রাহুল ঘোষ

পরাজিতদের গল্প //পঞ্চম পর্ব/ দশানন
পঞ্চম পর্ব রাবণের আরেক নাম 'দশানন'। স্থানান্তরে 'দশমুখ' ও 'দশগ্রীবা' নামদুটিও প্রচলিত আছে। তবে 'দশানন'-ই বেশি পরিচিত। এমন কোনো ভারতীয় বোধহয় নেই, অথবা ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্য সম্পর্কে জ্ঞাত এমন কোনো মানুষ নেই, যাঁর রাবণের দশটি মস্তকবিশিষ্ট চেহারাটি নিয়ে অন্তত একটুও ধারণা নেই। রাবণের দশ মাথা সম্পর্কে সবাই জানেন, এমনকি কোনো-কোনো বর্ণনায় তো তাঁর কুড়িটি হাতেরও উল্লেখ পাওয়া যায়! বিশ্বাসীরা এইসব উল্লেখ প্রশ্নহীন হয়ে মেনে এসেছেন বরাবর। তাঁদের মনেই হয়নি, দেব হোক বা দানব হোক বা মানব, এরকম বেখাপ্পা চেহারা নিয়ে কেউ চলাফেরা করবে কী করে! তার উপরে রাবণ হচ্ছেন গিয়ে ত্রিলোকবিজয়ী যোদ্ধা, তাঁর তো এতসব বাহুল্যে আরও অসুবিধা হওয়ার কথা! যুদ্ধক্ষেত্রে এরকম শরীর নিয়ে তাঁকে নড়াচড়ার সুযোগ আর কে দেবে, যুদ্ধজয় তো দূরের কথা! 

কিন্তু লঘু চপলতা ছেড়ে আমাদের এবার বরং মানুষের মনের অন্তরালের কারণটি বিবেচনা করা দরকার। আসলে যতই বীর হোন আর স্বর্ণলঙ্কার রাজা হিসেবে প্রসিদ্ধ হোন, মানুষের কাছে আদতে তো তিনি রাক্ষস! অথবা অসুর-সংস্কৃতির ধারক-বাহক। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি তথাকথিত দেবশক্তির প্রতিস্পর্ধী। এমন একটি চরিত্রকে যদি ভয়ানক, বিকৃত চেহারায় আঁকা যায়; তাহলে তার ভয়াল রূপটিকে বেশ গুছিয়ে তুলে ধরা যায়। একই সঙ্গে, কেন এরকম একটি ভয়ানক ব্যক্তিকে হারানো দেবতাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে, যাঁকে মারার জন্য নাকি স্বয়ং বিষ্ণুকে মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে, তারও একটা যৌক্তিকতা খাড়া করা যায় বই-কী! না-হলে যে দেবতাদের ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে ভক্তমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে! তাই রাবণের দশ মাথা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস আনার জন্য আরও কিছু অতিরঞ্জিত গল্প আনতে হলো। যেমন, কৈকেশী ও বিশ্রবার প্রথম সাক্ষাতের সময়টি নাকি এতই অশুভ ছিল যে তাঁদের সন্তানেরা ভয়ানক-দর্শন ও হিংস্র হবে! রাধা বিশ্বনাথ তাঁর রাবণকেন্দ্রিক পুনর্নির্মাণে দেখিয়েছেন, একথা কীভাবে বিশ্রবাকে দিয়েই কৈকেশীকে বলানো হলো। ঋষিবাক্য সত্যি করে কৈকেশীর প্রথম সন্তান দশটি মাথা, বিরাট শরীর ও বাজখাঁই কন্ঠস্বর নিয়ে জন্মালো। সদ্যজাত শিশুর কান্না শুনে বিশ্রবার আশ্রম ও আশপাশের পশু-পাখিরা সব ভীত হয়ে পড়লো, ইত্যাদি-ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্রবার কাছে শিক্ষালাভের জন্য আসা ছাত্ররা যখন রাবণের অতগুলি মাথা ও হাত নিয়ে ঠাট্টা করতো বা কুম্ভকর্ণের বিশালাকৃতির কান দেখে মজা পেত, তখন বিশ্রবা তপস্যাশক্তি দিয়ে তাঁর এই দুই পুত্রকে স্বাভাবিক চেহারায় এনে দিয়েছিলেন, সেই উল্লেখও আছে। কিন্তু এই ঘটনার ফলে রাবণ যে তাঁর অতিরিক্ত নয়টি মাথা এবং ১৮টি হাত হারিয়ে ফেললেন, তাও নয়! এই প্রসঙ্গে রাধা বিশ্বনাথের লেখনীতে রাবণের বয়ানটি উল্লেখ করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না: 'Slowly, one by one, nine of my ten heads dissolved, and the same happened with nine pairs of my arms. But I did not lose them. They are all there, inside me somewhere and they will come out when I want them or need them.'

এই গল্পটি আরও কৌতূহলজনক হয়ে ওঠে, যখন অমর হওয়ার বর পাওয়ার জন্য নিজের দুই ভাইকে নিয়ে রাবণ তপস্যা শুরু করেন। দীর্ঘ তপস্যার পরেও কিছুতেই প্রপিতামহ ব্রহ্মা আবির্ভূত হচ্ছিলেন না বলে রাবণ যজ্ঞে নিজের মাথা কেটে আহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি তো জানেন যে তাঁর একটি মাথা গেলে আরও নয়টি মাথা আছে! এভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তপস্যাকালীন যজ্ঞে নিজের মাথা আহুতি দিতে-দিতে যখন রাবণের আর একটি মাথাই অবশিষ্ট, সেই সময় তিনি সেটিও আহুতি দিতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা আবির্ভূত হয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করেন। এরপরে রাবণ-সহ তিনভাইকেই তিনি বর দেন, কিন্তু সে-কথায় প্রসঙ্গান্তরে আসা যাবে। তবে এখানে যে-কথা বলার, তা হলো, বরদান ছাড়াও ব্রহ্মা কিন্তু রাবণের আগের নয়টি মাথাও ফিরিয়ে দেন!

আমরা আগেও বলেছি, মহাকাব্যে উল্লিখিত বা মহাকাব্যকে কেন্দ্র করে প্রচারিত সবকিছুকে আক্ষরিক অর্থে ধরার প্রয়োজন একেবারেই নেই। রূপক ও উপমার ব্যবহার যে-কোনো উৎকৃষ্ট সাহিত্যেরই অন্যতম শক্তি, প্রাচীন মহাকাব্যে তো বটেই! এই কথা আমরা মনে রাখি না বলেই আজও দশেরায় রাবণের দশমাথার উদ্ভটদর্শন পুতুল জ্বালিয়ে আনন্দ পাই। আমরা ভুলে যাই যে, রাবণ আসলে এক মহাজ্ঞানী যোদ্ধা, যাঁর ছয় শাস্ত্র ও চার বেদে অপরিসীম পাণ্ডিত্য। সেই পাণ্ডিত্যেরই ইঙ্গিত তাঁর ওই দশটি মাথার উল্লেখে। তিনি যুদ্ধবিদ্যার সব শাখায় চূড়ান্ত দক্ষ। তিনি শিল্পের ৬৪ কলায় সিদ্ধহস্ত। এককথায়, তাঁর একার জ্ঞান-ক্ষমতা-দক্ষতা দশজনের সম্মিলিত শক্তির সমতুল্য। এই অতিমানবিক দক্ষতারই ইঙ্গিত রয়েছে তাঁর ওই দশ মাথায়। আর ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর কুড়িটি হাতের উল্লেখ আসলে রাবণের পরাক্রম ও কৌশলের পরিচায়ক। রাধা বিশ্বনাথের পূর্বোল্লিখিত রাবণ-বয়ান থেকে আমরা কিন্তু এই বাস্তবসম্মত ধারণারও ইঙ্গিত পাবো: 'Meanwhile, my ability to think with ten different minds, examining each issue from ten different aspects at the same time, has remained with me.'

এখানেই শেষ নয়। রাবণের দশানন হওয়ার আরও ব্যাখ্যা আছে। অনেক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রাবণের দশ মাথা আসলে মানুষের চারিত্রিক দশটি বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক। কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, মদ বা গর্ব, মাৎসর্য বা ঈর্ষা, মন, বুদ্ধি, চিত্ত বা ইচ্ছাশক্তি ও অহং---এই হলো সেই দশটি বৈশিষ্ট্য, যা কাউকে পরিচালনা করে। হিন্দু দর্শনে এদের মধ্যে বাকি নয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বুদ্ধিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। একমাত্র তাহলেই কোনো ব্যক্তি সিদ্ধি অর্জন করার জায়গায় পৌঁছতে পারবে। পৌঁছে যেতে পারবে দেবত্বের কাছাকাছি। কিন্তু রাবণ চরিত্রের বিশ্লেষণ যদি আমরা দেখি, তিনি তো দেবতা হতে চাননি কোনোদিন! বরং যাবতীয় দেবত্বকে নিজের পদানত করার দিকেই ছিল তাঁর আগ্রহ। এর পিছনে সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সুর-অসুর দ্বন্দ্বের কারণ ছিল, নাকি শুধুই রাবণের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সে-প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। তবে সবকিছুর উপরে যে তিনি নিজের পুরুষকারকে স্থান দিয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রাবণকে কেন দশানন বলা হয়, তা নিয়ে আনন্দ নীলকন্ঠনও চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষের দশটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্রোধ, অহংকার, ঈর্ষা, আনন্দ, দুঃখ, ভয়, স্বার্থপরতা, আবেগ, উচ্ছাকাঙ্ক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা। রাবণকে কেন্দ্র করে রামায়ণের কাহিনি পুনর্নির্মাণে তিনি প্রাচীন অসুররাজ মহাবলীর প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। মহাবলী বা মাভেলি ছিলেন কেরালাপুত্র প্রজাতির রাজা, যাঁকে অনেকেই দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর প্রপৌত্র ও প্রহ্লাদের পৌত্র মনে করেন। আজকের দক্ষিণ ভারতে মুখ্যত কেরালাকে কেন্দ্র করে তাঁর রাজত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। খুব জনপ্রিয় ও কল্যাণকামী রাজা হলেও মূলত দেবশক্তির বিরুদ্ধতার দায়ে ও বামনরূপী বিষ্ণুর বুদ্ধিতে রাজ্য হারিয়ে তিনি নির্বাসিত হন জনহীন এলাকায়। কিন্তু মহাবলী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ অনুগামী এই নির্বাসনের মধ্যেও অসুর-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখানে আমরা অবিকল রাবণের মাতামহ সুমালী ও তাঁর ইচ্ছার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। নীলকন্ঠন নিজের কাহিনিতে রাবণের সঙ্গে মহাবলীর সাক্ষাৎ দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মহাবলীও যে রাবণকেই অসুর-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপযুক্ত ভেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাও উল্লেখ করেছেন। প্রশিক্ষণ শেষে রাবণকে তিনি বাকি নয়টি বৈশিষ্ট্যের তাড়না থেকে মুক্ত হয়ে বুদ্ধিমত্তার উপরে নির্ভর করার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাবণের নিজের উপর অগাধ আস্থা। তাছাড়া তিনি বিশ্বাস করেন, এইসব দোষ-গুণের সমন্বয়েই একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র হয়ে ওঠার বাসনা তো তাঁর ছিল বলে মনে হয় না! তিনি অবশ্যই মহান হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তাঁর শৌর্য ও জ্ঞান দিয়ে। কিছু ত্যাগ করে নয়, বরং সবকিছুর ব্যবহারেই তাঁর পথের সিদ্ধিলাভ। তাই রাবণ আসলে একজন অতিমানবিক ক্ষমতাসম্পন্ন অথচ বাস্তবোচিত মহাকাব্যিক ব্যক্তিত্ব। আমাদের দুর্ভাগ্য, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতাই আমাদের কাছে রাবণকে শুধু রূপকথার একটি খল-চরিত্র করে রেখে দিয়েছে।

(ক্রমশ)
চতুর্থ পর্ব পড়ুন


rahulbabin1@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.