হিরি শিরি দুই বোন। একজন হিরি একজন শিরি।
যমজ। বছর বারো বয়েস। একেবারে এক রকম চেহারা। টেপা নাক। ভাসা চোখ। আলু আলু গাল। হলুদ হলুদ গায়ের রং। সকাল বেলা উঠে ওদের মা দুরকম জামা পরিয়ে, দুরকম চুল বেঁধে দেবেন যাতে চিনতে ভুল না হয়, তারপরেও হিরি এসে শিরির ভাগের দুধ খাবে। দুজনে একসঙ্গে বাইরে গেল, একজন ফিরে এসে যদি তার নিজের নাম নিয়েই জিজ্ঞেস করে সে কোথায়? তাদের মা অবাক চোখে করে তাকিয়ে থাকবে। তার কিছুতেই মনে পড়বে না, কার অঙ্গে ছিল লাল জামা, কার অঙ্গে নীল? "
এই টুকু বলে ফুলন কাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন:
বুঝলি?
আমি কিছুই বুঝি নি। কিন্তু সে কথা কাকুকে বলা যাবে না। কাকু তাহলে আবার প্রথম থেকে শুরু করবেন। হিরি শিরির কাহিনী। আলুর মত গাল, টেপা নাক ... তার চেয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলাই ভালো। ফুলন কাকু সাধাসিধে মানুষ। উনি পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সরকারি স্কুল , অধিকাংশ দিন ছুটি। ওনার বয়স মেরে কেটে পঞ্চাশ। পাক্কা ব্যাচেলার। ধূমপান মদ্যপান কোনো নেশা না থাকলেও একটা অদ্ভুত শখ আছে। এমন শখ আর কারো আছে বলে শুনিনি। অনেক বছর বাদে যখন থাইল্যান্ডের বাসিন্দা হলাম, তখন ওখানকার যারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী , তাদের মধ্যে এই বিশেষ জ্ঞান দেখেছিলাম। তারা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ আসলে স্বপ্নের মধ্যে বাঁচে অথবা মরে। মানসিক বহু রোগ ঘুমের মধ্যে দিয়ে মনে ঢুকে পড়ে। থাই সন্ন্যাসীরা কি সব প্রক্রিয়ায় ঘুমন্ত মন জাগানোর চেষ্টা করতেন।
খুব অদ্ভুত ভাবে ফুলন কাকুর এই শখ। স্বপ্ন ব্যাখ্যা। পাড়ার রতন মুদির বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন ফুলন কাকু। রতন মুদি নির্বিরোধী ভদ্রলোক। রোজ রাতে দোকান বন্ধ করে উনি যখন বাড়ি ঢোকেন, তখন ফুলন
কাকুর ঘরে আলো জ্বলে। মাষ্টার লোকেদের উপর রতনমুদির আস্থা এই যুগেও কমে নি। সে বিশ্বাস করে মাষ্টার লেখা পড়া করে অনেক রাত পর্যন্ত। এই গদ গদ বিশ্বাসে সে মাঝে মাঝে ভাড়া চাইতে ভুল করে। সারারাত আলো জ্বললেও কিছু মনে করে না।
" হিরি শিরি র এমন অদ্ভুত নাম কেউ দেয়নি। বলতে পারিস ওরা নাম প্রাপ্ত। দুই যমজ মেয়ে জন্মের সময় ফুটফুটে ছিল বলেই একজন হিরের মত আর একজন চিনির শিরার মত। ওই যে ডাক শুরু হল, তার থেকেই অমন দাঁড়াল। স্কুলে ওদের নাম হিমানী আর চন্দনী।
আমার ওদের চেনার কথা নই। ওরা এখানে থাকেই না। ওরা থাকে খাস কলকাতায়। নিউ আলিপুরে। ওরা দুই জন ভারি অদ্ভুত। বারো বছর বয়স হলে কি হবে? ওদের চিন্তা ভাবনার গভীরতা বিশাল। বলতে পারিস একটা বেড়ালের মৃত্যু আমাকে ওদের কাছে পৌঁছে দিল।
- বেড়ালের মৃত্যু! সে আবার কি কথা!
খুব অবাক গলায় প্রশ্ন করলাম।
- ওদের বাড়ির সামনে এক উঁচু তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে কিছু বজ্জাত ছেলে একটা বেড়ালকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেয়। বেড়াল টা পড়ছে, দুই বোন জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছে। পড়তে পড়তে বেড়ালটা ওদের কিছু বলে যায়।
- বেড়াল? সে কি বলবে?
- কেন? অবাক কেন? মৃত্যু যন্ত্রণা সবাই বোঝে। বিড়াল বুঝবে না কেন? হত্যা করা হচ্ছে যখন প্রাণীটিকে, তখন সব প্রাণীর ভাষা এক ... আমাকে বাঁচাও। "
এই টুকু বলে কাকু আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , বুঝলি?
এবার মনে মনে খুব রাগ হল। একে সামনে বারো ক্লাসের পরীক্ষা। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী।
কেউ যদি অকারণ বক বক করেন, পড়ার ক্ষতি হবেই। অন্য কেউ বাড়িতে টু শব্দ করলে মার মার কাট কাট। কিন্তু ফুলন কাকু বাড়িতে এলেই মা মহ খুশি। ফুলন কাকুর আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। উনি স্বভাব মিশুকে। পরোপকারী। তাছাড়াও উনি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে পারেন। এইটা আমার মায়ের ভারি পছন্দের বিষয়। ফুলন কাকু এলেই, মা স্বপ্নের ভান্ডার খুলে বসবে:
বুঝলেন মাষ্টার মশাই, গত রাতে দেখলাম একটা কালো পোকা, না না কালো না , কালো না, কেমন যেন ছাই ছাই রঙের পোকা উড়ে উড়ে ঘরে ঢুকছে। যতবার তাড়া করি, সে ততবার ঢোকে। শেষে আমার দিকেই এগিয়ে এল। , চোখ গুলো যেন আগুনের মত জ্বলছে আর নিবছে ... আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। রিনির বাবা ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে বসলেন। "
রিনি মানে আমি সে কথা বলাই বাহুল্য। আমার আর কোনো ভাই বোন নেই। বাবা আমি মা এই তিন জন ছাড়াও আছে ভুলো কুকুর , পুষি বেড়াল। ছোট চৌবাচ্চায় জিয়ান তেলাপিয়া। আর ঠিক কাজের মাসী।
সন্ধ্যা নাগাদ ফুলন কাকু আসবেন। রোজ আসেন না। কিন্তু প্রায় আসেন। চা জলখাবার খাবেন। একতলা বাড়ির লাল বারান্দায় মোড়া পেতে বসবেন। মাটিতে আসন পেতে বসা মায়ের কথা শুনবেন, শুনতে শুনতে মিটি হাসবেন, চোখ দুটি বুজে আসবে , ওই বোজা চোখ দুলিয়ে বলবেন__
" আত্মা আত্মা বোঝলেন বৌদি আমরা সব আত্মা। এই জগতের কেউ না আমরা। ঘুমের মধ্যে যোগাযোগ হয়, অন্য জগতের তাদের সঙ্গে। জেগে থাকলে বুঝিনা।
- পোকা আত্মা?
