বেতলার পথে...
আবার একটা নতুন সূর্যের উদয় দেখে শুরু হল আমাদের নতুন একটা দিন। ন’টার মধ্যেই স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি আমরা। হোটেলের ম্যানেজারের ভাই বেতলায় থাকেন,সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে আসছেন। আমাদের বেতলা নিয়ে যাবেন। প্রায় পুরো দিনটাই আমাদের পথে পথে কাটবে। ঠিক ন’টা বাজে তখন, একটা জিপ এসে দাঁড়াল। হোটেলের ছেলে গুলোই আমাদের জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিল। যাত্রাপথে কয়েকটি স্পট দেখে নেব এমনই কথা আছে ড্রাইভারের সাথে। বললাম, ‘দাদা এখানে একটা প্রাকৃতিক ঝিল আছে শুনেছিলাম, একবার ওটা দেখাতে নিয়ে যাবেন?’ ড্রাইভার দা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ ঠিক হ্যয়, চলিয়ে,মগর ইয়াদা টাইম নেহি হ্যয় ম্যাডামজি’।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, বেশি সময় নেব না।একটু ফটো তুলেই চলে আসব’।
গাড়ি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এসে দাঁড়াল একটা বিশাল আকৃতির ঝিলের সামনে। স্বচ্ছ সাদা জলে সূর্যের আলো চকচক করছে। বেশ কিছুটা দূরে বড় বড় গাছগুলোর শান্ত ছায়া ছবির মতো আঁকা রয়েছে ঝিলের বুকে। কি প্রশান্তি! দীর্ঘক্ষণ সেই দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে মন চাই। বেশ কিছু ফটো তুলে গিয়ে বসলাম গাড়িতে। না, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। কিন্তু কপালে যদি সময় নষ্ট লেখা থাকে তবে? ঠিক সেটাই ঘটল। গাড়ি বেশ ছুটে চলছিল সরু কালো পিচের রাস্তার উপর দিয়ে। কোথাও দু’পাশে ধু ধু মাঠ, কোথাও বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাছ। মাঝে মাঝে বক্সাইট খনি থেকে মাল বোঝাই ট্রাককে সাইড দিয়ে আমাদের গাড়ি বেশ ভালোই ছুটছিল, হঠাৎ ব্রেক লাগিয়ে থেমে গেল গাড়ি। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, আগে দুটো ট্রাক দাঁড়িয়ে। যা ঘটেছে তার ঠিক আগে। কি ঘটেছে জানার আগেই আমাদের পিছনে অনন্ত চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। ড্রাইভার এসে জানালেন, সামনে একটা ট্রাকের চাকা এমন ভাবে ফেটেছে যে, সে গাড়ি রাস্তায় আড়াআড়ি ভাবে দাঁরিয়ে পড়েছে। পাশ দিয়ে খুব বেশি হলে একটা মানুষ যাওয়ার রাস্তা আছে। জানতে চাইলাম, ‘কি হবে এবার?’
ড্রাইভার জানালেন, ষাট কিমি দূরে একটা গ্রাম আছে, সেখান থেকে মেকানিক আসবে তবে রাস্তা পরিষ্কার হবে। বললাম, ‘বিকল্প কোনো রাস্তা নেই?’ উনি জানালেন না। দু’পাশে ঝোঁপে ভরা মাঠ, তাও রাস্তা থেকে অনন্ত দু’হাত নিচু, সুতরাং পাশ দিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। যা বুঝলাম, দুপুর দুটোর আগে এপথে এগোনো সম্ভব নয়, আর এমনটা হলে আমাদের আর ‘লোধ’ জলপ্রপাতটা দেখতে যাওয়া হবে না। উফ্! এবার সত্যিই বিরক্ত হলাম,আর ভীষণ কান্না পেল আমার। এই ভ্রমণে কি শুধুই ভেস্তে যাবে সব!প্রায় ঘন্টাখানেক পর দেখলাম, পিছন থেকে দু-একটা গাড়ি ব্যাকগিয়ারে পিছনের দিকে যাচ্ছে। কিছু তো কারণ আছে। ড্রাইভারদা জানালেন, ‘একটা রাস্তা পাওয়া গিয়েছে,কিন্তু সব ধরণের গাড়ি যেতে পারবে না। দেখি একবার চেষ্টা করে’। পিছাতে লাগল আমাদের গাড়িও। বেশ কিছুটা ব্যাকে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম, রাস্তার ডানদিকে এবড়োখেবড়ো উঁচু নিচু ঢিবি ও ঝোঁপের মাঝখান দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছে। পাশের জমিটা রাস্তা থেকে হাতখানেক নিচু।জিপের মতো শক্তপোক্ত গাড়ি ছাড়া সত্যিই ওই পথে কোনো গাড়ির যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের গাড়িও ঢকাম ঢকাম করে লাফাতে লাফাতে কিছুটা এগোতেই একটা ঢিবিতে গেল আটকে। ড্রাইভার স্টেয়ারিং এ বসে থাকল,দুজন লোক পিছন থেকে ধাক্কা দিতেই সেই গাড়ি আবার লাফাতে লাফাতে চলতে শুরু করল। অবশেষে আবার এসে উঠলাম পিচের রাস্তায়। জানি না সামনের পথে আর কি কি বাকি আছে,তবে মনটা আবার আনন্দে ভরে উঠল কারণ, লোধ দেখা হবে। ভেস্তে যেতে যেতেও ভেস্তে না যাওয়া ভ্রমণের গল্প এটা। গাড়ি আপন গতিতে ছুটে চলল। প্রায় ষাট কিমি পথ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম এই পথের একমাত্র বর্ধিষ্ণু গ্রামে। গ্রামটির নাম ‘মহুয়া’। নেতারহাটের মানুষ সপ্তাহে একদিন এই গ্রামে এসেই সারা সপ্তাহের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে নিয়ে যায়। এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে, আরেকটা রাস্তা বাঁ-দিকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।যদিও বেতলা যেতে হলে আমাদের ঐ সোজা রাস্তা ধরেই এগোতে হবে,কিন্তু লোধ দেখতে হলে আমাদের ঐ গ্রামের মধ্যের রাস্তাটা ধরতে হবে। গ্রামে ঢোকার আগেই রাস্তার মুখে একটা ছোট্ট হোটেলে ড্রাইভারদা দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে এগিয়ে চললেন গ্রামের রাস্তা ধরে। মহুয়া গ্রাম থেকে বাইশ কিমি পথ যেতে হবে আমাদের। গ্রামের জনবহুল রাস্তা ছেড়ে আমরা নির্জন পথে নেমে এলাম। সরু পিছের রাস্তা দু’পাশে ধু ধু মাঠ, রোদে পোড়া হলদে ঘাস। রাস্তা ঢেউয়ের মতো আঁকা বাঁকা। গাড়ি চলতে চলতে কখনও ঊর্ধমুখী আবার কখনও নিম্নমুখী। যেন ঢেউ এর ছন্দে পথচলা। নির্জন একটা গ্রামের মধ্যদিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছাল একটা খোলা মাঠের সামনে। এরপর আর কোনো রাস্তা নেই। ওই মাঠ পেরোলে আবার একটা নতুন রাস্তা শুরু হবে।
মাঠ পেরিয়ে যে রাস্তায় এসে পড়লাম,তার রূপ একেবারে অন্যরকম। সরু কালো রাস্তার দু’ধারে মানুষ সমান ঘন ঘাসের জঙ্গল। সে জঙ্গলের রং কোথাও সবুজ আবার কোথাও রোদে পুড়ে হলুদ।মাঝে মাঝে একটা দুটো বড় গাছ ন্যাড়া, পাতা নেই।আসলে মরশুমটাই তো পাতা ঝরার। কোথাও কোথাও দু-একটি দেহাতি মানুষ কাঠ সংগ্রহে ব্যস্ত। কিছুদূর যেতেই দূরে একটি পাহাড়ের দিকে হাত তুলে ড্রাইভারদা দেখালেন, ‘ঐ যে পাহাড়টা দেখছেন, আমরা ওখানেই যাব। ঐ পাহাড়েই রয়েছে লোধপ্রপাত। বর্ষার সময় হলে এই এখান থেকেই শুনতে পেতেন গর্জন’। গাছগাছালি ঘেরা হালকা জঙ্গলের পথ দিয়ে চলতে চলতে নজরে এল কোথাও জলের ধারা নালা থেকে নেমে পথের এপাশ থেকে ওপাশে বয়ে যাচ্ছে কুলু কুলু ছন্দে। এই জলধারা ঐ প্রপাত থেকে জঙ্গলের বিভিন্ন পথ ঘুরে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা জঙ্গলঘেরা পোড়ো জায়গায় এসে দাঁরিয়ে পড়ল আমাদের গাড়ি। অসম্ভব রকমের নির্জন এই জায়গাটা। ঝরনার জলের গমগমে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারদা’র সাথে আরেকটি ছেলেও আমাদের এই পথের সঙ্গী ছিল। সে বলল, ‘সামনে সরু ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে, আসুন আপনারা’। দেখলাম একটা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এক-দেড় ফুট চওড়া ভাঙা হাতে তৈরি সিঁড়ি নিচে নেমে গিয়েছে। চারপাশের ঝোঁপ এমনভাবে রয়েছে যে, সে সিঁড়ি প্রায় দেখাই যায় না। অনেক কষ্টে দেওয়াল ঘেঁষে ঝোঁপ সরিয়ে কিছুটা নিচে নেমে দেখলাম, এরপর বেশ কয়েকধাপ সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আবার নিচে নামতে নামতে প্রায় দুশোটা সিঁড়ি পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম সেই অবর্নণীয় সৌন্দর্যের সামনে, যার সামনে এক কথায় মাথা নত করা যায়। প্রায় ৪৪৫ ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বুঢ়ানদী। ঝারখন্ড আর ছত্তিশগড়ের সীমানায় এ নদীর উৎস। কি অপূর্ব এই রূপ! এ কেবল চোখেই ধারণ করা যায়। চারপাশের পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঝরণার জল পাহাড়ের পাদদেশে সৃষ্টি করেছে ঘন সবুজ জলাশয়ের। মাঝে মাঝে মাথা তুলে আছে পাথর। টলটলে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে মন চাই। বসলাম একটা উঁচু পাথরে। নিমেষের মধ্যে চোখমুখ ভরে উঠল বিন্দু বিন্দু জলকণায়। এক অদ্ভুত তৃপ্তি সারা মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। ফিরতে মন চায়না তবু ফিরতে তো হবেই।
এখনও কত বিস্ময় যে বাকি আছে। আবার একই পথে ফিরে এলাম। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আবার এসে দাঁড়ালাম সেই মহুয়া গ্রামের হোটেলটির সামনে। খাবার কথা আগেই বলা ছিল। সামান্য নিরামিষ ভাত খেয়ে আবার শুরু হল পথচলা। এপথের শেষ হবে বেতলায়। বেশ ঘন্টাখানেকের পথ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম একটা ছোট্ট গ্রাম বরেসাঁড়। এখানে ভালো ক্ষীরের পেঁড়া পাওয়া যায়। জঙ্গলে মিষ্টিমুখ ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ভালো। সঙ্গে নিলাম পেঁড়া। গ্রাম ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথে এগিয়ে এসেছি বেতলার পথে,হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম, একটা জঙ্গলের সীমানা। গাড়ি আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল ‘মারোমার’ জঙ্গলের পথে। নির্জন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে শুয়ে আছে কালো পিচের রাস্তা, ঝকঝকে পরিষ্কার। একটা অদ্ভুত জীবন্ত অনুভূতি! চারিদিকে অজস্র প্রাণের স্পন্দন জেগে আছে,কিন্তু শুধু অনুভবে। সব প্রাণ জেগে আছে অন্তরালে, সবুজ গাছের পাতায় পাতায়,ডালে ডালে। অজানা আচেনা শব্দের গায়ে, লুকিয়ে থাকা বন্য জন্তুর উপস্থিতির অনুভবে। রাস্তায় পড়ে আছে টাটকা হাতির বিষ্ঠা।পথের দু’পাশে বাঁশের ঝারে যেন ঘূর্ণিমাতন বয়ে গিয়েছে। হয়তো মিনিট কয়েক আগেই এপথে জংলি হাতির দল গিয়েছে,আর যাবার আগে রেখে গিয়েছে তাদের দামালপনার চিহ্ন। বাঁশ হাতির প্রিয় খাদ্য। চোখ,কান, মস্তিষ্ক যেন সজাগ হয়ে আছে,যদি কারোর দেখা মেলে! একটা অদ্ভুত শিহরণ বুকে নিয়ে ছুটে চলেছি আমরা মারোমার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। রাস্তার বাঁ-দিকে পড়ে আছে একটা পোড়া জিপের কাঠামো। সালটা ঠিক মনে পড়ছে না, তবে সম্ভবত ১৯৯৯ হবে, মাওবাদীদের আক্রমণে পুড়ে গিয়েছিল এই জিপগাড়িটি ও মারোমার বনবাংলো। বেশ দীর্ঘপথ পেরিয়ে তখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে প্রায়, এসে পৌঁছালাম বেতলায়। নেতারহাট থেকেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাছবাড়িটি আমাদের বুকিং করা হয়েছিল। গাড়ি একটা বড় গেটে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা উঁচু টিলার উপর রয়েছে বনদপ্তরের লজ। বাইরে থেকে দেখতে বেশ সাজানো গোছানো। ছোট্ট কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। লজের এড়িয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। উপরে উঠেই বাঁদিকে একটা পায়েহাঁটা রাস্তা চলে গিয়েছে। একটি ছেলে এসে আমাদের জিনিস নিয়ে ঐ পথে হাঁটছে দেখে আমরাও পিছন পিছন গেলাম। একটা বড় গাছ, তার মাঝ থেকে পিলারের উপর রয়েছে একটা বাড়ি। একটা কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে উপরে। ছেলেটি ঐ সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে ঘরের তালা খুলল। সিঁড়িটি ভাঙা, ঘরটির বারান্দায় অসম্ভব নোংরা ছড়ানো।বাঁদরের পায়খানা। সিঁড়িতে, ছাদে, বারান্দার রেলিং এ এদিক ওদিকে দিয়ে ঝুলে আছে বাঁদর।
কোনো রকমে ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করলাম ঘরে ভিতর। ভীষণ অন্ধকার। ভতরে দুটি রুম।পুরো কাঠের তৈরি, কিন্তু বারান্দায়, দরজায় সূক্ষ্ণ তারের নেট লাগানো। কেমন যেন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মনে হল,হাঁপিয়ে যাচ্ছি। ছেলেটি জানাল এটাই আমাদের বুকিং সিছিল। বাথরুমে গরমজল পাওয়া যাবে না। জানালা লাগিয়ে না রাখলে মশা ঢুকবে। ঘরটার শূন্যতা দেখে বুকের ভিতরে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা বোধ হতে লাগল। দুটো দিন এই ঘরে কাটাব কেমন করে! ঠিক করলাম,এই ঘরে থাকব না আমরা। ছেলেটিকে জানাতেই সে বলল, ‘তবে চলুন অফিসে, কেয়ারটেকারকে বললে তিনি অন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দেবেন। দরজায় তালা দিয়ে ছেলেটি নেমে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে হঠাৎ বাঁ-দিকের জঙ্গলের দিকে চোখ আটকে গেল। বিস্ময়ের বিস্ময়! পঞ্চাশ-ষাট ফুট দুরেই একপাল চিতলহরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে। ঘাস খাচ্ছে। এভাবে গরুর পাল, ছাগলের পালকে দেখেছি অনেক কিন্তু চিতলহরিণের এমন সমাবেশ এত প্রাকৃতিক ভাবে এই প্রথম। বিস্ময়ে চোখ ফেরাতে পারলাম না। তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। মুগ্ধটা এতটাই ছিল যে, ফটো তুলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়তেই দ্রুত ক্যামেরায় তাক করলাম।
ঢোকার মুখে লজের যে দিকটা দেখেছিলাম, সেখানেই লজের কেয়ারটেকার একটা ভালো রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। ডাল্টনগঞ্জের অফিসে ফোন করে রুমটা তিনিই বুক করে দিলেন। ঘরে ঢুকেই মন ভরে গেল। বেশ বড় ঘরটা। মাঝ বরাবর একটা স্ট্যান্ড দেওয়া খাট।পাশের দুটো সোফা,মাঝে কাচ লাগানো বেটের টেবিল। খাটের উলটো দিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা ৩২ ইঞ্চির টিভি। একটা কাঠের আলমারি। ভিতরের দিকে দরজা দেখে সেটা খুললাম। দরজার ওপাশে জঙ্গলের দিকে একটা খোলা বারান্দা। দারুণ ব্যপার।মন আনন্দের নেচে উঠল। জিনিসপত্র ভিতরে রেখে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা।তখনও সন্ধ্যা নামেনি। লজের সামনের দিকেই আছে খাবার,রান্নার জায়গা। সামনে বাঁধানো চাতালে চেয়ার পাতা। আমরা হাঁটতে হাঁটতে লজের পিছনের দিক দিয়ে জঙ্গলের এড়িয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছি নিজের অজান্তেই। অনতিদূরে বড় শিংওয়ালা একপাল হরিণ দেখে সেই দিকেই হাঁটছি, হঠাৎ পিছন থেকে ডাক এল, ‘উধার যানা মানা হ্যয়’। ভয়ে আর এগোলাম না। টিলার নিচ দিয়ে ঘুরে এসে বসলাম লজের রান্নাঘরের সামনের চেয়ারে। এবার একটু একটু করে যেন নেমে আসছে সন্ধে। ঠান্ডাটাও বেশ জোরাল হচ্ছে। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ গল্প চলল আমাদের। ঠিক সন্ধের মুখে রুমে ফেরার ঠিক আগেই কেয়ারটেকার এসে হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা ছয় ইঞ্চির মোমবাতি। কারণ জানতে চাইলাম। বললে, ‘রাখ লিজিয়ে, কাম আয়েগা’। রুমে ফিরে ব্যলকনির দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম! আর কত বিস্ময় লুকানো আছে এই বেতলার জঙ্গলে? ব্যলকনির খোলা রেলিং থেকে হাত দশেক দূরেই ঘুরে বেড়াচ্ছা চিতলহরিণের দল। এতকাছে! জীবনে কখনও আর এমন কি দেখাতে পাব? বন্য হরিণ প্রাকৃতিক ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষের এত কাছে! সামান্য নিঃশ্বাসটাও যেন জোরে নিতে পারছিনা তখন। একটু আওয়াজেই সরে যাচ্ছে ওরা দূরে। ছোটো ছোটো ঘাসে মুখ ডুবিয়ে খেয়ে চলেছে একমনে। ক্রমশ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। মিশে যাচ্ছে হরিণের দল অন্ধকারের সাথে। ব্যলকনি বন্ধ করে ভিতরে এলাম। গোটা ঘর জুড়ে ঝকঝকে আলো। রাতের খাবারে ফ্রাইডরাইস আর চিলিচিকেন বলা আছে। ঐ একটাই মেনু আজ সবার জন্য। বলেছে সন্ধের দিকেই খাবার দিয়ে যাবে। ঘড়িতে ছটা বাজে। টিভিটা খুলতে গেলাম, কিন্তু কিছুতেই চলল না। হঠাৎ দেখলাম, সব অন্ধকার! কারেন্ট চলে গিয়েছে। মোমবাতির প্রয়োজনীয়তা এবার বুঝতে পারলাম। অন্ধকারে কিছুক্ষণ ভূতের মতো বসে থেকে মোমবাতি জ্বালালাম। ঘড়িতে সাতটা বাজে। দরজায় খটখট আওয়াজ। খুলতেই ভিতরে ঢুকল একটি ছেলে, হাতে ধরা রাতের খাবার। চক্ষু তখন চড়কগাছ। এই সন্ধেবেলা ডিনার! বলতেই ছেলেটি হেসে বলল, ‘ রাতমে অউর কুছ নেহি মিলে গা’। আমি বললাম কফি? সে মাথা নাড়ল। ‘হাম সব ঘর চলে যায়েঙ্গে। হামলোগ সাত বাজেই খানা দে দেতে হ্যয়’।
আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কারেন্ট কখন আসবে?’
সে বলল, ‘দশ বাজে। ইঁহা ছে বাজে কারেন্ট যাতে হ্যয় অউর দশ বাজে আতে হ্যয় রোজ’।
একটা বড় করে ঢোঁক গিলে বললাম, ‘আর টিভি? সেটা চলল না কেন?’
ছেলেটি হা হা করে হেসে বলল, ‘সব বান্দরকা কামাল হ্যয় ম্যাডামজি’।
বান্দরকা কামাল!!
ক্রমশ......
rumkiraydutta@gmail.com
সুচিন্তিত মতামত দিন