সেই কতযুগ আগে একটি সুনীল-কলম লিখেছিল, 'বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ '। ধরা যাক, এমন করে হঠাৎ নীরার জন্য লেখায় কলমটিকে আশ্চর্য বিদ্রুপে ভরিয়ে দিয়ে নীরা বলে উঠলো, 'আর মনগড়া স্বপ্ন দেখতে হবে না'। তাহলে তো আর লেখাই হতো না সারাটা জীবন, শিল্প কিংবা সত্যবদ্ধ অভিমান! এমন 'পুরস্কার' পেলে তো একটি প্রকৃত কলম অসম্মান আর আত্মধিক্কারে পুড়ে যেতে-যেতে একদিন ছাই হতে পারে! 'প্রকৃত' শব্দটির উপর জোর দেওয়া জরুরি এখানে। আর মনে রাখা জরুরি, পৃথিবীর যাবতীয় আত্মপ্রচারক, ধান্দাবাজ ও তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কে দড় কলমগুলির এই বিপন্নতা না-থাকাই স্বাভাবিক। তারা প্রতিভাধর, প্রতিভাহীন, অথবা মধ্যমেধার কারবারি, যাই হোক না-কেন!
এই বোধ আয়ত্তে ছিল বলেই নীরা জানতো, আজও নীরারা হয়তো জানে, স্বপ্ন দেখার অধিকারও কিন্তু অর্জন করতে হয়! স্বপ্ন যদি একনিষ্ঠ ও নিয়তিতাড়িত হয়; স্বপ্ন যদি নির্ভেজাল বাস্তবের শক্ত জমিতে যাপিত হয়ে থাকে প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত, সেখানে আসলে মনগড়া বলে থাকে না কিছুই। কিন্তু সময়ের অভিশাপ। মাঝেমাঝে পচা শামুকেও পা কাটে! মেলা-খেলা-মোচ্ছবে পরিপূর্ণ এই পঙ্কিল জনপদে চেতনাকে নির্বাসন দিয়েছে যে-সব মস্তিষ্ক, তাদের করোটি পড়ে থাকে শুধু। 'আ ম্যান ইজ নোন বাই দ্য কোম্পানি হি কিপস'। উঁহু, পাঠক ঘাবড়ে যাবেন না, কথাটা লিঙ্গান্তরেও সত্যি। চেতনায় মিথ্যাভাষের রঙিন প্রলেপ পড়তে থাকলে বোধের জগতে ঋণাত্মক বিচ্ছুরন ঘটবেই, দেখার চোখেও। তখন সহজেই অস্বীকার করা যায় যাপনের যাবতীয় অন্তহীন। ঝেড়ে ফেলা যায় বিবেকের যাবতীয় দায় ও টানের রূপকথা। দেওয়াল ভরে ওঠে ব্যঙ্গাত্মক কফ, থুতু ও বমির বিবমিষায়।
হ্যাঁ, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম। প্রকৃত প্রেমে ও বিপ্লবে স্বপ্ন না-দেখাটাই তো আশ্চর্যের! মেধা ও মননের সামান্য সঙ্গত ছিল বলে, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম দিনবদলের। 'সাম্য' নামক আপাত-ইউটোপিয়ান শব্দটিকে উপহাস করার কথা জীবনেও ভাবিনি, যাপনেও নয়। বরং যেহেতু ওই শব্দ থেকেই সমতার কথা আসে, একটু বৃহত্তর অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে চেয়েছি তাকে। রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাজে, সমাজ থেকে ব্যক্তিতে। সমতা মানে শুধু সমান অধিকারের কথা নয়, সমান বিচারের কথাও। যে-মাপকাঠিতে আমার বিচার করছো, ঠিক সেই মাপকাঠিতে তোমার বিচারের আসরও বসাও, তবে তো বুঝবো! কিন্তু অরণ্যে রোদন! চিরকাল নিয়ম ছিল, মানুষ পাখিকে কথা শেখাবে। আজ, বদলে যেতে থাকা এই সময়ে, সেই মানুষের মুখে ভাষা জোগাচ্ছে কাকাতুয়া। এমনও দেখে যেতে হবে!
কাকাতুয়া-পর্বটিই এমন, গভীর বিষাদেও কৌতুক আসে! আমরা তো জানি, এই পোড়াদেশে একটি চমৎকার প্রবাদ আছে, 'কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন'। সমনামী হলেই কেউ সমান কাজের হয় না, এই উপলব্ধিও তো মানুষের আজকের নয়! যে-পাখি শুধু কাঠিশিল্প জানে, সে আর কী করে জানবে স্বপ্ন আসলে কী এবং কেন! এমন পাখিরা তাই কাঠি দেয়, স্বপ্নের অপমৃত্যু কামনা করে, এবং তাতে ধোঁয়া দেয়; যেমন সে নাকি আগেও করে এসেছে আরও অজস্র জানালায়। বোধের উপর এভাবেই জমতে থাকে পলির স্তর। সেই স্তর এতটাই পুরু যে, সে বিস্মৃত হয়, গতকাল সকালেও সে স্বপ্নকে ডেকে-ডেকে বলেছে, 'কাল সারারাত তুমি ছিলে, ভোরে ঘুম ভাঙা পর্যন্ত। শুনেছি, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়!'
বোধ বিস্মরণে গেলে, সে যে শুধুই স্বপ্নকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, তা নয়। খোলাবাজারে সে যে শুধুই স্বপ্নকে নিয়ে শ্লেষ বিতরণ করে, তাও নয়। তখন সে স্বপ্নকে 'মনগড়া' আখ্যা দিতে ব্যস্ত হয়ে ভুলতে থাকে তার সঙ্গে জুড়ে থাকা সবকিছু। দেওয়াল ও জানালার কথা তুলে স্বপ্নকে সে ঘরে ঢুকিয়ে রাখে, তবে যাবতীয় আসবাবে তালা দিয়ে! কিন্তু পৃথিবীটা প্রায় গোলাকার। উদগান্ডু কাকাতুয়া থেকে আতাক্যালা মিডিয়া পর্যন্ত এখন যে প্রকাশ্য যাত্রা, আর মাঝখানে উপলক্ষ মাত্র যে-সব লোকদেখানো স্টপেজ, সে-পথের দুর্গন্ধে নাক ঢাকে তামাম পথিক। নেহাত বধির না-হলে বোঝা যেত, এরকম হলে মানুষের বাক্যে কতটা ধিক্কার মেশানো থাকে! সে ভুলে যায়, সমস্ত আঁকিবুকিদের সকল জারিজুরি ধরে ফেলার আসল জায়গা ছিল তাদের চোখ। কারণ, ভাষার পটুত্ব আমাদের আজীবন মিথ্যা বলে যেতে পারে। কিন্তু যাদের চোখ ধূর্ত ও লোভী এরকম, তাদের সহচর শিয়াল-শকুন ছাড়া কেউ ছিল না কস্মিনকালেও!
তবুও এটাই শেষ কথা নয়। আসলে প্রকৃত প্রেম ও বিপ্লবে শেষ বলে কিছু হয় না! এমনকি, নিহত স্বপ্নেরও নয়! তার যাপিত বাস্তব তো থেকেই যায়। তাছাড়া, লাইফ ইজ আ গ্রেট লেভেলার, মাই ডিয়ার! জীবন সব হিসাব ঠিক বরাবর করে দেবে। কালের হাতে আছে নির্মম ঝাঁটা। আর সত্যি বলতে কী, জীবনের কোনো খেলাই চিরদিন কালারফুল থাকে না। তারপর? এইসব খেলাধুলো মিটে গেলে? অথবা সব খেলা বেরং হলে? কমলালেবুর মতো এই পৃথিবীটা তো বেঁচে থাকবে তখনও! নির্ঘুমে তখন বোঝা যাবে, নিহত স্বপ্নের শব নিয়ে বসে আছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের স্বপ্নগুলো নিমগ্ন ছিল, 'মনগড়া' ছিল না কোনোদিন।
সুচিন্তিত মতামত দিন