ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলোর মত মেঘ সারা আকাশ জুড়ে। তারাগুলো মাঝে মাঝে জ্বলছে, নিবছে, ঠিক নিয়ন আলোর মত। কোথাও কি বৃষ্টি হচ্ছে? একটা ঠান্ডাবাতাস থেকে থেকে বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের গুমোটের পর ভাল লাগছিল এই বাতাস। আকাশেও অল্প অল্প মেঘ। মাঝে মাঝে তারা দেখা যাচ্ছে, আবার আড়ালে চলে যাচ্ছে। যদিও তারারা নিয়ন আলো নয়। কিন্তু নয়ই বা কেন! এক একটা তারা কত লক্ষ লক্ষ গুণ নিয়ন আলোর সমষ্টি...সন্ধ্যা-রাত্রির মাঝামাঝি বাগানের মাটিতে ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছিল সুবোধ।
আজ আর বকুলরা এলো না। বকুল, তার দাদা মৃদুল আর রমেশের আসার কথা ছিল আজ। রমেশ হয়ত খুব শিঘ্রি বিয়ে করবে বকুলকে, দেখে শুনে সেইরকমই মনে হয়। করুক, ছেলে হিসাবে রমেশ খারাপ নয়। মাঝারি মাপের একটা চাকরি আছে, নিজের স্ত্রীকে খেতে পরতে দেবার মত ক্ষমতা সে রাখে। বাড়িটাও পৈতৃক। তাহলে আর অসুবিধে কোথায়? বাকি যা টুকটাক অসুবিধে, সে কোন সংসারেই না আছে? বকুল বুদ্ধিমতী মেয়ে, ওটুকু মানিয়ে নেবে। বকুল সম্বন্ধে ভাবনাটুকু যেন সেরে রাখল সুবোধ। একটা সময় বকুল তার কাছাকাছি এসেছিল। বকুল এসেছিল, না সে নিজে বকুলের কাছে গিয়েছিল আজ আর মনে করতে পারে না সুবোধ। তখন বড় অস্থির সময়। মা মারা গেছে, দাদাও হঠাৎ করে...। মায়ের যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায়। বড় রোগে আক্রান্ত রোগীকে সারানোর ক্ষমতা সেসময় সুবোধের ছিল না। তখন মৃদুলই একটা হাসপাতালের খোঁজ এনে দিয়েছিল। টাকা পয়সা হয়ত কিছু লাগত, কিন্তু কিভাবে যেন মৃদুল সেটার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। সুবোধও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কিছুটা চিকিৎসা তো হবে! আর কিছু না হোক ব্যথা কমাবার ওষুধটাও তো পাওয়া যাবে, হঠাৎ হঠাৎ মায়ের যন্ত্রণার চীৎকারটা কানে এসে লাগবে না। মা তারপর খুব বেশিদিন আর ছিল না, কয়েকমাস পরেই চলে গেল। শুধু যাবার সময় ...কি অদ্ভুত শান্ত আর নিরাসক্ত মায়ের মুখ! মায়ের সেই মুখখানা একবার মনে করার চেষ্টা করল সুবোধ। বুকের ঠিক মধ্যিখানে একটা বল যেন গড়িয়ে গেল এতদিন পরেও। মা চলে গেছে আজ প্রায় সাত বছর। দাদার চলে যাওয়াও সাত বছর হল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যাবার দিন সুবোধের কানে কানে মা বলে গিয়েছিল, বকুলকে মায়ের ভাল লেগেছে। অবাক হয়েছিল সেদিন সে। মা কি তার বিয়ে, ঘর-সংসার এসবের ইঙ্গিত দিয়ে গেল? তখন কোথায় কি! শুধু হাসপাতালের সূত্রে, মায়ের রোগ-বালাইয়ের কারণে মৃদুল, বকুলের এ বাড়িতে আসা-যাওয়া ঘটছে, বাড়ছে। মা কি কিছু বুঝতে পেরেছিল? অথচ, তার নিজের বকুলকে ধরে রাখার মত ক্ষমতা হল কই! হাতটা একবার কপালে বুলিয়ে নিয়ে আবার আকাশের দিকে চেয়ে রইল সুবোধ। না, ভুল হল। ক্ষমতা ছিল, ইচ্ছেটা ছিল না। এক বিকেলে দাদা চলে গেলে তার নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই চলে গেল। তারও পরে মালিনী...বকুল কি জানে এসব, বুঝতে পেরেছিল!
সন্ধ্যাবেলার চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই তখন থেকেই। বকুলরা আর আসেনি। সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলে সুবোধ বুঝেছিল বকুলরা আসবে না। একবার মৃদুলকে ফোন করার কথা ভেবেছিল, করেনি। তাদের যদি আসার প্রয়োজন না থাকে, অনর্থক ডেকে এনে অসুবিধেয় ফেলার কোন যুক্তি নেই। সে তা করবে না। রাতে খাবার ইচ্ছেও খুব একটা ছিল না। মেনকাদি, তার রান্না ও কাজের মহিলাটিকে ডেকে বলেছিল খাবার করার দরকার নেই। মেনকাদি কি বুঝেছিল সে জানে না। যাবার সময় জানিয়ে গেল, খাবার টেবিলে রুটি আর তরকারি ঢাকা দিয়ে রাখা আছে, দাদা যেন খেয়ে নেয়।
রাত এখন গভীর। খাবে না মনে করেও কিছুক্ষণ আগে সে খাবারের ঢাকা খুলে একটা রুটি, কিছু একটা তরকারি, যা সে না বুঝেই খেয়েছে আর মিষ্টি রাখা ছিল বাটিতে সেখান থেকে ভেঙ্গে অল্প একটু মুখে দিয়েই জল খেয়ে শুয়ে পড়েছে। ক্লান্তি লাগছিল। সারাদিনের অপেক্ষা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। কার জন্য অপেক্ষা করেছিল সে, বকুল? বকুল এলনা কেন, তাকে এড়িয়ে যেতে চায়? এসবের জন্য দাদাই কি দায়ী নয়? দাদা, নাকি সে নিজে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্লান্ত, অবসন্ন সুবোধ ঘুমোবার চেষ্টা করল।
#
ট্রেনটা ষ্টেশনের খুব কাছে এসে পড়েছে। সুবোধ অনর্থক এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। এসে পড়ল ট্রেন, ছেড়েও দিল। ধরতে পারল না সুবোধ। সে ছুটছে, ছুটছে...ছুটছে...চারিদিকে পাহাড়, ছোট ছোট টিলা। তার ভিতর দিয়ে রাস্তা......সে ছুটছে। ট্রেন ষ্টেশনের আওতা থেকে বেরিয়ে গেলেও সে ছুটছে। সামনে একটা গভীর গর্ত, ছুটতে গিয়ে পড়ে গেল তার মধ্যে। সুবোধ চীৎকার করে ডাকছে কাউকে। খালি শুনশান ষ্টেশন, একটাও লোক নেই, খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। ভয় পেল সুবোধ। ভয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সে ডাকছে, যদি কেউ শুনতে পায়! নিজের গলার চীৎকারে নিজেরই ঘুম ভাঙ্গল। স্বপ্ন দেখছিল সে। সারাগায়ে বৃষ্টির দানার মত ঘাম, সুধাময় ভয় পেয়েছে। অবাক হল সুবোধ...এই একই স্বপ্ন সে আগে রোজ দেখত...রোজ। এতদিন পর আজ আবার দেখল কেন? দাদা আজও তাকে মালিনীর খোঁজ করতে বলেছে সেই আগের মত। দাদা এসেছে এভাবেই কতবার ঘুমের মধ্যে। আসত আর বলত, মালিনীর খোঁজ নিস। কিন্তু মালিনী তো অনেক পরে...তারও আগে দাদার চলে যাওয়া।
সেদিনও সকাল থেকে বৃষ্টি। দুপুরে একবার ধরেছিল কিছুক্ষণের জন্য, বিকেল থেকে আবার নামল। সুধাময় তখন একটা অফিসে চাকরি করে। তেমন কিছু বড় অফিস নয়, ছোটখাটো অফিস,কর্মচারীও খুব বেশী নয়। সুধাময়ের নিজের চাহিদা খুব বেশী ছিল না, মাসের শেষে যা পেত তাতেই সন্তুষ্ট ছিল সে। দাদা কি করে যেন একটা ভাল চাকরি যোগাড় করেছিল, ভাল মাইনে পেত। আগে যদি এই চাকরিটা পেত, মায়ের জন্য মৃদুলদের কাছে হাত পাততে হত না, অত চিন্তাও করতে হত না। দাদা চলে গেলে একরকম তার অফিস থেকে পাওয়া টাকাতেই সুবোধের এখনকার জীবন চলছে। চাকরি করতে আর ভাল লাগে না। দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা তার এখন আছে, হয়েছে।
বিকেলে আবার বৃষ্টিটা শুরু হতেই অফিস থেকে বাড়ি চলে এসেছিল সে। বাড়ি ফিরে দেখল দাদাও অফিস থেকে ফিরে এসেছে। অবাক হল। দাদা তো অফিস কামাই করে তার মত বাড়িতে বসে থাকার লোক নয়। মেনকাদি পুরনো লোক, তখনও ছিল এবাড়িতে। জিজ্ঞেস করতেই বলল—বড়দা খোঁজ করছিলেন। সুবোধ দাদার ঘরে আসতেই মনোময় বিছানায় বসে কিছু একটা বলতে যাবে, বিছানাতেই শুয়ে পড়ল। কি হল, কি হয়েছে...মেনকাদিকে ডাকাডাকির মধ্যেই যেন চলে যাবার মুখে। সুবোধ তখন চীৎকার করে ডাকছে মনোময়কে, ঝাঁকাচ্ছে তার দুই হাত ধরে। তবে কি শরীর খারাপ হওয়াতেই অফিস থেকে চলে এসেছিল? একটা কথাই বলতে পেরেছিল মনোময়... মালিনী, হিল রোড... পোষ্ট...দেখিস।‘ আর বলতে পারেনি। জলজ্যান্ত একটা মানুষ, যে কিনা তার নিজের দাদা, মা চলে যাবার মাসখানেকের মধ্যেই তাকে একা রেখে দিয়ে চলে গেল। এই ঘটনায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল সুবোধ। নিজের উপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শুধু এই একটাই স্বপ্ন বারবার তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যেত। কোথায় নিয়ে যেত সে জানত না, বুঝত না। স্বপ্নের গর্তে পড়ে গেলে তার ঘুম ভাঙ্গত নিজের চীৎকারে, সে সারা গায়ে বৃষ্টিদানা নিয়ে বিছানায় উঠে বসত। দুহাতে মাথা চেপে ধরে চীৎকার করত। সেদিন কেবলমাত্র রান্নার দিদি মেনকাদি, তার মায়ের চেয়েও বেশী মমতায় আঁকড়ে ধরেছিল সুবোধকে, বাঁচিয়েছিল তাকে।
অনেকদিন পর তার স্বপ্নের মানে সে খুঁজে পেয়েছিল। দাদার বলে যাওয়া হিল রোড, যেখানে উঁচুনিচু রাস্তা তার স্বপ্নে পাহাড় হয়ে দেখা দিত। ট্রেন ধরতে গিয়ে না ধরতে পারা তার জীবনের অক্ষমতাকে মনে করিয়ে দিত। এক সময়ের ভরা সংসার এখন শূন্য...খালি...তাই সে ওইরকম খালি শূন্য স্টেশন দেখত। সে শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই শূন্যতাকে পেরিয়ে যাবার। না পেরে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে গর্তের মধ্যে পড়ে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত।
অনেক দিন পর তার এক বন্ধু তাকে এইরকম বুঝিয়েছিল। যখন বোঝাল, তখন সে মালিনীর দেখা পেয়েছে। হিল রোডে পোষ্টাপিসের পাশে শ্যামাচরণ মাষ্টারের মেয়ে মালিনী শান্ত, সুশ্রী একটি মেয়ে, যে হাঁটতে পারে না। তার এক পা ছোট, হাঁটতে গেলে একদিক ঝুঁকে যায়, মুখের অভিব্যক্তি যা হয়, সেদিকে তাকানো যায় না। নুয়ে পড়ে শরীরের একদিক। তাই বাড়িতে হাঁটাচলা করলেও কারো সামনে সে হাঁটে না, বসে থাকে চেয়ারে। বাড়িতে বসেই কিছু ছেলেমেয়েকে পড়ায়। দাদার সঙ্গে মালিনীর কি সম্পর্ক ছিল সে জানে না, জানতে চায়নি কোনদিন। শুধু মালিনী কাছে আসার পর বকুল কি করে যেন দূরে সরে গেছে। স্বেচ্ছায়, নাকি সুবোধের কারণে তাও সে জানে না।
মালিনী এখন সুবোধের আকাশে সেই তারা যার সান্নিধ্যে কখনও সুবোধের বুক আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে, কখনও তার দুঃখে কাতর হয়...ঠিক নিয়ন আলোর মত কখনও জ্বলে, কখনও নিভে আসে।
ভালবাসা বড় অদ্ভুত, কখন যে কাকে, কিভাবে দেখা দেয়, সেই শুধু জানে!
chatterjee.jharna@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন