এম ওয়াসিক আলি

 অত:পর ট্রেনটি চলে গেল
ত:পর ট্রেনটি চলে গেল।

অনীশ হাঁফাতে হাঁফাতে কোনও রকমে প্লাটফর্মে পৌঁছে দেখে ট্রেনটি প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে ধুক ধুক করে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রাণপণে দৌড়েও নাগাল পেল না। কিছু লোক হৈ হৈ করতে লাগল, একি আর দৌড়বেন না, সামনে প্লাটফর্ম শেষ, আকসিডেন্ট হয়ে যাবে। শূন্য চোখে ট্রেনটিকে চলে দেখতে লাগল এবং কিছু পরে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। দু চোখে শুধু অন্ধকার আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, সামান্য বর্ষণেই দু-গাল বেয়ে পাহাড়ি ঝর্নার মত অশ্রুধারা বেয়ে চলল।

দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে ঠিক কতক্ষণ কেঁদেছিল, মনে নেই, হঠাৎ করে মাথায় কোমল স্পর্শ। চোখ তুলে অবাক!!নিমেষে বাতাবরণে এক আকস্মিক পরিবর্তন। ঘোর কাটতে একটু সময় লাগলো অনীশের। শুধু অস্ফুটস্বরে বলল, তুমি যাওনি?

মেঘা মিটিমিটি হাসছিল। তোমার বিয়ে করা বউ আমি, এতো সহজে নিস্তার পাবে না! আরও অনেক দুঃখ দেওয়া বাকি, অনেক জ্বালাতন করা বাকি! তারপরেই বিদেয় নেব চিরতরে তোমার জীবন থেকে।

বলা নেই কওয়া নেই , সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বায়না, একা একা গাংটক যাওয়ার। কোনও আপত্তি কানে না তুলে সটান স্টেশনে হাজির। অনীশ ওয়াশ রূম থেকে ফিরে দেখে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ও টেবিলে এক টুকরো কাগজ, তাতে লেখা "আমি গাংটক চললাম, ফোন বন্ধ, ফালতু চেষ্টা করো না, আর কবে নাগাদ ফিরব পরে ফোনে জানাবো"।

শান্তশিষ্ট বউয়ের, মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট আচরণের কারণ অনীশের বোধগম্য হচ্ছিল না। মেঘা কি তার কোনও পরীক্ষা নিচ্ছে? না কোনও মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংসারে তো কোনও অশান্তি বা সমস্যা নেই, তবুও মেঘার পাগলামী। তবে মেঘার সব পাগলামী অনীশ বিয়ের পর থেকেই প্রশয় দিয়ে আসছে এবং ভাল লাগে।

স্টেশন শুদ্ধ লোকের উপস্থিতি উপেক্ষা করে অনীশ মেঘাকে সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরে, কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে, খুব লজ্জা পেল, সবাই গোল করে ঘিরে ফেলেছে ও হাততালি দিচ্ছে, কেউ কেউ আবার সিঁটি দিতে ব্যস্ত।

অনীশই প্রথম জানতে পেয়েছিল মেঘার অসুখের কথা। ডাক্তার গুপ্ত কোনও রাখঢাক না করে বলেছিলেন, বড্ড দেরি করে ফেলেছো অনীশ, বড়জোর ছ-মাস, ক্যান্সারের মরণ বীজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা করিয়ে লাভ নেই বরং বাড়িতেই হেসে খেলা থাকুক। অনীশ মেঘার অজান্তে, নিজের দিক থেকে সেবা-যত্নে কোনোরকম চ্যুতি-বিচ্যুতি করেনি। যতটা সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু আশ্চর্য মেঘার আচরণে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। মৃত্যুর ঠিক দশ দিন আগে কাতর সুরে পাশে ডেকেছিল, অনীশের হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলেছিল, আমি সব জানি এবং প্রথম দিন থেকেই। রিপোর্টগুলো পড়ে বোঝার মত ক্ষমতা ভগবান আমাকেও দিয়েছেন, আর বাকিটা গুগল বাবার কামাল। বলেই মেঘা হাহাহাহাহা করে অষ্টহাসিতে ফেটে পড়ে, কিন্তু হাসিটা দুঃখের না বিজয়ের বোধগম্য হয়নি।

আর একটি অনুরোধ আছে। রাখবে তো? মেঘা স্বাভাবিক ভাবেই বলল।

বল।

বিয়ের পিঁড়িতে যে সাত জনমের সাথে থাকার পণ করেছিলাম, হয়তো মিথ্যা ছিল। তোমাকে একাই ছেড়ে যেতে হবে, এই ভেবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। তুমি কথা দাও, আবার বিয়ে-থা করে ঘর সংসার করবে!!!

কিন্তু অনীশের পায়ের তলা থেকে মাটি যেন ক্রমশঃ হুড়হুড করে নেমে যাচ্ছিল। আশ্চর্য মেঘা তাকে কিছুই বুঝতেই দেয়নি। এত বড় নির্মম পরিহাসকে হেসে-খেলে পরীভূত করেছে। এই বিষপানের এত সাহসই বা পেল কোথায়?

কই জবাব দিচ্ছ না কেন?

অনীশ নিজেকে শক্ত করে বলল, পাগলী তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তোমার পাশে।

মেঘা শুধু হাসল।

এখন নিশ্চিত সব কিছু জেনে শুনেই সে নিত্য নতুন উদ্ভট উদ্ভট সব কান্ডকারখানাগুলো করতো? বোকা অনীশ! ভেবে ভেবে নিজেকে সান্তনা দিত, কোনোমতেই মেঘার অসুখের কথা মরে গেলেও তাকে জানতে দেবে না। এখন সব কিছুই অনীশের কাছে জলের মতো স্বচ্ছ। প্রতিটি মুহূর্ত সে জীবনকে উপভোগ করছে, সব অপূর্ণ স্বাদ আহ্লাদ এই অল্প সময়ে পূরণ করার চেষ্টা করেছে এবং হার মানেনি, উল্টে মরণ কামড়ের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েই,মাত্র পাঁচ বছরের সুখী দাম্পত্যে চিরতরে লাল দাড়ি টেনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। এবং মাথা উঁচু করে।

না, অনীশ আর বিয়ে করেনি , মেঘার স্মৃতিগুলো সযত্নে বুকে আগলে রেখে বাকিটা জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিল। আজ সে অশীতিপর বৃদ্ধ, আজকাল প্রায়ই স্বপ্নে দেখে, মেঘা প্রশস্ত হাতজোড়া মেলে তাকে নিজের কাছে ডাকে। যখনই এগিয়ে যায় এবং ওপারের হাতজোড়া নাগালের মধ্যে আসে, হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না, বাকি রাত শুয়ে শুয়ে স্মৃতিমন্থনে কাটিয়ে দেয় আর ভাবে পাগলীটা সত্যিকারেরই পাগলী ছিল।

সেদিনের স্টেশনের ঘটনাক্রমেও পাগলী ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেয়নি সত্যি সত্যি এ পাগলকে অকুলসাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নেবে এবং তার হাসিচ্ছলের কথাগুলো একদিন সত্য হবে।

mw.murarai@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.