছে কুচকাওয়াজে। ক্লাবের সেক্রেটারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সকলের ভেতর দেশপ্রেমের ছোঁয়াচে উপসর্গটা বেশ প্রকট। মন্ত্রীমশাই সেক্রেটারীর লিখে দেয়া দেশপ্রেমে মাখো মাখো ভাষণ পূর্বদিন পর্যন্ত মুখস্থ করছেন মনোযোগী ছাত্রের মতো। আফটার অল ওই ভাষণটুকুই তো সম্বল। ওটা দিয়েই তো জনতা জনার্দনকে বেকুব বানিয়ে পরেরবারের টিকিটের বন্দোবস্তটা পাকা করতে হবে। একটা আলগা দেশভক্তির প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে আপামর ভারতবর্ষের দৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে মাইল মাইল স্বপ্নদেখা দিন, স্বপ্নভঙ্গের কালো রাত। কেমন আছে ভারতবর্ষ ৭০তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে! কেমন আছি আমরা বৃহত্তর প্রজাতন্ত্রের প্রজাসাধারণ! দেখে নেয়া যাক খানিকটা চালচিত্র।

উড্ডীয়মান তেরঙ্গার নীচে গোল হয়ে দাঁড়ানো মুষ্টিবদ্ধ ছোট্ট ছোট্ট কচি কচি হাত একদিন কি গভীর বিশ্বাসে আর দৃঢ়তায় মুষ্টিবদ্ধ হয়েছিলো এমন একটা ভারতবর্ষের ভাবনায়। চোখের ভূখন্ডে এঁকেছিলো একটা নিটোল ভারতবর্ষের মানচিত্র। যে ভারতবর্ষে স্বাধীনতা মানে চিন্তা হবে মুক্ত, অভিব্যক্তি হবে স্বাধীন, বিশ্বাস হবে আগলহীন, আর মানুষের ধর্মাচরণ হবে স্বেচ্ছাধীন। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা চালিত হবে দেশ। সাম্য মৈত্রী আর সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মানুষ হয়ে উঠবে মানুষের একান্ত আশ্রয়।যে ভারতবর্ষের ভাবনায় "দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।" কিন্তু এ কালবেলায় ভারতবর্ষের বিশ্বাসের মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্ষমতালোভীর লোভ আর আত্মস্বার্থের উদগ্র বেনোজলে। বিশ্বের বৃহত্তর গণতন্ত্র আজ প্রতিমুহূর্তে বিকিয়ে যাচ্ছে মরিচীকার দামে। রিগিং, ছাপ্পাভোট, বুথজ্যাম এবং এরকম বহুবিধ চোরাপথে চালান হয়ে যাচ্ছে একশো ত্রিশ কোটির স্বপ্ন, সাধনা, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা।গণতন্ত্রের ধর্ষকরা দেশটাকে সর্বস্বান্ত করে,নিলামে তুলে,গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি গেঁথে বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যথেচ্ছা স্পর্ধায়। 'ধর্মনিরপেক্ষ'তার সাংবিধানিক শীলমোহরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনীতির ময়দানে ধর্মের নামে মানুষকে লড়িয়ে দিয়ে, মানুষের ভাবাবেগকে অসহিষ্ণুতার অন্ধপথে চালিত করার মারণ খেলায় মেতেছে। এ কথা সত্য যে ধর্ম আর রাজনীতি প্রাচীন কাল থেকেই একে অন্যের পরিপূরক থেকেছে সাধারণের ওপর আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের মতো এতো নগ্ন প্রকাশ এর আগে ছিলো না। যা বিগত কয়েকবছরে হয়েছে।

একটা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সাধারণ নাগরিক সাংবিধানিক অধিকারেই রাষ্ট্রের কাছে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রও সে প্রত্যাশা তথা দাবী পূরণে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হবে একটা সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থায় এটাই সর্বাধিক কাম্য। কিন্তু অধুনা ভারতবর্ষের কর্মসংস্থানের যে চিত্র তা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। দেশের বৃহত্তর শিক্ষিত যুবসমাজ আজ সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত। কি কেন্দ্র কি রাজ্য। চাকরী, শিল্প, সবক্ষেত্রেই চিত্র এক।নতুন শিল্পের কোন উদ্যোগ নেই, পুরনো শিল্পগুলিও হয় পরিচর্যাহীন, নয় তো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে শিল্প কারখানা। "উৎপাদিত দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আত্মঘাতী কৃষক" এ খবর এখন আমাদের গা সওয়া।কৃষকের শরীরে লেগে থাকা কাদামাটি আর ঘেমো গন্ধের, নিরন্ন সংসারের বারোমাস্যা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের কাচের ভারী পাল্লার ভেদ করে পৌঁছায় না জনপ্রতিনিধির নিশ্ছিদ্র নিরাপদ ঘর পর্যন্ত। তাই এ দেশের চাষার আশায় বাঁচার শক্তিও প্রায় নিঃশেষ। কর্মসংস্থান না করে একটা বহত্তর সমাজকে মেরুদন্ডহীন ভিক্ষাজীবীতে পরিণত করার নির্লজ্জ প্রয়াস চলছে দেশজুড়ে। দশবছর আগে যে ছেলেটি এম. এ.,বি.এড. পাশ করে চাকরী পাওয়ার স্বপ্ন দেখতো। সুস্থভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতো। চাকরীর জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে তার জুতোর সুকতলার সাথে সাথে ক্ষয়ে গেছে ইচ্ছের ধার। ফুরিয়ে গেছে সরকারী চাকরীর বয়সসীমা। তাদের কেউ ভিনরাজ্যে, ভিনদেশে শ্রমিক, মজুর যা হোক একটা কাজ পাওয়ার মরিয়া আশায় ছুটে গেছে। কেউ বা ব্যর্থ জীবনের গ্লানি ভুলতে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। যে রাষ্ট্র তার প্রজাসাধারণের বেঁচে থাকার,নুন্যতম মৌলিক চাহিদাটুকু পুরণের নিশ্চয়তা দিতে পারেনা। এইসমস্ত কৃষকের, শিক্ষিত বেকারের আত্মহত্যার দায় কি পক্ষান্তরে তার ওপর বর্তায় না! আজ যদি এই কৃষক বা এই দিশাহীন শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে কেউ জননেতার শেখানো স্লোগানে গলা না মিলিয়ে,স্রোতের উল্টোমুখে সটান দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়! তাকে কি দোষ দেয়া যায়? যে দেশে প্রতি চারমিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষিতা হয়, সে রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি তার নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। তার ব্যর্থতা ঢাকবে কোন চতুরতায়! শুধু বুলি কপচিয়ে কতোদিনই বা মগজধোলাই করে কন্ঠরোধ করে রাখা যায় আমজনতার!!

তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আজ যে ক্ষমতাসীন দলের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে বিরোধী দল হৈ চৈ করে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। মিছিলে পা মেলায়।এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। কাল যখন আবার পাশা উল্টে ক্ষমতার রজ্জুটা তার হাতে যায় পৌঁছায় তখন কিন্তু সেও একই পথে পা রাখে দ্বিধাহীন। আমআদমির জীবনে 'পরিবর্তন' আসেনা। 'আচ্ছেদিন' সোনার পাথরবাটি হয়ে অধরাই থেকে যায়। দিন চলে যায়, দিন বদলায়। রাজা আসে যায়, রাজা বদলায় ।আর আমরা সোনার হরিণ ভেবে পিছু নিই শুধু। আসলে এ উলঙ্গ রাজার দেশে সিংসাহনে বসার প্রাথমিক শর্তই বোধহয় পোষাক হীন হয়ে বসা। তাই যেই রাজা হোক উলঙ্গ তাকে হতেই হবে। আর তাঁর চারদিকে ঘিরে থাকা স্তাবকেরা হাততালি দেবে, জয়ধ্বনি দেবে মুহূর্মুহু। গল্পের সেই সরল সত্যবাদী শিশুটিকে সেদিনও পাওয়া যায়নি, আজও নয়। তবু মিছিল কিন্তু থেমে থাকেনি। থেমে থাকবেনা। মিছিল চলবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের প্রতিবাদে। মিছিল চলবে ন্যায়ের দাবীতে, অধিকারের দাবীতে। চলতে চলতে একদিন দেখা হয়েও তো যেতে পারে সরল, সত্যবাদী, নির্ভীক সেই শিশুটির! যে সমস্ত হাততালির উর্ধে গলা তুলে বলবে "রাজা তোর কাপড় কোথায়?" হয়তো সে মিশে আছে এমনই কোন প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রভাতফেরির মিছিলে মিছিলে? কে বলতে পারে??


anishakrk333@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.