শর্মিষ্ঠা ঘোষ - গঙ্গার ওপার থেকে উজিয়ে এলেন এক বনেদী বাড়ির বউ হয়ে । তারপর সংসার , চাকরি , সাহিত্য ও সম্পাদনা । কতটা মসৃন ছিল সে উড়ান ?
সুনন্দা গোস্বামী - সত্যিই গঙ্গার ওপার থেকে এপারে আসা ব্যাপারটা সহজ হয় নি । ১৯৭১ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর প্রথম রায়গঞ্জে পা রাখা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখনো চলছে । তাই শহরের আলো নেভা রাস্তা দিয়েই আমাদের প্রবেশ । ' গোস্বামী ভবন " সেদিন আলোক মালায় সজ্জিত হয় নি । তবে বরণপটে আন্তরিকতার অভাব ছিল না । প্রথমেই বলেছি , ' সহজ হয় নি ' কারণ আমার সবে উনিশ বছর , থার্ড ইয়ার চলছে , বেকার । এখানে এলাম যে পরিবারে আভিজাত্য থাকলেও সৌভাগ্যলক্ষ্মী তখন বিমূখ । আমার শ্বশুর মশাই কল্যাণ কুমার গোস্বামীর অকালমৃত্যু , তাঁর দীর্ঘ অসুস্হতা এর কারণ ।
যাই হোক , আমি বহরমপুর গার্লস কলেজের হস্টেলে থাকতাম । এখানে আসার আগেও আমি কবিতা , গল্প বা প্রবন্ধ লিখতাম । পরে কলেজের ম্যাগাজিন সেক্রেটারি হয়েছিলাম । হাতে লেখা ম্যাগাদিনও বের করেছিলাম । প্রথম বর্ষের কলেজ ম্যাগাজিনে আমার একটা গল্প প্রকাশিত হয় । গল্পের নাম ' মরীচিকা ' । আমার বাংলায় অনার্স নেবার সিদ্ধান্ত সম্পুর্ণ আমার নিজের । আমার বাবা - মা আমার এই ইচ্ছের মর্যাদা রেখেছিলেন ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - রায়গঞ্জের সাহিত্যজগতে যে সময় পা রাখলেন কেমন ছিল পরিমন্ডল ? আজ তার কোন পরিবর্তন টের পান ?
সুনন্দা গোস্বামী - রায়গঞ্জে আসার পর ১৯৭৩ - ৭৪ সালে এখানকার লেখকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ হয় । আমাদের পাড়ায় অর্থাৎ বন্দরে 'অয়ন ' পত্রিকার সম্পাদক রাজকুমার বণিক থাকতেন । ঐ পত্রিকায় প্রথম আমার কবিতা প্রকাশিত হয় । ১৯৭৫ - ৭৬ নাগাদ রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউটের গ্রণ্হাগারে সাহিত্য সভায় যেতাম । গ্রণ্হাগারের মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে বসা হোত । এখানেই ডাঃ বৃন্দাবন বাগচী , অধ্যাপক হরীশ দেবনাথ , কবি কান্তি সিংহ , কবি হরিদাস মিত্র , সাহিত্যিক তপন কিরণ রায়, অধ্যাপক মিহির মুখার্জী , কবি নীরদ রায় এছাড়াও তুহিন শংকর চন্দ , দেবেশ কান্তি চক্রবর্তী , রথীন রায় , শান্তনু প্রামাণিক, রামসিংহাসন মাহাতো, কবি অরুণ চক্রবর্তী , জয় নারায়ণ সাহা , শ্রীযুক্ত প্রশান্ত দেব , সৌরেন চৌধুরী এদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় । তপন কিরণ রায়ের ' অভিযান ' পত্রিকায় আমার অনেকগুলি গল্প প্রকাশিত হয় । প্রথম গল্পের নাম 'মণিকোঠা' । এই গল্পটি আমি ইনস্টিটিউটের সাহিত্য বাসরে পড়ার পর প্রশংসিত হয় । ডাঃ বৃন্দাবন বাগচী গল্পটির অন্তর্নিহিত মনস্তাত্বিক বিষয়ের বিশ্লেষণ করেন । সেই সময় কবি সুশান্ত আচার্য্যর 'কবিতা পাক্ষিক ' নামে একটা পত্রিকা ছিলো , সেখানেও লিখেছি । এছাড়া উত্তরবঙ্গের অন্যান্য পত্রিকা যেমন ' উত্তর সৈকত ' নামে একটা পত্রিকার কথা মনে পড়ছে সম্পাদকের নাম ছিল প্রিয়কুমুদ চক্রবর্তী , যেখানে নিয়মিত লিখেছি । তুহিন শংকর চন্দর 'প্রেক্ষণ' পত্রিকায় লিখেছি । কবি কান্তি সিংহের জুতোর দোকানে শনিবারের সাহিত্য বাসর হত । পরে কবি হরিদাস মিত্রের বাসভবনে এবং বর্তমানে দীপা চৌধুরীর বাসভবনে সেই আসর চলছে ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - আপনার হাত ধরে "চৈতন্য" আজ একটা উদীয়মান ও পরিচিত পত্রিকা । কিভাবে শুরু করেছিলেন ? কি ভেবে এলেন সম্পাদনায় ?
সুনন্দা গোস্বামী - আমার পত্রিকা ' চৈতন্য ' শুরুর আগে বেশ কয়েক বছর আমি ও আমার স্বামী কমলেশ গোস্বামী 'চয়ন' পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম । কবি অরুণ চক্রবর্তী এবং গল্পকার সৌরেন চৌধুরীর অনুরোধে আমরা যুক্ত হই । সে সময়ই 'চয়ন' অ্যাকাডেমি পুরস্কারের সম্মান পায় ।
যাই হোক বলতে গেলে হাতেখড়ি তখনই । তারপর ' চৈতন্য' র পরিকল্পনা , তবে এই পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক পর্বে কবি নীরদ রায়ের সহায়তা কোনদিন ভুলব না । পরবর্তী সময় কবি শর্মিষ্ঠা ঘোষের সহায়তা পেয়েছি । আজও পাচ্ছি । 'চৈতন্য' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কবি স্বপ্না কর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন । পরে তিনি অনীহা প্রকাশ করে সরে যান ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - কবি সুনন্দা গোস্বামী এবং গল্পকার সুনন্দা গোস্বামী , কোনটা প্রথম পছন্দ ? কেন ?
সুনন্দা গোস্বামী - কবি সুনন্দা গোস্বামী নয় , গল্পকার সুনন্দা গোস্বামীই আমার প্রথম পছন্দ ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - আপনি তো বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন , তাই না ? কাউকে পেয়েছেন মেন্টর হিসেবে ?
সুনন্দা গোস্বামী - ১৯৭৮ সালে কবি ও সম্পাদক দেবকুমার বসু রায়গঞ্জে আসেন । তখন ইনস্টিটিউটে একটি অনুষ্ঠান হয় । দেবকুমার বসু ওঁর ঠিকানা নিজে হাতে লিখে দিয়েছিলেন । তবে আমি মানুষটা চিরকালীন অকেজো , তাই যোগাযোগ হয়নি ওঁর সঙ্গে । কবি ব্রততী ঘোষ রায়ের বাড়িতে সেসময় যাই । তখন এই বাড়িতে উনি থাকতেন না । ব্রততীদির সঙ্গে পরিচয় হয় ।
কবি নীরদ রায়ের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় ছিল না । উনি ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত একটা সাহিত্য সভা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত খবর লিখেছিলেন । সেটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ পায় । সেখানে উনি আমার সম্পর্কে লিখেছিলেন ' প্রতিশ্রুতি সম্পন্না লেখিকা ' । হয়ত আমার উচিত ছিল কলম না থামানো । কিন্তু না হয়নি । চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন কাটানো সুনন্দা তখন ভীষণভাবে একটা চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে । তাই পায়ের তলায় মাটি খোঁজার তাগিদেই হয়ত হারিয়ে ফেললাম আমার প্রাণের কলমকে । বি. এড. পড়ার সময় (১৯৭৯ সালে ) ঐ কলেজের ম্যাগাজিনে আমার গল্প 'বাবলুর গল্প ' প্রকাশিত হয় । ১৯৮২ সালে চাকরি পেলেও সেভাবে লেখাটাকে আঁকড়ে থাকা হল না , সংসার , সন্তান , নতুন চাকরি , এদের সব আবদার মিটিয়ে কলমকে ডাকা হয় নি । টুকটাক লিখতাম , কখনো কোন ছেঁড়া পাতায় , কখনো বা হিসেবের খাতায় , আজও সেগুনো কিছু কিছু আছে । অনেক বছর বাদে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় বনতোযিনীর প্রতিপক্ষের আসরে গেলাম ব্রততীদির আমন্ত্রণে । আবার শুরু পথ চলা , কিন্তু সুদীর্ঘ ২০ বছর আমার নির্বাসনে কাটানো ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - আপনার এখন অবধি প্রকাশিত কাব্যগ্রণ্হ ও গল্পসংকলন কয়টি ও কি কি ? কোন উপন্যাস বা প্রবন্ধসংকলন আছে কি ?
সুনন্দা গোস্বামী - আমার একটা গল্পের বই ও দুটো কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে । হয়ত আরো দু চারটে গল্পের বই হতেই পারত , কিন্তু ভাগ্য আমার জীবনে ' সু - সময় ' সেভাবে দেয় নি ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - আপনার কবিতা বা গল্পে অবধারিত ভাবেই মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এবং একটা বিষন্নতা থাকে । বিষয় নির্বাচনে কি বিশেষ কোন ভাবনা থাকে না কি যা যেমন ভাবে আসে ?
সুনন্দা গোস্বামী - আমার সব গল্পই আমার জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল । তবে আরো অনেক লেখার বাকি আছে । আমি গ্রামের মেয়ে , সেখানে মেয়েদের জীবন আমি যেমন দেখেছি তা সুখকর না । পরবর্তী সময় কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে যাদের দেখেছি সেই সত্তর থেকে আশির দশকে বা তার পরবর্তী সময়ে তা স্বাভাবিক ভাবেই আমার লেখায় এসেছে ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - সময়ের সাথে সাথে প্রিন্ট মিডিয়া এবং সাহিত্যের সাথে সমান তালে চলছে ওয়েব ম্যাগ এবং ভারচুয়াল মিডিয়া । এই পরিবর্তনকে কি চোখে দেখেন ?
সুনন্দা গোস্বামী - ওয়েবম্যাগ বা ভার্চুয়াল মিডিয়া সেও তো সময়ের অবদান । যদিও আমার মনে হয় ছাপার অক্ষরই চিরস্হায়ী । তবে নবীন চিন্তাধারাকেও আমি স্বাগত জানাই ।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ - আমাদের লেখালেখিতে বহমানতা থাকা কি দরকার নাকি ছকভাঙা আন্দোলনটা বেশি প্রয়োজন ? আপনার নিজস্ব ঘরানার ভিত্তিতে একটু বিশদে বলুন ।
সুনন্দা গোস্বামী - আমাদের লেখালেখিতে বহমানতা থাকা দরকার নাকি ছকভাঙা আন্দোলন ? আসলে সাহিত্য তো সবসময়ই ছক ভেঙেই চলেছে । জীবন তো বহমান । তাই নদীর মত পাথর ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলে আমাদের কলম । আমি তো মনে করি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বদলায় । তাই স্বাভাবিক ভাবে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাহিত্যও ছক ভেঙে চলে । নইলে তো সে জীবনের কাছাকাছি থাকতেই পারবেনা ।
সুচিন্তিত মতামত দিন