- বইকি! ফুলন কাকু সাধুদের মত হাসবেন__
হতেই পারে। কেউ আপনার ক্ষতি করতে চাইছে। আপনার নিজের ভিতরের যে শক্তি, সে আপনাকে জানতে চাইছে সেই খবর, জেগে থাকলে কত হাবি জাবি কাজ। রাজ্যের কাজ। সংকেত ধরতে হলে চাই নীরব
মন। নীরব মন বাতাসের কম্পন থেকে সংকেত ধরে মগজে সেই বার্তা পাঠিয়ে দে। তখন স্বপ্নের মধ্যে সেই খবর পৌঁছে যায় আপনার কাছে।
পড়ার ঘর আর বারান্দার ফাঁকের জানলা দিয়ে দেখলাম মায়ের মুখ ক্রমশ গোল। এখুনি এক মাছি, টপাস করে ঢুকে যেতে পারে। একদম সম্মোহিত। কথা মানুষের কত বড় শক্তি, কত মানুষকে বেকুব বানানো যায় কথা দিয়ে সে কথা মা বুঝলে ত! ফুলন কাকু স্বপ্ন তত্ত্বের এমন ব্যাখ্যায় লোক পটে যায়। ফুলন কাকুর ডাক পড়ে কারো কারো বাড়ি।
তিনি তাদের বাড়ি যান। সাধু মুখ করে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন। লোক মুগ্ধ । হাত জোড় করে শোনে।
ফুলন কাকুর এই জনপ্রিয়তার কারণ খুব সহজ। স্বপ্ন শব্দটি শুনতে যত মধুর, আসলে তার উল্টো। স্বপ্ন মানুষকে বেশির ভাগ সময় বোকা বানায়। কিছু কিছু স্বপ্ন এমন ভয়ঙ্কর হয়, লোক তার জ্বালাতে পাগলের মত আচরণ করতে থাকে। এক লোক ঘুমালেই দেখত তাকে পাগলা কুকুর তাড়া করে। ছোট ছোট ছোট। ছুটতে ছুটতে ঝপাং করে পানা পুকুর। ঘামে জবজব শরীর নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। রাত হলে আতঙ্ক। ঘুম পেলে আতঙ্ক। আশির দশকে কলোনীর ছোট্ট পাড়ায় মনের ডাক্তার কই? ফুলন কাকু ভরসা। তার স্বপ্ন ব্যাখ্যার শক্তির কথা লোক জেনে গ্যাছে। রাত জেগে জেগে তিনি আরো পড়াশুনো করেন, সে কথাও লোক জানে। তাই তার ডাক পড়ে। মাঝে মাঝে এই রকম কিছু গল্প তিনি আমাকে শোনান। কারণ তার ধারণা আমার মধ্যে এক শক্তি আছে। প্রায়ই তিনি আমাকে বলেন:
রিনি, কোনো মানুষ আমের মত টপ করে পড়ল আর তার আচার বনে গেল, এটা হয় না। হতে পারে না। এই যে তুমি বিজ্ঞান পড়ো, ভালো ফল করো, সব কিছু জানার প্রতি তোমার আগ্রহ ... গভীর ভাবে ভাবো ... এক পরিবারের সকলে কি তোমার মত? কখনো না।
আমি বললাম ... কেন? অনেকেই বলে আমি ঠিক আমার বাবার মত।
ফুলন কাকু সেই সাধু সাধু হাসলেন। কাঁচা পাকা দাড়ির ফাঁক দিয়ে দাঁত দেখা গেল। দাঁতে পোকা। ময়লা পাজামা ফতুয়া। পায়ে কমদামী চপ্পল। একেবারেই সাধারণ। তবু এনার কথা সবাই শোনে। কেন যে শোনে? । রাগ হয়। আমি জোরে বললাম:
হাসেন কেনো? "
বাবার মত আমি একটু গম্ভীর প্রকৃতির। চট জলদি কিছু করিনা। বারো ক্লাস পড়ি যেখানে, সেটা কো এড স্কুল। সেখানে ভালো ছাত্রী হিসেবে সুনাম থাকলেও , আমার মনের কথা জানে এক মাকড়সা।
ফিজিক্স ক্লাসের তরুণ শিক্ষক রণজয় স্যারের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ। সে যখন পড়ায়, আমি মুগ্ধ চোখে তার আঙ্গুল গুলি দেখি। প্রতিটি আঙ্গুলের মাথার নখ সুগোল। পরিষ্কার। তালু গোলাপী। উপরের পাতায় অল্প লোম। কি সুন্দর দুটি হাত। মনে হয় ঠোঁট নামিয়ে দি ওই হাতে। এমন ভাবনার মাঝেই চোখ পড়ে ক্লাস ঘরের উঁচু সিলিংয়ের কোনার মাকড়সার দিকে। চোখ পড়ে কারণ ও আমার দিকেই তাকিয়ে কি যেন বলে। কি বলে?
