রিয়্যালিটি শোতে প্রথম হওয়ার আনন্দের চেয়ে আজ দৈতার জীবনে স্বপ্ন পূরণের আনন্দটা প্রবল। যে স্বপ্ন একদিন ওকে স্থির থাকতে দেয়নি, আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে।
দৈতা ছোটবেলা থেকেই নাচ করতে খুব ভালোবাসতো। গরীব ঘরের মেয়ে হওয়ায় নাচটা শেখার সুযোগ হয়নি কখনো। তার উপরে একটা সময়ে দৈতার মাধ্যমিকের পরেই ওর বাবা ভালো ছেলে পেয়ে ওকে পাত্রস্থ করে নিজের দায়িত্ব মিটিয়ে দেন। দৈতার বিয়ে হয় এক আভিজাত্য বাড়ির ছেলে রাতুলের সাথে। রাতুলদের বাড়ির সবাই পারিবারিক ব্যবসাতেই যুক্ত ছিল। আর ওই বাড়ির বউদের কাজ ছিল শুধু সংসার সামলানো। যে বাড়িতে বউরা বাড়ির বাইরে পা রাখতেও স্বামীদের অনুমতি নেয়, সেই বাড়িতে দৈতা ওর নাচের শখের কথা বলতে পারেনি।
দৈতা মাঝেমধ্যে কাজকর্ম শেষ করে স্বামীর অবর্তমানে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে নাচ করতো। একদিন জানালা খোলা থাকায় সেটা ওর শাশুড়ি দেখে ফেলেন। আর দৈতা যাবে কোথায়!
"বউমা..." বলে চিৎকার করে ওঠেন দৈতার শাশুড়ি।
দৈতা ভয়ে কাঁপতে থাকে। ভয়ে ভয়েই দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল দৈতা ওর শাশুড়ির সামনে।
-"তুমি এই বাড়ির বউ হয়ে ধেইধেই করে নাচ করছো?"
-"না মা, মানে..."
-"মানে আবার কি? আজকে আসতে দাও খোকাকে। তোমার এই বেলেল্লাপনা যদি ওকে না বলেছি!"
-"না মা আপনার ছেলেকে কিছু বলবেন না।" দৈতা ওর শাশুড়ির পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে কাকুতিমিনতি করতে শুরু করে দেয়।
কিন্তু ওর শাশুড়ির কোনো কথাই কানে ঢোকে না। পা থেকে এক ঝটকায় দৈতাকে সরিয়ে দিয়ে চলে যান উনি। পরে রাতুল ব্যবসা থেকে বাড়ি আসতেই সব জানান। সব শুনে রাতুল রেগে "দৈতা...দৈতা..." চিৎকার করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকেছিল।
দৈতা আগে থেকেই এই ঝড়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। রাতুল ঘরে আসতেই দৈতা তাই হাত জোর করে বলে, "আমি আর এমন করবো না।"
-"তোর সাহস কিভাবে হয় আমার বউ হয়ে ঘরের মধ্যে ধেইধেই করে নাচার?" দৈতার চুলের মুটি ধরে রাতুল জিজ্ঞেস করেছিল।
-"আমাকে মাফ করে দাও।"
-তোর বাপ বিয়ের সময় তো এটা বলেনি যে, তোর বেলেল্লাপনার শখ আছে।"
-"বাবার কোনো দোষ নেই এতে। আমি নাচটা ভালোবাসি। কখনো শিখিনি। কিন্তু বাড়িতে আগে নিজে নিজেই টুকটাক করতাম।"
-"আর এখানে আসার পর ভেবে বসলি যে, তোদের ওই ভিখারীর ঘরে যেটা হতো সেটা এখানেও হবে।"
-তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আর কখনো এই ভুল হবে না।"
-"মাফ? আমি কাউকে মাফ করিনা, শাস্তি দিই।" বলে রাতুল দৈতার চুলের মুটি ছেড়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল।
নাহ! দৈতা মারা যায়নি। দৈতার কোমরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। আর দৈতা গিয়ে পড়েছিল আবার ওর গরীব বাবার ঘরে। সব জানার পরে দৈতার বাবা কথা বলতেন না ওর সাথে। দৈতার ক্ষমতা ছিল না অর্থ দিয়ে রাতুলের বিরুদ্ধে আইনি মামলা করার।
দৈতাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হলেও, দৈতার মনের জোর প্রবল ছিল। আর্থিক সমস্যার কারণে কোমরের হাড় জোরা লাগার পরেও দাঁড়ানোর জন্য ফিজিওথেরাপি করাতে না পারলেও নিজেই মোবাইলে দেখে দেখে অল্প অল্প করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দৈতা। আর ওর এই যুদ্ধে ওর পাশে ছিল ওর মা।
দুই বছর সময় লাগে দৈতার পুরোপুরি সুস্থ হতে। তারপরে শুরু হয় আরেক দফায় যুদ্ধ। না, দৈতা আর স্বামীর ঘরে ফিরে যায়নি। নিজের নাচের মধ্যে দিয়েই জীবনে সংগ্রাম করে গেছে। আর তারই ফলস্বরূপ আজ ও একটা বড় নাচের রিয়্যালিটি শোয়ের চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা হাতে নেওয়ার সময় দৈতা দেখলো, দর্শকাসনে বসে থাকা ওর বাবার চোখে জল। আজ দৈতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। না, এই স্বপ্ন দৈতার ভোরে দেখা ঘুমন্ত অবস্থার স্বপ্ন ছিল না। এই স্বপ্ন দৈতা খোলা চোখে দেখেছিল।
swasroy1994@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন