চেনা ঘরবাড়ি ছেড়ে চেনা রাস্তা দিয়ে একটা ঠেলা গাড়ি চলেছে। গাড়ির ভিতর বাসনপত্র, জামা –কাপড়ের পুটুলি , তোষক –বিছানা পত্র আরো দৈনন্দিন জীবনের কত শত টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র । জিনিস পত্রের দিকে তাকালেই যে পরিবারের জিনিস পত্র যাচ্ছে তার আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটা প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। গাড়ির পিছনে যারা যাচ্ছেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা এই পরিবারের সদস্য – স্বামী -স্ত্রী । পিছনে একটি ছেলে ও মেয়ে। একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙ্গে। মিনতি দেখে আশেপাশে চলন্ত ট্রেনে ঘুমন্ত সব মানুষজন। সেও বোধ হয় ঘুমিয়ে পরেছিল।
চোখে এখনো লেগে আছে সদ্য দেখা স্বপ্ন। স্বপ্ন নাকি তার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কয়েকমাস পর পর এক ভাড়া বাড়ি থেকে অন্য ভাড়া বাড়ি যাওয়া আবার সেই বাড়ি থেকে অন্য আরেক ভাড়া বাড়িতে কয়েক মাস পর আসা – এতো তার লেগেই থাকে। এখন সে চলেছে ক্যানিং থেকে নরেন্দ্রপুর । রোজ সকালে প্রথম ট্রেন ধরে চলে আসে নরেন্দ্রপুর । সেখানে এক আবাসনে বারোটি ফ্ল্যাটে কাজ করে। সেই টাকায় তার সংসার চলে। ছেলে- মেয়ের স্কুল , বরের হম্বি- তম্বি সবই মিনতির রোজগারের টাকায়। কাক ভোরে রান্না করে সে বাড়ি থেকে বেরোয়। বিকেল চারটে নাগাদ ছুটতে ছুটতে সব কাজ শেষ করে সে বাড়ির পথে পা বাড়ায় । রোজই তার ফিরতে রাত হয় । বর তখন মদের নেশায় চিৎকার করে পাড়া কাঁপিয়ে বিঁড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলে ওঠে, “ কোন ভদ্দর বাড়ির বউ এত রাত অব্ধি বাড়ির বাইরে থাকে। পরের দিন দেরী করে এলে বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব এই আমি বলে দিলাম” । যদিও বিড়ি আর মদের টাকা আসে মিনতির রোজগার থেকে তবু ও মিনতি চুপ করে থাকে । শাড়ি পালটে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার বাসনপত্র মাজতে বসে। ক্লাস ফাইভে পড়া তার ছোট্ট মেয়ে সংসারের অনেক কাজ করে দেয়। মিনতি জল তুলে আর রান্না করে ট্রেন ধরতে সেই ভোর বেলায় ছোটে। মেয়েটা সকালে বিছানা তোলে, কাপড় কাঁচে আরও বাড়ির কত শত কাজ করে। তারপর খেয়ে স্কুলে যায়। বাড়ি ফিরে রাতের খাবার করে। পড়তে বসে। মেয়েটার পড়াশুনোর মাথা ভালো কিন্তু কতদূর সে পড়াতে পারবে কে জানে ? বাপের রোজগারের ঠিক নেই। আর বাপতো এখন থেকে বিয়ে বিয়ে করছে। কিন্তু মিনতি সেটা হতে দেবে না। সে মেয়ে কে পড়াবে। ছেলের দ্বারা পড়াশুনো হবেনা সে বুঝে গেছে। এক ক্লাসে দুবারের কম থাকে না ছেলে । বাপের মত সেও আড্ডাবাজ হয়েছে। ফেল করে নাইনে পড়া ছেলে এখনি বলে মোবাইল কিনে দিতে , না হলে বন্ধুতের কাছে তার মান সম্মান থাকছে না । এই সব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সব কাজ শেষ হয়, চোখের জল মুছে সে শুতে যায়।
একটা সুন্দর ছোট্ট টালির বাড়ি। জানলায় সুন্দর পর্দা। একটি ছেলে মেয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে মনে হয়, স্কুলে যাচ্ছে। বাড়ির পিছনে এক ফালি সুন্দর বাগান। সেখানে যেমন টগর গাছ আছে সেরকম আছে পেয়ারা থেকে সব্জির গাছ। ঘরের ভিতর এক মহিলা রান্নায় ব্যস্ত। খুব সম্ভব বাড়ির কর্তা কাজে যাবেন, খেতে বসেছেন। ব্যস্ত হাতে ডাল দিয়ে ভাত মাখছেন। মহিলাটি একটি মাছ ভাজা নিয়ে এগিয়ে আসেন।
দূরে কোথাও অনেক মানুষের আওয়াজ। মিনতির ঘুম ভেঙ্গে যায়। আওয়াজ শুনে বোঝে জল এসে গেছে। বালতি, কলসি হাতে লোকজন বেরিয়েও পরেছে। মিনতির ইচ্ছে করছে না এতক্ষণ যে সুন্দর ছবির মত স্বপ্ন দেখছিল সেই স্বপ্নকে ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে পা দিতে। সে বাবুদের বাড়ি ঘর পরিষ্কার করতে করতে মাঝে মাঝেই ভাবে, তারও তো ছোট্ট একটা ঘর হতে পারতো। মার্বেলের চাই না টালির ঘর হলেই হত। নিজেদের ঘর হলে কিছুদিন পরপর তাদের সংসার কে ঠেলা গাড়ির উপর চাপিয়ে অন্য আস্তানায় ছুটতে হত না। আর তার ইচ্ছে তিনতলার সেই ফ্ল্যাট বাড়ির লোকজনের মত তার বাড়ির সবাই যেন হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর সে তাঁদের বাড়ি কাজ করছে কিন্তু কোনদিন কোনো চিৎকার চেঁচামেচি শোনেনি। বাড়ির চার দেওয়াল থেকে যেন শান্তি চুইয়ে পরছে- এই সব ভাবতে ভাবতে বালতি হাতে সে জল আনতে চলে।
indranisamaddar5@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন