বদিউর রহমান

হস্টেল জীবনের কয়েকটা জলছবি
৯৬৫। দেওবন্দ, সাহারানপুর না গিয়ে আব্বার আদেশ অনুযায়ী অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভর্তি হলাম কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়। ইলিয়ট হস্টেলের ৪১ নম্বর রুমের প্রথম দিনের কথা। ক্লাস সেরে ইলিয়ট–বেকার হস্টেলের মধ্যিখানের মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছি। সিঁড়িতে পাণ্ডুয়ার বাটার দোকান থেকে সদ্য কেনা একটা সুন্দর চামড়ার ব্রাউন রঙের চপ্পল রেখে মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজের পর সিঁড়িতে চপ্পলটা খুঁজছি। পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখছি। পাচ্ছি না। হঠাৎ ইয়াকুব সাহেব সেখানে উদয় হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি হলো?’ বললাম নতুন চপ্পলটা এখানে রেখেছিলাম, পাচ্ছি না। উত্তর এল “পাবিও না; রুমে ফেরৎ যা আর মসজিদে যাসনা, আমিও যাই না। অত নামাজ পড়ার কী আছে!”

সেই যে হস্টেল জীবন আরম্ভ হল তা দীর্ঘ এগার বারো বৎসর দীর্ঘায়িত হয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এক একটা হস্টেলে বিভিন্ন রকমের চরিত্র খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ঐ ইয়াকুব সাহেবও এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। উনি আমাদের পাণ্ডুয়াতেও কয়েক বৎসর পড়েছেন। আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। মুখে তখনই দাড়ি। কলকাতা এসে আবার দেখা। সম্ভবতঃ তখন আমার থেকে দু-বৎসরের উঁচু ক্লাসে পড়েন। পড়াশুনায় কোন আগ্রহ ছিল না, পরীক্ষা দেওয়াতেও অনীহা। তাই কয়েক বৎসরের মধ্যে আমার ক্লাসমেট; তারপর আমার পিছনের ক্লাসে। তাতে কী! পান চিবানোর বিরাম ছিলনা আর ক্লান্তি ছিলনা ছোট্ট ট্রাঞ্জিস্টারে গান শোনার। তা শোনারও বিশেষ ষ্টাইল ছিল। ট্রাঞ্জিস্টারটা কানের কাছে তুলে গানের সঙ্গে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে তাল দিতে দিতে শুনতেন বিবিধ ভারতি। বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান। বাড়ি থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে আসতেন। তাঁর বাবা একবার তাঁর বন্ধুদের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন যে ‘ছেলেটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধু টাকা যুগিয়ে যাওয়ার; কলকাতা যাওয়ার সময় সালামটুকু করে না’। ইয়াকুব সাহেব তখন থেকে কলকাতা আসার সময় দূর থেকে বাবাকে চিৎকার করে বলতেন “বাপ সালাম, আমি যাচ্ছি।’ প্রচুর টাকা নিয়ে কলকাতার জীবন উপভোগ করতেন। সকালের টিফিনের সঙ্গে নুরুমিঞা এক ফ্লাস্ক চা ও আট দশটা পান দিয়ে যেত আর থাকত কাঁচি সিগারেট। ক্লাস ও পড়াশুনার ধার ধারতেন না। বিকাল হলে প্যান্ট-শার্ট পরে এসপ্ল্যানেডের ব্যানার্জি কেবিনে মোগলাই পরোটা অথবা রিগাল সিনেমার কাছে একটা রেষ্টুরেন্টে মহিলা পরিবেশিত খাবার খেতেন। পরিবেশনকারীরা আব্দার করে অনেক বেশি বেশি খাবার খাইয়ে ভাল করে বিল বাড়াতেন। মেকী রাগ দেখিয়ে সাহেব বলতেন “আর এখানে আসব না।” কিন্তু কথার খেলাপ করে মাঝে মধ্যেই সেখানে হাজির হতেন। অনেকদিন ধূতি-পাঞ্জাবীতে বের হতেন – আর পূজোর সময় কদিন ঐ রকম ড্রেসতো অনিবার্য। কত ভাসানের মিছিলের সঙ্গে গঙ্গা পর্যন্ত যেতেন। সব থেকে অমার্জনীয় আচরণ ছিল রাস্তাঘাটে মহিলাদের ধাক্কা দেওয়া; আর হষ্টেলের জানালা দিয়ে মহিলাদের যাওয়া-আসা লক্ষ করে মন্তব্য করা। একজন বিবাহিত মানুষের এহেন আচরণ দুর্বিষহ লাগত। বারণ করলেও কোন পরিবর্তন লক্ষ করিনি। ঐ হষ্টেলে ছ’বৎসর পড়াশুনা করে মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ার সময় বেকার হষ্টেলে থাকতাম। ইয়াকুব সাহেব কোথায় গেলেন জানিনা। ১৯৮১ সালে দিল্লিতে চাকরি করি। শুনলাম পাণ্ডুয়ার অনেকে নিজামুদ্দিনের মার্কাযে এসেছেন। দেশের মানুষের টানে হামদার্দ নগর থেকে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওখানে জামায়েতের লোকেদের থাকার জায়গায় পাণ্ডুয়ার লোকদের খুঁজছিলাম। অনেকে শুয়ে বসে রেষ্ট করছেন। হঠাৎ একজন আমার একটা পা টেনে ধরলেন। ভয়ে আঁতকে উঠি কারও শরীরে পা পড়ল নাকি! যিনি পা ধরে রেখেছেন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়াটা বলি। সত্য বলার জন্য ক্ষমা করবেন। আমার ঐ মুখটা দেখে তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল খলিল জিব্রানের বর্ণিত শয়তানের মুখটা। অত্যাধিক পাপে লিপ্ত মানুষের মুখের রেখার উপর তা প্রতিফলিত হতে দেখেছিলাম। তবুও চিনতে পারলাম। বললাম ‘আপনি এখানে?’ বললেন “বাপ হজে গিয়েছিল; তিনদিন আগে দিল্লি ফেরার কথা। প্রতিদিন এয়ারপোর্ট যাচ্ছি আর ফেরৎ আসছি। মরুকগে। আমি আজ রাতে ট্রেনে চেপে বাড়ি যাচ্ছি।” সেই শেষ দেখা। কিন্তু হষ্টেলে বিভিন্ন রকমের চরিত্র দেখা সেখানেই শেষ নয়।

বেকার হষ্টেলের তিন বৎসরে বেশ কয়েকটা আনন্দদায়ক চরিত্রের সমাগম। কুলটির ষ্টীল-প্লান্টের এক ইঞ্জিনীয়র সাহেবের দুই জমজ পুত্র। আসল নামগুলো ভুলে সকলে ‘বড়ে-ছোটে’ বলেই ডাকতো। তাঁরা দু’ভাই-ই খুব সুন্দর ফুটবল খেলতো। তাদের বাবা ছেলেদের কলকাতা পাঠিয়েছিলেন বড় ক্লাবে ফুটবলের সুযোগ করে নিতে। যতদূর মনে পড়ে টালিগঞ্জ ক্লাবে তারা শিক্ষানবিশি করত। হষ্টেল ও বঙ্গবাসী কলেজের হয়ে অনেক খেলায় ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল। আর ভাল খেলার জন্য হষ্টেল সংলগ্ন পাড়ার ছেলেরা ছিল ঐ দু ভাইয়ের ভক্ত। ফুটবল ছাড়াও দুজনাই অপূর্ব টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন ও ভলিবল খেলতো। তারা ছিল দুষ্টু বুদ্ধিতে তুখোড়। ৭০’ এর দশকে প্রায়শঃই লোডশেডিং এ সন্ধ্যার সময় দীর্ঘক্ষণ অন্ধকার হয়ে যেতো। দুভাই চিৎকার করে একজনকে ক্ষ্যাপাত ‘মোল্লা ব্রাউন’ বলে। শুরু করতেন ওরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হষ্টেলের বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যেত ‘মোল্লা ব্রাউন’। আসলে একজন ছাত্র ছিল খুব ফর্সা। পড়ত ফার্সি অনার্স। সামান্য দাড়ি রেখেছিল আর সেগুলো ছিল কটা। তাই তাকে ঐভাবে চলত ক্ষেপানো।

ঐ দু’ভাই আর একজনের পিছু লাগত – তাঁর নাম কামার। বিহার থেকে আগত কামারের হিন্দির মধ্যে বিহারের ছাপ ছিল প্রকট ও স্পষ্ট। ‘কেয়া হুয়া’কে বলতো ‘ক্যা হুয়া’। ফিজিক্সের ছাত্র কামার অতি ভোজি। তখনকার দিনে কড়া র‍্যাশনিং এর জন্য তিন রাত্রি রুটি খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সাধারণ জলসম ডাল ও সবজি দিয়ে কামার গোটা কুড়ি-পঁচিশ রুটি সাবড়ে দিত। সে সময় ‘বড়ে’ বলতো “হামারে নাম মেঁ ওমলেট মঙ্গাউ কিয়া”। কামার বলতো ‘মাঙ্গওয়াইয়ে মাঙ্গওয়াইয়ে’। সেই ওমলেট দিয়ে আবার দশ পনেরোটা রুটি ধ্বংস করে দিত কামার। আর মেসের কন্ট্রাক্টর হতেন অশেষ বিরক্ত।

গরমের দিনে ফ্যানবিহীন রুমে শোওয়ার পদ্ধতি ছিল খাটটা দরজা দিয়ে করিডরে অর্ধেক বের করে শোওয়া। অত্যাধিক খাওয়ার পর কামার ঘুমাতো বেঘোরে। বড়ে-ছোটে কামারের খাটের তলায় তুবড়ি ফাটালো। কামার নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার তুবড়ি। কামার পাশ ফিরে ঘুমাতে লাগলো। তৃতীয়টার পর ঘুম জড়ানো আওয়াজে বলল “বড়েভাই সোনে ভি দো।” এম.এ পড়ার সময় আমি চলে যাই বৈঠকখানা রোডে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারমাইকেল হস্টেলে কামার কোথায় গেল জানতাম না। বহুদিন পর হঠাৎ একদিন এক ট্র্যামে দেখা। বলল সে জার্মানীতে পিএইচ ডি করে সে দেশেই থাকে।

বেকার হষ্টেলের আর দু’একটা কথা বলে শেষ করব। আশুতোষ কলেজে কেমিষ্ট্রী পড়তেন সাখাওয়াত সাহেব। চোখের চশমাটা ছিল মাইনাস বারোর। চশমা খুললে প্রায় অন্ধ। উনি ছিলেন ভীষণ জমাটে। রাত্রে খাওয়ার পর গল্প আরম্ভ করলে দু’তিন ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাসে তাঁর কথা শুনতাম। আমাদের ঘনঘন হাই উঠতে দেখে বলতেন আজ থাক। চলে যেতেন নিজের রুমে। তখন শুরু হত তাঁর ‘দেশ’ ও ‘ইলাষ্ট্রেটেড উইকলি’ ইত্যাদি পড়া। রাত চারটের দিকে নস্যি রঙের চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে সকাল ন’টা দশটা পর্যন্ত ঘুমাতেন। স্বভাবতই প্রতিদিন কলেজে পৌঁছাতে দেরী হ’ত। ক্লাসে ঢুকতেন প্রফেসরদের অনুনয় বিনয় করে। সাখাওয়াত বলতেন ‘বন্ধুরা সব আগে থেকে ক্লাসে ঢুকে বসে যেত – সামনের বেঞ্চ খালি রেখে – পিছনের দিকে’। বাধ্য হয়ে সাখাওয়াত বসতেন সামনের বেঞ্চে। কী অদ্ভুত ব্যাপার কিছুক্ষণ পরেই তাঁর দুচোখ বুজে আসতো ঘুমে। ক্লাসের মধ্যে উনি ছিলেন একমাত্র মুসলমান ছাত্র। প্রফেসররা ঘুমে ঢলে পড়া সাখাওয়াতের জন্য বলতেন “নওয়াব সাহেবকে তাকিয়া দাও।” সাখাওয়াত চোখ খুলেই বলতেন “স্যার সারা রাত জেগে পড়েছিতো তাই এখন ঘুম পাচ্ছে।” স্যার বলতেন “ঠিকই তো যে ছাত্র আগ্রহভরে সারা রাত পড়ে সে তো দিনের বেলায় কলেজের ক্লাসে ঘুমাবে! এ কথাও বিশ্বাস করতে হবে!” এছাড়াও তিনি একবার প্রাক্টিক্যাল ক্লাসে একটা কেমিক্যাল টেষ্ট করার সময় দশ-পনেরো ফোঁটা অন্য কী একটা ধাতু মিশ্রণ করার সময় ফোঁটা গুলো গুনতে ওঁর চোখে চাপ পড়ে; তাই উনি আন্দাজ মতো ভ্যাল্ভটা লুজ করলে বেশি পরিমানে ওই ধাতব পড়ে বার্ষ্ট করে ছাদ পর্যন্ত ঐ মিশ্রণ ছড়িয়ে পড়ে। পাশেই ছিলেন এক প্রফেসর। দেখা গেল তাঁর পরনের পাঞ্জাবী শরীর থেকে খুলে পড়ছে এমনকি ধূতিটারও অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। নতুন কাপড় কিনে স্যারকে সেদিন বাড়ি যেতে হয়। তারপর থেকে সাখাওয়াতের প্রাক্টিক্যালের সময় ঐ স্যার আর তাঁর ধারে কাছে থাকতেন না। সাখাওয়াত সাহেব বলতেন “এই চোখ নিয়ে আমার কেমেষ্ট্রি পড়া উচিত হয়নি। বাবার জন্য বাধ্য হয়েছি বিজ্ঞান পড়তে। আমার ভাল লাগার বিষয় ইতিহাস।”

তখনকার দিনে একটা ইংরেজী দৈনিকের সপ্তাহান্তে থাকতো পেন-ফ্রেন্ডশিপের কলামে কিছু বার্তা। সাখাওয়াত সাহেব ভাষা দিয়ে সুন্দর চিঠি দিতেন। কিছু দিনের মধ্যেই এক মহিলার সঙ্গে চিঠির আদান-প্রদান শুরু হল, শুরু হল দেখা সাক্ষাৎ, ঘোরা ফেরা, সিনেমা ইত্যাদি। সাখাওয়াত সাহেবের এক বিশেষ ভক্ত মতিন গুরুকে চা-পানি খাইয়ে তোওয়াজ করতে শুরু করল তার হয়ে চিঠি লিখে দিতে কেননা সে ভাল ইংরেজী জানেনা। সুযোগ বুঝে চা-জলখাবার খেয়ে চলেছেন সাখাওয়াত সাহেব। অবশ্য চিঠিও লিখে দেন। কী লেখেন জানি না; কোন উত্তর আর আসে না। শেষে মতিন বিরক্ত হয়ে আমার স্মরণাপন্ন হলে লিখে দিই দু’ চারটে চিঠি। কয়েকদিনের মধ্যে একটা উত্তর এল। মতিনের সেকী উল্লাস। আমার কাছে চিঠিটা নিয়ে এল ভালো করে বুঝে নিতে ও প্রতি-উত্তরে আবার একটা চিঠি লিখিয়ে নিতে। চিঠিটা পড়ে শোনালাম। ঠিকানা দেখি ‘ফিজি’। মতিনকে বোঝালাম অতদূরের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু কে শোনে আমার কথা। বাধ্য হলাম দু-তিনটে আরও চিঠি লিখে দিতে। এখান থেকে অনুরোধ হত তাঁর কলকাতা আসার আর ওখান থেকে উত্তর আসতো মতিনের ফিজি যাওয়ার। “শেষে মতিন চেয়ে পাঠাল তাঁর ফটোগ্রাফ আর এখান থেকে ফিজিতে পাঠাল সদ্য তোলা টাই বাঁধা নিজের ফটোগ্রাফ। ফটো এলো। বিশাল দেহের এক মহিলা – অদূরে এক বাচ্চা। আমি মতিনকে বললাম বাচ্চাটা সম্ভবতঃ ওই মহিলার। তা অসুবিধা নেই এদিকে আপনিও তো বিবাহিত।” কী হল জানিনা। মতিন সাহেব আর চিঠি লেখাতে আসেননি – যার জন্য মাঝে মধ্যে যে রকম খানাপিনা পাচ্ছিলাম সেটাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।

তা যাক। বিবাহিত যুবকের অনুরোধ উপরোধে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অপপ্রয়াস থেকে অব্যহতি পেয়ে নিজের ‘গিল্টি ফিলিং’ থেকে অন্ততঃ নিস্তার পেলাম – লেখনী বাবদ চা-জলপান বন্ধ হলো – তা হোক। নিজেকে অন্ততঃ নিষ্পাপ ভাবতে লাগলাম। তা আমি নিজে যে খুব ভাল ছিলাম তা নয়। ছিলাম খুবই নির্বিরোধ। অনেকের সঙ্গেই ছিল আলাপ। কিন্তু আমি নিজের পড়াশুনার জন্য সকলের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। আমার রুমে আড্ডার আসর কখনো বসত না। কিন্তু কিছু কিছু নিষ্পাপ দুষ্টুমি করতাম চুপি সাড়ে। কাজগুলো সেরে ভিজে বিড়ালের মত ভাবলেশহীন শান্ত থাকতাম। সে রকম একটা ঘটনা বলে বেকার হস্টেলের অধ্যায় শেষ করব। যদিও ষ্টকে অনেক কিছু বলার মত আছে।

বেকার হস্টেলের দোতলার দক্ষিণমুখী রূমে (৮২) থাকতাম। ডানদিকের রুমটি ছিল সাঈদ ভাইয়ের। ইকনমিক্সের ছাত্র আর বাম পাশের রুমে থাকতেন দর্শনের ছাত্র। সঈদ ভাই সকাল থেকে গেয়ে যেতেন ‘তুমি রবে নীরবে......’ সেদিনটা বাঁধা থাকতো রবীন্দ্রসঙ্গীতে। আর যেদিন সকালে মহাম্মদ রফির গান দিয়ে শুরু করতেন সারাটা দিন চলত মহাম্মদ রফি’। গলায় সুর ছিল। গাইতেনও ভাল। সব থেকে বড় কথা তাঁর মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকত। অনেকদিন তাঁর সঙ্গে হস্টেলে টেবিল টেনিস খেলেছি। খেলার সময় বড়ে-ছোটেও হাজির হতেন আর খেলতে আসতেন সেন্ট জেভিয়ার্সের কমার্সের ছাত্র কটকি রফিক। মৌলানা আজাদের ফিজিক্সের এক রোগা পটকা অথচ স্মার্ট ছাত্রও খেলত-আর বেশ ভাল খেলতো।

আমার রুমের বাঁ পাশের দর্শনের ছাত্রটি ছিলেন খানদানী ও আসল সৈয়দ। খানদানী বললাম এই কারণে যে তিনি উচ্চতায় কম হলেও খুব ফর্সা ও সুশ্রী। অনেক সৈয়দ দেখেছি যাদের গায়ের রঙ ময়লা। আমার মতে তারা নকল সৈয়দ। সে যাই হোক ঐ সৈয়দ সাহেব আমার শরীরের প্রায়শঃ খুব তারিফ করতেন। কখন কখন বলতেন আমার মত চেহারা পেলে একবার দেখে নিতেন। কী দেখে নিতেন জিজ্ঞাসা করলে লজ্জায় ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যেত।

হষ্টেলের স্নান করার জায়গাটা ছিল নীচে উত্তর দিকে। সেখানে যাওয়ার সময় গায়ের গেঞ্জিটাও খুলে উদোম গায়ে যেতাম। আমার বুকের পেশি ও হাতের বাইসেপগুলো তিনি শুধু লক্ষই করতেন না বরং হাত দিয়ে বাইসেপগুলো টিপে দেখতেন। তাঁর চাহনিতে আমার চেহারার প্রশংসা ফুটে উঠত। আসলে কলকাতা আসার বছরখানেক আগে আমার সেজদা খলিল ভাই ও রাজাদার ক্লাবে খালি হাতে ব্যায়াম করতাম। যোগ ব্যায়ামের ‘ধনুরাশন, পশ্চিমোত্তাশন এবং অন্যান্য কঠিন ব্যায়ামগুলো খুব সহজভাবে রপ্ত করেছিলাম। অনেক দর্শককে বলতে শুনেছি ‘ছেলেটার শরীরটা প্লাষ্টিকের মত; যেন হাড়গোড় বলে কিছু নেই’। সুন্দর নিটোল স্বাস্থ্য তৈরীর প্রথম সোপানটা পার করেছিলাম সেখানে; আর সে সময় প্রচুর দুধ-ঘি খেতাম। কলকাতায় খেলাধুলার মধ্যে প্রিয় ছিল ভলিবল, টেবিল টেনিস আর অ্যাথলেটিক্সের হাইজাম্প, শর্টপাট আর ডিসকাস। অবশ্য সব ধরনের খেলার আগে ওয়ার্ম আপ করতাম খালি হাতের ব্যায়াম দিয়ে।

শরীরের যত্ন নিতে আর দুটো কাজ করতাম। দু-থেকে তিনবার দাঁত ব্রাশ আর বৎসরের অন্ততঃ একবার নিতাম পারগেটিভ। পরের কাজটির জন্য আব্বার কম্পাউণ্ডার হাফিজ চৌধুরীর শরণাপন্ন হয়ে হেলমাসিড উইথ সিনা’ এক আউন্স নিতাম খেয়ে। রাত্রে শোওয়ার আগে খেতাম একটা ‘ডালকোলাক্স’। পরের দিন রাত্রে শোওয়ার আগে নিতাম আর একটা ঐ ট্যাবলেট।

একবার বেকার হষ্টেলে ফেরার পর দ্বিতীয় ডালকোলাক্সটা খাচ্ছিলাম। ঐ সৈয়দ সাহেব সেটা দেখে জিজ্ঞাসা করেন কী খাচ্ছি ও কেন খাচ্ছি ইত্যাদি। আমি কপট গম্ভীর হয়ে বললাম “স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য খেলাম।” উত্তরে বললেন “তাই বলি যে আপনার চেহারাটা এত সুন্দর কী করে। তা আমাকেও একটা দিন।” আর একটা ট্যাবলেট আমার কাছে ছিল। মোড়কটা খুলে সৈয়দ সাহেবের হাতে দিয়ে এক গ্লাস পানি দিলাম। ওটা খেয়ে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে উনি নিজের রুমে চলে গেলেন।

পরের দিন সকালে টেবিলে একটা বই নিয়ে বসেছি। দেখি সৈয়দ সাহেব প্রতিদিনের মত টয়লেট হয়ে এলেন। কাপড় জামা পাল্টে চললেন তালতলা বাজারের কাছাকাছি এক প্রফেসরের কাছে প্রাইভেট পড়তে। আমি আড় চোখে সব লক্ষ করে ভাবছি কী রকম হল! ট্যাবলেটের কোন অ্যাকশন হল না কেন! একটু আশ্চর্য হলাম।

কী আর করি আমি পড়ায় মন দিলাম। দশ মিনিটও হয়নি দেখি উনি হন্তদন্ত হয়ে যে কোন প্রকারে রুমের তালা খুলে জলের শূন্য পাত্রটা নিয়ে টয়লেটের দিকে দ্রুত দিলেন দৌড়। আমি ভাবলাম যাক অ্যাকশন হয়েছে। ভাল মানুষের মত বইটা নিয়ে বসে আছি। বুঝতে পারলাম উনি ফিরলেন। ওমা! কিছুক্ষণের মধ্যে লাগালেন আবার দৌড়। ফেরার সময় দেখলাম উনি যেন বেশ ক্লান্ত। ধীরে ধীরে নিজের রুমের খাটে শটান শুয়ে পড়ে মৃদু স্বরে আমাকে ডাকলেন ‘রহমান সাহেব, শরীরটা খুব খারাপ করছে একবার আসবেন?’ চেয়ার ছেড়ে গেলাম ওঁর রুমে। দেখি চোখমুখ মলীন করে শুয়ে পড়েছেন। বললেন “দু-তিনবার প্রচুর দাস্ত হল; হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, মারা যাব না তো।” ওঁর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললাম “গতকালের ট্যাবলেটটার জন্য আপনার পেট আজ পরিস্কার হল। কোন ভয় নেই। আরে ট্যাবলেট দিয়ে কি শরীর তৈরী হয়? তাঁর জন্য খেলাধূলা, ব্যায়াম করে শরীর চর্চা করতে হয়। সুখী শরীরটাকে একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে গায়ের ঘাম ঝরাতে হয়। উঠুন।” উঁহ বলে ‘কী মরে যাব’। আমার কথা শুনে একটু ধাতস্থ হয়ে রেগে গিয়ে বললেন “আপনাকে ভালো ছেলে বলে জানতাম। আপনি জানেন স্যারের বাড়ির দরজায় বেলটা দেওয়ার সময় পেটটা কি রকম মোচড় দিয়ে উঠল। স্যার দরজা খুলতেই মোচড়টা অসহনীয় হয়ে উঠলে শুধু ‘স্যার আজ...’ বলতে বলতে পিছটান দিয়ে একটা রিক্সা ধরে কী কষ্টে যে হষ্টেল পৌঁছাই। স্যার চিৎকার করে বলছিলেন “সৈয়দ কী হল...” রিক্সা থেকে স্যারের চিৎকার শুনতে পাই ‘কী হল সৈয়দ? পালাচ্ছ কেন...।” 

prof_badiur@rediffmail.com 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন