পিনাকি

স্বপ্নের মতন সত্যি


এখন  ঘড়িতে  দশটা । মুমিন  আমাকে  ফোন করে  বলল , - শীতের  সকালে  ছুটির দিন  ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে    না । আমি  একটি অনলাইন  ম্যাগাজিনে ত্রিনুদার  গল্প লিখি । সম্পাদক  আমার  জন্যই  এই বিশেষ  বিভাগটি শুরু  করেছেন । তার  কথা  হচ্ছে , আমাকে  প্রতি  মাসে  অন্তত  একটি করে  গল্প  দিতে  হবে  ।  আজ রবিবার । ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে  নেব  । আগের রাতে  বাড়ি  ফিরতে বেশ দেরী হয়েছিল ।

গল্পের  জন্যই  আজ এই সকালে  আমরা দু’জনে  চলে  এলাম ।  গেট খুলে  সিমেন্ট  দেওয়া  লম্বা পথ  পেড়িয়ে  দরজার সামনে  দাঁড়িয়ে   কলিংবেল   টিপলাম।  দরজা খুলে  দিল  ত্রিনয়দা  । আমাদের দেখে  হাসল।  কপালের উপর  ছড়িয়ে থাকা চুল  হাত দিয়ে  সরিয়ে  আমাদের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – আয় , তোদের জন্যই অপেক্ষা  করে  ছিলাম । বেশ  ভালো লাগছে । সারা সপ্তাহ নিজের  ভিতর নিজে  ব্যস্ত  থাকি । এখন হাতে  কোন কাজ নেই । শুধু  মানুষের অবচেতন  মনকে  ব্যবহার করে  ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা  , তা নিয়ে  একটা থিসিস  লিখছিলাম । লন্ডনে  আমার  থিসিস  পড়া হবে  । এরজন্য  টাকা পাব । আমার সম্মান আর  টাকা দুটোই দরকার  ।  আমার  অভিজ্ঞতা  অন্যের  সাথে  ভাগ  করে নিতে  ভালো লাগে  ।  

আমরা সিঁড়ি  দিয়ে  উপরে উঠলাম ।  ত্রিনয়নদার  ঘরে  ঢুকলাম ।  আমি আর  মুমিন   চেয়ারে  বসলাম । ত্রিনুদা  খাটের উপর  উঠে  বসল । 

মুমিন বলল – ত্রিনুদা , অবচেতন মন  ভবিষ্যতের ইঙ্গিত  দিতে পারে  !
ত্রিনুদা এই   শীতের  সকালে  পাঞ্জাবি ,পাজামা আর  চাদর  জড়িয়েছে । হাসছে , বলল  - 
-সত্ত্ব , রজঃ ,তম  গুন   নিয়ন্ত্রণের  মধ্যে  দিয়ে  অবচেতন মনকে  সক্রিয় করা  সম্ভব ।  এটা  নতুন কিছু  নয় । তবে  ইদানীং  এইসব  বিষয় নিয়ে  যে  কাজ  হচ্ছে  তা দেখবার  মতন । আমি   অলৌকিক  শক্তিতে বিশ্বাস করি ,তবে  সেই  শক্তির মধ্যেও বৈজ্ঞানিক  যুক্তি থাকতে হবে ।  কোন  ভাবেই  গুজবকে   বিশ্বাস করিনা ।  নিজের  জীবনে  যে  অভিজ্ঞতা  পেয়েছি  তাইতো  আমার  গল্প হয়ে ওঠে ।

আমি  বললাম –ত্রিনুদা  এত  সকালে  আমরা ছুটে এলাম , শুধুই  তোমার গল্পের মোহে ।  
-তাহলে তোরা  একটু   অপেক্ষা কর । আমি  বাগান  থেকে  লেবু  নিয়ে  আসছি । 
-কেন ?
-ভেবেছিলাম  কফি  অফার  করব । এখন  ইচ্ছা আসছে  একটু অন্যরকমের । মানে  লেবু চা ,বিটনুন  দিয়ে ।  সাথে  টমাটোর পাকোরা ।  
এর  জন্যই  ত্রিনয়নদার এই  বৈঠকি  আড্ডা  আমাদের কাছে  এতটা  প্রিয় । আমি  বললাম – মন্দ নয় । আমরা  ত্রিনুদার  দ্বোতলার  ঘরে  গিয়ে  আড্ডা জমালাম ।  ঘরে  দু দিকে  দুটো জানালা আছে  ।  একটা  জানালার  ধারে  সাদা  ধবধবে  চাদরে ঢাকা বিছানা ।  আরেকটা  জানলার  সামনে  ছোট্ট টেবিল আর  দুটো  চেয়ার ।  একটা  আরাম  কেদারায়  আমি  গিয়ে  বসলাম । পাশের   চেয়ারে  মুমিন  গিয়ে  বসল । কিছুক্ষণ বাদেই   ত্রিনুদা  তিনটে  চায়ের  কাপ  আর  সাদা ডিশে  ভরে থাকা গরম  পাকোরা  নিয়ে  এসে  ঢুকল ।

আমি  বললাম – দাদা ,  এখন  তোমার  গল্প  শুনব ।
ত্রিনুদা  হেসে  বলল -  বেলা এগারোটায়  গল্প ! দেখ আমিতো  বানিয়ে  কিছু  বলতে পারিনা  । আমার  জীবনের অভিজ্ঞতা   থেকেই  গল্প  বলতে  পারি  ।
-বলো  ।  বেশ  জমে  যাবে ।
মুমিনের  কথাকে  সায় দিয়ে  আমি  বললাম -  ত্রিনুদা  তুমি যাই  বলবে , তা আমাদের  এক  অন্য  জগতে  নিয়ে  যায় । আমরা   শুনতে  চাই  । 
ত্রিনয়ন দা  খাটের উপরে  পা ছড়িয়ে  টান –টান  করে  গা  হেলিয়ে  শুয়ে  পড়ল ।  পাশের টেবিলে থাকা  চায়ের  কাপ  হাতে  নিয়ে  পা নাড়াচ্ছিল ।

ত্রিনুদার  চোখ  দুটো বন্ধ । কাপে  শেষ  চুমুক  দিয়ে  টেবিলে  রেখে  বলল -  শুরু  করি ? 



আজ  থেকে  প্রায়   কুড়ি  বছর আগের  কথা  । এখনও মনে  আছে  । তোদের আমি  আমার  প্রথম  অভিজ্ঞতার গল্প করেছিলাম মনে  আছে  ?
আমি  বললাম  হ্যা ।
ত্রিনুদা বলল – সেই  ঘটনার  প্রায় দু’মাস বাদে  আমি  ফোন পেলাম  । মানে  সিউরি  থেকে  বিকাশ  ফোন করেছিল । কলেজে  থাকতে  আমরা  এক  বেঞ্চে  বসতাম । আমরা  নিউআলিপুর  কলেজে ইতিহাসের  স্নাতক বিভাগের  ছাত্র ছিলাম  । সেই  দিন  গুলো  স্বপ্নের মতন কাটত ।  বিকাশের  ইচ্ছা ছিল  খুব  বড় ঐতিহাসিক হবে  , আমাদের  দেশের  ইতিহাস  নিরুপেক্ষ ভাবে  লিখবে  ।  ওর  স্বপ্ন  আমাদের  বিভোর করে তুলেছিল ।  কলেজের  পাট চুকে  গিয়েছে  । আমিও  এম এ পড়ব বলে ছোটাছুটি করছিলাম । বিকাশকে অবশ্য  মাঝপথে  পড়া  ছেড়ে  দিতে  হয়েছিল । মানে  বিএ অনার্স করবার পর , আচমকাই ওর বাবার হার্ট এ্যাটার্ক  করল ।  সংসারের জন্য  কাজের  চেষ্টা করতে হচ্ছিল । আর  পড়ল না  ।আমাদের  মধ্যে  একবছর কোন যোগাযোগ  ছিল না।  আগে  বেশ কয়েকবার ওদের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলাম । 

সেই  দিন  শুক্রবার  , ফোন  সকাল আটটা  নাগাদ  বেজে  উঠল   ।  ফোন কানে  রাখতেই ,উল্টো দিক  থেকে  ভেসে  উঠল 
-কেমন  আছিস ? আমি  বিকাশ ।   
-আরে  ! বিকাশ  !!
-হ্যাঁ  ভাই  । কেমন  আছিস ?
-আমিতো  ভালো আছি , তুই  কেমন  আছিস ? 
-এখন   ঠিকাছি । 
-মেসমশাই ?  আমরা  শুনেছি , তুই রেজাল্ট  বেরানোর পরেই ভ্যানিশ  হয়ে গেলি !
বাবার  অসুস্থতার সময়  ভয় পেয়েছিলাম । সংসারের জন্য চাকরি খোঁজ করতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম , যোগাযোগ করতে  পারিনি । 
-আমিও রে । আমি  কিন্তু  তোর  ফোন নম্বরে  ফোন করেছিলাম । কিন্তু কোনভাবেই পেলাম না । 
-পাবি কেমন ভাবে ! আমার  ফোনটা  চুরি  হয়ে  যায় । নতুন সিম  নিয়েছি । তাইতো ভাবলাম ফোন করে তোকে  চমকে দেব ।
-বেশ করেছিস ।
-আরেকটা প্ল্যান অবশ্য আছে  ।
- মানে পরিকল্পনা ? মনে আছে আমি , তুই আর ডাবু  - সিউরির  বাড়িতে গিয়ে  কত  আনন্দ করেছি । সেই ফাস্ট ইয়ারে । মনে  আছে  ?
-হ্যাঁরে । মনে আছে  । আমি এখন  একটু থিথু  হয়েছি । শোন , আজ শুক্রবার । তুই শনিবার  চলে আয় ।
-কোথায় ?
-সিউরি ইন্টার সিটি  এক্সপ্রেসে  চেপে । সকালের  ট্রেন , হাওড়া থেকে  ধরবি । 
-ধুস , পরে একদিন ...
-না ভাই । পরের  ভরসায়  থাকা ঠিক নয় । ডাবুও  আসবে । দেখ  অনেক দিন বাদে  তিনজনে জমিয়ে  আড্ডা  দেব । আমি যে  দোকানে কাজ  করছি তা দুবরাজ পুরে । আমার আসতে মোটামুটি  ধরে নে  , রাত  ৯ টা ২০ । আশা করছি তুই আর  ডাবু  চলে আসবি । ডাবু  অবশ্য  দুপুরেই  চলে আসছে ।  দেখ  বাড়িতে  কেউ  থাকবে না  , বাবাকে  নিয়ে মা  মামা বাড়ি  যাবে । তাই ভাবলাম  একা  থাকব ! জানিস একা থাকতে  আমার  ভালো  লাগেনা । আমি ভাবলাম তোকে  ফোন করি । এমনিতেও তোকে খুব  দেখতে  ইচ্ছা  করছে । প্রায় একবছর  দেখা  হয়নি !  রবিবার ওরা  ফিরে  আসবে , বাবা –মা  তোকে  দেখে  খুশিই হবে  । ডাবুকে  তিনদিন  আগে  ফোন করেছিলাম ।ওর কাছ  থেকে  তোর নম্বরটা পেয়েছি ।তাছাড়া  সেই  একই ঠিকানা । আগে  বহুবার এখানে  এসেছিস ।  এখন আসতে ইতস্তত হওয়ার কথা  নয় । 
-ডাবু এটা ঠিক করেনি । একদিন আগেই  ফোনে  আমাদের  কথা  হল । তোর কথা  বলল  না ।
-হিঃ হিঃ ।
বিকাশের  হাসি  । 
আমি  বললাম  – শালা । তুই  ওকে   নিষেধ  করেছিলিস ? 
-অবশ্যই , না হলে  তোকে  সারপ্রাইজ  দিতে  পারতাম  না  । 
-বাদ দে  ।  একেতো  কোন  যোগাযোগ রাখিসনি  । এখন  আবার সারপ্রাইজ !
-ত্রিনু আমার কাছে  কিন্তু  ডাবুর নম্বরটা  ছিল  লেখা  ।   তোর নম্বরটা  ফোন  ছাড়া  আর  কোথাও লিখিনি । শোন , ধর যদি  ডাবুর  নম্বর  না  থাকত , আমি  কিন্তু   কোলকাতায় গিয়ে  তোমার সাথে  দেখা  করতামই । তাই  বলছি , ভাই  কাল  চলে  আয় ।
-এমন  ভাবে  বললে আসা যায় ?
-আসতে  হবে  । এটাই  আমাদের  বন্ধুত্বের পরীক্ষা । দেখি  আমরা  তিনজন বন্ধু  একবছর পর  কেমন  পাল্টেছি ! আমাদের  সেই  টান  আগের  মতন  আছে  কিনা  দেখব  । চলে আয়। ডাবু  কিন্তু আসবে ।
-ঠিকাছে আমি  দেখছি ।
-না  দেখছি  নয় ,  অবশ্যই  আসা চাই । 
কথা  বলবার পরেই  মনে –মনে  বললাম  – কলেজের  সেইসব দিন আর  ফিরবে না  । বিকাশ  আর ডাবুর  সাথে  যে  তিনটে  বছর কাটিয়েছে , তার  অভিজ্ঞতা  এখনও  তাকে  আনমনা  করে  দেয়  !   খুব ভালো  লাগছে ,  বিকাশের  গলা  শুনে  সেই  দিনে  ফিরে  যেতে মন  চাইছে ।   এমনিতেও  সোমবার  ইউনিভার্সিটিতে যাবেনা , তো  ছোট্ট ট্যুর  হয়ে যাক ।   ডাবু ব্যাটাকে  ফোন করা যাক । ভালো অভিনেতা , আগের দিন  সব  কিছু  জেনেও বেমালুম  চেপে   গিয়েছিল ।  



