জয়া চৌধুরী

আজাইরা বাজার কথন ১২ জয়া উবাচ/

বা
জারী কথা শব্দদুটোকে লোকে যে কেন গালাগাল মনে করে বুঝি না বাপু। তাকিয়ে দেখুন বাজার কোথায় নেই! সবজায়গায় স্রেফ দেওয়া এবং নেওয়ার হিসেব। নয় কি? হ্যাঁ এটা বলতে পারেন সব দেওয়া নেওয়ায় অর্থ জড়িয়ে নেই তাই একে বাজার বলা যাবে না। কী জানি হবে হয়ত। দার্শনিক কথা ছাড়ুন আজ বরং নিমগাছের কথা বলি। নিমগাছের গুণপনা নিয়ে বলতে বসি নি । সে এক লম্বা কাহিনী। জানি জানি ভেপ্পাম্পু চারু রসমের কথা শুনতে চাইবেন আপনারা। এ হল গে তামিল নববর্ষের আবশ্যকীয় ডিশ। বাঙালিদের নিম বেগুনের গল্প তো অনেক করলেন। গরমকালে খেয়ে খেয়ে হদ্দও হয়েছেন জানি। বাঙালিদের মত খাই খাই আর কারাই বা! মজা করলাম বটে তবে খাবার শুরুতে নিম বেগুন ও অমৃতের বিশেষ তফাত আছে বলেও জানি না। এ হল ভেপ্পাম্পু চারু রসমের কথা। নিম গাছের ফুল দেখে চিরটাকাল নজরুলের সেই গান মনে মনে গুনগুনিয়েছেন নির্ঘাত। সেই যে “নিমফুলের মৌ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা” গানটার কথাই বলছি আর কি। সেই ফুল যে খাওয়া যায় তেমন নিষ্ঠুর বাঙালিদের কেউ বলতে আসুক দেখি! বরং সে কাজ তামিলরা নিয়েছেন। এটি তাদেরই অত্যন্ত চালু পেয়। এমনকী নামটিও দেখুন- চারু রসম। কতখানি শ্রদ্ধা মিশে আছে এই পদটিতে! আজ্ঞে না এই লেখা পাক প্রণালী নিয়ে নয়। বরং এ হেন নিমগাছ একটি আছে আমাদের বাড়িতে। নো কোনো প্যাথোজ নয়। মানে বনফুলের নিমগাছ গল্পের সেই বউটির মত কোন স্যাড ঘটনা ঘটেনি কোনদিন। বরং গোটা পাড়ার একক মালিকানার বাড়িগুলি যখন একের পর এক হাতছাড়া করে দিচ্ছিল পাড়ার লোকেরা, যখন একটার পর একটা বৃক্ষ কেটে ফর্দাফাই করতে করতে পাঁচের বদলে পাঁচ হাজার মানুষ থাকার পাকাপাকি কবর খুঁড়ছিল প্রোমোটারেরা, আমরাই বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলাম এই নিমগাছটাকে। কেননা ছোট থেকেই বাবা নিমের গুণাগুণ বলে বলে এমন মর্মে গেঁথে দিয়েছিল আমাদের যে কালের সঙ্গে সঙ্গে বাকী সব বৃক্ষ কাটতে হলেও নিম আগলে রেখেছি। সেও অবিশ্যি আগলে রাখে আমাদের। সে শুধু আমার টাইফয়েড নয়, বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের বুড়ো জোয়ানের যাবতীয় অসুখবিসুখে কেবল দিয়ে গেছে আমাদের। হ্যাঁ পাতা ঝরার মরসুমে নাকালও করে যায় খুউউব। জানেন তো নিম কিন্তু খরারও বিরুদ্ধে খুব লড়াকু গাছ। কাজেই গ্রীষ্ম নয় ওকে কাবু করে শীত। সব পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া করে দেয় ওকে আর নিজের বাড়ির বাগানে আস্তরণ পরে যায় দুই ফুট উঁচু। সেখানে তখন আবার বেজী বেড়াল ইঁদুর ছুঁচো ইত্যাদির পোয়াবারো। এমনিতেও এ বাড়িতে কাক চড়ুই শালিক দোয়েল এমনকী টুনটুনিরও অবাধ গতায়াত। গাছের পাকা পেঁপে বা পেয়ারায় মুখ ডুবিয়ে যখন তেনারা স্যুপ খাবার মত করে খায় সে দৃশ্য বড্ড নয়নাভিরাম। দূষণময় এই শহরে এ আমার ভাগ্যই বটে। কিন্তু তাই বলে সাপ কমলো তো বেজী জ্বালাবে! কাঁহাতক আর ইঁদুরের গু পরিষ্কার করা যায় নিত্যিদিন। এই দেখুন “গু” এর মত ডিকশনারী বহির্ভূত শব্দ ব্যবহার করলাম। তাঁর চে ‘পটি’ বললে কি ভাল হত? আজকাল মুখে দেখি সকলেই এ শব্দ ব্যবহার করে। আমি কিন্তু মোটেই রাজী নই এ আচরণে। বিজাতীয় শব্দে প্রকাশ করলেই কি ‘গু’ এর ‘গন্ধ’ ফুলে বদলে যাবে? তাহলে আমিও স্প্যানিশে ‘মিয়েরদা’ বলতে পারি। তাহলেই বেশ গ্রাম্ভারী হয়ে যাবে। যাক গে যাক, বলছিলাম নিমগাছের কথা। তো সেটি এত বড় হয়ে গেছল যে দাড়িগোঁফ কেটে দেওয়া আবশ্যিক হয়ে পড়াতে পুরসভাকে খবর দিতে হল। দেখুন সাধারণ মানুষ হবার অনেক জ্বালা। গাছ কাটতে চাইলে লোক না ডাকলেও চলত। গাছের গোড়ায় কটি বিষ ইঞ্জেকশন দিলে অচিরেই পাতা ঝরে যেত সব। তারপর কঙ্কাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত যখন তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুচ করে কেটে নিলেই বৃক্ষময় অনুন্নয়ন সাফ। এবার উন্নয়ন শুরু। ঠিক যেমনি হয়ে চলেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সেরকম তো হবার নয়। অতএব পুরসভা ডাকা। 

বেশ পুলক হচ্ছিল জানেন? ওরা যখন কুঠার দা বেলচা দড়ি নিয়ে এল তখন বেশ আনন্দ হচ্ছিল গাছে চড়া দেখতে পাব বলে। সেই ছোটবেলায় দিদি চরত দেখতাম । সে আমার মত নক্কী ছিল না , ল্যাজ একটা তার বাল্যকাল থেকেই ছিল। তো তারপর আর এ দৃশ্য চোখে পরার সুযোগ হয় নি। কাঠুরে এসেই কোমরে দড়ি বেধে কাঠবেড়ালির মত তরতর করে উঠে গেল আর তার পরেই কাজ শুরু। সে এক মহাযজ্ঞ বাড়িতে । হই চই খট খট করে গাছের ডাল ছাঁটা, কাটা, আর কেটে লগ বানানো, উঠোনের একপাশে জড় করা। সঙ্গীটি কাজ সামলে উঠতে পারছিল না। গাছ তো শুধু নিম নয় আরও বেশ কটি। কিন্তু নিমের আভিজাত্যই আলাদা। চোখের সামনে ডালের গায়ে কোপ দিয়ে যখন টুকরো করছিল সামনে বসে হাঁ হয়ে গেলাম ডালের ভেতরকার রঙ দেখে। একবারে টকটকে লাল একটা আস্তরণ ছালের ঠিক নিচে। কত কাঠ কাটতে দেখি, কিন্তু কোন গাছের ছালের তলায় মানুষের হিমোগ্লোবিনের মত রক্ত রঙ দেখি নি! কাঠুরের সঙ্গীটি আমায় পরিপাটি করে নানান কথা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। এই ছাল ভিজিয়ে নাকি খাওয়া হয়। আর খেলে একেবারে মৃত সঞ্জীবনী। পরদিন ভোরে সেকথা মনে পড়তেই টুক করে জড় করা লগির মাঝ থেকে কটি তুলে এনে রেখে দিলাম। মরিতে কে চাহে আর এ- জঞ্জাল জীবনে! আখের খোসা ছাড়ানোর মত করে ছাল ছাড়িয়ে রাখব একদিন। গাছ কাটার বার্তা ক্রমে রটি গেল পাড়ায়। দলে দলে লোক এসে ভিড় করল দুয়ারে। কাহারো পাতা চাই সংরক্ষণ করে রাখবেন। অসময়ে ভেজে খাবেন। কেউ বা বাড়ির অসুখে ডালপালা নিলেন। আমি নিজেও তো আলমারীর বইয়ের তাকে পাতা সুদ্ধ ডাল গুঁজে রাখতে সরিয়ে রাখলাম কটি। আমাদের বাড়িতে এ উপায়েই বরাবর পুস্তক সংরক্ষণ হয়। মায়ের নিত্যিদিনের চানের জন্য আয়া মেয়েটি পাতা নিয়ে রাখল। পরে পাতা গজাতে গজাতে শীত শেষ হয়ে যাবে তো। তদ্দিন কাজ চালাবে কী করে! এমনকী দেখলাম কাজের ফাঁকে বৃন্দা এসে টুক করে কটি কচি ডাল নিয়ে গেল দাঁতের ব্রাশ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে। এমনকী এক ফাঁকে একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম, দেখি জঞ্জালের গাড়িতে রাখা ডালপালার স্তূপের সামনে বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতিবেশী বিজ্ঞানী গিন্নি। জিজ্ঞেস করতেই বললেন কিছু ডাল নিতাম কিন্তু এ তো দেখছি কাজ শেষ হয়ে এল। আমি সানন্দে বাগান থেকে কুড়িয়ে দিলাম কিছু তাকেও। একটি বৃক্ষ তো শুধু কাঠ ও পাতার দানে ধনী নয় তার সবটুকুই যে মানুষের কাজে লাগছে দেখে মন ভরে গেল। স্তূপাকৃতি জঞ্জাল সাফাইয়ে আরো লোক লাগত। দেখি হুড়দুড় করে ৬/৭ জন চলে এল। তাদের সবাইকে নয় রাখা হল আরো দুজনকে যাতে তারা গোটা প্রক্রিয়াটায় সাহায্য করে। মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেল। বেকারীত্ব এতই প্রবল যে যে কাজে দুজন লাগে সে কাজের প্রার্থী ছয়জন। তাও আবার একশ দিনের কাজ। অর্থাৎ বাকী ২৬৫ দিনের কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই। এরপরে কী করে বরাবরকার মতই বাগানে জঞ্জাল ফেলার গর্ত খোঁড়া হল, পাতা পরিষ্কার হল, মায় চারধারে ব্লিচিং ছড়ানো হল এসবও কী আজাইরা লেখার বিষয়! রোজ রোজ লিখতে হলে এসবও পড়তে হবে গো পাঠক। 

ঝকঝকে পরিষ্কার বাগানটায় যখন শীতের রোদ এসে আলোময় করে দিচ্ছিল, বেল গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখছিলাম সন্ধ্যামালতীটাকে। ওর কি ভাল লাগছে এত আলো পেয়ে? ফুল নাহয় আলো মরে এলে উপহার দেয় সে, কিন্তু শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে আর গর্ভবতী হতে ওরও তো সূর্যকে প্রয়োজন, নারীর যেমন প্রয়োজন পুরুষকে।


jayakc2004@yahoo.co.in

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.