-“ডঃ রায় তোমাকে এতো কথা বলতে বারণ করেছে।”
-“তুই একটু বিষ দে না।”
-“আমি চলে গেলে বা মরে গেলে তোমার অসুবিধা হবে তাই আমিও তোমার সাথে আছি মা।”কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চাহিয়া মাকে উত্তর প্রদান করিল আমোদিনী। দুই সপ্তাহ হইল সে তাহার মহার্ঘ্য চাকুরীটি ছাড়িয়া দিয়াছে। মধ্য ত্রিশ বৎসর তাহার বয়স হইল। প্রচুর অর্থ সে উপার্জন করিয়া সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। পিতার একমাত্র কন্যা হওয়াতে গৃহ আর মোটরগাড়ি তাহার রহিয়াছে।সে এখন অন্যরূপ জীবন যাপন করিতে চাহিতেছে। এমন কিছু সে করিবে যাহাতে সমাজে তাহাকে যাহারা জানে, তাহারা অবাক হইয়া থাকিবে।মায়ের সহিত তাহা লইয়ায় কলহ চলিতেছে। আমোদিনী বিবাহ না করিয়া ‘মা’ হইতে চাহিতেছে। উপযুক্ত সৎ, সৃজনশীল, মানবিক, বুদ্ধিমান,সুস্থ পিতার অন্বেষণ করিতেছে। গর্ভে সন্তান আসিলে তাহাকে সে একা ‘মানুষ’ করিবে।সঙ্কীর্ণতা যেন তাহার মনে কোনভাবে স্থান না পাইতে পারে।নিজে প্রতিদিন শরীরে আর মননে উপযুক্ত হইয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। এই বয়সে ‘মা’ হইতে গেলে নানান প্রকার সমস্যা আসিতে পারে।শহরের সর্বাপেক্ষা দক্ষ প্রসুতি বিশেষজ্ঞের কাছে স্মরনাপন্ন হইয়াছে। কিন্তু তাহার গর্ভধারিণীর পক্ষে এই ‘অদ্ভুত’ ইচ্ছা উন্মাদরোগ ভিন্ন কিছু মনে হইতেছে না। তাহার গুণী কন্যার মস্তিষ্কের এ হেন সমস্যা লইয়া তিনি যারপরনায় দুঃখ আর দুশ্চিন্তায় কাল যাপন করিতেছেন।
আমোদিনী উপযুক্ত কাহাকেও পাইতেছে না। একটি সৎ মানুষের বীজ তাহার লাগিবে। “ বলছি দিদি , এই যে রানা সেনগুপ্ত, হেব্বি দেখতে, স্কলার, ব্যন্ডের লিড গিটারিস্ট ... ফোন নাম্বার টা দিয়ে রাখছি কথা বলুন।” “ না,না... উফ অসহ্য ...অন্য কে অযথা ছোট করে... চলবে না।” “অমর শাসমল... অঙ্কের মাস্টার মশাই...মাটির মানুষ...।”
“সারাক্ষণ অসুস্থ থাকেন তো... না, তাছাড়া আপ্রোচ করবো কি ভাবে, উনি আকাশ থেকে পড়বেন।একটু ইয়াং দেখুন”। “শুভদীপ ঝাঁ... তেইশ বছর... চাবুক শরীর... বুদ্ধিমান... স্ট্রিট চিলড্রেন দের নিয়ে বিরাট কাজ।” আমোদিনী চুপ করিয়া রহিল। ফোন নাম্বার লইল।ফোন করিয়া দেখা করিবার কথা বলিল। ছেলেটি রাজি হইল। একখানি বীজ তাহার লাগিবে। এই কথা কিরূপে চাহিবে, কত টাকা তাহাকে দিতে হইতে পারে এই সকল চিন্তা করিয়া দ্রুত সময় কাটিতে লাগিল আমোদিনীর। সে মা কে আদর করিয়া ঘুম পাড়াইয়া পথে বাহির হইল।যে মিষ্টান্ন বিপনি হইতে এক কালে প্রচুর মিষ্টান্ন সে খাইয়াছে এখন তাহার দিকে সে ফিরিয়াও তাকাইল না। সে ত্যাগ করিয়াছে। তাহাকে শরীর নির্দোষ করিয়া রাখিতে হইবে। দ্রুত পদ চারণা করিয়া বাসস্টপে আসিল। সে নিজ চক্রযান টি গ্রহণ করে না। কষ্ট অভ্যাস করিতেছে। তাহাকে উপযুক্ত ‘মা’ হইতেই হইবে।
শুভদীপ ঝাঁ তাহার পথশিশুদের আশ্রয়টিতে ছোট একখানি ঘরে, একটি চেয়ারে বসিয়া পুরাতন জামাগুলিতে বোতাম লাগাইতে ছিল।নিজে একখানি নিচু টুলে বসিয়া চেয়ার খানিতে আমোদিনী উপবেশন করিতে বলিল। আমোদিনী ইতস্তত করিতেছে। ঘরে আরও দুইটি সদ্য কিশোর রহিয়াছে। একটি শিশু এই উতপ্ত দ্বিপ্রহরে গায়ে চাদর দিয়া ঘুমাইতেছে। সম্ভবত জ্বর হইয়াছে “একটু একা কথা বলা যাবে?” শুভদীপ ঝাঁ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইল, তাহার পর কিশোরদ্বয় কে বলিল বাহিরে গিয়া হাতের লেখা সম্পন্ন করিতে। “আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আপনার কাছে চাইতে এসেছি। একটু মন দিয়ে শুনে নিয়ে তারপর মতামত দেবেন।” শুভদীপ ঝাঁ তাহার দৃষ্টি সোজা করিয়া আমোদিনীর দিকে তাকাইল।আমোদিনী তাহার উচ্চপদের হেতু বহুকাল হইতে পুরুষের চোখে চোখ রাখিয়া বহু কাজ করিয়াছে। কিন্তু আজ তাহার অস্বস্তি হইতেছে। “ আমি ‘মা’ হতে চাই বুঝলেন।মানে বিয়ে থাওয়া করি নি। কিন্তু ‘মা’ হতে চাই। তাই আপনার একটা সাহায্য চাইছিলাম।” শুভদীপ ঝাঁ উল্লাস করিয়া উঠিল, “আপনি নেবেন। আপনার মতো মানুষ রা আছে বলে এখনো পৃথিবী সুন্দর। কেমন বাচ্চা চাইছেন বলুন। আমার কাছে দেড় বছর থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত আছে।” “ না না আপনি বুঝছেন না। আমি গর্ভে ধারণ করতে চাই। আমি জানি আপনি খুব সৎ আর এনারজেটিক। আপনি যদি স্পার্ম ডোনেট করেন ... তাহলে খুব ভালো হয়।” শুভদীপ ঝাঁ বিস্ফোরিত দৃষ্টি তে আমোদিনীর দিকে নিবিষ্ট হইয়া গেল। সে শান্ত অথচ রাগত স্বরে কহিল, “ আপনি কি পাগল। আপনার সামান্য সভ্যতা টুকু নেই। এতো বাচ্চা না খেতে পেয়ে, আশ্রয় না পেয়ে, কি কষ্টে বেঁচে আছে আর আপনি আমার ইয়ে চাইতে এসেছেন। মজা মারছেন। আপনি মানুষ? আর আপনার সেই বাচ্চা আপনার মত স্বার্থপর একটা অদ্ভুত জীব হবে। আপনাদের এতো টাকা...... একটা বাচ্চা কে আডপ্ট করলে হয় না। নিজের চাই... ন্যাকা ” ইহার সহিত শুভদীপ ঝাঁ ঘোরতর কিছু গালি দিল। সোজা হইয়া দাঁড়াইল তাহার পর স্থান ত্যাগ করিতে বলিল। আমোদিনী মাথা নিচু করিয়া বাহিরে আসিল। বাহিরে শিশুগুলি তাহার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লইয়া তাকাইয়া আছে। সে ধীর পায়ে হাঁটিতে লাগিল। গ্রিলের গেট টি ঠেলিয়া বাহিরে চলিয়া যাইবার সময় কি মনে হইল সে ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিল।
অবাক হইয়া দেখিল, মাত্র তেইশ বছরের এক যুবা সদ্য জাগ্রত শিশুটিকে কোলে করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, আর তার চারপাশে একরাশ শিশু। সকলে তাহার গমনের যাত্রা পথের দিকে তাকাইয়া আছে। আমোদিনী ফিরিবার সময় মিষ্টান্ন কিনিল।আমোদিনীর মার শরীর টি কিঞ্চিৎ ভালো আছে। আমোদিনী বহুকাল পরে এক সাথে চারটি রসগোল্লা খাইল। তাহার ঘুম আসিতেছে। ঘুমের মধ্যে দেখিল তাহার বিরাট গর্ভ হইয়াছে। ডাক্তার বলিতেছে, “আপনার দুটো বাচ্চা হবে।”
শুভদীপ ঝাঁর নিকট একটি ফোন আসিল,“ আমি আমোদিনী সরকার বলছি। ফোন নামাবেন না। আমি বাচ্চা গুলোর মা না হয়ে যদি বাবা হই? মানে আমার বাবার একটি বড় বাড়ি আছে। সেটাতে সব বাচ্চা নিয়ে আপনি চলে আসুন। ছোট একটু উঠোন আছে। ওরা খেলতে পারবে। আর খাওয়া পড়াশানার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। এটা না বলবেন না। আপনি ওদের মায়ের মতন যত্ন করবেন।” আমোদিনীর মা আজ খুব আনন্দে রহিয়াছেন। কন্যা পুনরায় চাকুরী করিতে যাইবে। আর কাহারা যেন এখন হইতে তাঁহার বাড়িতে আসিয়া থাকিবে। তাহারা আসিলে তাঁকে আর একাকী থাকিতে হইবে না।
সুচিন্তিত মতামত দিন