ঋতুপর্ণা রুদ্র

নিজের মেয়ে
রানু জোরে জোরে হাঁটছিল, রাস্তাটা ভাঙা গর্ত,  কোথাও কোথাও জল জমে আছে, কদিন খুব বৃষ্টি,  রাস্তারও তাই এই অবস্থা, ফের সেই পুজোর সময় কাজ হবে মনে হয়। আজ সব বাড়ি থেকে ছুটি নিয়েছে ও, ভেবেছিল সকাল সাতটার মধ্যে হিয়া দিদির বাড়ি পৌঁছে যাবে,দেখ না দেখ দেরি হয়ে গেল। রানুর মনটা খুব খারাপ,  হিয়া দিদি আজ কাকাবাবুকে নিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে মুম্বাই বলে একটা জায়গায় ট্রেনে নাকি দুদিন লাগে সেখানে যেতে, কত দূর রানুর আন্দাজ হয় না।

সকালে পৌঁছে একটু পরোটা আলু চচ্চড়ি করে দেবে ট্রেনে নিয়ে যাবে ওরা,  বাইরের খাবার কাকাবাবু খেতে ভালবাসেন না। রানু যখন অনেক ছোট সবে বিয়ে হয়েছে এপাড়ায় প্রথম আসা তখন কাকিমার কাছে কাজ নেওয়া। ওর বর বাস কন্ডাকটর দেবু প্রথম প্রথম খুব আদর সোহাগ দেখাতো কিন্তু অল্প কদিনেই রানু বুঝলো রোজগারের বেশিরভাগ নেশা করেই উড়িয়ে দেয় দেবু, রোজগারও অতি সামান্য। ঘর চালাতে গেলে তাকেও কিছু করতে হবে। সেই শুরু লোকের বাড়ি কাজ, পাশের বাড়ির কবিতাদি প্রথম নিয়ে গেল কাকিমার কাছে। হিয়া দিদি তখন কলেজে পড়ে। কাকিমা দেখে বলেছিলেন

“ওমা এ তো বাচ্চা মেয়ে রে হিয়ার থেকেও ছোট এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে! তা কাজ কর্ম পারবে তো”?

“একটু শিখিয়ে নেবে কাকিমা ও গাঁয়ের মেয়ে,তোমাদের রান্নাবান্না তো জানে না”।

রানুও বহাল হয়ে গেল,দোতলা বাড়ি এত গুলো ঘর, হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে কাকিমার খুব কষ্ট হতো, দেবু বেরিয়ে গেলেই তখন রানু চলে আসতো এই বাড়ি,  কাকিমার হাতে হাতে সব কাজ,  রান্নাও শিখে নিল।  কত বছর হয়ে গেল। রানুর মেয়ে এখন পনেরো পেরিয়েছে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে, ছেলে ক্লাস এইট। দেবুর কোন পরিবর্তন নেই, নেশা করে আসা জুয়ো খেলা সবই চলছে, সংসারে টাকা পয়সা দেয় খুবই সামান্য। রানু কিছু বলতে গেলেই মারধোর করে। ইদানীং রানু তাই ওর সাথে কথাই বলে না প্রায়, বিছানাও আলাদা। ছেলে মেয়েকে নিয়ে রানু ঘরে শোয়,  বারান্দায় দেবুর বিছানা।

ওবাড়িতেও কত পরিবর্তন।  হিয়া দিদি কলেজ পাস করে বেরিয়ে চাকরি পেল, তারপর নিজেই বিয়ে করল। জামাইবাবু খুব সুন্দর দেখতে বাড়িও ভাল। বিরাট করে বিয়ে দিয়েছিল কাকাবাবু।

“রানু তুই কিন্তু সব বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে এক সপ্তাহ এবাড়িতে থাকবি, মেয়ের বিয়ে কত কাজ বলতো, তোর কাকিমার বাতের ব্যাথা নিয়ে সব দিকে পারবে না”।

মেয়ে বুবু তখন ছোট, তাকে নিয়েই রানু  প্রায় দশ দিন ছিল ও বাড়িতে। ওরা চিরকাল বড্ড ভালবাসে তাকে, কত সুন্দর শাড়ি পেয়েছিল রানু, বুবুর জন্যও নতুন জামা এনেছিলেন কাকাবাবু। বিয়ে হয়ে যাবার পরে কাকিমা আবার আলাদা করে পাঁচশো টাকা দিল রানুকে।

“একি কাকিমা তুমি যে বল আমি তোমাদের মেয়ে তাহলে টাকা কিসের, ও টাকা নেব না আমি”।

কাকাবাবুর ধমক কি তখন।
“শোন রানু, ও টাকা তোকে দিই নি, ও টাকা বুবুর,কাল আমার সাথে যাবি, বাজারের ব্যাংকটাতে তোর নামে একট অ্যাকাউন্ট খুলে দেবো, মাসে মাসে যেমন পারবি জমাবি, নাহলে সব দেবু এসে তো কেড়ে নিয়ে যায় তোর থেকে, মেয়ের ভবিষ্যৎ আছে তো”।  আজও সেই ব্যংকে টাকা রাখে রানু, ব্যাংকের বই কাকাবাবুর কাছেই থাকতো, কাল কাকাবাবু ডেকে সব কাগজপত্র দিয়ে দিলেন রানুকে।

“রানুমা, আমি তো আর কলকাতায় থাকবো না রে, তুই এবার বুঝে নে, তোর ব্যাংকে প্রায় চল্লিশ হাজার আছে এখন, আর এই দুটো ফিক্সড এর কাগজ মনে আছে তো প্রায় এক লাখ কুড়ির মত মেয়াদ শেষে পাবি, খবরদার দেবুকে দিবি না,  খুব দরকার ছাড়া তুলবি না। এটা তোর আর ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ।”

রানুর চোখে জল তখন, চিরকাল কাকাবাবুই তো সব দেখতেন,একা কি করবে সে, তবুও মাথা নেড়েছিল।

রান্না ঘরে সবার জন্য চা স্যান্ডউইচ বানালো রানু, কাকিমার কাছে শেখা এবাড়িতে সবার খুব প্রিয়। আজ তো বাড়িতে অনেক লোক, হিয়া দিদি,  জামাইবাবু, দিদির ছেলে সোহম। কাকাবাবুর অফিসের দুজন আবার দেখা করতে এসেছে চলে যাবেন বলে। সবাইকে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল রানু, তারপর দুপুরের রান্না করবে। হাল্কা মাছের ঝোল ভাত। আর ট্রেনের টিফিন। খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে যাবে ওরা, রাতের ট্রেন। কিছু জিনিসপত্র আগেই কোম্পানির লোকেরা এসে বেঁধে ছেঁদে বম্বে পাঠিয়ে দিয়েছে। জামা কাপড় আর যা যা ছোট খাটো জিনিস পাঁচটা বড় সুটকেস দুটো ব্যাগে ঠেসে ভরেছে রানু আর হিয়া মিলে, তাও কত জিনিস যে রয়েছে।

“রানুমা যা যা রইল,আমার এই সিংগল খাট এই ছোট আলমারি, আর রান্না ঘরের সব তুই নিয়ে যাস একটা ভ্যান ডেকে, এই নে দুশ টাকা ভাড়া”। 

হিয়া দিদির ইচ্ছে ছিল রান্না ঘরের সব অল্প দামে বিক্রি করার কিন্তু কাকাবাবু রানুকে দিতে চান। এই নিয়ে বেশ তর্ক হল বাবা মেয়ের।

“বাপি আমার বম্বের ফ্ল্যাটে তো সবই আছে এত বাসন মিক্সি নিয়ে গিয়ে রাখবো কোথায় বলোতো আজকাল সবই বিক্রি হয়,  অনলাইনে ছবি দিয়ে দিই,বাড়িতে এসে লোকে নিয়ে যাবে,  যা পাওয়া যায়, তোমার জামাইও তাই বলছিল”।

“এমন বলিস না মামণি, তোর মায়ের হাতে গড়া রান্নাঘরের জিনিস সব, অচেনা লোক এসে নিয়ে যাবে তার থেকে রানুর কাছে থাক, সতেরো আঠেরো বছর ধরে ও তো ব্যবহার করছে এগুলো, ও তো আমার বাড়ির একজন”।

“বাপি আমি জানি ও ভাল করেই কাজ করে, মেয়েটাও ভাল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের লোক তো,  তুমি আর মা তোমরা বড্ড প্রশ্রয় দিয়ে এসেছো ওকে। মুম্বাইতে এরকম ভাবাই যায় না”।

“মামণি, তোর মা এর শেষ সময়ে ও যা করেছিল তা আমি কখনওই ভুলবো না, এই নিয়ে আর কথা বাড়াস না, সামান্য কটা জিনিস ওর কাছেই থাক”। কথায় ইতি টেনে দেন কাকাবাবু।

চোখের জল মুছে নেয় রানু, এত বাসন, মিক্সি স্টোভ নিয়ে কোথায় রাখবে ও জানে না। একফালি বারান্দায় রান্না। তবে তক্তপোশের পাশে এই খাট আর আলমারি রাখার জায়গা হয়ে যাবে। মেয়েটাকে আলাদা খাট দিতে চায় রানু, কত পড়ার চাপ ওর  একটু ভালো করে ঘুমের দরকার। বাসনকোসন বস্তায় ভরে আলমারির মাথায় রেখে দেবে, দরকার পড়লে নামাবে, খালি প্রেসার কুকারটা ব্যবহার করবে।

এই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে জামাইবাবু, অনেক টাকা পাওয়া গেছে শুনেছে। এত বড় বাড়ি, বাগানে কাকিমার নিজের হাতে পোঁতা সব ফুলগাছ। টগর জবা স্বর্ণচাঁপা,  স্থলপদ্ম, শেষের দিকে রানুই তুলে আনতো পুজোর ফুল। ঠাকুরকে সন্ধ্যে দেওয়া, সকালে মালা পরানো সবই ওর কাজ হয়ে গেছিলো, কাকিমা শেষের দিকে আর বিছানা থেকে উঠতে পারতো না। যেদিন কাকিমা অসুস্থ হয়ে গেলেন,  রানু একাই ছিল বাড়িতে, কাকু গেছিল বন্ধুর বাড়ি, ফোন করে ডেকে নেয় রানু। তারপর হাসপাতালে দিলেও আর জ্ঞান আসেনি কাকিমার। সাত দিন বাদে চলে গেলেন।

বছর খানেক হয়ে গেল। হিয়া দিদি বার কয়েক এসেছে এর মধ্যে কিন্তু দিদির স্কুলের চাকরি,  ছেলের স্কুল সব সামলে বারবার কলকাতায় আসা মুস্কিল। কাকাবাবুর শরীরও ভাল থাকেনা। হিয়া দিদি আর জামাইবাবু এসে এবারে অনেক বোঝালো কাকাবাবুকে।

“বাবা তুমি তো জানো বম্বেতে থাকার জায়গার কি সমস্যা।ওখানে আমাদের কাজেরও খুব চাপ বারবার আসা সম্ভব নয়। তোমারও তো বয়স বাড়ছে কতদিন একা থাকবে বলোতো। আমরা এখন ওয়ান বিএইচকে তে থাকি। এই বাড়ি বিক্রি করে দাও আমরাও ওটা বিক্রি করে সব টাকা মিলিয়ে একটা বড় টু বিএইচকে কিনি, সবাই একসাথে থাকবো। সোহমের জন্য মন খারাপ করো ওকেও তুমি কাছে পাবে। আমিও তোমাকে দেখতে পারবো”।

অনেক ভাবনা চিন্তা করে কাকাবাবুও রাজি হয়ে গেলেন। আজ যাবার সময়ে মুখ দেখেই রানু বুঝতে পারছে খুব মন খারাপ করছে ওনার। কিছুই খেলেন না প্রায়। রানুর মাথায় হাত বুলিয়ে চুপ করে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলে যাবার পর রানু এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়, বাগানের ফুল গাছ গুলোয় ফুটে রয়েছে ফুল আজ আর কেউ তোলেনি। একটু বাদে দেবু আসবে ওর বন্ধুর ভ্যান রিক্সা নিয়ে।  আর একটা জিনিস নেয়নি হিয়া দিদি। কাকিমার ঠাকুরের সিংহাসন। শুধু পেতলের বাসনগুলো নিয়েছে। কোথায় রাখবে জানেনা তবু রানু একটা ছোট প্লাস্টিকে গুছিয়ে নেয় মা লক্ষ্মীর ছোট মূর্তি,  গোপাল,  চন্দন পাটা ধূপের প্যাকেট। হুহু করে মনটা ওর, কাকিমার কি আদরের ছিলেন এরা আজ দেখো রানু না নিয়ে গেলে এভাবেই পড়ে থাকবে কেউ আর জল দেবে না ওদের।

“ঠাকুর তুমি বড় নিষ্ঠুর কেন কাকিমাকে নিয়ে গেলে তোমার কাছে এত তাড়াতাড়ি,এখন থাকো রানুর ছোট্ট ঘরে এত বড় বাড়ি ছেড়ে, শুধু নকুলদানা পাবে,  বুঝবে মজা”। 

দেবু এসে গেছে সব বেঁধে নেয় ভ্যান রিক্সায়, তালা দিয়ে পাশের বাড়ি অলকা মাসিমার কাছে চাবি দিয়ে দেয় রানু, যারা কিনেছে তারা কাল এসে চাবি নিয়ে বাড়ির দখল নেবে। হাঁটতে হাঁটতে বার বার পিছু ফিরে চায় রানু, অন্ধকার বাড়িটা, মনে হয় কাকিমা যেন একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ ওনাকে নিয়ে যায় নি। দেবু তাড়া দেয় ওকে,  চোখের জল মুছে রানুও এগোয়। আনমনে একটু হাত নাড়ে কাকিমার কথা ভেবে।

“চিন্তা করনা কাকিমা আমি দেখবো তোমার ঠাকুরদের, জল দেব গো দুবেলা, কাকাবাবু মেয়ের কাছে ভাল থাকবেন, তুমিও ভাল থেকো।”

(দুই)

বাড়ি ফিরে সব জিনিস গোছাতে অনেক সময় লেগে গেল। ঠাকুরের আসন পেরেকে ঝুলিয়ে দেওয়ালে টাঙালো, খেয়ে শুতে শুতে কত রাত। এবার নতুন একটা কাজ খুঁজতে হবে নাহলে দিন দিন সংসারের খরচ যা বাড়ছে সামলানো দায় হয়ে পড়বে। কদিন মনটা বড় খারাপ ছিল, তারপর সময়ের সাথে কিছুটা ফিকে হল। কাকাবাবু গিয়ে ফোন করে পোঁছানোর সংবাদ দিয়েছিলেন আর ফোন করেননি। গণেশ পুজোর দিন রানু নিজেই ফোন করল। ওদিকে তো খুব বড় করে হয় গণেশ পুজো হিয়া দিদির কাছে গল্প শুনেছে। এবাড়িতে কাকিমাও করতেন,রানু মালপোয়া আর লাড্ডু বানাতো ছেলে মেয়েরাও গিয়ে প্রসাদ খেত। আজ কি মনে হল, চারটে লাড্ডু দোকান থেকে কিনে কাকিমার ঠাকুরের সামনে রাখে রানু।

ফোন বাজছে,  কাকাবাবু। 
 “হ্যাঁ রে রানু বল, তোরা সবাই ভাল তো”?
“ ভাল আছি কাকাবাবু, আপনি কেমন আছেন, হিয়া দিদি জামাইবাবু সোহম ? ওখানে গণেশ পুজো কেমন দেখছেন…  শরীর ভাল আছে তো… ওষুধ নিয়মিত খান “?

প্রশ্নের ঝড় থামলে কাকাবাবুর শুকনো গলার উত্তর আসে  “সবাই ভাল আছে রে। আমি বেরোইনি তাই পুজো দেখা হয় নি”।

গলার স্বরে কি যেন ছিল কাকাবাবুর,  রানু থমকে যায়, দু একটা মামুলি কথার পরে ফোন নামিয়ে রাখে। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনের মধ্যে ঘুরতেই থাকে কথাটা, কি হয়েছে ওনার,  শরীর ঠিক আছে তো,  মেয়ের কাছে নাতির কাছে আছেন মন তো ভাল থাকার কথা। সেদিন এক বাড়ি কাজে যাবার সময়ে একটু ঘুরপথে কাকিমার বাড়ির সামনে দিয়ে যায়। না গেলেই ভাল হত, যারা কিনেছে তারা সব ফুলগাছ কেটে ফেলে জায়গাটা বাঁধিয়ে গাড়ি রেখেছে, শুধু গেটের কাছে সাদা জবার গাছটা আছে। কি মনে হতে গাছের একটা ডাল ভেঙে আনে রানু।

বাড়ি এসে একটা টবে ডালটা পুঁতে দেয়।  

“বুবু মা সকালে রোজ এই গাছটায় জল দিবি তো, খুব সুন্দর সাদা জবা ফুটবে রে, কাকিমার ঠাকুরদের সাজিয়ে দেবো ওরা খুশি হবেন জানিস”।

পুজোর মুখে গাছটায় সত্যি ফুল ফুটতে শুরু করলো। বুবু আর টুবুও খুব খুশি। গাছ থেকে কে ফুল নিয়ে ঠাকুরের কাছে দেবে সেই নিয়ে দুজনের রোজ ঝগড়া হয়।

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সব কাজ শেষ করে রানু ফিরছিল, বাতাসে একটা হিম হিম ভাব, হঠাৎ মনে হল ব্যাগে ফোনটা বাজছে। 
“হ্যালো”

“কাকাবাবু বলছি রে”।

রানুর গলায় উচ্ছাস ঝরে পড়ে
“কেমন আছেন, ওখানে পুজোর প্যান্ডেল হয়েছে ? হিয়া দিদি কেমন আছে”?

একটু চুপ থেকে কাকাবাবু বলেন

“আমি ভালো নেই রে একদম ভালো নেই… এখানে কিচ্ছু ভালো লাগে না”।

“কি হয়েছে বলুন না, শরীর ঠিক আছে তো”।

“এখানে আসা আমার উচিত হয় নি রে রানু, বড্ড বোকামি করেছি, তুই জানিস এখানে ওরা আমার টাকাগুলো দিয়ে একটা দুঘরের ফ্ল্যাট কিনেছে,একটা ঘরে হিয়ারা আর একটা ঘরে সোহম থাকে তার কুকুর নিয়ে,আমার কোন ঘর নেই, একটা ছোট বারান্দা তাতে একফালি বিছানায় আমি শুই, পাখা লাগানোর জায়গা নেই ছোট টেবিল ফ্যান,  কোন বই কাগজ নেই,  আমাকে কোথাও বেরোতেও দেয় না। বলে আমি নাকি কোথাও গেলে পথ হারিয়ে ফেলবো”।

হাঁফাচ্ছেন কাকাবাবু বোধহয় কাঁদছেনও।

রানু কি বলবে ভেবে পায় না।

“খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করছেন তো ? ঘরে বসে টিভি দেখবেন”।

“খাওয়ার কথা আর বলিস না রানু, ওদের একজন বাই সকালে এসে কি ছাই রেঁধে দিয়ে যায়,  আমি কিছুই খেতে পারিনা, বাঙালী রান্না নয় রে,  দুবেলাই রুটি রোজই নিরামিষ ওরা তো অফিসে খায় দিনের বেলা, আমার গলা দিয়ে কিছু নামে না”। রাত্তিরে দুধ মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি।

“তাহলে কি করবেন কাকাবাবু, হিয়া দিদিকে বলুন না আপনার কি অসুবিধা হচ্ছে”!

“নিজের সন্তানকে আর চিনতে পারিনা রে রানু, আমার পেন্সনটা এখানে ব্যাঙ্কে নিয়ে এসেছে, ওই একদিনই আমায় নিয়ে যায়, টাকা তোলার সাথে সাথে খরচা বাবদ সবটাই নিয়ে নেয়, খুব বললে পাঁচশ টাকা দেয় পুরো মাসের জন্য। তাই দিয়ে ফোনে পয়সা ভরালাম। আর টিভির কথা বলছিস সে ওদের শোবার ঘরে,  আমি ঢুকি না তো দেখব কি”।

হঠাৎ রানুর অসম্ভব রাগ হয়,  “আপনি চলে আসুন তো কাকাবাবু এখানে ফিরে আসুন, থাকতে হবে না ওখানে,ওরা বেশি কিছু বললে সোজা থানায় চলে যাবেন,আমি সেদিন টিভিতে দেখেছি বয়স্ক মানুষেরা এরকম থানায় গিয়ে নিজের ছেলে মেয়ের অত্যাচারের কথা বলছে। রানু এখনও বেঁচে আছে,  আমিও আপনার মেয়ে আমার কাছে এসে থাকুন”।

রানুর কথায় কি যে জোর পান,  গলাটা পালটে যায়, “হ্যাঁ ঠিক বলেছিস আমি থাকবো না এখানে দেখছি কি করা যায়, তুই সাবধানে থাকবি আমি পরে ফোন করবো”।

ফিরে এসে রানু বলে “বুঝলি বুবু লেখাপড়া শিখে এমন জানোয়ার হোস না যেন। বাপের টাকা কটা হাতিয়ে নিয়ে তাকে কি কষ্ট না দিচ্ছে, ছি ছি এরা আবার ভদ্দরলোক”। নিজের মনে আরও গজগজ করে চলে সে।

(তিন)

পুজো কেটে গিয়ে কালিপুজো পেরিয়ে গেল, রানুর একটু জ্বর জ্বর,  আজ আর কোন বাড়ি কাজে যায়নি, বুবু ভাতেভাত করেছিল। দু ভাই বোন খেয়ে ইস্কুলে গেল। বেলার দিকে রানু উঠে স্নান করে ঠাকুরকে বাতাসা আর জল দিল। দুটো ফুল দিল গাছ থেকে। প্রণাম করছে শোনে ফোন বাজছে।

“হ্যালো”

“রানু তুই কোথায় আছিস”?

“কাকাবাবু আপনি কেমন আছেন,  একবারও আর ফোন করেন নি,আমি ফোন করলে বলে অফফ আছে, খুব চিন্তা করছি কদিন”..

“শোন আগে,  এখন একবার ক্লাবের মোড়ে আসতে পারবি ”?

“ওখানে কি আছে”?

“তুই আয় না,  এলে বলছি”।

তালা দিয়ে রানু পাঁচ মিনিটে ক্লাবের পাশে। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, রোগা হয়ে গেছেন, আরও যেন বুড়ো হয়ে গেছেন কিন্তু মুখে হাসি ধরছেনা। রানু প্রণাম করতেই বললেন “আয় আমার সাথে।” ক্লাবের পাশের গলিতে মিত্তিরদের বাড়িতে একতলায় কাকাবাবু একটা ঘর নিয়েছেন। প্রনবেশ মিত্তির কাকাবাবুর ছোটবেলার বন্ধু।

“বুঝলি প্রনবেশ বলল তুই আপাতত এই ঘরে থাক। বিছানা বালিশ ওদের একটা পুরোন ফ্রিজ সব দিয়েছে। কাল এসেছি। তোকে যখন ফোন করে ছিলাম সেদিন ওকেও করেছিলাম। সব শুনে ও বলল চলে আসতে, ওরা সবাই বেরিয়ে যেতে নিজেই একদিন ব্যাঙ্কে গেলাম , সব ব্যবস্থা করে আবার পেন্সন এখানে ট্রান্সফার করে নিয়েছি। প্রনবেশ খুব সাহায্য করেছে। আমার এখানকার একটা ব্যঙ্কে সামান্য কিছু টাকা ছিল হিয়ারা জানত না জানলে বাঁচাতে পারতাম না। কিছুদিন ওই টাকায় চলে যাবে তারপর পেন্সন ভরসা। তবু তো নিজের মত থাকতে পারবো। ওখানে থাকলে আমি মরেই যেতাম”।

“ওসব কথা আর মনেও আনবেন না, ভাল করেছেন।ওদের না বলে এসেছেন নাকি”?

“বললে আসতে দিত নাকি, মাসে সাতাশ হাজার টাকা পেন্সন ওদের চলে গেল তো, তুই চিন্তা করতে পারবি না একটা রুটি বেশি খেলে আমায় কথা শোনাত, বেশি রুটি করতে ওদের বাঈ রাগ করে,  বেশি খেয়ে শরীর খারাপ করলে ওদের ডাক্তার দেখানোর সময় নেই এমনই সব কথা। তোর মাসীমার কত গয়না ছিল যাওয়া মাত্র লকারে রাখবে বলে আমার থেকে নিয়ে নিল, আর কত বলব”!

“আর বলতে হবে না কাকাবাবু। দুপুরে খেয়েছেন কিছু ?”

“খেলাম তো প্রনবেশের বাড়ি, ভাত মাছের ঝোল,  চিকেন আরো কত কি বানিয়েছিল, কত দিন বাদে মাছ খেলাম। তবে এবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে রোজ রোজ ওদের বাড়ি খাওয়া তো ভাল দেখায় না।”

বিকেলের মধ্যে রানু দেবুকে নিয়ে এল সাথে আলমারি ঠাকুরের সিংহাসন সাদা জবার গাছ। ছোট রান্নার জায়গায় সব পুরোন বাসন,ছোট গ্যাস দিয়ে সাজিয়ে ফেললো, ফ্রিজের ওপরে কাকিমার হাসিমুখের ছবি। ঘরে ঠাকুরের সিংহাসন বসিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করে রানু বললো  “দেখুন তো কাকাবাবু, কাকিমার ঠাকুরের আসন কেমন গুছিয়ে রেখেছিলাম,  আর এই জবা গাছটা চেনা লাগছে? কাকিমার হাতে লাগানো, রোজ ফুল দেয়। কমল কাগজ ওয়ালা কে বলে দিয়েছি কাল থেকে আপনাকে কাগজ দিয়ে যাবে যেমন দিত,  আর কাল গিয়ে একটা টিভি কিনে আনবেন, আমার ব্যাঙ্কের বই থেকে টাকা তুলে নেবেন দরকার হলে। না বললে কিন্তু খুব রাগ করবো, সকালে এসে আমি চা জলখাবার বানিয়ে দেব আর দুপুরের খাবার। রাতে রুটি তরকারি করে দিয়ে যাব।

হিয়া দিদি একদিন ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবে কাকাবাবু একটা ছেলে আছে তো,  দেখবেন”।

“ঠিক বলেছিস রে রানু,  ভুল বুঝলেই ভাল তবে আমি আর যোগাযোগ রাখতে চাই না। আর কে বলেছে তোর টাকায় টিভি কিনতে আমার আপত্তি, কোন আপত্তি নেই, রক্তের সম্পর্কই কি সব রে,  তুই তো আমার আসল মেয়ে।”

রানুর মাথায় হাত রাখেন বিভাস, ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে থেকে ধূপের মিষ্টি গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।


ritu_rudr@yahoo.co.in



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.