" রিনি , ওই আশা ত্যাগ করো। স্যারের হাতে চুমু খেতে পারবা না। উনি বিবাহিত। "
- জানি। এ ও জানি চুমু খাবার মত হাত পাব না কোনো দিন।
মাকড়সা বলে:
মানুষ না হলে পারতে। অদ্ভুত নিয়ম তোমাদের সমাজে। মনের মধ্যে লুকনো কাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ!"
ফিজিক্স স্যার নিয়ে এই সব ভাবনা শুধু মাকড়সা জানে। অতি প্রিয় বন্ধুরাও ভাবে আমি গম্ভীর। কটকটে। বাবার মত।
ফুলন কাকু বলেন ..."সে তোমার চলন বাবার মত, বলন বাবার মত। কিন্তু তোমার চিন্তন আলাদা। হতেই হবে। তুমি যে আলাদা আত্মা রিনি। অনেক গভীরে ঢুকতে পরো তুমি। ধরো, মন একটা সুড়ঙ্গ। তুমি দেখতে পাবে প্রায় শেষ পযর্ন্ত। তার ফলে খুলে যাবে অনেক রহস্য। যা তোমার বাবা পারেন না।"
আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম ফুলন কাকুর দিকে। সাধারণ শিক্ষক। অভাবী। কেবল তার ভাবনা গুলো আর কারো মত নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের ফারাক কেবল চোখ কান নাকের নয়। ভাবনার । ফুলন কাকু এমন সব ভাবেন কি করে?
দ্যাখো ওই হিরি শিরি যমজ, নিজের মা পর্যন্ত ভুল করে, কিন্তু তাদের চিন্তা একেবারে আলাদা।
ফুলন কাকু বলতে শুরু করেন ...
" হিরি যা চায়, শিরি চায় না। সব সময় কাছে কাছে থাকে যে দুই বোন, তারা একে অন্যের মনের গভীর গোপন খবর লুকিয়ে রাখে। ভাবনা আলাদা বলে তাদের স্বপ্ন গুলো আলাদা হয়। একজনের ভয়ঙ্কর অন্য জনের নিরীহ। একজন চায় প্রতিশোধ হোক নির্মম। আর একজন একটু নরম ভাবে দেখে। "
- কার কোন স্বপ্ন কাকু? কার ভয়ঙ্কর কার নিরীহ? কে নিল বিড়াল মারার প্রতিশোধ? তুমি কি করতে গেলে ওখানে? "
- আমাকে নিয়ে গেল কেউ। ওদের ভিতরের স্বপ্ন থেকে সত্যি খুঁজে বার করার কাজ আমাকে করতে হল।
- কি হল তারপর?
- আজ যাই। একটু কাজ আছে। কাল আসব। এসে বলব।
ফুলন কাকু এমনই। ইচ্ছে না হলে তিনি বলবেন না। আমিও পড়ার চাপে ভুলে যাই। কাকুও কাল আসব বলে বেশ কয়েক দিন পরে আসেন। এর মধ্যে মার স্বপ্নে পোকার বদলে এসেছে এক সুন্দর চিতি সাপ। সে আবার কামড়ায় না। আদর করে। মার মুখে তবু উদ্বেগ। সাপ কেন আদর করবে? মানুষের শান্তি নেই। কামড়ালে অশান্তি আদরে সন্দেহ? বিজ্ঞান ত বলেই উদ্বেগ থেকে মানুষ স্বপ্ন দেখে। ফুলন কাকু মন শান্ত করে ভিতর খুঁজতে বলেন। তার মধ্যেই নাকি লুকিয়ে আছে সব রহস্য। সমস্যার সমাধান। মা শান্ত হলে জানতে পারবে কেন সাপ তাকে আদর করে?
হিরি শিরি কে আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম। এই সময় হঠাৎ একদিন ফুলন কাকু এলেন। বিকেলে বেশ টিপ টিপ বৃষ্টি। ওনার মাথায় চাতার বদলে বড় কচুর পাতা। পাঞ্জাবী পাজম ভিজে ভিজে। চপ্পল নীচে খুলে রেখে তিনি এক দৌরে টিউকোলে পা ধুয়ে বারান্দায় উঠে পড়লেন। বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন:
গা হাত পা মুছে নাও ফুলন। আদা চা খাও।
মা হাসিতে উজ্জ্বল মুখে গামছা এনে দিলে। আজ বারান্দায় বসা যাবে না। ঘরে গিয়েই বসা হল। মার খুশি খুশি মুখ। মা অবশ্য এমনই। অকারণ খুশি আবার কোনো কারণ ছাড়া দুঃখ। বাবা মাঝে মাঝে রেগে যায়। ঘরের বউ এমন চঞ্চল কেন? আমার কিন্তু বেশ লাগে। ছুটির দুপুরে অঙ্ক করতে করতে শুনি উঠোনে মেলা কাপড় তুলতে তুলতে মা গান গাইছে ... মার খোলা হাওয়া ...
নিরিবিলি দুপুর। ঘুঘুর ডাক। গাছের পাতার সরসর। রবি ঠাকুরের গান। পাতলা ছিপছিপে মা। পৃথিবীতে তৈরি হয় স্বর্গীয় মুহূর্ত! বিনা পরিশ্রমে। বিনা খরচে।
- খিচুড়ি ইলিশ আছে। খেতে হবে কিন্তু। আমি চা নিয়ে এসে স্বপ্নের কথা বলব ঠাকুরপো?
মা লাজুক মুখে বলে।
- অবিশ্যি বলবেন বৌদি। কি দেখছেন আজকাল?
মা আলহাদি মুখে বলল:
এখন আর ভয়ের কিছু দেখি না। তবে একটা সুন্দর সাপ ...।
বলতে বলতে মা থেমে গেল। কিছু বোঝা কিছু না বোঝার মধ্যে দিয়ে সাপের আদর কথাটা যে বলা যাবে না এই বোধ তার কথা হঠাৎ করে থামিয়ে দিল। তিনি দুরদার করে চা আনতে চলে গেলে বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন
তোমার হিরি শিরির গল্পের কি হল? শেষ পর্যন্ত ?
- দাদা শুনতেন না কি?
ফুলন কাকু বেবাক অবাক।
- শুনতাম বটে। তবে ওই মাঝখানটায় কেটে কেটে কোথায় পালিয়ে যেতে, সেটা ভালো লাগত না।
ফুলন কাকু সিরিয়াস মুখ করে বললেন
কথাটা ঠিক দাদা। কোনো কথা মাঝখানে ছাড়তে নাই। কথা ফেলে রাখলে তার হাত পা গজায়। শিং গজায়। সে মাথা উচু করে ধাক্কা মারতে থাকে। তখন পেট গরম মাথা গরম, সেই থেকে আসে অদ্ভুত স্বপ্ন। বুঝি সব। কিন্তু দাদা, কত্ত জায়গায় যেতে হয়। এই ধরুন রতন মুদির ছেলে। আচ্ছা খাসা জোয়ান ছেলে। বাপের ব্যবসার হাল ধরবে। নতুন বিয়ে করল। তার কি অবস্থা!
বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন:
তাই না কি তাই না কি। কি হল তার আবার কি হল?
- ওই জন্যেই ত আটকে গেলাম দিন কতক। লোকটা ত প্রায় বিনি পয়সায় আমাকে থাকতে দেয়, আমার তো একটা কর্তব্য আছে?
- বটেই ত। বটেই ত।
- সে দিন দুপুরে ভূতের স্বপ্ন দ্যাখে। সব সময় তার মনে হয়, এই আলমারি খুলে গেল। এই খাট নড়ে উঠল। জল ভরা গ্লাস দুম করে পড়ে গেল।
- ঘটনা গুলো ঘটছে?
- কিছু ঘটে, কিছু ও কল্পনা করে, কিছু স্বপ্নে দ্যাখে। দাদা, মানুষ কেমন বলেন ত? জলের মত। যে পাত্রে রাখবেন তার আকার ধারণ করবে। এখন যদি সৎ সুন্দর পাত্রে রাখেন, তেমন চিন্তা করেন, শরীরে ফুর্তি জাগবে, শক্তি জাগবে__বায়ু তরঙ্গে খারাপ ভালো সব ঘোরে, সৎ পাত্রে খারাপ কিছু ঢুকতে পারে না। কিন্তু খারাপ যাবে কোথায়? বাসা বাঁধতে হলে দুর্বল মন দরকার যে, তখন তারা খুঁজে চলে। যেই অমন আধার পায় ভর করে বসে।
- ত রতন মুদির ছেলের কি হল?
বাবা অধৈর্য।
- বাবার পয়সা চুরি করত। জুয়া খেলে। নতুন বউএর গোয়না বেচে। মনের মধ্যে সাপ ভূত কিলবিল করে, ওগুলোই দ্যাখে।
ফুলন কাকু নির্বিকার মুখে বললেন। যেন এগুলো নিয়েই মানুষ ঘুরে বেড়ায়। খারাপ আর ভালো দুটো সত্ত্বা একসঙ্গে থাকে একটা মানুষের ভিতর? বাইরে বৃষ্টি ঝুপ ঝুপ। আমাদের পুরনো একতলা বাড়ি। চুনকাম করা। মলিন। লাল মেঝেতে ফাটল। পিঁপড়ে ঘোরে। বাড়ির চারদিকে আগাছা। কচুর জঙ্গল। ডুমুর গাছ। বাবা কেমন চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছেন। এ সব নিয়েই মানুষ। আর তার পৃথিবী। ভিজে মাটির গন্ধ, চা, খিচুড়ি ইলিশ মাছ ... খেতে খেতে গল্প ... এগুলো যা ঘটছে রোজকার জীবনে সে গুলো সত্য ময়? সত্য আরো গভীরে লুকিয়ে আছে। রতন মুদির ছেলে যদি তার ভিতরের ভালো সত্ত্বার খবর পায়, তবে হয়ত বেঁচে উঠবে। প্রত্যেক মানুষ ভাবে সে বেঁচে আছে। ফুর্তিতে আছে। ভেবে ভেবে আনন্দে নাচতে থাকে। বেঁচে আছে কি না জানতে হলে তাকে হত্যাকারী হতে হবে। মন্দ সত্ত্বার হত্যা। না হলে তাকে বলি হতে হবে ওই ভয়ানক কিলবিলে সাপের মত বিষাক্ত চিন্তার হাতে।
হঠাৎ আমার সারা শরীরে কেমন কাঁপুনি জাগল। চায়ের কাপ থেকে চা চলকে গেল বিছানায়। এ সব আমি কি ভাবছি? এ আমি কে আমি? বিজ্ঞান পড়া রিনি আমি? না কি অন্য কেউ? আমি তো ডাক্তার হতে চাই। বিদেশ যেতে চাই। টাকা রোজগার করতে চাই, কিন্তু জীবনের অঙ্ক মিলবে কি না তাই তো ভাবিনি কখনো!
ঘরে একটা চিন্তা তরঙ্গ ঘুরে ঘুরে দানা বাঁধার চেষ্টা করছে। রূপ ধরতে চাইছে।
এমন এক মুহূর্তে মা চা আর চিঁড়ে ভাজা নিয়ে ঘরে ঢুকে বললে ... হিরি শিরির গল্প শেষ? কি হল শেষ পযর্ন্ত?"
আমরা চুপ করে রইলাম। বাইরে বৃষ্টির এক টানা শব্দ। গল্প শেষ হল না শুরু হল আবার! কে জানে?
joyeelove@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন