সুমন সেন

মিলনান্তক
ত্যিই ভালোবাসতে জানত তুষার। কোথা কোথা থেকে যে নাম না জানা ফুল এনে চুলের খোঁপায় গুঁজে দিত – তা দেখে প্রতিবারই অবাক হয়েছে তনুশ্রী। এত সুন্দর ফুলের বাহার, সারা পৃথিবীতে যেন একমাত্র তুষারেরই চোখে পড়ে। নারকেলের কচি পাতা ভাঁজ করে এমন সুন্দর মুকুট বানিয়ে দিত, তা মাথায় দিয়ে নিজেকেই মিস্‌ ইন্ডিয়া ভেবে বসত তনুশ্রী। কয়েকবার তো ছবিও তুলে রেখেছে সে। নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে সে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত এবং ফুচ্‌কা খাওয়াত তনুশ্রীকে। তনুশ্রী কি ভালো খায়, তার কিসে অ্যালার্জী আছে, কোন কথায় রেগে ওঠে, কোনটা পছন্দ করে – সব দিকে খেয়াল ছিল তুষারের। পড়াশুনার ভীষন নেশা তুষারের। তাই কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে একটা হস্টেলে থেকে কলেজে পড়ত সে। কলেজের সময় থেকেই তার আলাপ তনুশ্রীর সাথে। পরে আলাপ থেকে প্রেম। চাষ-আবাদ করে সংসার চলত তুষারদের। বাবা, মা, একটা ছোট্ট বোন আর সে – এই ছিল তার পরিবার। অতটা সচ্ছল ছিল না, তবে কোনো রকমে তাদের সংসার খরচ ও তুষারের পড়াশুনার খরচ উঠে যেত। এদিকে তুষার টুক্‌টাক্‌ টিউশন করিয়ে নিজের হাতখরচটা তুলে নিত।

প্রতিবছর তনুশ্রীর জন্মদিনে মায়ের হাতে পায়েস রাঁধিয়ে নিয়ে আসত তুষার। শুধুমাত্র চাল, দুধ আর চিনি দিয়ে বানানো পায়েস – এর মধ্যে স্বাদ বাড়ানোর কোনো আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র থাকত না; তবুও এমন অভাবনীয় স্বাদ হত তার - যা তনুশ্রী আর কোথাও খায়নি! সে তো লুকিয়ে লুকিয়ে টিফিন কৌটোটা চেটে চেটেও খেত! একবার তো কোনো এক জন্মদিনে তনুশ্রীকে চম্‌কে দেবার জন্য হাতের মধ্যে বড় বড় করে তনুশ্রীর নামও লিখে ফেলেছিল তুষার। অবশ্য তনুশ্রীকে দেখাতেই সে চীৎকার করে ওঠে। উল্কি কোনোদিনই পছন্দ করেনা তনুশ্রী। তনুশ্রীর এই অপছন্দটা অজানা থেকে গিয়েছিল তুষারের। সেইদিন সারাদিন কথা বলেনি তারা। নিজেকে শাস্তি দেওয়া এবং ভুল সংশোধন করার জন্য ছুড়ি দিয়ে লেখাটা তুলে ফেলার চেষ্টাও করেছিল তুষার। রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল তার হাত। পরেরদিন, খবর পেয়ে তনুশ্রী নিজে তুষারের হস্টেলে গিয়ে তার হাতের পরিচর্যা করেছিল। সারাদিন একসাথে ছিল তারা। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিল তুষারকে। কিন্তু হায়! সেগুলোতো এখন স্মৃতির আড়ালে গুমড়ে মরা ইতিহাস।

তুষারকে নিজের করে নিতে পারেনি তনুশ্রী। পারেনি তাকে নিজের জীবনসঙ্গী করতে। কলেজ পাশের পর, তনুশ্রীর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দেয় তার বাবা-মা। ভালো চাকুরীরত পাত্র পেয়েছেন তারা। তনুশ্রী অবশ্য বাড়িতে বলেছিল তুষারের কথা। মেয়ের কথাকে অবজ্ঞায় উড়িয়েও দেননি তার বাবা-মা। বেকার তুষার বউ-এর ভরন-পোষনের দায়িত্ব যাতে নিতে পারে সে জন্য ছ’মাস সময় দিয়েছিলেন তারা। এর মধ্যেই সে যেন মোটামুটি মানের একটা কাজবাজ জুটিয়ে নেয়।

স্বামী বিবেকাকন্দের মতাদর্শী তুষার, কোনোমতেই চাকরী করতে চায় না সে। সে চায় হাতে-কলমে কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। যদিও এ’সব চিন্তাভাবনা এখনকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে খাটে না, তবুও কিভাবে সে এ’রকম চিন্তাভাবনা পোষন করত তা ভগবানই জানেন। ফলস্বরুপ, তার ভালোবাসা চিরতরে হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল তনুশ্রীর, এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত পাত্রের সাথে। প্রথমদিকটায় তো খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল তুষার। তাকে উৎসাহ দেবার প্রধান লোকটি তাকে ছেড়ে গিয়েছে বলে কথা! 

অন্যদিকে, স্বামীর ভালোবাসায় তুষারকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তনুশ্রী। এত ভালোবাসা, এত আদরে সর্বক্ষণ তাকে ভরিয়ে রাখে তার স্বামী অভিষেক। সোনা ছাড়া ডাকেই না তাকে। দামী দামী শাড়ি, গয়না – সবথেকে উৎকৃ্ষ্ট মানের জিনিসগুলো নিয়ে আসে অভিষেক তার স্ত্রীর জন্য। কিন্তু সে’সবও এখন অতীত। হ্যাঁ, স্টেটাস্‌ মেইন্টেন করার জন্য দামী দামী শাড়ি-গয়না আসে বটে; কিন্তু ভালোবাসাটা আর নেই। এখন তো প্রতি রাতে তনুশ্রীর শরীরটা নিয়ে আপন মনে খেলে চলে অভিষেক। তার পরে শুরু হয় পাশবিকতা। তনুশ্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অনেক সময় নিজের ইচ্ছাকে বড় করে তোলে অভিষেক। কাজের চাপে জন্মানো সমস্ত রাগ যেন ঝেড়ে ফেলে বিছানায়। মাঝে মধ্যে বদ্ধ শীৎকারে গুমড়ে ওঠে তনুশ্রী।

ছয়বছর হল ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে তনুশ্রীর। কিন্তু, এর পরেও বহুবার গর্ভপাত করাতে হয়েছে তাকে। শিক্ষিত যুবক অভিষেক, তার আত্মতৃপ্তির মাঝে কোনো তৃতীয় বস্তুর আসাটাকে মনে করে ‘কাবাব মেঁ হাড্ডি’! এখন তো কথার অবাধ্য হলে হাত-ও উঠে যায় তনুশ্রীর উপর। কোনো পার্টি তে যাবার আগে মেক-আপ এর রঙ-ও লুকোতে পারে না গালের লাল ছোপ।

এ’ব্যাপারে অবশ্য নিজের মা-বাবাকে কোনোদিন কিছু জানায়নি তনুশ্রী। একজন সুখী গৃহিনীর মত স্বামী-সংসার আগলে চলার চেষ্টা করেছে সে। মায়ের কাছে সে ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছে – বিয়ের পর স্বামীই পরম ঈশ্বর, তার কথাই শেষ কথা, মেয়েদের সবকিছু মানিয়ে নিয়ে সংসার করে চলতে হয়। মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে সে।

তনুশ্রী ভেবেছিল – নিজের মেয়েকে সামনে রেখে সারাজীবনটা হেসে-খেলে কাটিয়ে দেবে। মেয়েকে সর্বদা স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দেবে। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, ইদানিং বেশ কিছু রোগ আক্রমন করেছে তাকে। মাথার চুল উঠে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যাথা ইত্যাদি। চোখগুলো যেন অক্ষিগহ্বর-এর অনেক ভিতরে ঢুকে গেছে। কচি নারকেল পাতার মুকুট পরে মিস্‌ ইন্ডিয়া হবার জেল্লা যেন হারিয়েছে সে। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ রূপে দেখে সে। একদিকে অবশ্য ভালোই হয়েছে, অভিষেক এখন আর রাত্রিবেলা তার সাথে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনে রুচি খুঁজে পায় না। এক নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছে তনুশ্রী।

তিনদিন আগের পরীক্ষার রিপোর্টে ধরা পরে তার জরায়ুতে ক্যান্সার হয়েছে। সেকেন্ড স্টেজ।

হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। নার্স এবং আয়া সর্বদা থাকে তনুশ্রীকে দেখাশোনার জন্য। মাঝে মধ্যে অভিষেকও দেখা করে যায় স্ত্রীর সাথে। কিন্তু তনুশ্রী যেন আজকাল খুব একা হয়ে পড়েছে। তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারছে না, খেলতে পারছে না! সে তো এখন খুব ছোটো, এতকিছু বোঝে না। বুঝলে হয়তো সব ছেড়ে মায়ের কাছেই থেকে যেত সারাদিন। 

এরই মধ্যে সেদিন পোস্তা ব্রিজটা ভেঙ্গে পড়ল। পুরো কলকাতায় হই-হই পড়ে গেল। সকাল থেকে টি.ভি. তে এ’ব্যাপারেই খবর চলছে। এই হাসপাতেও বহু আহতকে ভর্তি করা হয়েছে।

আজ সকাল থেকেই তনুশ্রীর শ্বাসকষ্ট-টা একটু বেশি বেড়েছে। অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে রাখতে হচ্ছে তাকে। এক নতুন পেশেন্টকে নিয়ে আসা হয় সে রুমে। শোয়ানো হয় তনুশ্রীর পাশের বেড-এ। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আশে পাশের সকলের কথা শুনে তনুশ্রী বুঝতে পারে – লোকটাকে আনা হয়েছে ভেঙ্গে পড়া ব্রিজের নীচ থেকে। 

হঠাৎই তনুশ্রীর চোখ যায় লোকটির খোলা হাতের দিকে। চম্‌কে ওঠে সে। শত-সহস্র ড্রাম যেন একসাথে বাজতে শুরু করেছে তনুশ্রীর বুকের ভিতর। মাথাটা দপ্‌দপ্‌ করছে। এমন সময় একজন ডক্টর ও নার্স ঢুকল সেই রুমে। 

“পেশেন্টের সম্পর্কে কিছু জানা গেল, সিস্টার?” –ডক্টর প্রশ্ন করলেন।

“স্যার, ইনি একজন বড় কৃষি-বিজ্ঞানী, তুষার দত্ত। ৩৬ টা প্রোডাক্টের পেটেন্ট আছে এনার নামে। এনার একটু স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে স্যার।” –সেবিকা বলল।

“হয়েছে-টা কি?”

“সিরিয়াস ব্রেইন ইঞ্জুরি!”

“দেখ কতটা কি করতে পা্রো। আজ যা অবস্থা...”

ডক্টর চলে গেলেন। তনুশ্রীর নিষ্পলক দৃষ্টি তখনও লোকটির হাতের দিকে। যেখানে অস্পষ্ট অথচ বড় বড় করে লেখা ‘তনুশ্রী’।

রাত হয়েছে। ঘরে কেউ নেই এখন। শুধু তুষার আর তনুশ্রী, পাশাপাশি দুটো বেড-এ শুয়ে আছে। জ্ঞানহীন তুষার। তনুশ্রী একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে তুষারের দিকে, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে যেন- সুস্থ হয়ে ওঠে তুষার। একসময় হাত বাড়িয়ে – তুষারের খোলা হাতটাকে চেপে ধরল তনুশ্রী। অনেক রাত হল, তারা হাত ধরাধরি করে শুয়ে আছে পাশাপাশি। অনেক স্মৃতি রোমন্থন করল তনুশ্রী। চোখের কোণা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল বেড়িয়ে তার বালিশের অধিকাংশটাকেই সিক্ত করেছে। কিছু ভালোলাগার মূহুর্ত মনে পড়াতে – তার সমস্ত শারিরীক কষ্ট যেন এক ঝট্‌কায় চলে গেল।

হঠাৎ তনুশ্রীর মনে হল – তুষারের হাতটা যেন আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিকের থেকে অনেক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে তুষারের শরীর। তনুশ্রী যে কাউকে ডাকবে – সেই অবস্থাতেও নেই সে এখন। প্রচন্ড পরিমাণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। তাও একবার আপ্রাণ চেষ্টা করল চীৎকার করার। কিন্তু ফাঁকা ঘরের বাইরে বের হল না সেই আওয়াজ। শক্ত করে তুষারের হাত চেপে রয়েছে তনুশ্রী। সে বুঝতে পারছে – আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে তুষারের স্পন্দন। দাঁতে দাঁত চেপে তুষারের হাত শক্ত করে ধরে তনুশ্রী পড়ে রইল। আকাশ-পাতাল চিন্তা আসছে তার মাথায়। একটা সিদ্ধান্তের দ্বারা তারা আবার মিলিত হতে পারে – এই বদ্ধ খাঁচার বাইরে গিয়ে! একসময় এক নিশ্চল নীরবতা গ্রাস করল তার মন-কে। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে, সযত্নে বিছানার একপাশে রেখে দিল তনুশ্রী।

suman.sen303@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.