এখন ঘড়িতে দশটা । মুমিন আমাকে ফোন করে বলল , - শীতের সকালে ছুটির দিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না । আমি একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে ত্রিনুদার গল্প লিখি । সম্পাদক আমার জন্যই এই বিশেষ বিভাগটি শুরু করেছেন । তার কথা হচ্ছে , আমাকে প্রতি মাসে অন্তত একটি করে গল্প দিতে হবে । আজ রবিবার । ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে নেব । আগের রাতে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরী হয়েছিল ।
গল্পের জন্যই আজ এই সকালে আমরা দু’জনে চলে এলাম । গেট খুলে সিমেন্ট দেওয়া লম্বা পথ পেড়িয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপলাম। দরজা খুলে দিল ত্রিনয়দা । আমাদের দেখে হাসল। কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল হাত দিয়ে সরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল – আয় , তোদের জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম । বেশ ভালো লাগছে । সারা সপ্তাহ নিজের ভিতর নিজে ব্যস্ত থাকি । এখন হাতে কোন কাজ নেই । শুধু মানুষের অবচেতন মনকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা , তা নিয়ে একটা থিসিস লিখছিলাম । লন্ডনে আমার থিসিস পড়া হবে । এরজন্য টাকা পাব । আমার সম্মান আর টাকা দুটোই দরকার । আমার অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে ভালো লাগে ।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম । ত্রিনয়নদার ঘরে ঢুকলাম । আমি আর মুমিন চেয়ারে বসলাম । ত্রিনুদা খাটের উপর উঠে বসল ।
মুমিন বলল – ত্রিনুদা , অবচেতন মন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতে পারে !
ত্রিনুদা এই শীতের সকালে পাঞ্জাবি ,পাজামা আর চাদর জড়িয়েছে । হাসছে , বলল -
-সত্ত্ব , রজঃ ,তম গুন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে অবচেতন মনকে সক্রিয় করা সম্ভব । এটা নতুন কিছু নয় । তবে ইদানীং এইসব বিষয় নিয়ে যে কাজ হচ্ছে তা দেখবার মতন । আমি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করি ,তবে সেই শক্তির মধ্যেও বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকতে হবে । কোন ভাবেই গুজবকে বিশ্বাস করিনা । নিজের জীবনে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি তাইতো আমার গল্প হয়ে ওঠে ।
আমি বললাম –ত্রিনুদা এত সকালে আমরা ছুটে এলাম , শুধুই তোমার গল্পের মোহে ।
-তাহলে তোরা একটু অপেক্ষা কর । আমি বাগান থেকে লেবু নিয়ে আসছি ।
-কেন ?
-ভেবেছিলাম কফি অফার করব । এখন ইচ্ছা আসছে একটু অন্যরকমের । মানে লেবু চা ,বিটনুন দিয়ে । সাথে টমাটোর পাকোরা ।
এর জন্যই ত্রিনয়নদার এই বৈঠকি আড্ডা আমাদের কাছে এতটা প্রিয় । আমি বললাম – মন্দ নয় । আমরা ত্রিনুদার দ্বোতলার ঘরে গিয়ে আড্ডা জমালাম । ঘরে দু দিকে দুটো জানালা আছে । একটা জানালার ধারে সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা বিছানা । আরেকটা জানলার সামনে ছোট্ট টেবিল আর দুটো চেয়ার । একটা আরাম কেদারায় আমি গিয়ে বসলাম । পাশের চেয়ারে মুমিন গিয়ে বসল । কিছুক্ষণ বাদেই ত্রিনুদা তিনটে চায়ের কাপ আর সাদা ডিশে ভরে থাকা গরম পাকোরা নিয়ে এসে ঢুকল ।
আমি বললাম – দাদা , এখন তোমার গল্প শুনব ।
ত্রিনুদা হেসে বলল - বেলা এগারোটায় গল্প ! দেখ আমিতো বানিয়ে কিছু বলতে পারিনা । আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই গল্প বলতে পারি ।
-বলো । বেশ জমে যাবে ।
মুমিনের কথাকে সায় দিয়ে আমি বললাম - ত্রিনুদা তুমি যাই বলবে , তা আমাদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায় । আমরা শুনতে চাই ।
ত্রিনয়ন দা খাটের উপরে পা ছড়িয়ে টান –টান করে গা হেলিয়ে শুয়ে পড়ল । পাশের টেবিলে থাকা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পা নাড়াচ্ছিল ।
ত্রিনুদার চোখ দুটো বন্ধ । কাপে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলে রেখে বলল - শুরু করি ?
২
আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা । এখনও মনে আছে । তোদের আমি আমার প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প করেছিলাম মনে আছে ?
আমি বললাম হ্যা ।
ত্রিনুদা বলল – সেই ঘটনার প্রায় দু’মাস বাদে আমি ফোন পেলাম । মানে সিউরি থেকে বিকাশ ফোন করেছিল । কলেজে থাকতে আমরা এক বেঞ্চে বসতাম । আমরা নিউআলিপুর কলেজে ইতিহাসের স্নাতক বিভাগের ছাত্র ছিলাম । সেই দিন গুলো স্বপ্নের মতন কাটত । বিকাশের ইচ্ছা ছিল খুব বড় ঐতিহাসিক হবে , আমাদের দেশের ইতিহাস নিরুপেক্ষ ভাবে লিখবে । ওর স্বপ্ন আমাদের বিভোর করে তুলেছিল । কলেজের পাট চুকে গিয়েছে । আমিও এম এ পড়ব বলে ছোটাছুটি করছিলাম । বিকাশকে অবশ্য মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল । মানে বিএ অনার্স করবার পর , আচমকাই ওর বাবার হার্ট এ্যাটার্ক করল । সংসারের জন্য কাজের চেষ্টা করতে হচ্ছিল । আর পড়ল না ।আমাদের মধ্যে একবছর কোন যোগাযোগ ছিল না। আগে বেশ কয়েকবার ওদের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলাম ।
সেই দিন শুক্রবার , ফোন সকাল আটটা নাগাদ বেজে উঠল । ফোন কানে রাখতেই ,উল্টো দিক থেকে ভেসে উঠল
-কেমন আছিস ? আমি বিকাশ ।
-আরে ! বিকাশ !!
-হ্যাঁ ভাই । কেমন আছিস ?
-আমিতো ভালো আছি , তুই কেমন আছিস ?
-এখন ঠিকাছি ।
-মেসমশাই ? আমরা শুনেছি , তুই রেজাল্ট বেরানোর পরেই ভ্যানিশ হয়ে গেলি !
বাবার অসুস্থতার সময় ভয় পেয়েছিলাম । সংসারের জন্য চাকরি খোঁজ করতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম , যোগাযোগ করতে পারিনি ।
-আমিও রে । আমি কিন্তু তোর ফোন নম্বরে ফোন করেছিলাম । কিন্তু কোনভাবেই পেলাম না ।
-পাবি কেমন ভাবে ! আমার ফোনটা চুরি হয়ে যায় । নতুন সিম নিয়েছি । তাইতো ভাবলাম ফোন করে তোকে চমকে দেব ।
-বেশ করেছিস ।
-আরেকটা প্ল্যান অবশ্য আছে ।
- মানে পরিকল্পনা ? মনে আছে আমি , তুই আর ডাবু - সিউরির বাড়িতে গিয়ে কত আনন্দ করেছি । সেই ফাস্ট ইয়ারে । মনে আছে ?
-হ্যাঁরে । মনে আছে । আমি এখন একটু থিথু হয়েছি । শোন , আজ শুক্রবার । তুই শনিবার চলে আয় ।
-কোথায় ?
-সিউরি ইন্টার সিটি এক্সপ্রেসে চেপে । সকালের ট্রেন , হাওড়া থেকে ধরবি ।
-ধুস , পরে একদিন ...
-না ভাই । পরের ভরসায় থাকা ঠিক নয় । ডাবুও আসবে । দেখ অনেক দিন বাদে তিনজনে জমিয়ে আড্ডা দেব । আমি যে দোকানে কাজ করছি তা দুবরাজ পুরে । আমার আসতে মোটামুটি ধরে নে , রাত ৯ টা ২০ । আশা করছি তুই আর ডাবু চলে আসবি । ডাবু অবশ্য দুপুরেই চলে আসছে । দেখ বাড়িতে কেউ থাকবে না , বাবাকে নিয়ে মা মামা বাড়ি যাবে । তাই ভাবলাম একা থাকব ! জানিস একা থাকতে আমার ভালো লাগেনা । আমি ভাবলাম তোকে ফোন করি । এমনিতেও তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে । প্রায় একবছর দেখা হয়নি ! রবিবার ওরা ফিরে আসবে , বাবা –মা তোকে দেখে খুশিই হবে । ডাবুকে তিনদিন আগে ফোন করেছিলাম ।ওর কাছ থেকে তোর নম্বরটা পেয়েছি ।তাছাড়া সেই একই ঠিকানা । আগে বহুবার এখানে এসেছিস । এখন আসতে ইতস্তত হওয়ার কথা নয় ।
-ডাবু এটা ঠিক করেনি । একদিন আগেই ফোনে আমাদের কথা হল । তোর কথা বলল না ।
-হিঃ হিঃ ।
বিকাশের হাসি ।
আমি বললাম – শালা । তুই ওকে নিষেধ করেছিলিস ?
-অবশ্যই , না হলে তোকে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না ।
-বাদ দে । একেতো কোন যোগাযোগ রাখিসনি । এখন আবার সারপ্রাইজ !
-ত্রিনু আমার কাছে কিন্তু ডাবুর নম্বরটা ছিল লেখা । তোর নম্বরটা ফোন ছাড়া আর কোথাও লিখিনি । শোন , ধর যদি ডাবুর নম্বর না থাকত , আমি কিন্তু কোলকাতায় গিয়ে তোমার সাথে দেখা করতামই । তাই বলছি , ভাই কাল চলে আয় ।
-এমন ভাবে বললে আসা যায় ?
-আসতে হবে । এটাই আমাদের বন্ধুত্বের পরীক্ষা । দেখি আমরা তিনজন বন্ধু একবছর পর কেমন পাল্টেছি ! আমাদের সেই টান আগের মতন আছে কিনা দেখব । চলে আয়। ডাবু কিন্তু আসবে ।
-ঠিকাছে আমি দেখছি ।
-না দেখছি নয় , অবশ্যই আসা চাই ।
কথা বলবার পরেই মনে –মনে বললাম – কলেজের সেইসব দিন আর ফিরবে না । বিকাশ আর ডাবুর সাথে যে তিনটে বছর কাটিয়েছে , তার অভিজ্ঞতা এখনও তাকে আনমনা করে দেয় ! খুব ভালো লাগছে , বিকাশের গলা শুনে সেই দিনে ফিরে যেতে মন চাইছে । এমনিতেও সোমবার ইউনিভার্সিটিতে যাবেনা , তো ছোট্ট ট্যুর হয়ে যাক । ডাবু ব্যাটাকে ফোন করা যাক । ভালো অভিনেতা , আগের দিন সব কিছু জেনেও বেমালুম চেপে গিয়েছিল ।
৩
ইন্টারসিটি টা মিস করেছে । বিকেলের ট্রেনে উঠেছি । আমরা যখন সিউরিতে নামলাম রাত ৯ টা ১৪ । স্টেশনে নেমেই ডাবু বলল –অনেক দিন বাদে ,প্রায় একবছর বাদে এলাম !
আমি বললাম - বিকাশ না বললে এমন ভাবে আসতে পারতাম না । অনেক দিন বাদে দেখা হবে ।
-আমি যখন ওর প্রথম গলা শুনি চমকেই যাই । এতো দিন বাদে বিশ্বাসই করতে পারিনি ! তারপর যখন গলা শুনলাম খুব আনন্দ লাগছিল । মন দিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছিল । কত কথা হল , বেশির ভাগটাই কলেজের কথা । তখনই তোর ফোন নম্বর চাইল । আমি দিলাম । আমাকে বলল সিউরিতে এই সপ্তাহেই চলে আসতে । আমি বলেছিলাম যদি ত্রিনয়ন যায় আমার যেতে আপত্তি নেই ।
-আমায় ফোন করে এমন ভাবে বাধ্য করল ।
-ভালো হয়েছে ।
-আগে ওর বাড়িতে যাওয়া যাক । চাবিটা পাশের বাড়ি রেখে দেবে ।
-ঠিক আর ওর আসবার সময় হয়ে এসেছে ।
সিউরি স্টেশনটা রাতে আস্তে –আস্তে শান্ত হয়ে যাচ্ছে । ঠাণ্ডা পড়ছে । কলকাতায় যা ঠাণ্ডা , এখানে বেশিই । মাথার উপরে কালো আকাশ । কুয়াশা জমেছে , ঝাপসা । আমরা রিক্সায় চাপলাম ।
রিক্সাটা আমাদের নিয়ে চলেছে । স্টেশন থেকে বিকাশদের পাড়া খুব বেশিক্ষণের নয় । ঘড়ি মিলিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যেই চলে এলাম । নাম বলতেই বাড়ির মুখেই নামিয়ে দিল ।
স্টেশনে যদিও আলো ছিল , এই পাড়ার মুখে সেই আলো অনেক কম । কলকাতায় রাস্তায় যেনও আলর আলোর ছড়াছড়ি ,কিন্তু এই মফস্বল সদরের ভিতরে এই পাড়ায় অন্ধকারটা চোখে লাগছে । এখন মনে হচ্ছে আমাদের দুপুরের মধ্যে আসাটা উচিত ছিল । আসলে বাড়িতে কেউ থাকবেনা , আবার বিকাশ ফিরতে রাত হবে ;তাই আগে এসে বিরক্ত হতাম । ডাবুই বলেছিল , রাতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে না ।
বিকাশদের নাম লেখা গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম । বিকাশের ফোন বাজছে । ডাবু বলল – বাদ দে ,পাশের বাড়িতে চাবিটা রেখে দিয়ে গেছে । আর ফোনে বলেছে চেয়ে নিতে । ফালতু ফোন করে বিকাশকে বিরক্ত করিস না ।
আমরা পাশের ঘরে গিয়ে কলিংবেল দিলাম । দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক । আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন । আমি বললাম । কিছুক্ষণ শুনে বলল - আমি তোমাদের পরিচয় আগেই পেয়েছি , তাও জিজ্ঞেস করলাম পরীক্ষা করবার জন্য । এই নাও । কোন অসুবিধা হলে জানিও ।
আমাদের হাতে চাবি দিয়ে দিলেন ।
চাবি নিয়ে কথা মতন প্রথম ঘরের দরজা খুলে ঢুকলাম । এই ঘরেই বিশাল থাকে । বাকী ঘরের দরকার আমাদের ছিল না । গেট খুলতেই লম্বা বাধানো রাস্তা পেরিয়ে দ্বোতলা বাড়ি । একতলার বাঁদিকের ঘরে বিশাল থাকে । বাড়িতে যদি কাকিমা থাকত , এতক্ষণে চলে এসে আমাদের আপ্যায়ন করতেন । এইযে পেটে ক্ষিধে –ক্ষিধে পাচ্ছে , কাকিমা থাকলে ব্যবস্থা হয়ে যেত ।
বিশাল নির্ঘাত ট্রেন ধরতে পারেনি , আসতে –আসতে এগারোটা বাজবে ।
ঘরে ঢুকতেই দেখলাম বিছানার উপর ক্যারাম বোর্ড । ডাবু বলল – ভাই অনেক দিন ক্যারাম হয়না । আয় এই শীতে একহাত হয়ে যাক ।
আমি ঘরে ঢুকেই আলো জ্বাললাম , খুব অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে । তাতে ঘরের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে । এই ঘরে টিভি নেই । মানে আমাদের সময় কাটাতে হলে ক্যারামই খেলতে হবে ।
ডাবুকে বললাম – ক্ষিধে পেলেও , ক্যারামের উত্তেজনা আমাদের আপাতত সেই চিন্তা থেকে দূরে রাখতে পারে । কৃত্রিম উন্মাদনা তৈরি করে বস্ত্র –খাদ্য –বাসস্থানের প্রধান সমস্যা থেকে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল গুলো সব্যসাচী । এখন এই মূহুর্তে আমরা সেই চির সনাতনী পদ্ধতির শরণাপন্ন হলাম ।ক্যারামের উত্তেজনায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও ক্ষিধের সমস্যা থেকে ভুলে থাকা যাবে ।
আমি আর ডাবু মুখোমুখি বসলাম । পিছনের দরজা বন্ধ করে দিলাম । ডাবু আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখা যাক , খেলা কেমন জমে ?
আমি হাসতে –হাসতে বললাম অনেক দিন খেলা হয়না প্রাকটিস নেই ।
-সেতো আমারও নেই । দেখা যাক আমরা কতটা খেলা ভুলে গিয়েছি ।
প্রথম বোর্ডে আমি এগিয়ে গেলেও , পরের দুটোতে হেরে গেলাম । খেলা এমন একটা জায়গায় চলে আসবে বুঝতেও পারিনি । প্রথমে ভেবেছিলাম ডাবুকে হারিয়ে দিয়েছি । নীল গেম দেওয়ার মজাই আলাদা । পরের বোর্ডে আমি জিততে পারিনি । এখন খেলা খুব হাড্ডাহাড্ডি । এমন ভাবে কত সময় গিয়েছে জানিনা , তবে বোর্ডের পর বোর্ড খেলা চলছে । একটা নেশা যেনও লেগে গিয়েছে ! এমন সময় মনে হল বিকাশের গলা কানে এল !
ডাবু দরজার সামনেই বসে ছিল , দরজা খুলতেই বিকাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ! আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত দুটো !! অদ্ভুত ,এতো রাত ,অথচ আমরা খেয়ালি করিনি । ঘরে ঢুকেই বিকাশ বোর্ডের বাঁদিকে গিয়ে বসল । আমি দরজা বব্ধ করে বললাম –
বিকাশের মুখ দেখে মনে হচ্ছে , আজ সারাদিন খুব ধকল গিয়েছে ।
ডাবু বলল -তোর ব্যাপারটা বলতো ? বিকাশ রাত ১০ টায় আসবার কথা ছিল , এখন দুটো বাজে । এই অচেনা জায়গায় ভাগ্যিস ক্যারাম ছিল ! নচেৎ আমাদের হালত আরও খারাপ হত । তোর উপর ভীষণ রেগে আছি ।
আমি দেখলাম , বিকাশের চোখ দুটো পাথরের মতন স্থির ! বিকাশের মুখ দেখে মনে হচ্ছে , আজ ওর উপর বেশ ধকল গিয়েছে ।
-বিকাশ এতো দেরী কেন ? কি হয়েছে ?
বিকাশ চোখ দুটোকে স্থির করে রেখেছে , বলল – আমায় মাপ করে দিস । আমি জানি কলকাতা থেকে এতদূর ছুটে এলি তোরা , অথচ দেখ আমিই তোদের সাথে দেখা করতে পারলাম না। আমার অনেক পরিকল্পনা ছিল রে, সব শেষ। তাইতো এখানে এসেছি । তোদের না দেখে যাব কেমন করে ?
-ভাই , অন্তত ফোন করে দিতে পারতিস । আর কোথায় যাবি ? মানে অন্য কোথাও থেকে চাকরির ডাক এসেছে ?
-অনেক চেষ্টা করেছিলাম । বিশ্বাস কর আমি মন থেকে চেয়েছিলাম , সব সময় মন থেকে চাইলেই হয়না । দেখ আমার চাওয়া কিন্তু হল না ! আমি তোদের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম । জীবন খুব অনিশ্চিত ।
আমি বললাম -বাদ দে , তোর কথা মতন এসেছি । এটাই অনেক । আমাদের একসাথে দেখা করবার ইচ্ছাতো পূরণ হয়েছে ।দেখ বেঁচে থাকতে হলে চাকরি দরকার । তুই যেখানে সুযোগ পাবি সেখানেই যাবি । আমরা আছি ।
-তাই বুঝি ? আমি অনেক কিছুই আর চেষ্টা করলেও পারব না । তোদের সাথে আর হয়ত থাকতে পারলাম না ! আচমকাই ...
-তুই এমন ভাবে ভেঙে পরেছিস কেন ?
-না । ভাঙছি কোথায় ! আমি শেষ পর্যন্ত তোদের সাথে দেখা করতে আসতে পারব , বুঝতেও পারিনি। । তোরা কেমন আছিস ?
-ভালো । তুই ?
-ছিলাম মানে ভালোই ছিলাম ।
বিকাশ থেমে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল – মনে আছে , কলেজে থাকাকালীন ইউনিয়ান রুমে আমাদের খেলা ?
আমি বললাম – সব মনে আছে । বিকাশ , কাল চারপাশটা ঘুরে দেখব।
- কাল থাকিস । কাল তোদের অনেক কাজ থাকবে ।
-মানে ,
ইতিমধ্যে আমি দেখলাম ডাবুর চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে ! ঘামছে ।
বিকাশ সেই দিকে তাকিয়ে বলল – আমি জানি ভাই । ভয় পাস না , আমি ক্ষতি করব না। আসতাম না । বাধ্য হয়ে এলাম ।
এইবার আমার চোখ বিকাশের দিকে চলে গেল । আসলে আরেকটু খুলে বলতে , বিকাশের শরীরের নীচের দিকে তাকালাম ।
আমি যা দেখলাম , তা সেই মুহূর্তে বিশ্বাস হচ্ছিল না । ঠাণ্ডা স্রোত আমার গোটা শরীরে বয়ে গেল ! যা দেখছিলাম তা সত্যি হতে পারেনা ! অথচ তা সত্যিই । কেননা দরজা খোলা , বিকাশের ঘরের ভিতর আসাটা মিথ্যা নয় ।তাহলে কোনটা সত্যি ? বিকাশ শূন্যে বসে আছে । বিকাশের দেহের উপরের অংশ থাকলেও নীচের অংশ মানে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অদৃশ্য ! এটা খুব অদ্ভুত ঘটনা , এই ঘটনা আমাদের চোখের ভুল নয় । অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না , এমনটা কেমন করে হল ?
বিকাশ বলল – ভয় পাসনা । আমার বডি রেল পুলিসের কাছে আছে । দুবরাজপুরে আমার বডি কেউ শনাক্ত করেনি বলে সেখানকার হাসপাতালের মর্গে রয়েছে । বাবা –মা কে বলে দিস ।
আমার গলা শুকিয়ে আসছে , আমি তাও বললাম – বুঝছিনা । খুব ভয় করছে ...
বিকাশের গলার আওয়াজ খুব কম , তাও শোনা যাচ্ছে ।বিকাশ বলল
-আজ মালিকের সাথে একটু ঝমেলা হয়েছিল । ঠিক সময়ে ট্রেনটা পেলাম না । আমি স্টেশনে আসতেই ঘোষণা শুনলাম , ট্রেন অন্য প্ল্যাটফর্মে আসছে । ওভারব্রিজের নীচের লাইনের উপর দিয়ে তাড়াহুড়োয় পেড়োতে যাই । তখন আরেকটা ট্রেন ঢুকছিল । আমার পা স্লিপ খেয়ে উল্টে যায় । চোখ যতক্ষণ খোলা ছিল তোদের কথাই ভাবছিলাম । আমি আচমকাই দেখলাম চারপাশ অন্ধকার ! শুধু তোদের কথাই ভাবছিলাম । তারপর আমি আচমকা এখানে এসেছি , এতটুকু বুঝে গিয়েছি আমাকে অন্য কোথাও যেতে হবে । আমার দেহটা আমকে যন্ত্রণা দিচ্ছে ।
কথাটা শুনবার পরেই আমার গা ঘুলিয়ে উঠল । বমি পাচ্ছে । পাশে বসে থাকা ডাবুকে দেখলাম হুঁশ হারিয়ে সশব্দে মেঝেতে পড়ে গিয়েছে !
বিকাশ স্থির আবেগহীন অনুভূতিহীন দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – আমার বাবা –মা কে বলে বডি বাড়িতে নিয়ে আয় । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আমাকে ক্ষমা করিস ।আমি মুক্তি চাইছি । ট্রেনের চাকায় আমার মৃত্যুর সময় যে যন্ত্রণা ছিল , এখন যেনও আরও বেশি !
আচমকাই বিকাশের এইসব কথা আমি ঠিক নিতে পারছিলাম না , চোখের দৃষ্টি কমে আসছিল । ঘরের বাল্বের আলো ক্রমশই মনে হচ্ছে ফিকে হয়ে আসছে ! আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে হয়ত বিছানায় শুয়ে পড়ব । অনেক কষ্টে দরজার দিকে চোখ গেল , দেখি দরজা বন্ধই আছে । বিকাশ সামনে বসে আছে । আমার আর কিছু মাথায় ঢুকছে না।
৪
ত্রিনয়নদার গল্প থেমে যেতেই , আমাদের চমক ভাঙল । মুমিন আমার দিকে তাকালও । আমি ত্রিনয়নদার দিকে তাকিয়ে রয়েছি । মুমিন বলল – ত্রিনুদা , তারপর ...
ত্রিনুদা বিছানা থেকে নেমে বলল – দুটো বেজে গিয়েছে । কেষ্টদা খেতে ডাকছে ।
আমি বললাম – অসম্পূর্ণ গল্প ফেলে রেখে খাওয়াটা জমবে না । পরের কথা জানতে চাইছি ।
ত্রিনয়নদা মুচকি হাসল ।
বলল – পরের দিন বেলাতেই আমাদের ঘুম ভেঙেছিল । পাড়ার লোকেদের ডাকাডাকিতে দরজা খুলি । অবশ্য ততক্ষণে বিকাশের বাড়ির লোকের কাছে খবর চলে গিয়েছে । পাড়ার লোকেও বডি আনতে হাসপাতালে গিয়েছে । তখনো বুঝতে পারছিলাম না দরজা বন্ধ করে দিল কে ? আবার দরজা যে আমরাই খুলেছিলাম সেটাও ঠিক । তাহলে সবটা স্বপ্ন না স্বপ্নের মতন সত্যি !! আর , আগের রাতের ঘটনাটা স্বপ্ন ছিল না, কেননা বিকাশের মৃত্যুর খবর পরের দিন আমাদের কাছে বাসি বলে মনে হচ্ছিল । স্বপ্ন মানুষের মনকে ভাবাতে পারে, কিন্তু সত্যতার আভাস দিতে পারে না ।
আমি লক্ষ্য করলাম আমার গায়ের লোম উত্তেজনায় সজাগ হয়ে উঠছে ......
সুচিন্তিত মতামত দিন