পর্ব - ৩
প্রতিদিন ফিলাডেলফিয়ার পথে বেরোই,পায়ে হেঁটে পথ চলা শুরু হয়। আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, লেখবার রসদ নিয়ে ঘরে ফিরি। কত বিচিত্র মানুষের সমাগম এই আমেরিকা। এ পাড়ায় কৃষ্ণাঙ্গ আর হিজাবী অভিবাসীদের সংখ্যাই বেশী । আর ট্যুরিষ্টস্পটে বিচিত্র মানুষজনের সমাগম। কি রকমারী তাদের বেশভূষা, চালচলন, হাবভাব, কথাবর্তার ভঙ্গী। এদের দেখলে মনে হয় জীবনে কোনো টেনশন নেই বুঝি। জীবন শুধুমাত্র কাজ আর হ্যাঙ-আউট সর্বস্বতায় ভরা। বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া, দেদার ফূর্তিফার্তা আর অনাবিল প্রাণপ্রাচুর্য এ টৈটুম্বুর এদের জীবনের প্রতিটি পল, অণুপল। পরক্ষণেই নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠি, এপারেই সব সুখ আছে...এ ধারণা ভুল। অতএব আবারো ভ্রমি বিস্ময়ে।
আমেরিকার মাটীতে প্রথম পা রেখেছিলাম ১৯৮৯ সালে। এক একটি রাজ্যের এক একটি শহর এক এক রকম। প্রাচীন শহরগুলি বেশ আটপৌরে। আর নতুনগুলোয় শপিং মলের গন্ধ, ব্র্যান্ডেড দোকানপাটের আভিজাত্য। তবে এতগুলো বছর পরেও মনে হল পাল্টায়নি সে বাতাবরণ। সেই ডানকিন ডোনাটস, ওয়েন্ডিজ, ম্যাকডোনাল্ডস, কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন, ট্যাকো বেল, সেভেন-ইলেভেন সব ছিল যেমনটি, ঠিক তেমনি রয়েছে নিজের নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে। রিয়েল এস্টেটের রমরমা তেমনি রয়েছে। ফুটপাথ বেঁধে দিয়ে রাস্তা তৈরী তেমনি হয়ে চলেছে। নতুন নতুন ফ্লাইওভার, নতুন মডেলের গাড়ি...আমেরিকার সেই ট্র্যাডিশান তেমনি চলেছে তার ঠাট ঠমক নিয়ে।
ফিলির ইউনিভারসিটি পাড়ার রাস্তাগুলির নাম চমত্কার। ওয়ালনাট স্ট্রীট, চেস্টনাট স্ট্রীট, স্প্রুউস স্ট্রীট, লোকাস্ট স্ত্রীট। অনবরত গাড়ী চলছে ট্রাফিক লাইট মেনে। স্টুডেন্টরাও কলকল করে ক্লাস সেরে ঘরে ফিরছে। কেউ লাইব্রেরীর পথে, কেউ কফিশপে। কেউ বা কলেজের মাঠেই পড়ন্ত রোদে কাঠের চেয়ারে মেতে উঠেছে আড্ডায়।
ছেলে বলল. ফল্ অর্থাত পর্ণমোচনের মূহুর্তে এই এভিনিউ গুলির ফ্লোরেসেন্ট সবুজ রঙে আগুণ লাগা সৌন্দর্য এর কথা। আগুণ মানে আগুণ রঙে তখন সেজে ওঠে আশপাশ। অপরূপ দৃশ্য হয় তখন। এ হল আমাদের হেমন্তকাল। জীর্ণপাতা ঝরার বেলায় প্রকৃতির আরেকবার জ্বলে ওঠা, সেজে ওঠার সময়। আমেরিকায় এই সময় কে বলে ফল। তারপর শীতে শুনশান গাছ। বরফে আবৃত হয় কয়েক মাসের জন্যে। আবার বসন্তে কচিপাতায় ভরে ওঠে।
এখন বসন্ত চলে যাবার মূহুর্তে, গরম পড়ার ঠিক আগেই আমরা পৌঁছেচি সেই সবুজকে ক্যামেরা বন্দী করব বলে। তাই আবহাওয়া বেশ মনোরম, নাতিশীতোষ্ণ।
দুপাশে সবুজ গাছের ক্যানোপি ঘেরা পথ দিয়ে হাঁটতে হাজির হই ক্লাক্স পার্কে। একটু বসি আবার চলি। সবুজ গাছের ছায়ায় অন্ধকার গাঢ় হতে সময় লাগে এখানে। প্রচুর বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে এই পার্কে। শেষ বসন্তের কিছু ফুলও রয়েছে । আর রয়েছে দুধেআলতা প্রজাপতির মত চেরই ব্লসমের ঝরে পড়া। কি অপরূপ সে সরণী বেয়ে পথচলার অভিজ্ঞতা। রাস্তাঘাটে কোথাও একফোঁটা জঞ্জাল পড়ে থাকেনা। এমন কেন হয়না আমাদের? ভাবতে থাকি প্রতিবার আমেরিকায় এসে।
বিশাল এক পুরণো বাড়ির বাগানের সামনে দেখি পুরণো বই সব জলের দামে বিক্রি হচ্ছে। এ যেন বইয়ের ব্যুটিক। কি চমত্কার ভাবে সব সেকেন্ড হ্যান্ড বই রাখা রয়েছে। নীচে সব ঘরে ঘরে বই। পুরণো বইয়ের গন্ধে ম ম করছে ঘর দুয়ার। দোতলায় সায়েন্স ফিকশান। বাইরে কিছু বই ফ্রি তেও দেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যবস্থাপনায় যে মহিলা তিনি সদাহাস্য এক মধ্যবয়সী সুন্দরী। নিজে একা হাতে সামলাচ্ছেন তার দোকানপাট।
মন ভারী হয়ে যায়। আমাদের দেশের মত এদেশেও বই বিক্রিতে তেমন রমরমা নেই ঠিক যেমনটি রয়েছে প্রসাধনীতে, গাড়ী কেনায়, কোল্ড ড্রিংকস, ফাস্ট ফুড এর দোকানে। পরক্ষণেই আমার পুত্র তার স্টাইপেন্ডের মূল্যবান ডলার খরচ করে কিনে ফেলে দুটি বই। অবিশ্যি দোকানে খরিদ্দার ছিল দু একজন তবে সকলেই খাচ্চে কিন্তু গিলছে না। বই দেখছে উল্টেপাল্টে কিন্তু কিনছে না।
এখানে সন্ধ্যে হয় দেরীতে। বসন্তের ফুলে ঢাকা সরণী দিয়ে পায়ে হেঁটে আবারো ফিরি নিজের ডেরায়। এবার পরদিনের তোড়জোড়।
২০১৭ মে মাস। ফিলাডেলফিয়া পৌঁছানোর আগেই নিউজার্সির তিন লেখকবন্ধুকে কথা দেওয়া ছিল। ছেলের কাছে গিয়েই যেন তাদের সঙ্গে একটিবার হলেও দেখা করি। আর বন্ধু মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী তো আগাম নেমন্তন্ন করেই রেখেছিল তার বাড়িতে অন্ততঃ একটিবেলা যেন পাত পেড়ে খেয়ে আসি। ফেসবুকে তার রন্ধনশৈলীর দিব্যি পরিচয় পেয়ে আসছি সুস্বাদু বাহারী সব পদের মনোহরা ছবি দেখে। তাতেই এদ্দিন গ্যাস্ট্রোনমিক ফূর্তি হত। মৈত্রেয়ী যে সু রাঁধিয়ে তা জানতাম। সে রাঁধে আবার গল্পও বাঁধে নিজের কলমে। আরেকজন হল সুদীপ্তা বুয়া চ্যাটার্জী। মৈত্রেয়ীর পড়শী আরেক সৃষ্টিশীল মেয়ে। প্ল্যান ছিল অনেক কিন্তু ফিলি তে পা দেবার আগেই ফেসবুকে সুদীপ্তার ছেলের হাত ভেঙে যাবার ছবি দেখে সেখানে গিয়ে উতপাত করা বা গল্পবৈঠকে সামিল হওয়া, কোনোটাই মাথায় ছিল না। এই সুদীপ্তা আর মৈত্রেয়ী ফেসবুক আমাদের কলকাতার গল্পবৈঠকে ছবি দেখলেই এতদিন ধরে মনখারাপ করত আর বলত, দিদি, এখানে এলেই কিন্তু গল্পবৈঠক হবে। মনে আছে তো?
আরেকজন বন্ধু হল সংগ্রামী লাহিড়ী। তার সাথে আমার ওঠাবসা বহুদিনের। প্রথমে বেথুন, তারপর সায়েন্স কলেজ আর তারপর আমার কর্তার সহকর্মী ছিল সে প্রাইস ওয়াটার হাউস, কুপার্স, কলকাতায়। সংগ্রামী কোর বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্রী। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট অনুরাগ এবং দখল তার। এবার ফিলি তে গিয়ে একটু থিতু হয়েই মনে হল, আশেপাশেই এই তিনবন্ধু কে অন্ততঃ জানিয়ে দি ব্যাপারটা, যে আমি এখানে এসেছি। নয়ত ফেসবুকে ছবি সাঁটালে ওদের মন ভার হবে। ওরা বলবে, খেলব না। সংগ্রামী, সুদীপ্তা, মৈত্রেয়ী তিনজনেই বেদম গোঁসা করবে। আরো যেসব বন্ধুরা আমেরিকায় আছে তারা আমার থেকে অনেক অনেক দূরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিন্তু এই তিনজন একদম পাশের স্টেটেই। ইনবক্স করতেই ফোনাফুনি আর তারপরেই চরম উত্তেজনা আমাদের চার বন্ধুর।
- দিদি, তোমরা willow grove স্টেশনে পৌঁছনর মিনিট দশেক আগে একটিবার কল করে দিও রাজর্ষিকে। আনন্দের চোটে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে, আচ্ছা, তোমাদের আশাকরি কোনো ফুড অ্যালার্জি নেই, যদি থাকে একটু জানিও...
কি আনন্দ! কি আনন্দ! বিদেশ বিভূঁই তে বাঙালী বন্ধু যেন সহোদরা।
মৈত্রেয়ীই দায়িত্ব নিল। তার বাড়িতেই এক সপ্তাহান্তে গল্পবৈঠক হবে। সেই সঙ্গে ডিনার।
আগেই বলেছি ফিলাডেলফিয়ার যোগাযোগ ব্যাবস্থার জন্মলগ্নে বৃহষ্পতি তুঙ্গে। বাস, ট্রাম (ট্রলি) এবং লোকাল ট্রেন পরিষেবা একটিমাত্র কোম্পানির অধীনে যার নাম সেপটা (SEPTA) বা সাউথ ইষ্টার্ণ পেনসিলভেনিয়া ট্রান্সপোর্টেশান অথোরিটি । আর তাই বুঝি এত সুসংবদ্ধ এই নেটওয়ার্ক । অতএব পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেলাম বেলাবেলি। টিকিট কাটাই ছিল অনলাইনে। ঘন্টাদুয়েক চলার পর মৈত্রেয়ীর কথামত নেমে পড়ি উইলোগ্রোভ স্টেশনে। সেখানেই প্ল্যাটফর্মে হাজির ছিলেন বন্ধুপতি রাজর্ষি দা। মুগ্ধ হতে হল আতিথেয়তায়। কত যত্ন করে বেচারি নিজের উইকএন্ড প্ল্যান বাতিল করে শুধু আমার জন্যে ছুটে এলেন অফিস কাছারি সামলিয়ে।
প্রিন্সটন মেডোজ এর প্লেনসবরোতে কার্পেটের মত সবুজ ঘাসে মোড়া জঙ্গলের মধ্যে মৈত্রেয়ীর বাড়ি পৌঁছলাম। ঢুকতে ঢুকতেই ডিপ ফ্রায়েড মাছ-মাংসের ভারতীয় গন্ধে ম ম করছিল বাড়ির চৌহর্দ্দী। একরাশ খুশি মেয়েটার শরীরে। চোখে মুখে।উপছে উঠছে হাসি যেন, আমাদের কাছে পেয়ে। এ মেয়ের শরীরের ওপর দিয়ে এক সময় কত ঝড় বয়ে গেছে তা জানি আমি। তারপরেও কর্কট রোগকে হাসিমুখে জয় করে ওর যেন পুণর্জন্ম হয়েছে। লেখালেখি ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ফিলাডেলফিয়ার রান্নাঘরে বানানো পাটালীগুড় দিয়ে সিমাইয়ের পায়েস আর কলকাতা থেকে বয়ে আনা আমের চাটনীর ছোট্ট শিশিটা মৈত্রেয়ীর হাতে দিতেই লাফিয়ে উঠল মেয়েটা। আর মৈত্রেয়ী তনয়া স্বল্প ভাষী সুকন্যা ভারী মিষ্টি স্বভাবের।
