তপশ্রী পাল

চেতনে অচেতনে
কালে উঠে ব্যাজার মুখে বসে ছিল অমিতাভ । মাথা নীচু, চোখ মাটিতে – কি এক গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত । “এই যে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েছ? সাড়ে আটটা ! আজ অফিস বেরোবে না? মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিলে, এই নিয়ে তিনবার ডাকার পর উঠলে । উঠে থেকে বসেই আছো ! কি ব্যাপার বলো তো? শরীর খারাপ?” কপালে হাত দিল পাপিয়া । “না – না” মাথা ঝাঁকায় অমিতাভ “শরীর টরীর ঠিকই আছে – তবে কাল রাত্রে, বুঝলে – তা এই ভোরের দিকেই হবে, একবার বাথরুম করে এসে শুলাম, তারপর গভীর ঘুম। সেই ঘুমের মধ্যে একটা খুব ভয়ানক স্বপ্ন দেখলাম, জানো ! সেই থেকে - ” “ধুস ! স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে সকাল বেলায় ! রাত গেছে, স্বপ্ন গেছে । এখন ওঠ তো ! দয়া করে মুখ ধুয়ে চা খেয়ে নিয়ে আমায় উদ্ধার করো ।“ বিরক্ত মুখে বেরিয়ে যায় পাপিয়া ।

কিন্তু সেদিনের পর থেকে অমিতাভ সর্বদা অন্যমনস্ক । রোজ অফিসও যাচ্ছে, বাজারও করছে, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছে মায় আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী এলে দু চারটে কথাও বলছে । কিন্তু সবই যেন করতে হচ্ছে বলে করা । এই তো সেদিন ট্যাক্সি করে পাপিয়াদের বাড়ি যাচ্ছিলো রোববার বিকেলে । হঠাত রাস্তার একটা হোর্ডিং দেখিয়ে বলে উঠলো “জানো ঘরটা ঠিক এই ছবির মতো নীল রঙের ছিল !” “কোন ঘরটা?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পাপিয়া । “ঐ যে বলেছিলাম না – ঐ স্বপ্নের কথাটা – স্বপ্নে দেখা ঘরটা ঠিক এমনি রঙের ছিল !” “হে ভগবান ! তুমি এখনো ভোল নি সেই স্বপ্ন ! কি – ক্কি এমন ছিল বল তো সেই স্বপ্নে !” বলে ওঠে পাপিয়া । হঠাত কেমন ঝিম মেরে যায় অমিতাভ । তারপর বলে “শুনবে ! শুনবে কি ছিল সেই স্বপ্নে ! স্বপ্ন দেখলাম – যে আমি একটা ঘরে শুয়ে আছি । তার রঙ নীল ! আ-আ-আমার হাতের কাছে – একটা টেবল ! তাতে অনেকগুলো বই ! আর – আর একটা ওষুধের পাতা ! এমন সময় একটা হাত – হাতটা – হাতটা – হ্যাঁ ! অনেকটা - অনেকটা এই তোমার হাতটার মতো – আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিল ! তারপর – তারপর আমি কোথায় যেন আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছি – চোরাবালিতে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছি । হাতটা ধরার অনেক চেষ্টা করছি – ওঠার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না ! আমি দেখলাম আমার দেহটা সেই নীল ঘরে পড়ে আছে – আর আমি অনেক দূরে ! সেই থেকে মাথার মধ্যে শুধু স্বপ্নটা ঘুরছে ! আমি ভুলতে পারছি না পাপিয়া !” পাপিয়া হেসে বলল “জানো, বেশী রিচ খাবার খেয়ে শুলে এমন হয় । এ হল পেট গরমের ফল ! ভুলে যাও তো ! জানো মা আজ কেন ডেকে পাঠিয়েছেন ? আমাদের শ্যামবাজারের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে । আমরা সব ভাই বোন বেশ কিছু টাকা পাবো ! ভাল খবর না? এবার একটু হাসো !” ব্যাজার মুখে অমিতাভ বলে “ও তো তোমার টাকা, আমার কি? আর ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, জানো ?” “উঃ ! এই স্বপ্ন নিয়ে আর একটা কথা যদি বলেছ – আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে বলছি ! আর আমার টাকা মানে? আমার টাকা বুঝি তোমার টাকা নয়? ঠিক আছে যাও – টাকা পেলে তোমায় সাথে সাথে দিয়ে দেবো । এবার হল তো ?” স্বামীকে খুশী করার চেষ্টা করে পাপিয়া । 

সত্যি অনেকগুলো টাকা পেলো পাপিয়া । প্রায় দশ লাখ মতো । পুরো টাকাটাই দুজনের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে ফেলল । সাধারণ ক্লার্কের চাকরী করে অমিতাভ । থাকে নিজেদের দু ঘরের সরকারী ফ্ল্যাটে । এই টাকা অনেক, অমিতাভর কাছে । পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো । তাৎক্ষনিক খুশী হয়ে উঠলো সে । কিন্তু সেই স্বপ্ন তাকে তাড়া করে ফিরতে লাগলো । বেশ কয়েক মাস কেটে গেলো । হঠাত একদিন অমিতাভ বলল “জানো পাপিয়া, ভাবছি ওই টাকা থেকে ঘরদুটো রঙ করি ! কোনদিন তো রঙ হয় নি – টাকাই ছিল না !” “অ – তা বেশ ! করো – কিন্তু বিন্তির পছন্দটা দেখে কোরো বাপু – আজকালকার বাচ্চাদের অনেক রকম চয়েস – আর ওরা জানেও অনেক ।“ হেসে বলে পাপিয়া । 

বিন্তিই রঙ পছন্দ করেছে গোটা ফ্ল্যাটের । অমিতাভ ওকে ক্যাটালগ দিয়ে দিয়েছিল, ও কালার শেডগুলো টিক করে অমিতাভকে দিয়েছে । অমিতাভ আর অত মাথা ঘামায় নি । ওর বিন্তির ওপর অগাধ বিশ্বাস । মেয়ের ক্লাস টেন হল । সব দিকে ওস্তাদ । মিস্তিরি কাজ করতে লাগলো । কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছিলো অফিসের কাজে অমিতাভ । ফিরে এসে বাইরের ঘরে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেলো ! ঝকঝক করছে সূর্যমুখীর মতো হলুদ রঙ ! সুন্দর করে ঘরটা সাজিয়েছে পাপিয়া আর বিন্তি ! ওদের বেডরুমটা সুন্দর হাল্কা গোলাপী রঙ ! খুশী হয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই হঠাত হৃদপিন্ড থেমে গেলো অমিতাভর ! পাশেই বিন্তির ঘর ! এই তো সেই ঘর – যা সে স্বপ্নে দেখেছিল ! সেই নীল রঙ ! চেঁচিয়ে ডাকল অমিতাভ “বিন্তি ! বিন্তি !” পাপিয়া ছুটে এলো - “কি হল? বিন্তি পড়তে গেছে –“ । “এই দেখো সেই ঘর – সেই রঙ !” কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে বলল অমিতাভ । “কোন রঙ ! এ তো মেয়ের খুব পছন্দের আকাশী নীল রঙ ! খুব সুদিং রঙ !” “না না – এ রঙ চলবে না – এ-এ-এ রঙ বদলে ফেলো ! নইলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব !” বলে অমিতাভ । শুনে বিন্তি তো হেসেই বাঁচে না । “সামান্য একটা স্বপ্ন নিয়ে তুমি এরকম করছো বাপি ! কত খরচ করে করা বলতো ! সম্ভব এখন আবার চেঞ্জ করা ?” তখনকার মতো চুপ মেরে গেলো অমিতাভ । ওর নিজের ঘর তো নীল হয় নি – স্বপ্নে তো ওর ঘর নীল ছিল । মনে মনে ভাবে অমিতাভ । কিন্তু দিন দিন ওর ভয় আর খুঁতখুতি বাড়তেই থাকে ! ক্রমে এমন হল যে পাপিয়া একদিন মানসিক রোগের ডাক্তার ব্যানারজীর কাছে নিয়ে গেল ওকে । ডাক্তার ব্যানারজী অনেকক্ষণ কথা বলে চিন্তিত মুখে বললেন “এটা এক ধরণের মেন্টাল অবসেশন ! স্বপটাকে উনি সত্যি ভেবে নিয়েছেন এবং স্বপ্নটা যাতে সত্যি হয় ওনার অবচেতন মন তাই চাইছে – অথচ চেতন মন ভয় পাচ্ছে, পালিয়ে যেতে চাইছে । আমি ওষুধ দিচ্ছি – কিন্তু সারতে সময় লাগবে । এই অবসেশন বেড়েই চলে দিন দিন – এটাই এই রোগের বৈশিষ্ট – যতক্ষণ না ওনার এই বিশ্বাসটা ভাঙছে । ওনাকে সাবধানে রাখবেন ।“


