জয়তী রায়

নিজের মূল্যায়ন আগে/ দুনিয়া দেখুন পরে
গোটা পৃথিবী জুড়ে আজ হাহাকার। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। কোথাও বোমা বিষ্ফোরণ। কোথাও নিরীহ মানুষের উপর চলে গেল ট্রাক। কোনো স্কুলে শিশুদের উপর চলল গুলি বর্ষন। 

দিন দিন ক্ষিপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ধর্ষনের শিকার হচ্ছে, শিশু থেকে বৃদ্ধা। পরিবেশ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে দ্রুতলয়ে। 

পৃথিবী এবং দেশ রসাতলে যাচ্ছে, একথা শোনা যাচ্ছে যত্র তত্র। কারণ কি এবং কেন __সে কথা আলোচনা করতে বসলে এর ওর তার ঘাড়ে দোষ চাপানো চলতেই থাকে। 

বিচার করলে দেখা যায়, প্রত্যেক কার্যের পিছনে কারণ থাকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর যে ঘটনা গুলো খুব বিশ্রী রকমের আলোড়ন তোলে, তার সব কিছুর পিছনে কাজ করে বিপর্যস্ত মন। অর্থাৎ ঘটনার নায়ক যে ব্যক্তি, সে খুব সুস্থ মস্তিষ্কের নয় । 

দায়িত্ব এড়ানো যাবে না তাই বলে। ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয়ের পিছনে কোনো কোনো দিকে হাত থেকে রাষ্ট্রের। সমাজের। পরিবারের। অথবা , পরিবার সমাজ রাষ্ট্র__ব্যক্তির চ্যুতির পিছনে সমান দায়ী। আমেরিকায় সুলভে মেলে বন্দুক। যখন তখন তার প্রয়োগ করছে কেউ কেউ। বিপর্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা। বিপন্ন রাষ্ট্র। পরিবার অসহায়। পৃথিবী ক্রমশ এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। 

খুব কঠিন সত্য হল, ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয় নির্ভর করে তার বড় হওযার উপর। আজ যে অবক্ষয়ের সামনে এসে পৌঁছেছি আমরা, তাতে সার্ব

ব্যক্তি হল রাষ্ট্রের স্তম্ভ। নিচতলা থেকে উপরতলা__ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের মেলবন্ধন শক্ত করতে চাই ব্যক্তির মূল্যায়ন। 

দুই

প্রশ্ন হল, কিভাবে ব্যক্তি মূল্যায়ন করবে নিজের? তার ফলে সার্বিক উন্নতি কিভাবে সম্ভব? 

আমাদের জীবন হল বহমান নদীর মত। নদী কখনো এক ভাবে চলে না। এক বাঁক থেকে অপর বাঁকে ঘুরছে নদী, পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি। তৈরি হচ্ছে নতুন গল্প, এক সময় সাগরে মিশে যাচ্ছে নদী। শেষ হচ্ছে তার পথচলা।

জীবন কখনো মর্জি মত চলেনা। পরিকল্পনা মানুষ করে। ওটাই মানুষের চরিত্র। পাশার ছক মানুষ সাজায়, উল্টে দিতে থাকে জীবন। কখনো চূড়ান্ত হতাশা কখনো অপ্রত্যাশিত সাফল্য। চমক লুকিয়ে আছে কোন বাঁকে কিভাবে , সে কেউ জানে না। একসময় থামতে হয় , মিলতে হয় মহাকালের মহা শূন্যতায়। 

বদল ছন্দের গতিময়তা মেনে নিতেই হবে। সাফল্য ব্যর্থতা পাশাপাশি থাকবে। ব্যার্থ হলেই নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে বসলে, নিজেকে দোষারোপ করতে বসলে অথবা ভাগ্যের দোষ দিলে ভিতরে ভিতরে তৈরি হবে নেতিবাচক চিন্তা___আমি কিছুই পারি না। কিছুই হচ্ছে না। অমুক কত উপরে চলে গেল। অথচ ও কিছুই পারত না এক সময়!" নিত্য এমন হা হুতাশ মনের মধ্যে জমা হতে হতে তৈরি করে বিষ বৃক্ষ। তার ফল ভয়ঙ্কর। আত্মহত্যা, পরিবারকে হত্যা, এমন কি পাড়া প্রতিবেশীকে আক্রমণ ___বলা হয়, নৃশংস ক্রাইমের পিছনে লুকিয়ে থাকে বিপন্ন শৈশব। দুই থেকে সাত বছর বয়স মানুষের জীবনে খুব গুরত্বপূর্ণ। এই সময় অন্যান্য চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর চিন্তার ক্ষেত্রে অহমিকা বোধ, একাকীত্ব বোধ এই ধরণের জটিলতা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন অভিমানের উত্তর যদি ঠিক মত না পায়, শিশুটির মনে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিতে থাকে। ভবিষ্যতে বয়সে বাড়লেও মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অভিমানী শিশু , পরিবার, সমাজ এবং দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হলে ও হতে পারে। বন্দুক নিয়ে পৌঁছে যেতে পারে স্কুল, রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে, বাবা মাকে হত্যা করতে পারে। বিপদজনক অগ্নেয়োগিরির লাভা জেগে উঠে, ছড়িয়ে পড়ে ,জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছার খার করতে পারে সব। 

সরকার কাজ করছে না, পৃথিবী রসাতলে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন গুলো তোলার আগে, নিজের ঘর দেখি বরং। বারুদ জমা হচ্ছে ঘরের কোণে। আগুন আসছে বাইরে থেকে। 

স্বীকার করি চাই না করি, জীবনে নীতি থাকা জরুরী। একটার জন্য আরেকটা ছাড়তে নেই। রাজনীতি হচ্ছে, দেশ চলছে অথচ ব্রীজ ভেঙ্গে পড়ছে! আমেরিকার এত গর্ব নিজেকে নিয়ে, নিজের সম্পদ নিয়ে __ ক্রাইমের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে! উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। গোটা পৃথিবী নেমে যাচ্ছে অতল অবক্ষয়ের দিকে। 

কারণ কি কেউ খোঁজে? খুঁজতে চায়? প্রাচীন কালে রাজা হবার আগে শিখতে হত অনেক কিছু। রাজার দায়িত্ব সিংহাসনে বসার জন্য না, প্রজা পালনের জন্য। এই কথা পরিষ্কার করে বুঝতে পরলে তবেই রাজদণ্ড তুলে দেওয়া হত হাতে। 

ব্যক্তির নিজের মূল্যায়ন করতে হয় সবার আগে। পরিবারের প্রতি সময়, নিজের প্রতি সময় দিতে হবে। নিজেকে ভালোবাসার মানে স্বার্থপরতা না। নিজে সুন্দর থাকলে, দুনিয়া সুন্দর থাকে। আমরা কিন্তু করি ঠিক এর উল্টো। তাই পিছিয়ে পড়ি বার বার। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি মানে পরিবার,পরিবার হল সমাজ, সমাজ হল রাষ্ট্র। 

তাই আমাদের দায়িত্ব আছে। নিজেকে নতুন করে দেখা। নিজের ইতিবাচক মূল্যায়ন করা। 

ভালো বই, সিনেমা , বিভিন্ন সেমিনার , ভালো সঙ্গ, আলোচনা সভা__এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে আমাদের। বর্তমান অবস্থাকে অস্বীকার করে না, তাকে সামনে রেখেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারি। পরিস্থিতি মারাত্মক খারাপ যদি হয়, সেটার উপর হাত থাকে না, কিন্তু মনের পরিস্থিতি শক্ত রাখলে লড়তে ত পারব। রোজকার রুটিন যদি খুব খারাপও হয়, তবু নিজেকে একটু সময় দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো টিপস হল, ফেসবুক, বা অন্য কিছু থেকে পাঁচ মিনিটের বিরতি। নিজের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। রোজ । প্রতিদিন। প্রশ্ন করতে হবে কে আমি? 

নিজেকে ভালোবাসার ফল ফলবে হাতে নাতে। একজন সবল মনের ব্যক্তি কি না পারে? মনে পড়ে দশরথ মাঝির কথা? মাউন্টেন ম্যান নামে তিনি পরিচিত। শুধুমাত্র একটি ছেনির সাহায্যে ২২ বছর পরিশ্রমের ফলে তৈরি করেন রাস্তা। কারণ ছিল দুর্গম পাহাড়ি পথে পিছিলে যায় স্ত্রী ।পাহাড়ে কোনো রাস্তা নেই। হাসপাতাল যেতে পারেনি। চোখের সামনে স্ত্রীর মৃত্যু দেখে দশর থী , পাহাড় কেই চ্যালেঞ্জ জানান। 

সমস্যা আর পাহাড়ে ফারাক নেই বিশেষ। দুটোই অটল। 

নিজেকে নতুন করে দেখে, নিজের ভিতরকার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলে, পাহাড় কেটে সমাধানের পথ বেরুতেই পারে। ব্যক্তি দুনিয়ার অধীন না, দুনিয়া ব্যক্তি ছাড়া অচল। তাই , সার্বিক মূল্যায়ন হোক ব্যক্তির। পৃথিবী সুন্দর হতে বাধ্য। 

joyeelove@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.