ইন্টারসিটি টা  মিস  করেছে । বিকেলের ট্রেনে উঠেছি ।   আমরা    যখন  সিউরিতে  নামলাম রাত  ৯ টা  ১৪ ।  স্টেশনে  নেমেই  ডাবু  বলল –অনেক দিন বাদে ,প্রায় একবছর বাদে  এলাম ! 
আমি বললাম -  বিকাশ না বললে  এমন  ভাবে  আসতে পারতাম  না । অনেক দিন বাদে  দেখা  হবে  ।
-আমি  যখন ওর  প্রথম  গলা  শুনি  চমকেই যাই । এতো দিন বাদে   বিশ্বাসই করতে পারিনি  ! তারপর যখন  গলা শুনলাম  খুব  আনন্দ লাগছিল । মন দিয়ে  খুব আনন্দ  হচ্ছিল । কত কথা হল , বেশির ভাগটাই কলেজের  কথা  ।  তখনই তোর  ফোন নম্বর  চাইল  । আমি দিলাম । আমাকে  বলল  সিউরিতে এই  সপ্তাহেই  চলে  আসতে । আমি  বলেছিলাম যদি ত্রিনয়ন যায় আমার যেতে আপত্তি নেই ।
-আমায় ফোন করে  এমন  ভাবে  বাধ্য  করল ।
-ভালো  হয়েছে । 
-আগে  ওর  বাড়িতে যাওয়া  যাক । চাবিটা  পাশের  বাড়ি  রেখে  দেবে  ।
-ঠিক  আর  ওর  আসবার  সময় হয়ে  এসেছে  ।

সিউরি  স্টেশনটা  রাতে  আস্তে –আস্তে  শান্ত  হয়ে যাচ্ছে । ঠাণ্ডা  পড়ছে । কলকাতায় যা  ঠাণ্ডা , এখানে  বেশিই ।  মাথার  উপরে   কালো  আকাশ ।  কুয়াশা  জমেছে , ঝাপসা । আমরা রিক্সায়  চাপলাম ।  
রিক্সাটা  আমাদের  নিয়ে  চলেছে । স্টেশন থেকে  বিকাশদের  পাড়া  খুব  বেশিক্ষণের নয় । ঘড়ি মিলিয়ে  পনেরো মিনিটের মধ্যেই  চলে  এলাম  ।  নাম  বলতেই  বাড়ির  মুখেই  নামিয়ে  দিল । 

স্টেশনে যদিও আলো  ছিল , এই পাড়ার মুখে  সেই  আলো অনেক  কম ।  কলকাতায় রাস্তায়  যেনও আলর আলোর ছড়াছড়ি ,কিন্তু এই  মফস্বল  সদরের  ভিতরে এই   পাড়ায়  অন্ধকারটা চোখে  লাগছে ।  এখন মনে  হচ্ছে  আমাদের দুপুরের  মধ্যে  আসাটা উচিত  ছিল । আসলে  বাড়িতে  কেউ থাকবেনা  , আবার বিকাশ  ফিরতে  রাত হবে  ;তাই আগে  এসে বিরক্ত  হতাম । ডাবুই বলেছিল , রাতে গেলে  অপেক্ষা করতে হবে  না ।
বিকাশদের  নাম  লেখা  গেটের  সামনে  গিয়ে  দাঁড়িয়ে  ফোন করলাম ।  বিকাশের  ফোন  বাজছে । ডাবু বলল – বাদ দে  ,পাশের  বাড়িতে  চাবিটা  রেখে  দিয়ে  গেছে । আর  ফোনে  বলেছে   চেয়ে  নিতে  । ফালতু ফোন করে   বিকাশকে  বিরক্ত করিস না  ।  

আমরা পাশের  ঘরে  গিয়ে  কলিংবেল দিলাম  ।  দরজা খুলে  দাঁড়িয়ে  আছেন একজন  মধ্যবয়স্ক লোক । আমাদের  পরিচয় জানতে  চাইলেন । আমি  বললাম । কিছুক্ষণ  শুনে  বলল -  আমি  তোমাদের পরিচয়  আগেই  পেয়েছি  , তাও  জিজ্ঞেস  করলাম পরীক্ষা করবার  জন্য ।  এই নাও । কোন অসুবিধা  হলে জানিও ।

আমাদের হাতে  চাবি দিয়ে দিলেন ।

চাবি নিয়ে  কথা মতন প্রথম ঘরের দরজা খুলে  ঢুকলাম । এই  ঘরেই বিশাল থাকে  । বাকী ঘরের দরকার আমাদের  ছিল না । গেট খুলতেই  লম্বা  বাধানো রাস্তা  পেরিয়ে  দ্বোতলা  বাড়ি । একতলার  বাঁদিকের ঘরে বিশাল  থাকে । বাড়িতে  যদি কাকিমা  থাকত , এতক্ষণে  চলে এসে আমাদের  আপ্যায়ন করতেন । এইযে পেটে   ক্ষিধে –ক্ষিধে  পাচ্ছে , কাকিমা  থাকলে  ব্যবস্থা  হয়ে যেত । 
বিশাল  নির্ঘাত  ট্রেন   ধরতে  পারেনি  , আসতে –আসতে  এগারোটা  বাজবে  । 
ঘরে  ঢুকতেই  দেখলাম  বিছানার  উপর  ক্যারাম বোর্ড  । ডাবু বলল – ভাই  অনেক দিন ক্যারাম  হয়না । আয় এই শীতে  একহাত হয়ে যাক ।
আমি  ঘরে  ঢুকেই আলো জ্বাললাম , খুব  অল্প পাওয়ারের  বাল্ব জ্বলছে । তাতে  ঘরের  সব  কিছুই  দেখা  যাচ্ছে ।  এই ঘরে  টিভি  নেই  ।  মানে  আমাদের  সময় কাটাতে  হলে ক্যারামই  খেলতে  হবে  । 

ডাবুকে  বললাম – ক্ষিধে  পেলেও  , ক্যারামের  উত্তেজনা  আমাদের  আপাতত  সেই  চিন্তা  থেকে  দূরে রাখতে  পারে  । কৃত্রিম উন্মাদনা  তৈরি করে বস্ত্র –খাদ্য –বাসস্থানের  প্রধান  সমস্যা থেকে  নিজেদের  দায়িত্ব  এড়াতে  আমাদের  দেশের  রাজনৈতিক  দল গুলো  সব্যসাচী  । এখন এই  মূহুর্তে আমরা  সেই  চির সনাতনী পদ্ধতির   শরণাপন্ন হলাম ।ক্যারামের  উত্তেজনায় কিছুক্ষণের জন্য  হলেও  ক্ষিধের  সমস্যা  থেকে  ভুলে  থাকা  যাবে । 
আমি আর  ডাবু মুখোমুখি  বসলাম ।  পিছনের  দরজা বন্ধ  করে  দিলাম  । ডাবু আমার দিকে  তাকিয়ে  বলল 
-দেখা  যাক , খেলা  কেমন জমে  ?
আমি হাসতে –হাসতে  বললাম অনেক দিন খেলা  হয়না  প্রাকটিস নেই  ।
-সেতো  আমারও  নেই  । দেখা  যাক  আমরা  কতটা  খেলা  ভুলে  গিয়েছি ।

প্রথম বোর্ডে  আমি  এগিয়ে  গেলেও  ,  পরের দুটোতে  হেরে  গেলাম  ।  খেলা  এমন একটা  জায়গায় চলে  আসবে  বুঝতেও  পারিনি । প্রথমে  ভেবেছিলাম   ডাবুকে হারিয়ে  দিয়েছি ।  নীল গেম  দেওয়ার  মজাই আলাদা  ।  পরের  বোর্ডে  আমি  জিততে  পারিনি  । এখন  খেলা  খুব  হাড্ডাহাড্ডি ।  এমন  ভাবে  কত  সময়  গিয়েছে  জানিনা  , তবে  বোর্ডের পর বোর্ড খেলা  চলছে । একটা নেশা  যেনও লেগে  গিয়েছে ! এমন সময় মনে হল  বিকাশের গলা কানে  এল !

ডাবু  দরজার  সামনেই বসে  ছিল , দরজা খুলতেই   বিকাশকে  দাঁড়িয়ে  থাকতে  দেখল !  আমি   ঘড়ির  দিকে   তাকিয়ে  দেখলাম  রাত দুটো !! অদ্ভুত ,এতো রাত  ,অথচ আমরা খেয়ালি করিনি । ঘরে ঢুকেই বিকাশ  বোর্ডের  বাঁদিকে গিয়ে  বসল । আমি  দরজা বব্ধ  করে বললাম – 
বিকাশের  মুখ  দেখে  মনে হচ্ছে  , আজ  সারাদিন  খুব  ধকল  গিয়েছে  । 
ডাবু বলল -তোর ব্যাপারটা বলতো ? বিকাশ  রাত  ১০ টায়  আসবার  কথা  ছিল , এখন  দুটো  বাজে  ।  এই  অচেনা  জায়গায় ভাগ্যিস ক্যারাম  ছিল ! নচেৎ  আমাদের হালত  আরও খারাপ  হত । তোর উপর ভীষণ রেগে আছি ।
আমি  দেখলাম  ,  বিকাশের  চোখ দুটো পাথরের মতন  স্থির ! বিকাশের  মুখ  দেখে  মনে  হচ্ছে , আজ  ওর উপর বেশ  ধকল গিয়েছে  । 
-বিকাশ  এতো  দেরী কেন  ?  কি হয়েছে ?
বিকাশ  চোখ দুটোকে স্থির  করে  রেখেছে , বলল – আমায় মাপ করে দিস । আমি জানি  কলকাতা থেকে  এতদূর  ছুটে  এলি তোরা , অথচ দেখ আমিই  তোদের সাথে  দেখা  করতে পারলাম  না। আমার  অনেক  পরিকল্পনা  ছিল রে, সব  শেষ। তাইতো  এখানে  এসেছি । তোদের  না দেখে  যাব কেমন করে ?
-ভাই , অন্তত  ফোন করে  দিতে পারতিস । আর কোথায় যাবি ? মানে  অন্য কোথাও থেকে  চাকরির ডাক এসেছে  ? 
-অনেক চেষ্টা করেছিলাম ।  বিশ্বাস কর  আমি  মন  থেকে  চেয়েছিলাম  , সব সময় মন থেকে চাইলেই  হয়না । দেখ আমার চাওয়া  কিন্তু  হল না ! আমি তোদের সাথেই  থাকতে  চেয়েছিলাম  । জীবন খুব  অনিশ্চিত । 
আমি  বললাম  -বাদ  দে  , তোর কথা  মতন  এসেছি । এটাই অনেক  ।  আমাদের  একসাথে  দেখা  করবার ইচ্ছাতো  পূরণ হয়েছে ।দেখ  বেঁচে থাকতে  হলে  চাকরি  দরকার । তুই  যেখানে সুযোগ পাবি সেখানেই  যাবি । আমরা আছি  । 
-তাই  বুঝি  ? আমি  অনেক  কিছুই আর  চেষ্টা করলেও পারব  না  । তোদের  সাথে  আর  হয়ত থাকতে  পারলাম না  ! আচমকাই  ...  
-তুই এমন  ভাবে  ভেঙে পরেছিস কেন  ?  
-না । ভাঙছি কোথায় ! আমি শেষ পর্যন্ত তোদের  সাথে  দেখা  করতে   আসতে পারব , বুঝতেও  পারিনি। । তোরা কেমন  আছিস ?
-ভালো ।  তুই ?
-ছিলাম মানে  ভালোই  ছিলাম  । 
বিকাশ  থেমে  বোর্ডের  দিকে  তাকিয়ে  বলল – মনে আছে  , কলেজে থাকাকালীন  ইউনিয়ান  রুমে  আমাদের  খেলা ? 
আমি  বললাম – সব  মনে  আছে  । বিকাশ  , কাল  চারপাশটা ঘুরে  দেখব।
- কাল    থাকিস । কাল  তোদের অনেক  কাজ  থাকবে  । 
-মানে  ,
 ইতিমধ্যে  আমি  দেখলাম   ডাবুর  চেহারায়  অদ্ভুত  পরিবর্তন হয়েছে ! ঘামছে ।  
বিকাশ  সেই দিকে  তাকিয়ে  বলল – আমি জানি  ভাই   । ভয় পাস না , আমি  ক্ষতি করব না। আসতাম না । বাধ্য  হয়ে  এলাম ।
এইবার আমার চোখ বিকাশের  দিকে  চলে  গেল । আসলে আরেকটু খুলে  বলতে , বিকাশের  শরীরের নীচের দিকে  তাকালাম ।  

আমি যা  দেখলাম , তা  সেই  মুহূর্তে  বিশ্বাস হচ্ছিল  না । ঠাণ্ডা  স্রোত  আমার  গোটা শরীরে বয়ে  গেল  ! যা  দেখছিলাম  তা  সত্যি হতে পারেনা  ! অথচ  তা সত্যিই । কেননা  দরজা খোলা , বিকাশের  ঘরের  ভিতর  আসাটা মিথ্যা  নয় ।তাহলে কোনটা সত্যি ? বিকাশ শূন্যে  বসে আছে  ।  বিকাশের দেহের   উপরের  অংশ থাকলেও নীচের অংশ  মানে  কোমর থেকে  পা  পর্যন্ত  অদৃশ্য !  এটা খুব  অদ্ভুত  ঘটনা , এই ঘটনা আমাদের  চোখের  ভুল  নয় ।  অথচ  আমি  কিছুই  বুঝতে  পারলাম  না , এমনটা কেমন করে হল ? 

বিকাশ  বলল – ভয় পাসনা । আমার  বডি  রেল পুলিসের  কাছে  আছে  । দুবরাজপুরে  আমার বডি কেউ  শনাক্ত  করেনি বলে  সেখানকার হাসপাতালের মর্গে  রয়েছে ।  বাবা –মা  কে  বলে  দিস ।
আমার গলা  শুকিয়ে  আসছে , আমি তাও  বললাম – বুঝছিনা । খুব  ভয় করছে ...
বিকাশের গলার  আওয়াজ  খুব  কম , তাও  শোনা যাচ্ছে ।বিকাশ বলল
-আজ মালিকের  সাথে  একটু ঝমেলা  হয়েছিল । ঠিক  সময়ে ট্রেনটা  পেলাম না । আমি স্টেশনে  আসতেই ঘোষণা  শুনলাম   , ট্রেন  অন্য প্ল্যাটফর্মে  আসছে । ওভারব্রিজের  নীচের  লাইনের উপর  দিয়ে  তাড়াহুড়োয় পেড়োতে  যাই ।  তখন  আরেকটা ট্রেন  ঢুকছিল ।  আমার পা  স্লিপ খেয়ে  উল্টে যায় ।  চোখ  যতক্ষণ খোলা ছিল  তোদের কথাই ভাবছিলাম । আমি আচমকাই দেখলাম  চারপাশ অন্ধকার ! শুধু  তোদের কথাই ভাবছিলাম । তারপর আমি আচমকা এখানে  এসেছি , এতটুকু বুঝে গিয়েছি আমাকে  অন্য কোথাও যেতে হবে  । আমার  দেহটা আমকে যন্ত্রণা  দিচ্ছে ।

কথাটা   শুনবার  পরেই  আমার গা ঘুলিয়ে  উঠল । বমি পাচ্ছে ।  পাশে  বসে  থাকা  ডাবুকে  দেখলাম  হুঁশ হারিয়ে সশব্দে  মেঝেতে  পড়ে  গিয়েছে !

বিকাশ  স্থির  আবেগহীন  অনুভূতিহীন   দৃষ্টি নিয়ে  আমার দিকে  তাকিয়ে বলল – আমার বাবা –মা  কে  বলে বডি  বাড়িতে নিয়ে  আয় । আমার  খুব  কষ্ট হচ্ছে । আমাকে  ক্ষমা করিস ।আমি মুক্তি চাইছি ।  ট্রেনের চাকায় আমার  মৃত্যুর সময়  যে  যন্ত্রণা ছিল , এখন যেনও আরও  বেশি  ! 

আচমকাই  বিকাশের  এইসব কথা  আমি  ঠিক নিতে  পারছিলাম  না , চোখের  দৃষ্টি কমে  আসছিল ।  ঘরের  বাল্বের আলো  ক্রমশই মনে হচ্ছে  ফিকে  হয়ে  আসছে  ! আমি আর  কিছুক্ষণের মধ্যে  হয়ত  বিছানায়  শুয়ে  পড়ব । অনেক  কষ্টে  দরজার  দিকে  চোখ  গেল  , দেখি  দরজা  বন্ধই আছে । বিকাশ  সামনে বসে আছে  ।  আমার আর কিছু  মাথায়  ঢুকছে না।   



ত্রিনয়নদার  গল্প  থেমে  যেতেই , আমাদের চমক ভাঙল ।  মুমিন আমার দিকে  তাকালও । আমি ত্রিনয়নদার দিকে তাকিয়ে  রয়েছি । মুমিন বলল – ত্রিনুদা , তারপর ...
ত্রিনুদা  বিছানা  থেকে  নেমে  বলল – দুটো   বেজে  গিয়েছে ।  কেষ্টদা  খেতে ডাকছে । 
আমি  বললাম – অসম্পূর্ণ  গল্প  ফেলে  রেখে খাওয়াটা জমবে না  । পরের  কথা  জানতে চাইছি । 
ত্রিনয়নদা  মুচকি  হাসল ।
বলল – পরের  দিন  বেলাতেই  আমাদের  ঘুম  ভেঙেছিল  ।  পাড়ার লোকেদের  ডাকাডাকিতে  দরজা খুলি  ।  অবশ্য  ততক্ষণে  বিকাশের  বাড়ির লোকের কাছে  খবর  চলে  গিয়েছে । পাড়ার লোকেও  বডি আনতে  হাসপাতালে  গিয়েছে ।  তখনো বুঝতে  পারছিলাম না  দরজা  বন্ধ  করে  দিল  কে  ?  আবার  দরজা যে  আমরাই খুলেছিলাম  সেটাও ঠিক । তাহলে  সবটা  স্বপ্ন না   স্বপ্নের মতন  সত্যি  !! আর  , আগের রাতের ঘটনাটা   স্বপ্ন ছিল না, কেননা  বিকাশের  মৃত্যুর খবর পরের  দিন আমাদের কাছে  বাসি  বলে মনে হচ্ছিল । স্বপ্ন  মানুষের মনকে  ভাবাতে  পারে,  কিন্তু  সত্যতার  আভাস   দিতে  পারে না ।

আমি  লক্ষ্য করলাম  আমার গায়ের  লোম উত্তেজনায় সজাগ হয়ে উঠছে ...... 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.