অমিতাভ কিছুতেই ওষুধ খাবে না । খালি বলে – “আমি কি পাগল নাকি? শুধু শুধু ওষুধ খাবো কেন ?” প্রায় জোর করে বিন্তি অথবা পাপিয়া ওষুধ খাওয়ায় । মাঝরাতে অনেক সময়েই পাপিয়ার ঘুম ভেঙে যায় । ঊঠে দেখে অমিতাভ পাশে নেই । হয় বাথরুমে, নয় ঊঠে বারান্দায় বসে আছে মাঝরাতে । জিজ্ঞাসা করলে বলে “স্বপ্নটা – স্বপ্নটা সত্যি হবে দেখো – নইলে বিন্তির ঘরটা নীল হত না !” 

ওষুধটা আস্তে আস্তে কাজ করছে । মাসখানেক কোন স্বপ্ন দেখে নি অমিতাভ । কিন্তু সেদিন ছিল শনিবার । খাটে শুয়ে গভীর ঘুমোচ্ছিল অমিতাভ । সারা সপ্তাহ খাটনির পর আজকের ঘুমটাই যা আরাম ! কাল রবিবার – ওঠার তাড়া নেই । গভীর ঘুমিয়ে পড়তেই আবার সেই স্বপ্ন ! সেই নীল ঘর ! “নাহ নাহ !” চেঁচিয়ে ওঠে অমিতাভ ! সে পালাতে চায় এই স্বপ্ন থেকে! ধড়মড় করে উঠে বসে! ছুটে আসে পাপিয়া । সব শুনে বলে “চলো – কোথাও কদিন ঘুরে আসি – তোমারো মনটা ভালো হবে – বাড়ি থেকেও কদিন মুক্তি ।“ কদিন পুরী থেকে ঘুরে আসবে প্ল্যান করে অমিতাভ । কিন্তু পরেরদিনই ফোন এলো যে দিল্লি থেকে অমিতাভর ভাই সুমিতাভ, বৌ নন্দিতা আর বাচ্চা ছেলে টুটুল আসছে ! ওরা সিকিম বেড়াতে যাবে । যাওয়ার পথে এক সপ্তাহ কলকাতা দেখে তারপর । পিছিয়ে গেলো পুরী যাওয়ার প্ল্যান । এই ছোট ফ্ল্যাটে কোথায় থাকতে দেবে এদের – ভেবে ভেবে পাপিয়া নিজেদের শোয়ার ঘরটাই দিয়ে দেবে ঠিক করলো সুমিতাভদের কদিনের জন্য । এই কদিন বিন্তি বাইরের ঘরের সোফায় শোবে আর অমিতাভ আর পাপিয়া বিন্তির ঘরে । দিন দশেক পর আসছে ওরা । 

টুটুল আসবে তাই বিন্তির খুব মজা । কলকাতা দেখানোর প্ল্যান রেডি । এদিকে সামনে টেস্ট পরীক্ষা বিন্তির । সব সাবজেক্ট এ ভালো ও, শুধু অঙ্ক ছাড়া । নতুন টিচার ঠিক হল অঙ্কের জন্য । সপ্তাহে দুদিন । বাড়িতে এসে পড়াবেন । বাইরের ঘরে নানা লোকজন আসে । বিন্তি ধরে পড়লো অমিতাভকে । “বাপি আমার ঘরে একটা স্টাডি টেবল এনে দাও না ।“ মেয়ের বোর্ডের পরীক্ষা বলে কথা । রাজী হয়ে গেল অমিতাভ । পাড়ার ফারনিচারের দোকানে বলে এল একটা স্টাডি টেবল বানিয়ে দেবার জন্য । ওরা বলল “রেডিমেড টেবল নিয়ে নিন দাদা, সস্তা পড়বে ।“ বিন্তিরও আরজেন্ট দরকার ! পরদিনই টেবল দিয়ে গেলো, আমিতাভ তখন অফিসে। 

সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে বিন্তির ঘরে উঁকি দিয়ে আঁতকে উঠল অমিতাভ ! সেই টেবল ! ঠিক সেই স্বপ্নের মতো ! পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের সামনে ! চমক ভাঙল পাপিয়ার ডাকে । “কি গো ! সরে এসো – মেয়েটা পড়ছে তো !” 

“পাপিয়া ! সেই টেবল !” বলে সোফায় এসে ধপ করে বসে পড়ল অমিতাভ । পাপিয়ার মনটাও আজ প্রথমবার কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগলো ! ধূর সেও পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি ! কোথাকার একটা স্বপ্ন – অথচ – নাহ, অমিতাভকে আর একবার ডাক্তার ব্যানারজীর কাছে নিয়ে যেতে হবে । 


ডাক্তার ব্যানারজী সব শুনে বললেন “দেখুন – আগেই বলেছিলাম এই রোগ বেড়েই চলে যতক্ষণ না ওনার মন থেকে ঐ বিশ্বাস যাবে । ওষুধ চলুক । সঙ্গে যে জিনিষগুলো থেকে ওনার মনে হচ্ছে স্বপ্ন সত্যি হবে, সেগুলোকে বদলে দিন । তাহলে বিশ্বাসটা ভাঙতে পারে ! “

যতই খরচ হোক বিন্তির ঘরের রঙ বদলে কচি কলা পাতা সবুজ করে দেওয়া হল । পড়ার ঘরের টেবল বাইরের ঘরে চলে এলো । অমিতাভ এখন খানিকটা নিশ্চিন্ত । সুমিতাভরা এলো , দিন দশেক ঘুরে গেলো । কোথা দিয়ে যে এ কটা দিন কেটে গেলো বোঝাই গেলো না । এ কদিন অমিতাভ আর পাপিয়া বিন্তির ঘরে শুয়েছে । অমিতাভ আর স্বপ্ন দেখে নি । পাপিয়া প্রায় ভুলে যেতে বসেছে ব্যাপারটা । যাক বাবা, ওষুধ কাজ করেছে ।

প্রায় ছয় মাস পরের কথা । হঠাত একদিন অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়লো অমিতাভ । অফিস থেকেই হাসপাতালে নিয়ে গেলো । ডাক্তার বলেছেন হঠাত প্রেশার বেড়ে গিয়ে মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক । খবর পেয়ে ছুটে গেলো পাপিয়া ! এখন অন্তত দু সপ্তাহ অবসারভেশনে রাখতে হবে! আবার অ্যাটাক হতে পারে । অমিতাভ ছেলেমানুষের মতো করছে “আমি বাড়ি যাব ! আমি ঠিক হয়ে যাব বাড়ি গেলে ।“ একটু ভুলে থাকার জন্য বাড়ি থেকে অমিতাভর প্রিয় বইগুলো এনে দিয়েছে পাপিয়া । অমিতাভ কিছুতেই রেগুলার ওষুধ খেতে চায় না । ডাক্তার বললেন “উনি নার্সদের কথা শুনছেন না । আপনি থাকুন ওনার সঙ্গে ! ওনাকে একটা সিংগল রুমে শিফট করতে বলছি । ওখানে এক্সট্রা বেড আছে বাড়ির লোক থাকার – খরচ যদিও একটু বেশী ।” শুরু হল পাপিয়ার বাড়ি হাসপাতাল ছোটাছুটি আর টানা পোড়েন । 

তারপর সেই দিন । সকালে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে গেছে নার্স । টেবলে ওষুধের পাতা থেকে প্রেশারের ওষুধ বার করে এগিয়ে দিল পাপিয়া । অমিতাভ হঠাত বলে উঠলো “ঐ তো – ঐ তো সেই হাত ! নাহ, আমি ওষুধ খাবো না !” প্রায় জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিল পাপিয়া ! কোনরকমে ওষুধ গিলেই ঢলে পড়লো অমিতাভ । ম্যাসিভ অ্যাটাক ! সব শেষ ! কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না পাপিয়া ! এতো তাড়াতাড়ি ! হঠাত চোখ পড়লো হাসপাতালের ঘরের দেওয়ালে । দেওয়ালের রঙ আকাশী নীল ! সামনে টেবল । তার ওপর অমিতাভের প্রিয় বইগুলি । তার সামনে ওষুধের পাতা ! বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো পাপিয়া !



tapasripal57@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.