কিছপরেই রীতিমত মাঞ্জা দিয়ে মাটন কারীর ঝোলা হাতে সুদীপ্তার প্রবেশ সাউথ ব্রান্সউইক থেকে।আর তার কিছু পরেই পার্সিপেনি থেকে এল সংগ্রামী তার কগনিজেন্টের ব্যাস্ত দায়ভার সামলিয়ে, নিজে হাতে বেক করা কেক নিয়ে।
তারপরেই চা কফি পর্ব সঙ্গে মৈত্রেয়ীর হাতের বানানো ফিশ পকোড়া, সংগ্রামীর কেক জমে গেল সেই বিকেলে। এবার কথা না বাড়িয়েই গল্প পর্ব। গল্পপাঠ শুরু হল। পাশেই জঙ্গল, পাখির কিচিরমিচির। বাইরে কাঁচের দরজায় ঝোলানো বার্ডফিড এর সুদৃশ্য খুপরী। হালকা ঠান্ডার রেশ তখনো। পাখী আসতে বাধ্য। মন উচাটন। ওরে ওরে রোদ থাকতে থাকতে ছবি তোল। ছেলে ছবি তুলছে কখনো পাখীর, কখনো আমাদের গল্পপাঠের।
অতঃপর, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে।
শুরু হল আমাদের গল্প পাঠ। বিদেশের মাটিতে প্রথমবার। মুগ্ধ শ্রোতা, আমার পুত্র শুভায়ন, সুদীপ্তার দুই পুত্র, স্বয়ং শুভ্র আর সায়ন শুভ্র, মৈত্রেয়ীর কন্যা সুকন্যা এবং আমাদের তিনজনের পতিদেবতারা। আর কি চাই? একেবারে ফাঁকা মাঠে গল্প বৈঠক কখনো গোল দেয় না।
এরপর সংগ্রামীর সেদেশের ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়ে, এক্কেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। তারপরে সুদীপ্তার আগের দিন রাতে লেখা গল্প "নির্ভেজাল দিনের আত্মকথন। আর সবশেষে আমার অলৌকিক গল্প "চুনীর আংটি এবং থুরা' দিয়ে শেষ হল সেদিনের গল্পের আড্ডা।
তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়া মৈত্রেয়ির ডাইনিং টেবিলে। রীতিমত সসৈন্যে আক্রমণ যেন। ডাল-ভাত-ফুলকপির ডালনার সঙ্গে ধোঁকার ডানলা, টার্কির বল কারি আর সুদীপ্তার মনোহরা মাটন জমে ক্ষীর সেই মূহুর্তে।
ছেড়ে যেতে মন চায় না তবুও ফিরতেই হল সে রাতে। রাজর্ষি দা সেই রাতে নিউজার্সি থেকে আমাদের গাড়ি চালিয়ে ছেড়ে দিয়ে গেলেন ফিলি তে। এ বন্ধুতার কোনও ত্রুটি নেই। আপ্যায়নে কোনও খামতি নেই।
আর প্রাপ্তিস্বরূপ গল্পবৈঠকের টুপিতে আরো একটি পালক যুক্ত হল সেদিন। দেশের গন্ডী পেরিয়ে তার প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা...বেশ অন্যরকম, খুব আনন্দদায়ক।
(সমাপ্ত)
সুচিন্তিত মতামত দিন